"লেখা কম, পড়া বেশি" ব্লগার
ব্লগার কায়সার রুশোর এই লেখা পড়ে বুয়েটের একদল ছাত্রকে ফাল দিয়ে উঠতে দেখে বেশ মজা লাগছে। ঐ লেখা তাদের কাছেই ভাল না লাগার, কথা যারা বুয়েটে পড়েন দেখে হামবড়া ভাব নিয়ে চলেন। এই ধরনের প্রকৌশলী আর হবু প্রকৌশলীদের জন্য শুধুই করুনা রইল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বুয়েটের অধিকাংশ ছাত্রই এধরনের পোষণ করেন না। সেটা বোঝা যায় উপরে রাগিব ভাই সহ আরও কয়েক জন সহনশীল ব্লগারদের কমেন্ট পড়ে।
কমেন্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনলাইনে বুয়েট ব্যতীত অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনেক কম একটিভ। তাই বুয়েটিয়ানদের অনেক ভ্রান্ত ধারনার জবাব দেওয়া হয়নি। সেজন্যই আমি লিখতে বসলাম। বুয়েট গুচ্ছ পদ্ধতিতে আসেনি সেটা তার প্রশাসনিক বিষয়। তবে তা ঠিক কি বেঠিক সেটা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।
রাজশাহীতে রিকশাওয়ালাদের রুয়েট বললে তারা চেনে না। কিন্তু বিআইটি বললে তারা নিমিষেই চিনতে পারে। রিকশাওয়ালারা চিনতে না পারলে কোন সমস্যা নাই, কিন্তু এই ছোট্ট দেশে সবচেয়ে মেধাবী দাবী করা একদল মানুষ যদি জেনে শুনে বারবার এ কথা বলে তখন ব্যাপারটা আর সহজ ভাবে নেওয়া যায় না।
এই পোস্টের লেখক লেখার শুরুতেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বুয়েটে দেশের সেরা ছাত্ররা লেখা পড়া করে। তারপরেও যারা “কোথায় আগরতলা, আর কোথায় চৌকির তলা “ জাতীয় মন্তব্য করেন তাদের মানষিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
যারা সমান ডিগ্রীধারীদের নিয়েই এমন মন্তব্য করতে পারে, আমার সন্দেহ হয় তারা অন্যান্য ননটেক বিশ্ববিদ্যালয় আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মানুষ মনে করে কিনা। যদিও আমরা ভাল করেই জানি বুয়েটের প্রথম সারির সাবজেক্টগুলো ছাড়া তথাকথিত পেছনদিকের সাবজেক্টগুলোতে পড়তে যাওয়ার সময় সবাই একবার অন্তত চিন্তা করে বুয়েটে এই পেছনের বিষয় নিয়ে পড়বে, নাকি রুয়েট/কুয়েট/চুয়েটের অপেক্ষাকৃত প্রথম সারির বিষয়ে পড়বে কিনা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বুয়েট ছেড়ে রুয়েট/কুয়েট/চুয়েটে চলে আসে। (“তথাকথিত” কথাটি বলছি কারন “ভাল সাবজেক্ট” আর “খারাপ সাবজেক্ট” কথাগুলি আমার কাছে একদমই ভাল লাগে না। আমার মতে সব সাবজেক্টই ভাল, সব সাবজেক্টেই মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রয়োজন আছে।
)
ছোট্ট একটা দেশ আমাদের। বিভক্তি এখানে চরম আকার ধারন করেছে। দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় ঢাকা শহরে শিক্ষিত মানুষের অবস্থানের ঘনত্ব শরীরে টিউমারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঢাকা কেন্দ্রীক শিক্ষাব্যবস্থা দূর না করা পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হবে না। সে জন্য প্রয়োজন হবে ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অথবা বর্তমানে চালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন করা।
সেক্ষেত্রে এই গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি প্রথম ধাপ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। পরবর্তিতে প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষক স্থানান্তর, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এবারে তাদের উদ্দেশ্য কিছু বলি যারা বুয়েটের ভর্তিপরীক্ষার মান নিয়ে খুব গর্ব করছেন, আর ভাবছেন যে রুয়েট/কুয়েট/চুয়েটে চোখ বন্ধ করে খাতায় হিজিবিজি এঁকে এলেই প্রথম সারির বিষয়গুলোতে ভর্তি হওয়া যায়। সাম্প্রতিক কালের রুয়েট/কুয়েট/চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিষয়ে কি কোন ধারনা আছে? এখন সকলেই অর্ধেক MCQ আর অর্ধেক লিখিত পরীক্ষা নেয়। আগে থেকে কাওকে না জানালে এই চারটা ইউনির ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে সে কনফিউজড হয়ে যবে কোনটা বুয়েটের, আর কোনটা রুয়েট/কুয়েট/চুয়েটের প্রশ্ন তা বের করতে।
তবুও আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় কয়েকটা সমস্যা দেওয়া হয় তা সমাধান করা আসলেই বেশ কঠিন। গুচ্ছ ভর্তিপরীক্ষার কোথাও কি বলা আছে যে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার মান কমাতে হবে? মান কমানোর তো প্রশ্নই উঠছে না।
এবারে আসা যাক তাদের বিষয়ে, যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়ছেন, আর মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের উদাহরন দিচ্ছেন। মেডিকেলে সবচেয়ে বড় কারচুপি হয়েছে ২০০৬ সালে যারা HSC পাশ করেছে তাদের ভর্তি পরীক্ষার সময়। এর আগে ও পরেও বিভিন্ন সময় প্রশ্ন ফাঁসের কথা শোনা গেছে।
তবে তা কোন মতেই “মুড়ি মুড়কির মত প্রশ্ন বিক্রি হয়” এমন মনে হয় নয়। আর নেগেটিভ উদাহরনকে কেন বারবার সামনে আনছেন? আমাদের সামনে কিন্তু অনেক পজিটিভ উদাহরন আছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বড় দুইটি পরীক্ষা SSC এবং HSC কিন্তু দেশ ব্যাপী একসাথে অনুষ্ঠিত হয়। আর সম্প্রতি কয়েক বছরে কিন্তু এই দুই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সুতরাং সদিচ্ছা থাকলে দেশজুড়ে মাত্র চারটি ইউনিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া কি খুব কঠিন হবে?
