দেশের প্রকৌশল বিদ্যার অন্যতম বিদ্যাপিঠ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। বিশ্বের প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে পিছিয়ে নেই এখানকার কারিগররাও।
লাইন ফলোয়ার, মেজ সলভার, অবস্টাকল অ্যাভয়ডার, গারবেজ ক্লিনার, ভয়েস কন্ট্রোল রোবট তাদের অনেক আগেই তৈরি করা।
এবার এখানকার শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছেন চালকবিহীন এবং নিঃশব্দে চলা উড়োজাহাজের (ড্রোন) আদলে চালকবিহীন একটি উড়ন্ত যান। যা দিয়ে উদ্ধার অভিযান চালানোসহ আরও অনেক কাজ করা যাবে।
ড্রোন আদলের চালকবিহীন এ উড়োজাহাজটি তৈরি করেছেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের ০৮ ব্যাচের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন খান দীপ।
শুক্রবার এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে দীপ বলেন, ড্রোন কপ্টারটি তৈরিতে সময় লেগেছে এক বছর। এটি আমার ৪র্থ বর্ষের থিসিস প্রজেক্ট ছিল। এই প্রজেক্টের সুপারভাইজার ছিলেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শাহাজাহান স্যার।
তিনি জানান, এর ফ্রেম তৈরিতে সাহায্য করেছেন তার বন্ধু রিজভি আহমেদ।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে সহপাঠী গোলাম সুলতান মাহমুদ রানা।
ড্রোন কপ্টারটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এই কপ্টারটির ব্যবহার বহুবিধ। এটি সোজাভাবে উঠতে ও নামতে সক্ষম। তাই সাধারণ প্লেনের মতো এর উড্ডয়নের জন্য বড় কোনো জায়গার প্রয়োজন নেই। কন্ট্রোল অ্যালগরিদমের যদি ভালো হয় তবে একে একটি ছোট রুমের মধ্যেও চালানো সম্ভব।
এছাড়া কোনো জায়গায় কোনো বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব আছে কিনা এ ড্রোন বিমানটি ব্যবহার করে তা সহজে নির্ণয় করা যাবে। এছাড়াও যখন কোনো নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয় তখন একে ওই জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দেখা সম্ভব যে ওখানে রেডিয়েশনের মাত্রা কতটুকু আছে। এটি যে জায়গায় যাবে সেখানকার লাইভ ভিডিও সে পাঠাতে পারে। ফলে খুব সহজেই একে ১-২ কিলোমিটার দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এর সঙ্গে যেহেতু ভিডিও ক্যামেরা সংযুক্ত আছে সেহেতু কোনো বহুতল ভবনে যদি আগুন লাগে তখন সেখানে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা এই উড়োজাহাজটির পাঠানো ভিডিও দেখে নির্ণয় করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, ড্রোন কপ্টার মূলত একটি উড়ন্ত যান, যেটি কন্ট্রোল করা হয় চারদিকে চারটি ব্রাশলেস ডিসি মটর ও প্রোপেলার দিয়ে। এটি নরমাল উড়োজাহাজের মতো রোল, পিচ এবং ইও (yaw) এই তিন অক্ষ বরাবর চলতে পারে।
এছাড়া চারটি মোটরের স্পিড পরিবর্তন করে একে এই তিন অক্ষ বরাবর ঘোরানো যায়। আর এটি স্বাভাবিক অবস্থায় যেকোনো একটি পয়েন্টে ভেসে থাকতে পারে। একে হোভারিং অবস্থা বলা হয়।
এ অবস্থায় চারটি মোটরের স্পিড পুরোপুরি সমান থাকে এবং পুরো ক্রাফটটি ভূমির সাথে সমান্তরাল অবস্থায় থাকে।
কপ্টারটি তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফ্রেম বা কাঠামো তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে ০.৫ অ্যালুমিনিয়াম (aluminum ) স্কয়ার বার। দু’টি ২ ফিট বার একটি আরেকটির সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি কোণ করে আছে। এই দু’টি বারের মধ্যবিন্দুতে কপ্টারটির ভারকেন্দ্র (centre of gravity) অবস্থিত। এই ভারকেন্দ্র থেকে চারটি মোটর লম্বালম্বিভাবে সমদূরত্বে অবস্থিত।
অনেক সময় ডিজাইন ত্রুটির কারণে ভারকেন্দ্রটি যেকোনো একদিকে সরে যেতে পারে। এটি হলে কপ্টারটিকে ওড়ানো অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণে আগের তৈরি কপ্টারটিকে সফলভাবে ওড়ানো সম্ভব হয়নি। আগের ত্রুটিগুলো সংশোধন করেই এবারের ক্রাফটটি ডিজাইন করা হয়েছে বলে জানান দীপ।
তিনি বলেন, আগের তৈরি কপ্টারটি নামানোর সময় ল্যান্ডিং গিয়ার বার বার ভেঙে যাচ্ছিল।
এ সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসেন এলাকার বড় ভাই অমিত দা। তিনি আমাকে দর্শনীয় এবং শক্ত পোক্ত একটি লান্ডিং গিয়ার বানিয়ে দেন।
কপ্টারটি তৈরি প্রসঙ্গে তিনি জানান, এই এয়ার ক্রাফটটি কন্ট্রোল করার জন্য রয়েছে একটি আইএমইউ (IMU) বোর্ড। এতে আছে থ্রি-এক্সিস জাইরো (gyro ), এক্সেলেড়োমিটার ও মাগনেটোমিটার। এক্সেলেড়োমিটারটি তিন অক্ষ (রোল, পিচ এবং ইও/yaw) বরাবর এয়ার ক্রাফটটির এক্সিলারেশন সম্পর্কিত ডাটা মেইন প্রসেসরে পাঠায়।
জাইরোস্কোপ সেন্সরটি তিন অক্ষ বরাবর এটি কতটুকু হেলানো অবস্থায় আছে সেই সম্পর্কিত ডাটা মেইন প্রসেসরে পাঠায়। এই ডাটাগুলো মেইন প্রসেসর কম্বাইন করে বুঝতে পারে যে এখন ক্রাফটটি কি অবস্থায় আছে।
