আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি।
যে জাতি কঠিন সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মুখোমুখি হয় সেই জাতির পক্ষে তার সম্ভ্রম ও স্বাধীনতা রক্ষার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সন্তান-সন্ততিকে সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীর ওপর বহুবিধ গুরুভার অর্পিত হয়। অন্য কথায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নারীর জন্যও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
তবে তাঁদেরকে সে দায়িত্ব পালন করতে হয় কখনো সরাসরিভাবে সামনা-সামনি দুশমনের মোকাবিলা করে, আবার কখনও পরোক্ষভাবে, যুদ্ধক্ষেত্রের পেছনে থেকে যুদ্ধে সহায়ক কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে অথবা যুদ্ধকালীন নগরীর ভেতরের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে।
বাগদাদের সামরিক জান্তার তরফ হতে ইসলামি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ইরানের ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে ইরানের মহিলাদের যোগদান করাকে কেন্দ্র করেই এই আলোচনার সূত্রপাত। আমরা এ সম্পর্কে তিনটি বৃত্তের পর্যালোচনার মাধ্যমে আলোকপাত করব।
প্রথম বৃত্ত : আদর্শগত দিক
যোদ্ধা সেজে অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দুশমনের মোকাবিলা করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়াজিব কি না?
যুদ্ধের প্রকারভেদে এই প্রশ্নের উত্তরও বিভিন্ন ধরনের হবে। আক্রমণাত্মক যুদ্ধ হলে তাতে যোগদান করা নারীর ওপর ওয়াজিব হবে না। আর যুদ্ধ যদি আত্মরক্ষামূলক হয়, মুসলিম দেশকে আগ্রাসনকারী দুশমনের হাত হতে রক্ষা করার জন্য হয়, মুসলমানদের জান, মাল ও ইজ্জত-আবরুর ওপর চড়াওকারী শত্রুকে হটাবার জন্য হয় তখন নারী-পুরুষ সকল সক্ষম মুসলমানের ওপর আগ্রাসনের মোকাবিলা করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত বলা যায় যে, যুদ্ধে নারীর যোগদান ওয়াজিব না হলেও এর অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধের সহায়ক কাজ করা বা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করার কাজে নারীর অংশগ্রহণের অধিকার থাকবে না। বরং এরূপ যাবতীয় কাজ সমাধা করার অবকাশ নারীর রয়েছে। এখানে নারীর দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উঠে না।
এতে বোঝা যাচ্ছে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে নারীর দায়িত্ব পালনের বিষয়টি যুদ্ধের প্রকারভেদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যুদ্ধ যদি আত্মরক্ষামূলক হয় তবে তাতে নারীর অংশগ্রহণকে ইসলাম ওয়াজিব বলে সমর্থন করে।
আর আক্রমণাত্মক হলে তা সমর্থন করে না। প্রশ্ন ওঠে, কেন এ পার্থক্য করা হয়। এখানে এরূপ বিধান প্রবর্তনের দর্শন ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। এর দার্শনিক দিক ফিকাহের গ্রন্থাদিতে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয় বৃত্ত : বিপ্লবে ইরানি নারীর ভূমিকা
বিপ্লব সাধনে ইরানি মহিলাদের যোগদান নারীর ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিকোণ উপলব্ধি করার জন্য অতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে পরিগণিত হয়।
