নৈরাজ্যের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তহীনতা
ফকির ইলিয়াস
=======================================
বেশ কিছু নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে আরেকটি হরতাল হয়ে গেল। হরতালের পূর্বরাতে ঢাকায় বেশ কিছু গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হরতাল তখনও শুরু হয়নি। তারপরও এ সময়ে গাড়ি পোড়ানোর কারণ কি? কারণটি হচ্ছে নৈরাজ্য তৈরি করা। গণমানুষের মনে তীব্র ভীতির সঞ্চার করা।
তথাকথিত হরতালকে যদি গণতান্ত্রিক অধিকার বলা হয়, তবে যারা হরতাল ডাকবে তাদের উচিত হরতাল ডেকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করা। তারা রাজপথ দখলে নামবে কেন? অন্যের প্রাত্যহিক জীবনে বাধা দেবে কেন?
বাংলাদেশে হরতাল মানেই চরম ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা। এবারের হরতালের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে একটি মারাত্মক তথ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, হরতালকারী বিএনপি-জামায়াত জোট নাকি ঢাকার বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে ভাড়াটে পিকেটার সংগ্রহ করেছে। চুক্তি হয়েছে, একটি রিকশা ভাঙলে এক হাজার টাকা, মোটরসাইকেল পোড়ালে দুই হাজার টাকা, সিএনজি পোড়ালো তিন হাজার টাকা, বাসে অগ্নিসংযোগ করলে পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়া হবে!
এই তথ্যটি যদি সত্যি হয় তবে তা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
ভাড়া করে ভাঙচুরকারী, দাঙ্গাবাজ এনে কার ক্ষতির চেষ্টা করা হচ্ছে? এ ক্ষতি কি রাষ্ট্রের নয়?
হরতালের পূর্বরাতে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার হাত ছিল বলে পুলিশ বলছে। এই ঘটনায় কিছু গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
হরতালকারীদের মারমুখী কিছু মিছিলে পাল্টা হামলা হয়েছে। বিএনপির ছাত্রদলের মতে এরা নাকি ছাত্রলীগের কর্মী। এরা প্রকৃতপক্ষে ছাত্রলীগের কর্মী, নাকি বিএনপির উঠতি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর ব্যক্তিগত প্রতিপক্ষ-তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
কারণ হঠাৎ করে এ্যানীর ওপরই হামলা কেন? তা কেবল ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতেই কেউ করতে পারে।
এ ছাড়া বিএনপির উঠতি নেতাদের এমন অতীত ইতিহাস রয়েছে, তারা প্রায়ই নিজেদের 'কৃতিত্ব জাহির' করার জন্য মাঝে মধ্যে সিনক্রিয়েট করেন। যেমনটি মাত্র কিছুদিন আগে বিএনপির মহাসচিবের আদরের তনয় নাজমুল পবন করেছিলেন। তিনিও ভাড়াটে বোমাবাজ আমদানি করেছিলেন 'নেতা' সাজার জন্য।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ছাত্রলীগের নাম বিক্রি করে কেউ নৈরাজ্য করলে এর দায় আওয়ামী লীগ নেবে না।
কারণ গঠনতন্ত্র মোতাবেক ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন নয়।
ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন কিনা সেটা বড় কথা নয়। তবে মনে রাখা দরকার দেশের অন্য দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে এবং জামায়াত, তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরকে পোষ্য হিসেবেই রেখেছে এবং নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখন সরকারে আছে। তাই হয়তো ছাত্রলীগের খুব বেশি প্রয়োজন মনে করছে না।
কিন্তু তারা তো চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। বিরোধীদলে গেলে তাদের ছাত্রলীগের সমর্থন পাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা, তা এখনই ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। সেই আলোকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ঢেলে সাজানো দরকার। এটা গোটা দেশবাসী জানেন, কিছু লোভী, সুবিধাবাদী অছাত্রদের কারণেই সারাদেশে ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এদের চিহ্নিত করে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া মোটেই কঠিন কোন কাজ নয়।
কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তা না করে দায় এড়াতে চাইছেন। কোন লিখিত বিধান স্বীকার করুক আর নাই করুক, ছাত্রলীগ যে আওয়ামী লীগের পরিপূরক সংগঠন তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পারার কোন উপায়ও নেই। তাই কেন যে ছাত্রলীগের ঘাড়ে চাপা ভূত তাড়াতে সরকার তৎপর নয়, তা মোটেই বোধগম্য নয়।
দুই.