জাইরো এর ডাটা দেখে মেইন প্রসেসর সহজেই বুঝতে পারে যে ক্রাফটটি কোনো দিকে হেলে আছে কিনা। কেননা যদি এটি কোনো দিকে হেলে থাকে তাহলে ক্রাফটটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থাকবে না। এমনকি বেশি হেলে থাকলে পুরো ক্রাফটটি উল্টে যেতে পারে।
তিনি জানান, এই জাইরো এবং অ্যাক্সেলেড়োমিটার আজকালকার স্মার্ট ফোনেও দেখা যায়। স্মার্ট ফোনে গেম খেলার সময় এটিকে কতটুকু বাঁকা করা হয় তা এই জাইরো এবং অ্যাক্সেলেড়োমিটারের রিডিং দেখেই স্মার্ট ফোনের প্রসেসর বুঝে যায়।
রিয়েল টাইম ডাটা রিডিং ও অ্যানালাইসিসের জন্য পি আই ডি কন্ট্রোলার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি সফটওয়্যার অ্যালগরিদম যেটি ডাটা ইনপুট নিয়ে সেটিকে সেই ডাটাকে প্রসেস করে সহজেই বুঝতে পারে যে কপ্টারটি তার টার্গেট পজিসন থেকে কতটুকু সরে আছে।
এটি সেই অনুযায়ী মোটরগুলোকে আউটপুট সিগন্যাল পাঠায়।
মটরগুলো তখন প্রসেসরের পাঠানো কমান্ড অনুযায়ী তাদের স্পিড পরিবর্তন করে কপ্টারটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসে। কেননা মোটরের স্পিড পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাধ্যমে উৎপন্ন থ্রাস্টও (thrust) পরিবর্তিত হয়।
দীপ জানান, এই কপ্টারটিকে পুরোপুরি অটোম্যাটিক মুডে চালানোর কাজও শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও জি পি এস এর মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অটোম্যাটিকালি নিয়ে যাওয়ার কাজও প্রায় শেষ। এখন আরও উন্নতির জন্য দরকার সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
কপ্টারটি তৈরি করতে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কপ্টারটির ব্যবহার যেমন বহুমুখী তেমনি ততটাই জটিল এর কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণ। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি এটি নিয়ে কাজ করেছি । অনেক বাধা, অনেক সমস্যা, অনেক সীমাবধ্যতার সম্মুখীন হয়েছি। চাহিদামতো প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্রই সময় মতো পাইনি। শুধুমাত্র কাঠামো বানাতে গিয়েই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
ইলেক্ট্রনিক্স অনেক জিনিসপত্র দেশের বাইরে থেকে আনাতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল আর্থিক। স্পন্সরের জন্য অনেক ঘোরাঘুরিও করেছি।
তিনি আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ০০ ব্যাচের ইমন ভাই, ০২ ব্যাচের রাইয়ান ভাই, তাদেরও অনেক সিনিয়র আজাদ ভাই এবং তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের ০৪ ব্যাচের লিটন ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তবে সার্বক্ষণিক আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ এবং সাহায্য করে গেছেন আমার মেজ মামা খুরশিদ আলম ও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ০০ ব্যাচের ইমন ভাই।
কুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, এই প্রথম দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী এ ধরনের ড্রোন কপ্টার তৈরি করে সফলভাবে উড়িয়েছে ও নামিয়েছে।
তিনি জানান, দীপের তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতির এ ড্রোন কপ্টারটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পরিচালনা সম্ভব। ছোট আকৃতির ব্যাটারির মাধ্যমে এটি চালানো হয়। ব্যাটারি দুর্বল হয়ে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে আসবে।
তিনি আশা করেন, দুর্যোগপ্রবণ আমাদের এই দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অনেক ক্ষেত্রে এ যানটি উপকার করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বাংলানিউজকে বলেন, চালকবিহীন উড়োজাহাজ তৈরি করে কুয়েট শিক্ষার্থী দীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। চালকবিহীন ও নিঃশব্দে চলা ড্রোনটি দুর্যোগকালীন সময়ে কোথায় কি হচ্ছে তা জানাতে পারবে।
তিনি বলেন, এসব গবেষণার কাজে পূর্বের ন্যায় আগামী দিনেও কুয়েটের শিক্ষার্থীদের কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
এক্ষেত্রে তিনি সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর দাবি জানান।
উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ আল মামুন খান দীপ ১৯৮৯ সালে রংপুর জেলা সদর গোমস্তাপাড়ায় নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ থানার উত্তর হাজাতিয়া গ্রামে।
তার বাবা মো. দৌলত খান এবং মা নূরজাহান খান। তিনি ২০১৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় রোবোটিক কম্পিটিশন ‘ইন্টারন্যাশনাল অটোনোমাস রোবোটিক কম্পিটিশনে’ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল আই ই ই ই (IEEE) কনফারেন্সে তার গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো বর্তমানে (IEEE EXPLORE) নামক ডিজিটাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।