বস্তুত বিপ্লবে ইরানি নারীর ভূমিকা ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সংমিশ্রণ। ইরানের বিপ্লবে নারীদেরকে নানা ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এক্ষেত্রে যেসব বাস্তব তথ্য পাওয়া যায় তার সাথে পরিচয় ঘটলে যুদ্ধে ইরানি নারীর ভূমিকা বুঝতে সহজ হবে। আমরা এ বিষয়ে তিনটি মৌলিক শিরোনামের মাধ্যমে আলোকপাত করব।
বিপ্লবে মায়েদের ভূমিকা
প্রকৃতপক্ষে মায়েরা বিপ্লব সাধনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
মায়েরা মিছিলে যোগদান করেছেন, আন্দোলনের নির্দেশাবলি কার্যকর করেছেন এবং স্বৈরশাসনের মোকাবিলার জন্য নিত্য নতুন পন্থা খুঁজে বের করেছেন। সর্বোপরি, তাঁরা তাঁদের সন্তান ও স্বামীদেরকে স্বৈরশাসনের মোকাবিলা করার জন্য রাজপথে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অথচ তাঁরা অবগত ছিলেন যে, এর ফলে তাঁদের সন্তান ও স্বামীরা রাজপথে মারা যেতে পারেন। পরিণামে তাঁদেরকে দুঃখ-কষ্ট পোহাতে হবে। কিন্তু তাঁরা এসব জেনেও বিপ্লব সাধনে নিজেদের ইসলামি দায়িত্ব পালনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েও তা করেছেন।
স্বামী ও সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া তো দূরের কথা তাঁদের সামান্য কষ্টও যাঁদের কাম্য নয় তাঁরাই যখন এতবড় আত্মত্যাগে এগিয়ে আসেন তখন তার মূল্যায়ন করা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়।
আমরা জানি যে, শাহ সরকারের আমলে কেবল জীবনের বিনিময়েই অসত্যের মোকাবিলা করতে হতো। তবুও মায়েরা তাঁদের ছেলেদেরকে নেতার নির্দেশ পালনের জন্য বিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁরা নিজেরা মিছিলের অগ্রভাগে থেকেও সন্তানদেরকে উৎসাহিত করতেন।
এ থেকেই ইরানের সমাজ ও রাজনীতিসচেতন মায়েদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে এবং তাঁরা জাতীয় সমস্যাবলির সমাধানের পথ নিজেরাই খুঁজে নিতে পারেন।
প্রশ্ন ওঠে এমনটি হলো কী করে?
এর কারণ ছিল, মায়েরা ন্যায় কাজে নির্দেশ দান এবং অন্যায় কাজে বাধাদান করার নির্দেশপ্রাপ্ত ছিলেন। এর ফলে বিপ্লবের নেতাদের শরীয়তসম্মত নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তাঁরা মোকাবিলা করেছেন তাগুতী শাসনব্যবস্থার। আর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে যোগদান করেছেন সমাজের অন্যান্য শ্রেণির সাথে।
এমনি করে ইরানের হাজার হাজার মা সংগ্রাম করতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। তাঁদের স্লোগান ছিল : ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহর পথে প্রাণপাত করাতেই আমাদের গৌরব।
’
বিপ্লব সাধনে স্ত্রীদের ভূমিকা
বিপ্লবে স্ত্রীর ভূমিকা হলো তাঁরা এলাহী মূল্যবোধ এবং বিপ্লবী নেতৃত্বের নির্দেশ পালনকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। দাম্পত্য সম্পর্ক সেখানে প্রাধান্য পায়নি। বিপ্লবে স্বামী-স্ত্রী একযোগে অংশ নিয়েছেন।
কোনো স্ত্রীরই একথা অজানা ছিল না যে, বিপ্লবে তাঁর স্বামীর অংশগ্রহণের ফলে তাঁকে বৈধব্যবরণ করে নিতে হতে পারে। কিন্তু সে আশঙ্কা তাঁকে কিছুমাত্র হতোদ্যম করতে পারেনি।
প্রত্যেক স্ত্রীই তাঁর খোদায়ী মূল্যবোধে সুদৃঢ় ছিলেন, স্বামী দায়িত্ব পালনে তৎপর ছিলেন। তাই তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে তাঁর স্বামীকে বৈপ্লবিক কাজে যোগদান করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আর স্বামী যখন দেখতে পান যে, তাঁর স্ত্রী শুধু তাঁকেই বিপ্লবে ঠেলে দিচ্ছেন না; বরং নিজেও বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন তখন তাঁর আর সময় নষ্ট করার অবকাশ কোথায়?
