নির্বোধদের সাথে কখনো তর্ক করা উচিত না, তারা প্রথমে তোমাকে নিজেদের কাতারে নামিয়ে আনবে এবং তারপর তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তোমাকে তর্কে পরাজিত করবে - মার্ক টোয়েন।
নামাজে হাত রাখবো কোথায় ? হাত রাখা ভুল হলে কি নামাজ হবেনা?
নামাজে হাত বাঁধার ব্যপার নিয়ে জানার আগে আমাদের জানতে হবে যে হাত বাধা নামাজের ভিতর ফরজ/ওয়াজিব কোন বিধান নয় যার মধ্যে ভুল হলে নামাজ হবেনা। হাত বাঁধা হলো সুন্নাহ। আমাদের মনে রাখতে হবে একটা বিষয়ে যে, ইসলামের ফরজ ইবাদাত গুলোর ব্যপারে উম্মাতের ইমামদের কোন মতভেদ হয়নি। মতভেদ হয়েছে ছোটখাট কিছু ব্যাপার নিয়ে।
আমাদের ইমামদের মধ্যে কেউ নাভির নিচে হাত বাঁধার কথা বলেছেন, কেউ হাত না বাঁধার ব্যাপারে মত দিয়েছেন, কেউ বলেছেন নাভির উপরে বা নাভীর নিচে এক জায়গায় বাঁধলেই হবে আবার কেউ বলেছেন যে বুকের উপর হাত বাঁধতে হবে।
প্রকৃত পক্ষে নামাজে হাত বাঁধাটা সুন্নাহ বলে প্রমানীত। হাদীস খানা আমি উল্লেখ করছি। বুখারী শরীফ এর “কিতাবুস সালাত” অধ্যায়ে সাহল ইবনে সাদ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন সালাতে লোকদের নির্দেশ দেয়া হতো যে, সালাতে প্রত্যেকে ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে। আবু হাযিম (রহ) বলেন সাহল এ হাদিসটি নবী (সা) থেকে বর্ণনা করতেন বলেই জানি।
ইসমাঈল (রহ) বলেন এ হাদীসটি নবী (সা) থেকেই বর্ণনা করা হত। তবে তিনি এরুপ বলেন নি যে সাহল (রা) নবী (সা) থেকে বর্ণনা করতেন।
উপরের বর্ণনা টি সহীহ বুখারীর। আর সব যুগে বুখারী শরীফ এর সব হাদীস সহীহ বলে প্রমানীত। আরো একটি বর্ণনা আমি তুলে ধরছি।
এতে করে পরিস্কার হয়ে যায় নামাযে হাত বাধা নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। তবে কোথায় বাঁধতে হবে তা পরিস্কার নয়। হাদীস খানা নিচে উল্লেখ করা হলো।
কাবীসা ইবনু হুলব (রা) হতে তাঁর পিতার সুত্রে বর্ণিত আছে, তিনি (হুলব) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের ইমামতি করতেন এবং (দাঁড়ানো অবস্থায়) নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত ধরতেন” তীরমিযি ২৫২ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ইবনু মাজাহ-৮০৯ – হাদিসটি হাসান (গ্রহণযোগ্য) এ অনুচ্ছেদে তীরমিযি তে ওয়াইল বিন হুজর (রা), গুতাইফ ইবনু হারিস (রা), ইবনু আব্বাস (রা), ইবনু মাসউদ (রা) এবং সাহল বিন সাদ (রা) হতেও হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং উপরের হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে নামাযে হাত বাঁধা(ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা) মর্মে সহীহ এবং হাসান পর্যায়ের হাদীস রয়েছে।
কিন্তু কোথায় হাত বাঁধতে হবে, তা জানতে গেলে বিস্তারিত একটু আলোচনা প্রয়োজন। সহীহ মুসলিম এ ওয়ায়েল বিন হুজর (রা) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। আর ওয়ায়েল বিন হুজুর এর বর্ণনা মতে নাভির উপরে হাত বাঁধতে হবে (বুকের উপর)।
এর মানে বুকের একেবারে উপরে গলার কাছেও নয় আর একবারে নাভীর উপরের পেটের উপরেও নয়। সৌদি আরবের প্রধান মুফতি শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায (রহ) তার “রাসুল (সা) এর নামাজ” বইতে ওয়ায়েল বিন হুজর (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের কথা বলেছেন।
