আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তগদ্য: গল্পের কথা

ডুবোজ্বর গল্প কী? গল্প আসলে তেমন কিছু না। আমার কিংবা আপনার কথা তোমাকে বা তাকে শোনানো। এই ক্ষেত্রে আমি বা আপনি বক্তা হলে তুমি বা সে শ্রোতা। আমি বা আপনি লেখক হলে তুমি বা সে পাঠক, প্রকারান্তে পাঠিকা। আমার কথাই গল্প।

আমি কেমন করে যাই, কেমন করে গাই, কেমন করে বাঁচি, কেমন করে মরি, কেমন করে ভালোবাসি, কেমন করে মুখ ভেংচাই, দাড়ি কাটি, ক্ষুর ধরি ইত্যকার বিষয়াদি। এখন এর ধরন কী? এর আসলে কোনো ধরন নাই এখন। এক শব্দেও গল্প হয়। ধরেন, আপনি লিখলেন, ‘লাল’। এই একটা শব্দের ভিতর যে মাইল মাইল গল্প নিহিত তা প্রলম্বিত করবে পাঠক তার মাথার ভিতর।

এই উদাহরণ পৃথিবীর মহান গল্পকারগণ আরো ষাট/সত্তুর বছর আগে দেখিয়ে গেছেন। আপনি পাঠক এইসব আপনি খুঁজে নেবেন। আচ্ছা, আমি একটা গল্প লিখি, আপনারা পড়ে দেখেন, ‘রবিনাথ বললো, কী বেদনা তুমি জানো, ওগো মিতা? আরিফ মনে মনে ভাবে তার দাড়ির সংখ্যা কতো হতে পারে। আরিফের মাথার ভিতর ঘুরছিলো ব্রহ্মাণ্ড। সে কী যেনো বলেছিলো, ...আমি যদি তার হাত ধরে চলে যাই-- তোমার কিছু করার আছে? মনে করো সে গড়িয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমার ঠোঁটে চুমু খেলো-- তোমার কিছু করার আছে?... শহীদ কাদরী বললো, কালো রাতগুলি বৃষ্টিতে হবে শাদা।

আমি চিরদিন বেকার থাকবো এইটা ভাবছো কেনো-- চাকরি তো একটা হবেই...। বাল হবে। আমি ইনকাম করি, আমি খরচ করবো। পাশের রুমটা সাবলেট দিয়ে দিই, চলো। দাদা, আমার জীবনটা এমন হলো কেনো? ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছি।

আরিফ কথাগুলি বলে শূন্য চোখে গুরু ফরিদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তোর কবিতা যেমন তরল, তোর ভালোবাসাও মনে হইতেছে তরল... আরিফ বাসায় ফিরে দেখে সে নেই। অফিসের কাজে সে বোধহয় বাহিরে গেছে-- ফিরতে লাগবে তেরোদিন। অতঃপর মনে হলো ডিপফ্রিজে ঢুকলে তার ভালোবাসা তরল থেকে কঠিন হবে। এই ভেবে সে ডিপফ্রিজে আইচক্রিম, চিংড়ি, কয়েকপ্যাকেট গরুর কলিজা এবং মুরগির কাঁচামাংসের পাশে বসে ডালাটা টেনে দিলো।

খুট করে শব্দ হলো। সে অবশ্য ভাবে নাই এইটা অটো লক হয়ে যাবে। সে মনে মনে দস্তয়ভস্কির হোয়াইট নাইট গল্পটা ভাবতে ভাবতে জমে শাদা হয়ে গেলো। ’ পড়া শেষ? এইবার বলি শোনেন, এই গল্প প্রথাগত কাঠামোতে লেখা নয়। এইখানে পাঠকের জন্যে অনেক ফাঁকা জায়গা রাখা আছে।

কবিতায় সাধারণত আমি যে ধরনের স্পেস ব্যবহার করি, এইখানেও অনেকটা সেইরকম। প্রথাগত কাঠামো হলো সেই আদি-মধ্য-অন্ত নির্মাণ। আর আমাদের রবিনাথ বলেন, ‘ছোটো বালুকার কণা/ ছোটো ছোটো দুঃখকথা...’ তারপর বলেন, ‘শেষ হইয়াও যার হইলো না শেষ’ এই হলো গল্প। এইখানেই গল্পকারের মৃত্যু পাঠকের শুরু। গল্পকার যেখানে শেষ করলেন পাঠক সেখানে তার কল্পনার দ্বার উন্মোচন করবেন।

তারপর রোঁলা বার্থ কী বলেছিলেন আপনার মনে আছে? এখন অবশ্য সেই ধরনও গেছে পাল্টে। শেষ হইয়াও যার হইলো না শেষ-- এই ব্যাপারটার সাথে এখন আরো স্পেসের ব্যবহার ঢুকে গেছে। আমার নিজের কথাই বলি, আমি লেখালেখির ক্ষেত্রে কাউকে অনুসরণ করি না। করতে চাইও না। তবে নিজের লেখার মধ্যে মহান, অতিশয় ভালো কোনো লেখার প্রচ্ছন্ন প্রভাব থেকেই যায়।