বিপ্লবে যুবতী মেয়েদের ভূমিকা
অনুরূপভাবে ইরানের যুবতী মেয়েরাও বিপ্লবকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বাস্তবে আমরা এমন কোনো মিছিলই দেখতে পাইনি যেখানে জনতা ও শাহের বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে, অথচ সে মিছিলে ইরানি যুবতীদের অংশ ছিল না।
ইরানি বিপ্লবে যুবতীদের যোগদানের হেতু হলো, তারা তাগুতের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাদের ইসলামি দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল।
বস্তুত এ দায়িত্ব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ওপর সমানভাবে বর্তায়। নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) এবং হযরত ফাতিমার কন্যা হযরত যাইনাব (সা. আ.)-এর আদর্শও ইরানি যুবতীদেরকে বিপ্লবে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তৃতীয় বৃত্ত : যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ
আমরা এখন যুদ্ধে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে আলোপাত করব। প্রথমত আত্মরক্ষার যুদ্ধে যোগদান করা ফরয-ই-কিফায়াহ১। যুদ্ধ দু প্রকার : আক্রমণাত্মক এবং আত্মরক্ষামূলক।
শেষোক্ত যুদ্ধে যোগদান করা সকল সমর্থ নরী-পুরুষের কর্তব্য। এ কর্তব্য পালন করা ফরয-ই-ফিকায়াহ। অর্থাৎ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে যোগদান করা পুরুষদের ন্যায় মহিলাদের ওপরও শরীয়ত মতে ফরয। তবে তা ফরয-ই-কিফায়াহ। কারণ, সমাজের কিছুসংখ্যক যুবক প্রতিরক্ষার কাজে বাথপন্থী দুশমনদের মোকাবিলার জন্য যখন যুদ্ধের ময়দানে যাবে তখন সরাসরি যুদ্ধে যোগদান করার জন্য অন্যদের স্ব স্ব কাজ থেকে অবসর নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
এর অর্থ হলো যুদ্ধ চলাকালে সকল পুরুষের ওপরে যুদ্ধে যোগদান করা ওয়াজিব নয়। আর মেয়েরা ভিতরের কাজের ময়দানে থেকে যাবেন। তাঁরা সামাজিক জীবনের দায়িত্ব পালন করবেন। আর সমাজের পুরুষদের এক বিরাট অংশ যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে থেকে উৎপাদনের কাজে ব্যস্ত থাকবে। বলা বাহুল্য, যুদ্ধের হাল-হকিকত ও পরিস্থিতি দ্বারা ভেতরের কাজকর্মও প্রভাবান্বিত হয়ে থাকে।
কিন্তু যেসব পুরুষ যুদ্ধের ময়দানের বাইরে কাজ করে যাচ্ছে এবং যাদের এখনও যুদ্ধে যোগদানের প্রয়োজন দেখা দেয়নি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার একটা দিক রয়েছে। তারা অস্ত্রধারণের যোগ্যতা রাখে। তাদের সবার জন্যই যুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। যাতে তারাও আল্লাহর নামে যুদ্ধে যোগদান করার অংশ পেতে পারে আর শাহাদত বরণ করে কামিয়াব হতে পারে।
দ্বিতীয়ত : যুদ্ধের সময় যুদ্ধের ময়দানের পেছনে থেকে যোদ্ধাদের সাহায্যার্থেও অনেক কাজ করতে হয়।
তাদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা, বস্ত্রাদি তৈরি করা ইত্যাদি কাজের কথা বলা যেতে পারে। এসব কাজ ইরানি নারীরা সুন্দরভাবে সমাধা করতে পারেন। আর এ কাজে ইরানি মেয়েদের চমৎকার দক্ষতা আমরা দেখেছি।
তৃতীয়ত : যুদ্ধাহত সৈনিকদের সেবার কাজে ইরানি নারীদের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। তাঁরা এক্ষেত্রে অসাধারণ আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
আমরা বিপ্লবের সেনানীদের মাঝে (পাসদারান) এরূপ বহু যুবতীকে দেখেছি যারা এই কঠিন কাজে পুরুষের চাইতে অধিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। এসব মহিলা মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এখানে বিশষভাবে উল্লেখ করা যায় যে, সেবা-শুশ্রুষার কাজে যোগদান করা ইরানি মহিলাদের ঐচ্ছিক ব্যাপার। এ কাজের জন্য তাঁদেরকে বাধ্য করা হয় না। পক্ষান্তরে বাগদাদ জান্তা আইন করে এক বছরের জন্য সেবা-শুশ্রুষার কাজে যোগদান করাকে মহিলা চিকিৎসক বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর বাধ্যতামূলক করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে যোগদান করার পূর্বে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়।
