নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এক হচ্ছে তিন গ্রুপে বিভক্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। পাশাপাশি তারা দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে সশস্ত্র জিহাদ শুরুর বিষয়ে একমত হয়েছে। হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) তিনটি গ্রুপ এরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক দফা বৈঠকেও বসেছে। জুলাইয়ের মধ্যেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কার্যক্রম শুরু করবে এবং আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বড় কোনো ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেবে। এরপর তারা জিহাদ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিতে পারে।
হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর মজলিশে শুরা ও মজলিশে আমেলার একাধিক সদস্য এসব তথ্য দিয়েছেন।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর মুফতি আবদুস সালামের নেতৃত্বাধীন অংশটি তিনটি গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে গত ৩ জানুয়ারি তাদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তারা আরো কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ মে সিলেটের গোটাটিকরে অবস্থিত একটি বাড়িতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় মাওলানা আবু বকরের সভাপতিত্বে।
ওই বৈঠকেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সশস্ত্র জিহাদের পক্ষে মতৈক্যে পেঁৗছায়।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সশস্ত্র জিহাদের পক্ষে হরকাতুল জিহাদ দেশের এক হাজার মুফতির স্বাক্ষরসংবলিত একটি ফতোয়াও প্রকাশ করবে। এ ছাড়া তালেবানপ্রধান মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের স্বাক্ষরসংবলিত বাংলাদেশে জিহাদ শুরুর অনুমতি শীর্ষক একটি প্রচারপত্রও তারা প্রকাশ করবে। এরই মধ্যে মোল্লা ওমরের অনুমতি সংগ্রহ করা হয়েছে।
জানা গেছে, হরকাতুল জিহাদের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে।
তারা জিহাদ শুরুর আগে বাংলাদেশে আসবে। ওই তিন সদস্যের প্যানেল নেতৃত্বেই বাংলাদেশে জিহাদ শুরুর পরিকল্পনা করছে হরকাতুল জিহাদ।
জানা গেছে, বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের প্রশ্নেই মূলত তিন গ্রুপে বিভক্ত হয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী। মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বাধীন হরকাতুল মুজাহিদীন, মুফতি আবদুর রউফের নেতৃত্বাধীন তামির-উদ-দীন শুরু থেকেই সশস্ত্র জিহাদের চিন্তা লালন করে আসছে। তবে মূলধারা বলে পরিচিত মুফতি আবদুস সালামের নেতৃত্বাধীন হরকাতুল জিহাদ সশস্ত্র জিহাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
তারা এমনকি সংগঠনের নাম পাল্টে প্রথমে ইসলামী দাওয়াতি কাফেলা, পরে সচেতন ইসলামী জনতা, এরপর ইসলামী গণআন্দোলন, সর্বশেষ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) নামে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করে। নির্বাচন কমিশনে আইডিপি নামে তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদনও করে। ২০০৬ সালের ১৮ আগস্ট সচেতন ইসলামী জনতার ব্যানারে তারা রাজধানীর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে প্রকাশ্যে মিছিল ও সমাবেশ করে।
জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এটি মূলত আফগান যুদ্ধফেরত মুজাহিদদের নিয়ে গড়ে ওঠা পাকিস্তানভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন।
এ সংগঠনের মূল নেতা আফগান মুজাহিদদের অন্যতম কমান্ডার পাকিস্তানি নাগরিক সাইফুল্লাহ আখার। তখন হরকাতুল জিহাদের নেতৃত্বে ছিলেন যশোরের মনিরামপুরের কমান্ডার মুফতি আবদুর রহমান ফারুকী। আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি তরুণদের তিনি ছিলেন স্বপ্নপুরুষ। সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৮৯ সালের ১১ মে ফারুকী আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন আফগান যোদ্ধা ভৈরবের মুফতি শফিকুর রহমান।
প্রায় ছয় বছর গোপনে সংগঠিত হলেও হরকাতুল জিহাদ জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্দপ্রকাশ করে ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম দিকে কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে সদস্য সংগ্রহ করে আফগান যুদ্ধে পাঠানোই ছিল এ সংগঠনের মূল কাজ। আফগান যুদ্ধ শেষে হরকাতুল জিহাদ মিয়ানমারে লোক পাঠানো শুরু করে। এ সময় কক্সবাজার ও বান্দরবানের গহিন অরণ্যে রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে হরকাতুল জিহাদের সদস্যদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। দেশের বিভিন্ন জেলার মাদ্রাসা থেকে সদস্য এনে জঙ্গিদের দিয়ে এ অঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি উখিয়ায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় তাদের ৪১ সদস্য সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিল।
হরকাতুল জিহাদ সূত্রে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে আত্দপ্রকাশের পর তারা প্রথমে বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের টার্গেট নিয়ে কাজ শুরু করে। এ লক্ষ্যে তারা দেশের বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে বাছাই করা তরুণদের কক্সবাজার ও বান্দরবানের গহিন অরণ্যে নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এভাবে তারা প্রায় পাঁচ হাজার কর্মীকে আফগান স্টাইলে প্রশিক্ষণ দেয়। এসব কর্মী প্রচলিত গণতান্ত্রিক ধারার ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীদের জঙ্গি কার্যক্রমে ভেড়াতে চেষ্টা করে।