আর তারপর তিনি নাভির উপরে বুকের মাঝামাঝি হাত বাধার কথা বলেছেন। ইমাম শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি (রহ) তার ‘রাসুল (সা) এর নামাজ’ বইতে একি কথা বলেছেন। দেখা যাচ্ছে যে সহীহ মুসলিম এ বর্ণিত হাদিসটি বুকের উপর হাত বাঁধার ব্যাপারে একমাত্র হাদীস যা রাসুল (সা) থেকে প্রমানীত। এছাড়া অন্যান্য যেসব হাদীস রয়েছে, সেগুলো সহীহ বলে প্রমানীত নয়। সনদ দুর্বল বলে অভিযোগে অভিযুক্ত।
আর যুগে যুগে সকল মুহাদ্দীস এবং হাদীসবেত্তাগন দুর্বল হাদীস এর উপর আমল করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম মুসলিম বলেন, “দুর্বল রাবীদের থেকে হাদীস বর্ণনা করা নিষিদ্ধ এবং হাদীস গ্রহনে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক” হাদীস এর সমস্ত যুগে ইমাম বুখারী আর মুসলিম এর বেঁধে দেয়া এই শর্ত সবাই মেনে চলেছেন সহীহ হাদীস নির্ণয়ের জন্য। তাই বুখারী আর মুসলিম এর সকল হাদীস দুর্বলতা মুক্ত আর সহীহ বলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। এ কারণে বুখারী আর মুসলিমকে একসাথে “সহীহাইন” বলা হয়।
এবার আসুন নাভীর নিচে হাত বাঁধার ব্যাপারে হাদীস সম্পর্কে জানা যাক।
ইমাম আবু দাউদ তাঁর “আবু দাউদ শরীফ” এ দুটি হাদীস নিয়ে এসেছেন। একটিতে বলা আছে রাবী আলী (রা) কে নাভীর উপরে হাত বাঁধতে দেখেছেন এবং অপরটিতে বলা আছে রাবী আলী (রা) কে বলতে শুনেছেন নাভীর নিচে হাত বাঁধতে। এ মর্মে রাসুল (সা) থেকে হাদীস বর্ণিত নেই। যা রয়েছে তা সাহাবীর বর্ণনা বা আমল। কিন্তু বর্ণনা টি দুর্বল বলে অভিযুক্ত।
তাছাড়া আলী (রা) থেকে বর্ণিত আমল দুই রকম হতে পারেনা। ব্যাপারটা একটার সাথে আরেকটা বিপরীত বর্ণনা। অপর দিকে অন্য এক রাবী দাবি করেছেন আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন যে তিনি নাভীর নিচে হাত বাঁধেন। কিন্তু এই বর্ণনার বর্ণনাকারীদের মধ্যে ‘ইবনে ইসহাক-আল কুফী’ নামে একজন বর্ণনাকারী আছেন যাকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল দুর্বল বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রিও পাঠক আবু দাউদ শরীফ খুলে “কিতাবুস সালাত” অংশের “নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখা” অংশ দেখুন।
আবু দাউদ শরীফ এর আরেকটি বর্ণনায় আছে, তাউস (রহ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা) নামাজে ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে তা বুকের উপর বেঁধে রাখতেন”, এ বর্ণনার সনদ সম্পর্কে বা বর্ণনাকারী সম্পর্কে ইমাম আবু দাউদ কোন অভিযোগ করেন নি। তাহলে আমরা নাভীর উপরে হাত বাঁধার ব্যাপারে অর্থাৎ বুকের মাঝামাঝি হাত বাঁধার ব্যাপারে সহীহ অভিমত পাচ্ছি কিন্তু নাভীর নিচে হাত বাঁধার ব্যাপারে বর্ণনা সহীহ বলে প্রমানীত নয়। তাছাড়া নাভীর নিচে হাত বাঁধার ব্যাপারে রাসুল (সা) থেকে সরাসরি কোন বর্ণনা ও পাওয়া যায়না। ইমাম মালেক এবং ইমাম শাফেঈ নাভীর উপরে হাত বাঁধার ব্যাপারেই তাদের অভিমত প্রদান করেছেন। ইমাম আবু হানিফা নাভীর নিচে হাত বাঁধার কথা বলেছেন।
ইমাম আবু হানিফা কেন নাভির নিচে হাত বাঁধার কথা বলেছেন তা আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন, তবে ইমামদের কেউ কখনো নিজের স্বার্থে কোন আমল করেন নি বা মত দেন নি। হয়ত আবু হানিফা (রহ) এর কাছে সহীহ দলিল গুলো পৌঁছায়নি বিধায় তিনি তাঁর কাছে থাকা দলিলগুলো থেকেই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। আমাদের দেশে অনেক লোক নাভীর নিচে হাত বাঁধতে গিয়ে ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরেন। মুহাদ্দীসগন এই পদ্ধতিকে বেদআত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কারন দলিল এ পাওয়া যায় হাত রাখার বিষয়।