চতুর্থত : মেয়েরা যুদ্ধের প্রয়োজনে সকল প্রকার সাহায্য সংগ্রহের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এতে সরকারের গুরুভার লাঘব হয়।
বস্তুতপক্ষে মেয়েদের এই তৎপরতা যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনে জাতিকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে। যোদ্ধাদের সার্বিক কল্যাণে তাঁদের অবদান অপরিসীম।
যুদ্ধের পাঁচটি বছর চলছে। সরকার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাইরে থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য ঋণ গ্রহণ করেনি। পক্ষান্তরে ইরাকের সরকার ঋণের বোঝার চাপে জর্জরিত। তারা এখন সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যের ওপর টিকে আছে। সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্য দু সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে ইরাকি সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে।
যুদ্ধের অর্থ যোগানদানের ব্যাপারে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধানে ইরান সরকারের নীতি হলো জাতির ওপর আস্থা রাখা। আর এ বিষয়ে বিপ্লব উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। সরকারের এ নীতির প্রতি জনগণেরও সমর্থন রয়েছে। তারা যুদ্ধের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে।
আমরা এ পরিপ্রেক্ষিতে মহিলাদের সাহায্যের মূল্যায়ন করতে পারি।
বিশেষ করে, তাঁরা যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্বেচ্ছায় তাঁদের স্বর্ণালংকার দান করে দিচ্ছেন। তাঁদের এই সাহায্যকে কোনো ক্রমেই জবরদস্তিমূলক বলা যাবে না।
প্রসঙ্গত বলা যায় যে, শুধু অলংকার দান করেই মহিলারা ক্ষান্ত হননি। তাঁরা সম্ভাব্য সব উপায়ে যোদ্ধাদের সেবা করেছেন। তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য, কাপড়-চোপড় এবং তৈজসদ্রব্যাদি সংগ্রহ করেছেন।
পঞ্চমত : যোদ্ধা সেজে জিহাদের ময়দানে কাতারবন্দি হয়ে লড়াই করার জন্য তাঁরা তাঁদের সন্তান ও স্বামীদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। স্বামী হারালে বা সন্তানের শাহাদাত বরণে যে দায়িত্ব তাঁদের ওপর বর্তাবে তাঁরা তা পালন করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। আমরা এখানে এসে ইরানি নারীদের এক্ষেত্রে উৎসাহ ও উদ্দীপনার এমন ভূমিকা দেখতে পাই যার ধারণা করাও আমাদের পক্ষে দুরূহ ছিল। মহিলাদের এ ত্যাগের বর্ণনা করতে গিয়ে লেখনী হার মানে। বিপ্লবের বিপক্ষে সাম্রাজ্যবাদীদের যাবতীয় ভয়ভীতি ও চোখ রাঙানিকে তাঁরা উপেক্ষা করেছেন।
স্বামী-পুত্র হারিয়ে তাঁরা শোক প্রকাশ করেননি; বরং তাঁরা লাভবান হয়েছেন বলে ধারণা পোষণ করেছেন। ইসলামি ব্যবস্থার প্রতি কোনোরূপ অসন্তোষ তাঁরা রাখেননি। কারণ, ইসলামি হুকুমত আত্মরক্ষার্থে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের ক্ষোভ-অসন্তোষ সবকিছুই বাগদাদের যুদ্ধবাজ সরদারদের ওপর। স্বামী বা সন্তানের শাহাদাত বরণ করার দরুন ইরানি মহিলারা নিজেদেরকে গৌরবান্বিত বলে মনে করেন।
কারণ, তাঁরা মনে করেন যে, বিপ্লবের হাদিয়াস্বরূপ তাঁরা তাঁদের সন্তানদের রক্ত পেশ করতে পেরেছেন। আর তাঁরা ঠেলে দিতে পেরেছেন নিজেদের স্বামীদেরকে সংঘর্ষের ময়দানের দিকে।
পক্ষান্তরে বাগদাদ প্রশাসন এসব বিষয়ে জাহেলি দর্শন অবলম্বন করে সমাধান বের করে থাকে। তারা স্বৈরাচার দ্বারা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যুদ্ধে যোগদান করাকে দেশবাসীর ওপরে বাধ্যতামূলক করেছে।