বুয়েটে ভর্তিপরীক্ষার ঐতিহ্য নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন।
কিন্তু এর কোন ভিত্তি নেই। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে ছিল সম্পূর্ণ লিখিত, এখন হয়েছে অর্ধেক লিখিত আর অর্ধেক MCQ। আগে এখানে কোন পরীক্ষার্থী পরপর দু’বছর পরীক্ষা দিতে পারত, এখন পারে মাত্র এক বার।
আগে SSC আর HSC তে অপেক্ষাকৃত কম নম্বর পেয়েই ভর্তি ফরম তোলা যেত, এখন সেই ফরম তুলতে অনেক বেশি মার্কসের দরকার হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বুয়েটও কোন নির্দিষ্ট ঐতিহ্যে থেমে নেই। তারা প্রয়োজন অনুসারে পদ্ধতির পরিবর্তন এনেছে বরেই আজ বুয়েটকে একবাক্যে সবাই দেশের সেরা প্রকৌশল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মেনে নেয়। এই পরীবর্তনে লজ্জার কিছু নেই। ভাল কিছুতে যে আগে যোগ দেবে, সে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে।
অসুখকে ঐতিহ্য বলে লালন করার মধ্যে গর্বের কিছু নেই।
দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বৈষম্য আর দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে আনতে সবচেয়ে সরব দেখা গিয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মনির হাসান কে। তারা নির্মোহ দৃষ্টিতে বিষয়টি অবলোকন করেছেন দেখেই এমন সমাধানের কথা ভেবেছেন। দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একেক বিশ্ববিদ্যালয় একেক পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।
সেজন্য প্রস্তুতিও হয়, তাদের ভর্তি প্রক্রিয়াও বিভিন্ন। একজন ছাত্রের পক্ষে এতগুলো বিষয় মাথায় রেখে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আসলেই অনেক কঠিন ব্যাপার। আবার এটা খুব সাধারন ঘটনা যে একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পড়া। তখন পরীক্ষার্থীকে পয়সা খরচ করে ফরম তোলার পরেও যে কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কে বেছে নিতে হয় পরীক্ষা দেবার জন্য। অনেকে বলতে পারেন ঐ ছাত্রের এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম তোলার দরকার কি? উত্তর হল, কোন ছাত্র যে ইউনিতে ভর্তি হতে চাইছে, তাতে সে যে ভর্তি হতে পারবেই, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনের তুলনায় এতে ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং পুরো বিষয়টিকে ১০ বছর আগের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে চলবে না। কারন তখন সারাদেশে হাতেগোনা কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আর হত কয়েক বছরে উচ্চ শিক্ষা নিতে আসা ছাত্রের সংখ্যা বেড়েছে অনেক গুন। একবার চিন্তা করুন মেডিকেলগুলো যদি ভিন্ন ভিন্ন করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করত, তাহলে একজন ছাত্রকে ঘুরে ঘুরে সারাদেশ জুড়ে ১৩ বার পরীক্ষা দিতে হত। এ বিষয়ে মনির হাসান প্রথম আলোতে একটা কলাম লিখেছিলেন।
পড়লেই বুঝতে পারবেন ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছাত্র/ছাত্রীদের কত দূর্ভোগ পোহাতে হয়। সেটা নিয়ে আমিও একটা পোস্ট দিয়েছিলাম।
আলোচ্য পোস্টে কয়েকজনকে দেখা গিয়েছে নিজের বাবা থেকে শুরু করে শিক্ষকের রেফারেন্স দিয়ে রুয়েট নাকি, কুয়েট নাকি চুয়েটে ভাল তা নিয়ে রীতিমত লড়াই শুরু করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, যে যেখানে পড়ে, তারকাছে সেটাই ভাল লাগবে। অন্যগুলো তার কাছে ম্রিয়মান।
সুতরাং আসুন নিজেদের অভিজাত প্রমাণের লড়াইয়ে না নেমে চেষ্টা করি কেমন করে দেশে একটি সময়োপযোগী শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন করা যায়। নিজেদের মাঝে কুকুরের মত মাংস টানাটানি না করে নিজেদের ইউনিগুলোকে বাইরের দেশের নামকরা ইউনিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতার চেষ্টা করি। সর্বোপরি কূপমন্ডুকতা দূর করি।
লেখক কে বলছি, আপনার শেষের কয়েকটা লাইনে আপনি বলেছেন যেহেতু বুয়েট গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি সরে গিয়েছে, আপনারাও আন্দোলন করে আপনাদের ইউনিকে এই পদ্ধতি থেকে সরিয়ে নেবেন। এই কথা সম্ভবত বুয়েটিয়ানদের খারাপ লেগেছে।
না রুশো ভাই, ওরা যদি ভূল করে সরে যায়ও, আমাদের এখান থেকে সরে আসা বোকামি হবে। তবে এমন একটা পোস্টের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অসুস্থতার জন্য কমেন্টটা দিতে দেরি হল।
পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।