কিন্তু হাত ধরার ব্যাপারে যে হাদীস তা সহীহ নয়। আর হাত ধরার হাদীসের বিপরীতে হাত রাখার ব্যাপারে বোখারী আর মুসলিম এর সহীহ হাদীস রয়েছে। তাই কোন বিষয়ে সহীহ হাদীস থাকা সত্ত্বেও দুর্বল হাদীস এর দিকে যাওয়া উচিত নয়। এটা স্পষ্ট সুন্নাত প্রত্যাখ্যান এর শামিল। আমাদের সবার খেয়াল রাখতে হবে যে, হাদীস যখন সহীহ হবে তখন সেটা মেনে নেয়াটা আমাদের জন্য জরুরী।
ইমাম আবু হানিফা সহ সকল ইমাম একটা কথায় একমত হয়েছেন। তাঁরা সবাই বলে গেছেন, "হাদীস যখন সহীহ প্রমাণ হবে,তখন সেটাই আমার মাযহাব"।
আমাদের দেশে নারী আর পুরুষদের হাত বাঁধার ব্যাপারে বা নামাজ আদায়ের ব্যাপারে যে পার্থক্য করা হয়, তা মূলত গবেষণা প্রসুত কথা। কোন সহীহ হাদীস দ্বারা এর প্রমাণ পাওয়া যায়না কিংবা সাহাবীদের আমল থেকে তা জানা যায়না। একটা সহীহ মতামত রয়েছে যেটা আলী (রা) বলেছেন যে মেয়েরা জড়সড় হয়ে নামাজ আদায় করবে।
এর মানে এই নয় যে নামাজের পুরা পদ্ধতি পরিবর্তন করে দিবে। বরং জড়সড় বলতে বুঝানো হচ্ছে একটু নারীসুলভ বিনয় নিয়ে নামাজ আদায় করবে। রাসুল (সা) এর সহীহ হাদীস রয়েছে। তিনি বলেছেন, "তোমরা নামাজ আদায় কর, যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখ" যদি নারীদের বেলায় আলাদা কোন নিয়ম থাকতো তবে অবশ্যই তিনি বলতেন যে "হে পুরুষরা তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ আদায় করতে দেখ সেভাবে নামাজ আদায় কর" কিন্তু তিনি এভাবে বলেন নি। তাই আমাদের উচিত নয় হাদীস এ যা বলা হয়নি তা আমল করা।
যা কিছু হাদীস এবং সাহাবীদের আমল দ্বারা প্রমানীত নয় তা বেদআত।
তাই পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আমলের দিক থেকে আমাদের অধিক বিশুদ্ধ মতামতটাই মেনে নেয়া উচিত। তবে যেহেতু হাত বাঁধা নিয়ে নামায ছুটে যাবার আশংকা নেই, সেহেতু এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে বিবেক কে কাজ লাগিয়ে আমাদের সহীহ আমল করা উচিত। আমাদের সমাজে আমরা কোন একটি কাজ আমাদের নিজেদের বিপরীত হলেই বলে বসি যে আপনার নামাজ হবেনা বা এটা করলে নামাজ হবেনা। এমনটা করে মতভেদ আর তর্ক করা কবিরা গুনাহ।
আপনার পাশে যদি কেউ নাভির নিচে হাত বাঁধে, আপনার জন্য এমনটা বলা বৈধ নয় যে আপনি তাকে গিয়ে বলবেন যে আপনার নামাজ ভুল। কারন সব আমলের কিছু না কিছু দলিল রয়েছে। আপনি বড়জোর কাউকে হাদীস দুর্বল বা সহীহ বলে আনিয়ে দিতে পারেন। এখানেই আপনার দায়িত্ব। কাউকে আঘাত করা বা কারো হাত বাঁধা নিয়ে তর্ক করা কারো জন্য বৈধ নয়।
ইমামরা কেউ কখনো এমন করেন নি বা বলেন নি কিংবা ঝগড়া করেন নি। বরং তাঁরা জ্ঞান এর খাতিরে নিজ নিজ মতামত তুলে ধরেছেন মাত্র। তাই আমরা নিজ নিজ আমলের ব্যাপারে সতর্ক হব। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ) একই কথা বলেছেন যে, মতভেদের বিষয় গুলো নিয়ে তর্ক করে গুনাহগার হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীন এর সঠিক বুঝ দান করুন এই দুয়া করি।
আমীন
ধন্যবাদ ভাই Nur Uddin Al Masud কে তার এই সুন্দর ব্যাখ্যামূলক লেখার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।