তাদের কোনো যোদ্ধা নিহত হলে তার স্ত্রী-পুত্ররা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না।
ষষ্ঠত : যুদ্ধে শহীদ পরিবারের দুঃখ-কষ্টে অন্যান্য মহিলাদের একাত্মতা প্রদর্শন।
মহল্লা এবং শহরের মেয়েরা শহীদদের মা-বোন ও ছেলে-মেয়েদের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখেন। তাঁরা মনে করেন যে, তাঁদের (শহীদ পরিবারের) দুঃখ মূলত তাঁদেরই দুঃখ। তাঁরা শহীদ পরিবারকে শহীদ ব্যক্তির বিরহ-যাতনা সহ্য করার জন্য একা ছেড়ে দেন না; বরং এলাকার মহিলারা এসে শহীদ পরিবারের সঙ্গে যোগ দেন।
এইভাবে শহীদ পরিবারের যাতনাবোধকে তাঁরা লাঘব করে দেন। শহীদ পরিবারের সঙ্গে তাঁদের এই একাত্মতা সাময়িক নয়। তাঁরা শহীদদের সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক শোকসভায় যোগদান করে থাকেন। এমনি করে তাঁরা শহীদদের শোকসভায়ও সম্মিলিতভাবে যোগদান করেন। ফলে শহীদ পরিবারগুলোর অন্তরে শান্তি আসে, তাঁরা সান্ত্বনা লাভ করেন।
যদি জানা যায় যে, সরকার অথবা স্বয়ং ইমাম শহীদ পরিবারের জন্য কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন তাহলে শহীদ পরিবারের দুঃখ-শোক লাঘব না হয়ে পারে না। যে পরিবার ঈমানে দঢ়, যাঁরা দায়িত্ব চেতনায় সজীব, তাঁরা জানেন যে, তাঁদের সন্তান ও শহীদ পরিবারের শহীদ পিতা ক্ষতির চেয়ে লাভবান হয়েছেন অধিক। কারণ, তিনি বেহেশত লাভ করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন। যাবতীয় কল্যাণ লাভে কৃতার্থ হয়েছেন।
তাঁরা হাল যামানার তাগুতদের মোকাবিলায় এবং মন্দকর্মে নির্দেশদাতা প্রবৃত্তির (নাফসের) মোকাবিলায় সময় অতিবাহিত করার বদলে অনন্ত রিযিক লাভের সুযোগ পেয়েছেন।
অনুরূপভাবে সকলে মিলে শহীদানের কবর জিয়ারতের জন্য পালাক্রমে গমন করা, বিশেষত, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও জাতীয় দিবসগুলোতে তাঁদের সমাধি প্রান্তে উপস্থিত হয়ে তাঁদের কবর যিয়ারত করা ইরানি মহিলাদের এক নৈমিত্তিক ব্যাপার। ইসলামের অগ্রগতিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য শহীদরা যে ভূমিকা পালন করেছেন তার স্বীকৃতিদানের জন্য তাঁরা এইরূপ সমাবেশে মিলিত হন। এর দ্বারা শহীদের মা, স্ত্রী এবং মেয়েরা উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাঁদের শহীদ জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছেন। তাঁরা অনুভব করেন যে, শহীদের জন্য যাতনা পোহাতে তাঁরা একা নন।
এলাকার সকল মহিলা, ইরানের সকল নারী এবং বলা যায়, জগতের নারীকুল তাঁদের শহীদদের শোকে শোকাতুর। কারণ, শহীদ ব্যক্তি জগতে সকল নারীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রাণ দিয়েছেন।
কাজেই সকল নারীরই শহীদদের জন্য শোক প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে রক্তের বন্ধন বা আত্মীয়তার বন্ধন গৌণ ব্যাপার। আর আমরা যে শোক প্রকাশ করে থাকি তা দুঃখ ও ক্ষোভে ডুবে থাকা নয়, তা হচ্ছে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য দুঃখ বরণ করা।
তা হচ্ছে ইসলামের জন্য যাতনা ভোগ করা।
এসব মূল্যবোধ কল্পনাপ্রসূত নয়। এসব হচ্ছে বাস্তব। যার দিকে কুরআন আহ্বান জানিয়েছে। আর আমরা এর বাস্তবতাকে ইরানের বিপ্লবের মধ্যে অবলোকন করেছি।
ইরানি নারীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে আহতদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে গমন করেন এবং আহতদের ভালোমন্দ জানার প্রয়াস পান। তাঁরা আহতদের জন্য বহুবিধ উপঢৌকন নিয়ে যান। তাঁরা তাঁদের আশু রোগমুক্তি কামনা করে আহতদের আশ্বস্ত করেন।
সপ্তমত : যুদ্ধের ব্যাপারে মেয়েদের রাজনৈতিক ভূমিকা পালন। ইসলামি দৃষ্টিকোণে মেয়েদের ওপর সামাজিক ও রাজনৈতিক বহুবিধ দায়িত্ব বর্তায়।