এটা এড়ানো সম্ভব না, আবার দরকারও নেই। এটা সবার মধ্যেই ছিলো। এবং থাকবে। তবে নিজের স্বর আবিস্কারে চেষ্টা খুব্বি জরুরি। যদি দস্তয়ভস্কির ছেলেটি-- যার নাম রাস্কলনিকভ-- তার যন্ত্রণা ধরতে পারেন তাহলে আপনি যথার্থ পাঠক।

লেখক হওয়ার পূর্বশর্ত পাঠক হওয়া। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো আমরা পাঠক হওয়ার আগে লেখক হতে চাই। আমরা জানতে চাই না যে আমাদের জন্যে এটা খুবি খারাপ। এবং দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা নিকোলাই গোগোল না পড়েই গল্প লিখতে বসে যাই।

অন্তত তার ওভারকোট পড়েন, পড়তে না পারেন খানিকটা পরে দেখেন। শতছিন্ন একটি ওভারকোটের ভিতর থেকে কেমন করে বাহির হয়ে আসে গল্পের নদীদল, তা আপনাকেই জানতে হবে। আমরা দস্তয়ভস্কি না পড়েই লেখক হয়ে যাই। এমন কি আমরা রবিনাথও পুরোপুরি পড়ি না। আমরা পুরাণ-কুরান, দর্শনবিজ্ঞান, ইতিহাস ভাসাভাসা জানি, একলাইন মাইকেল পড়ি নি।

কিন্তু ভাবালুতা করে বলি কবিতা। লিখতে গেলে আমাদের সাহিত্যের মহান ওল্ডমাস্টার (মাইকেল, বঙ্কিম, রবিনাথ, বিভূতি, মানিক, তারাশঙ্করসহ সবাই)দের সব লেখাই পড়তে হবে তাও জানি না। কারণ আমাদের ধৈর্যের বড় অভাব। সানগ্লাস পরে, দামি কাগজমলাটে চারফর্মা বীর্য ছাপিয়ে লেখক হয়ে যাই। কিংবা মদগাঞ্জা খেয়ে কোনো মহান লেখক বা কবির সমাধির উপর পড়ে কান্নাকাটি করে রাত কাটাই।

আহ্ একেই বলে লেখক! কমলকুমার মজুমদার পড়ে আমি আপ্লুত থেকেছি অনেকদিন। হাসান আজিজুল হকের অনেক গল্প পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার আলব্যের ক্যামুর কথা মনে হয়েছে। হাসান আধুনিক এবং চমৎকার স্পেসের ব্যবহার জানেন। তারপর আসি শহীদুল জহিরের কাছে।

তিনি অনন্য ছিলেন। তিনি গল্পে প্রচুর কথা বলতেন কিন্তু গতির কারণে বাহুল্য মুখ্য হয়ে উঠতো না। তার ভাষা অসাধারণ। যদিও তার ধরন বেরিয়ে এসেছে মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশবছর থেকে-- তারপরও সেটা তিনি নিজস্ব করে প্রকাশ করেছেন। এ ধরন অনেকটা মন্দিরের আঙ্গিনায় বসা কথকঠাকুরের মতো, মানে গল্পবলার ধরন।

তারপর বলি আরেকজন গল্পকারের কথা। তার নাম শাহাদুজ্জামান। অনেক অনেক দিন আগে তার একটি গল্প ‘মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়া’ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। গল্পটা আসলে এক লেফটেনেন্টের চিঠি। তারপর তার অনেক গল্প পড়েছি ভালো লেগেছে।

কিন্তু পরে বিরক্ত হয়েছি, যখন দেখি তিনি মার্কেজ আর বোর্হেস এর গল্পবলার ধরনকে অনুকরণ করে গল্প লিখছেন। তারপর সবচে’ আগে যার কথা বলা দরকার ছিলো তার নাম হুমায়ূন আহমেদ। গল্পের ক্ষেত্রে ইনি শ্রেষ্ঠ এবং ইউনিক। প্রিয় পাঠক, এই নাম শুনে দয়া করে আগে হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা সব গল্প পড়ে আসেন, তারপর নাক ছিটকান। আমাদের দেশে হুমায়ূন আহমেদ এর সাথে তুলনা চলে এন গল্পকার নাই।

বাহিরে আপনি হারুকি মুরাকামির সাথে তুলনা করতে পারেন। তারপর আপনি পড়তে পারেন ওয়াসি আহমেদ আর খোকন কায়সারের লেখা গল্প। পড়তে পারেন সুমন রহমানের গরিবি অমরতা। পড়তে পারেন মানস চৌধুরীর লেখা গল্প। কাজল শাহনেওয়াজ, হামীম কামরুল হক, সুস্মিতা রেজা খান, হাসান মাহবুব, জাহেদ সরওয়ার, লাবণ্য প্রভা’র লেখা গল্প পড়তে পারেন, পড়তে পারেন দুপুর মিত্রের গল্প।