এ নিয়ে ইসলামী দলগুলোর বিভিন্ন নেতা-কর্মীর সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে হাতাহাতি মারামারির ঘটনা ছিল অনেকটাই নৈমিত্তিক বিষয়। এমনকি ইসলামী দলগুলোর বিভিন্ন নেতাকে তারা হত্যার হুমকিও দিয়েছে বহুবার।
কবি শামসুর রাহমানকে হত্যাচেষ্টার পর কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় নাম যুক্ত হয়ে গেলে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়ে হরকাতুল জিহাদ। একপর্যায়ে তারা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সাংগঠনিক সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুর রউফ ও মুফতি আবদুল হাইসহ অনেকেই ধরা পড়ে।
তখন তাদের সাংগঠনিক মুখপত্র মাসিক জাগো মুজাহিদ পত্রিকাটির প্রকাশনাও সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে জাগো মুজাহিদ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও একই কর্মী বাহিনী নিয়ে এবং চিন্তাধারা এমনকি আকৃতি সব কিছু ঠিক রেখে 'মাসিক রহমত' নামে জাগো মুজাহিদই এখনো বের হচ্ছে মাওলানা মনযূর আহমাদের সম্পাদনায়।
জানা গেছে, এ সময় হরকাতুল জিহাদের নেতারা বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের চিন্তা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে তাদের মজলিশে আমেলার (নির্বাহী কমিটি) কয়েক দফা বৈঠকও হয়। তাতে বড় একটি অংশ বাধা দেয়।
এ অংশটি সশস্ত্র জিহাদের পক্ষে কাজ করতে নেতাদের চাপ দিতে থাকে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হলে ১৯৯৬ সালে প্রথম হরকাতুল জিহাদে ভাঙন ধরে। সে সময় মুফতি আবদুল হান্নান তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হরকাতুল জিহাদের নেতৃত্বের সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাল্টা কমিটি গঠন করেন। সশস্ত্র পদ্ধতিতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েই তিনি সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। হরকাতুল জিহাদের একটি অংশও তাঁর নেতৃত্বে যোগ দেয়।
জানা গেছে, মুফতি হান্নান হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করার পর পাকিস্তানের আরেকটি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের নেতা মাওলানা ফজলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে হান্নানের। পাকিস্তানে এ সংগঠনটি হরকাতুল জিহাদকে চ্যালেঞ্জ করে গঠিত হয়েছিল বলে হরকতের কর্মীরা হরকাতুল মুজাহিদীনকে ভালো চোখে দেখে না। এ কারণে মুফতি হান্নান কাগজে-কলমে হরকাতুল মুজাহিদীনের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তিনি মাঠপর্যায়ে হরকাতুল জিহাদের নামেই কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে মাওলানা আবু জাফর, মাওলানা মনির ওরফে মদিনা হুজুরও সংগঠনের নীতিনির্ধারণী কমিটিতে স্থান পান। ২০০৫ সালের অক্টোবরে র্যাবের হাতে মুফতি হান্নান ধরা পড়েন।
হরকাতুল জিহাদে দ্বিতীয় দফা ভাঙন ধরে ১৯৯৮ সালে। মূল নেতারা সশস্ত্র জিহাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় চিফ কমান্ডার মুফতি আবদুর রউফও নেতাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়েও একে অন্যকে দোষারোপ করলে একপর্যায়ে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে মুফতি আবদুর রউফকে হরকাতুল জিহাদ থেকে বহিষ্কার করার দাবি করেন হরকাতুল জিহাদ নেতারা। তবে আবদুর রউফের অনুসারীরা দাবি করছেন, তাঁরা নিজেরাই বেরিয়ে গিয়ে পৃথক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এ সময় তাঁরা আবদুর রউফের নেতৃত্বে তামির-উদ-দীন নামে নতুন জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলেন।
তিনি হরকাতুল জিহাদের চিফ কমান্ডার থাকায় সংগঠনের বড় একটি অংশ তাঁর নেতৃত্বে যোগ দেয়। অল্প দিনেই দেশের ৩৪ জেলাজুড়ে গড়ে ওঠে এই সংগঠনের নেটওয়ার্ক। তারা সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করতে ২০০১ সালে মাসিক আত তাহরীয নামে একটি ম্যাগাজিনের প্রকাশনাও শুরু করে। ডিক্লারেশনবিহীন এ পত্রিকাটি প্রায় ছয় মাস বের হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় কার্যালয় হিসেবে সাভারের একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হতো।
সম্পাদক ছিলেন মাওলানা আবদুল হালিম হুসাইনী। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ির জীবনতলা হাফিজিয়া নুরানী কওমি মাদ্রাসা থেকে র্যাব ২০০৬ সালের ২ আগস্ট মুফতি আবদুর রউফ ও তাঁর ২৬ সঙ্গীকে আটক করে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বললে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর মজলিশে আমেলার (নির্বাহী কমিটি) অন্যতম এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের সশস্ত্র জিহাদের অভিজ্ঞতা আছে। আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম জীবিত ফিরে আসার জন্য নয়। এখন বেঁচে থাকাটাই আমাদের বোনাস।
আমরা স্বাভাবিক ধারায় প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চেয়েছিলাম। গত জোট সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমনকি বর্তমান মহাজোট সরকার কেউই আমাদের সেই সুযোগ দেয়নি। বাধ্য হয়েই আমরা সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছি। '
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'জিহাদে আমাদের টার্গেট সাধারণ মানুষ নয়। আমরা চাই না সাধারণ একজন মানুষের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হোক।
এর পরও জিহাদ শুরু হলে কিছু ক্ষতি হবেই। আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারব কি না, জানি না। চেষ্টা করব। সাফল্য দেবেন আল্লাহ। ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে না হয় ৯ বছর জিহাদ করতে হবে। আফগানিস্তানে তালেবান তো এখনো জিহাদ করছে। আমাদের ধমনীতে সেই তালেবানি রক্তই। ' (কালের কণ্ঠ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।