এ দায়িত্ব পুরুষদের দায়িত্বের ন্যায়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। ইসলামি আইন তা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছে। সেসব ক্ষেত্রকে ইসলাম পুরুষদের জন্য খাস করে দিয়েছে। যেমন রাষ্ট্রপতি হওয়া বা বিচারপতি হওয়া ইসলামি আইন অথবা দেশের সংবিধান কেবল পুরুষদের জন্যই নির্ধারিত করেছে।
অবশ্য যুদ্ধ পরিচালনার সাংবিধানিক ভূমিকা পালন করেন নেতৃবর্গ। কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, তার দায়িত্ব বহন করা জাতির স্কন্ধে অর্পিত। আর ওই জাতির মাঝে মেয়েরাও শামিল। এখানে আমরা বলতে পারি যে, যুদ্ধ সম্পর্কে জাতির সিদ্ধান্ত নেতৃবর্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরাট প্রভাব ফেলে। বস্তুত ইসলামের ন্যায়-নীতিও তা সমর্থন করে।
একথা ঠিক যে, যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। যুদ্ধ বিরতির ঘোষণাও তাঁকেই দিতে হয়। তবে কোনো কোনো সময় সেনাপতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পটভূমি সৃষ্টি করে জাতি।
আমরা যে কথাটি বলতে চাই তা হলো যুদ্ধ সম্পর্কে জাতির রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে, তার রূপরেখা অংকনে মেয়েরা বিশেষভাবে জড়িত। কারণ, তাঁরা জাতির অর্ধেক।
সমাজের লোকদের সাথে মেয়েদের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। সমাজে ভালো-মন্দের প্রভাব তাঁদের ওপরে পড়ে।
প্রতি বছর রমযানের সর্বশেষ জুমআয় যে বিরাট আকারের মিছিল বের হয় তাতে মহিলাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে পারি। তাঁরা তখন যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে তাঁদের জঙ্গি মনোভাবটিকে ঠেলে নিয়ে যান মহামান্য ইমামের সমীপে।
উপসংহারে যুদ্ধের ব্যাপারে ইরানি নারীর বিশেষ ভূমিকা পালনে যেসব বুনিয়াদি চিন্তাধারা কাজ করছে তা আমরা নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই :
১. নারী সমাজের অংশবিশেষ।
ইসলামি দৃষ্টিকোণে নারী সমাজজীবনে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
২. পুরুষদের ওপরে এ বিষয়ে ইসলামের যে রূপ দায়িত্ব রয়েছে, নারীদের ওপরও অনুরূপ দায়িত্ব রয়েছে।
৩. বিজয় কিংবা পরাজয়ের প্রভাব সমানভাবে নারীর ওপর পড়ে।
৪. যুদ্ধের ব্যাপারে পুরুষের দায়িত্ব পালনের পরিপূরক হয় নারীর দায়িত্ব পালন। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমপর্যায়ে এসে যান।
৫. প্রয়োজনবোধে নারী সর্বক্ষণ অস্ত্রধারণ করে থাকবেন- তাঁরা এরূপ যোগ্যতা রাখেন।
আমাদের এই আলোচনায় যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের দার্শনিক দিক তুলে ধরা হয়েছে। মেয়েদের যুদ্ধে যোগদানের বাস্তব নকশা আঁকতে গেলে খ্যাতিমান শিল্পী ও রূপকারগণও হার মানতে বাধ্য হবেন। সর্বদা এরূপই হয়ে থাকে দায়িত্বসচেতন নারীর ভূমিকা।
টীকা
১. যে নির্দেশ সরাসরি ব্যক্তির ওপর বর্তায় তাকে ‘ফরয-ই’ আইন বলে।
যেমন- নামায, রোযা ইত্যাদি। ব্যক্তির প্রতি সমষ্টির সদস্য হিসাবে যে হুকুম হয় তা পালন করা ফরয-ই-কিফায়াহ। অর্থাৎ হুকুমটি সমষ্টির ওপর ছিল। সমষ্টির অংশবিশেষ, অর্ধেক বা তারও কম লোকজন তা পালন করার ক্ষমতা রাখে। এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে শরীয়তের উদ্দেশ্য হাসিল হওয়া।
‘ফরয-ই-কিফায়াহ’-এর কাঠামোতে তা কখনো সমষ্টির দ্বারা আবার কখনো ব্যক্তির দ্বারা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। - দেখুন, আল উসুলুল আমআহ আল-ফিকাহ, পৃ. ৫৯।
২. ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান।
৩. ইসলামি সংবিধান ধারা নং ১১০ পৃ. ৪৯।
প্রবন্ধটি শহীদ পত্রিকার ১০১ সংখ্যা ৯ মহরম ১৪০৬ হিজরিতে ছাপা হয়।
(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৮৬ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।