তখন কতোই বা বয়স? ১২-১৩ হবে কি? ঐ রকমই কিছু একটা। লুকিয়ে লুকিয়ে কেবল বড় ভাই’য়ের কবিতার ডায়েরী ঘাটিয়ে পড়তে শিখেছি। খুব যে বুঝি তাও না, কিন্তু কেনো যেন ডায়েরীর লেখাগুলো খুব মনে ধরে যেত। নিজের কবিতার পাশাপাশি বিভিন্ন কবি’দের কবিতার অংশবিশেষও কবির নামসহ ভাইয়া ডায়েরীতে লিখে রাখতো। পরবর্তীতে সেইসব কবিতাই ভাইয়াকে আবৃত্তি করতে শুনতাম।
এভাবেই পড়তে পড়তে একদিন পড়লাম...
“আমি যার হাতে ফুল তুলে দিই
সে-ই প্রথম ভুল বোঝে আমাকে।
আমি যাকে বিশ্বাসযোগ্য ভেবে
মনে মনে এক নির্জন স্বপ্নকে স্বাস্থ্যবান কোরে তুলি,
আমার বিশ্বাস নিয়ে সুবর্ন চোর
শুধু সে-ই পালিয়ে যায়। “
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
চোখ আটকে গেলো লেখাটায়, কবি’র সম্পর্কে জানার আগ্রহ চাপলো মাথায় কিন্তু ভাইয়াকে প্রচন্ড ভয় পাওয়ার কারনে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে গেলাম জিজ্ঞেস করবো কি করবো না সে নিয়ে। শেষতক অনেক ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। আশ্চর্য হলাম বিন্দুমাত্র রাগ না করে, ধমক না দিয়ে সেদিন অনেকটা সময় ভাইয়া রুদ্রকে নিয়ে কথা বললেন।
জানলাম এক সময়ের বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় গান
“ভালো আছি ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। “
গানটি রুদ্র’র লেখা এবং সুর করা। কতবার শুনেছি, গেয়েছিও অথচ জানতামই না এ গানটির স্রষ্টা কে! আরো অনেক কিছু জানলাম; রুদ্র’র কবিতা, ব্যক্তি জীবনে রুদ্র, আরো অনেক অনেক তথ্য। শুনলাম আরো কিছু কবিতা, উপলব্ধি করলাম তার বলিষ্ঠ আওয়াজ’কে...
“বাতাসে লাশের গন্ধ_
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংশের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।
“
দুঃখ পেলাম জেনে, এতসব সুন্দর-সাহসী কবিতার কবি পৃথিবী ত্যাগ করেছেন খুবই অল্প বয়সে। ব্যক্তি জীবনের হতাশা-ক্রোধ-অভিমান-অবহেলায় কবির জীবন এতোটাই অসহায় ছিলো যে তিনি নিজের যত্নের কথা খেয়াল করেননি কখনোই। দিনের পর দিন অনিয়ম করে গেছেন এবং মদের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে গেছেন, যার ফলে শরীরে বাসা বেধেছিলো নানা রকম অসুখ-বিসুখ। মানসিক-শারীরিক কোনো ভাবেই কবি সুস্থ্য-সুস্থির ছিলেন না, যার কারনে ১৯৯১ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে অকালে প্রাণ হারান তিনি।
ব্যক্তি জীবনে রুদ্র ছিলেন খুবই দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং সকল প্রকার কুসংস্কারমুক্ত; নিজের মনে যখন যা চাইতেন, যতদিন বেঁচে ছিলেন তাই করে গেছেন।
কবিতার প্রতি তিনি ছিলেন অসম্ভব যত্নশীল। প্রেম-স্বপ্ন, বিদ্রোহ-বিক্ষোভ, অভিমান-অস্বীকার সব কিছুর সংমিশ্রনে সর্বদাই প্রজ্জ্বলিত ছিলেন তারুন্যর প্রতীক এই তরুন কবি। নিজের বিশ্বাসের প্রতি ছিলেন প্রচন্ড অটল, কখনোই এক্ষেত্রে আপোষ করেননি কোথাও। নিজের জীবনের নানান ঝামেলার মধ্য থেকেও রুদ্র লিখে গেছেন আপোষহীন দূর্দান্ত সাহসী সব কবিতা। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৫ বছর, কিন্তু এত অল্প সময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দু’হাত ভরে লিখে গেছেন প্রেমের কবিতা, অহিংসার কবিতা, জীবনের কবিতা, প্রকৃতির কবিতা এবং সর্বোপরি মানুষের কবিতা। কবিতা লিখে দাগ রেখে গেছেন অসংখ্য ভক্ত এবং পাঠকের মনে, যারা আজো মনোমুগ্ধ হয়ে রুদ্র’র কবিতা পড়ে এবং ভালোবেসে স্মরন করে।
আজ ২১ শে জুন, ২০১০ প্রিয় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করি তাকে। অনেক অনেক ভালোবাসা জানাই তোমাকে প্রিয় কবি...
“চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভুবনে আছো। ।
“
চ’লে গিয়ে তুমি আরো কাছে রয়েছো, চ’লে গিয়ে তুমি সত্যিই আমাদের সমস্ত ভুবন জুড়ে আছো...!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।