আগামী বছরটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে খুব স্থিতিশীল যাবে তা বলার কোন সুযোগ নেই।
তার কারণ, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে ঘাতক-দালাল-রাজাকাররা যেমন একটি বড় রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের মওকা খুঁজছে তেমনি লুটপাটকারীরাও তাদের মসনদ ফিরে পেতে যে কোন মূল্যে সরকার হটাবার ফন্দিফিকির করছে। ২৭ জুনের হরতালের পর, বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতা বলেছেন, এই হরতাল তাদের শক্তিকে সুসংহত করেছে। তার অর্থ হলো, জামায়াত এবং সমমনারা তাদেরকে সমর্থন দিয়েছে।
বাংলাদেশে পরাজিত রাজাকার শক্তি একটি রাহুর মতো। এটি বিএনপি কখনোই স্বীকার করবে না।
তার কারণ হলো বিএনপির জন্মই হয়েছে, এই আলবদর-রাজাকার শক্তির মদদ নিয়ে।
হতাশাজনক কথা হচ্ছে এই, যারা মুক্তিযুদ্ধের শানিত চেতনায় বিশ্বাসী, তারা গণমানুষের মুখের ভাষা পড়তে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। জনগণ তাদেরকে ম্যান্ডেট দেয়ার পরও তারা তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখলাম, হজরত মুহম্মদ (সা.)-কে কটাক্ষ করার অপরাধে জামায়াতের আমির নিজামী, সেক্রেটারি মুজাহিদ এবং আরেকজন নেতা সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামায়াতিরা এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রায়ই দেয়।
তাদের এসব কথাবার্তা নতুন নয়। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী তার জীবদ্দশায় নানারকম বিতর্কিত কথাবার্তা বলে গেছেন। যা উপমহাদেশের হাক্কানি আলেমসমাজ বরাবরই প্রত্যাখ্যান, প্রতিবাদ করে এসেছেন। বাংলাদেশে গ্রেফতার এবং জামিনের সরকারি কূটচাল মানুষ অনেক দেখেছে। এসব আলো-আঁধারি খেলাই বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছে বহুলাংশে।
আর সেই সুবাদেই আজ দেশে মির্জা আব্বাস কিংবা শমসের মুবিন চৌধুরীর মতো নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা জ্বালাও পোড়াও-এর মদদ দিয়েছেন। শমসের মুবিন চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি জাতির জনকের ঘাতকদেরকে বিদেশে পালিয়ে যেতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মদদপুষ্ট হয়ে খুনিদেরকে বিদেশেও সাহায্য করেছিলেন। এই শমসের মুবিন চৌধুরী, সিলেট বিভাগে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের শূন্যস্থান পূরণ করতে চাইছেন।
যদিও বিএনপির সম্ভাব্য কর্ণধার তারেক রহমান চাইছেন, সিলেটে বিএনপির হাল ধরবেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিএনপি নেতা, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কমরউদ্দিন। উল্লেখ্য, তারেক রহমান বিলাতে বর্তমানে এই কমরউদ্দিনের তত্ত্বাবধানেই পরবাস জীবন কাটাচ্ছেন। তাই ফ্রন্ট লাইনে আসার জন্য শমসের মুবিন চৌধুরী যে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু নৈরাজ্যের রাজনীতি কি গ্রহণ করে জনগণ?
নিউইয়র্ক, ২৯ জুন ২০১০
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা।
২ জুলাই ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।