পড়তে পারেন ফজলুল কবিরীর লেখা গল্প। আমাদের বাঙলাদেশে অনেক তরুণ গল্পকার আছেন যারা কাউকে অনুকরণ অনুসরণ না করে স্বকীয় ধরনে গল্প লেখার চেষ্টা করছেন। আমরা লিখতে গেলেই অন্য অনেক লেখকের নকল হয়ে যায়। ধরা পড়লে বলি, আমিতো তার লেখা কখনোই পড়ি নাই। কিংবা বলি এইটা হইলো, নৈর্ব্যক্তিক অবচেতনের ফল।

অনেকে আবার ইংরিজিতে বলি, দাদা, ইহা কালেক্টিভ আনকনসাস। হাহাহাহা... এইসব বলে হয়তো কিছু সময়ের জন্যে পার পেয়ে যাই। কিন্তু সময় যে কী কঠোর জল্লাদ তা আমরা জানি না। জানি না যে সময় ঠিকই আমাদের গলা কেটে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে রেখে যাবে, হয়ে যাবো ইঁদুর আর গন্ধমুষিকের আহার। আহা! প্যাটার্নের মিল থাকতেই পারে।

এইখানে আমি অনুকরণের কথা বলেছি। যেটা বলতে গেলে চুরির পর্যায়ে পড়ে। যেটা আসলে চোখে লাগে। চুরি করে যদি নিজের ধরনের সাথে মিলিয়ে দেয়া যায় তাহলে শিল্পের সৃষ্টি হয়, এমন চুরি অনেক মহান লেখকরাও করেছেন। জীবনানন্দ চুরি করেছেন ইয়েটস, অ্যালেন পো প্রমুখ কবির কবিতা থেকে-- সেটা তার নিজের কবিতা হয়ে গেছে।

রবিনাথ অ্যালেন পোর গল্প থেকে নিয়েছেন। এমন কি তার রক্ত করবী নাটকের প্লট এবং কিছু সংলাপ পর্যন্ত বাইরের একটা রচনা থেকে নেয়া। আবার রবিনাথের ডাকঘর নাটকের মতোই লাগে ল্যুসুনের কাব্য নাটক দ্য পাসার বাই। এটা ল্যুসুন রবিনাথ থেকেই নিয়েছেন। শামসুর রাহমানের অনেক কবিতা ডিলান টমাস থেকে নেয়া।

কিন্তু তার হয়ে উঠেছে। চোকা পেরেকের মতো চোখে লাগে না। এই ব্যাপারটা আগেও ছিলো এখনো আছে। আমি আসলে তাদের কথাই বলেছি যারা চোরাইমালের ব্যবহার জানেন না। চৌকির মাঝখানে যা চোখা পেরেকের মতো হা করে থাকে, শুলেই পিঠে বিঁধে।

খুঁজলেই পাবেন, এমন চোর আশেপাশেই আছে। এইসব নিয়ে ইতোমধ্যে কবি সবুজ তাপস লিখেছেন। অগ্রজ কবি মুজিব মেহদীও লিখেছেন। আরো অনেকেই লিখছেন। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।

কিন্তু সময় এদের ক্ষমা করবে না। আমরা জানি না যে, অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার জন্যে, নিজস্ব ধরন তৈরি করার জন্যেই পড়তে হবে। আর দায়-ফায় বাজে এবং বস্তাপঁচা কথা। এইটুকু জানি ব্যক্তিসত্তা নৈব্যর্ক্তিক সত্তার পূর্বগামী। আমি সত্য হলে জগৎ সত্য, আমি মিথ্যা হলে জগত মিথ্যা।

আমি বিন্দু। আমাকে ঘিরেই বৃত্ত, বৃত্তের পরিধি। প্রথমত রাস্তা বানাবো আমি নিজে হাঁটার জন্যে। অপর সেই রাস্তাতেই হাঁটবে পরে। যেহেতু নিজের জন্যে বানাবো, ভালো মতোই বানাবো নিশ্চয়ই।

আমরা মনে করি লেখক হওয়া অনেক সহজ, অনায়াসে হওয়া যায়-- যেনো লিখতে পারলেই লেখক। কিন্তু জানি না যে, এ বড় কঠিন কাজ, অনেক সাধনার, অনেক পাঠপরিক্রমার। উদ্ভিদের মতো বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম, তারপর চারা, ক্রমশ বৃক্ষ এবং বৃক্ষের বয়স। বালিকার স্তন গজানোর মতো-- দিনের পর দিন প্রতীক্ষা, অনেক রক্তের স্রোতে সাঁতার, ভয়, আনন্দ, সংকোচের ভিতর বন্ধুর পথে হেঁটে হয়ে উঠা গোপনগোলাপ। [ডিসক্লেইমার: এইটা মুক্তগদ্য।

আমি মুক্তগদ্য একটানে লিখি। ফলত অনেক ভালোগল্পকারের কথা মনে না আসায় বাদ পড়ে থাকতে পারে। ] ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।