রত্নার প্রথম 'অপরাধ' ছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে দেওয়া স্বর্ণের চেইনটি বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় হারিয়ে ফেলা। দ্বিতীয় 'অপরাধ' যৌতুক না দেওয়া। ফলে শুরু হলো স্বামী, শাশুড়ি ও দেবরের নির্যাতন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। টানা তিন বছর মুখ বুঝে সহ্য করে আসছিলেনও রত্না। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বেকার স্বামী নীহার রঞ্জন ঘোষ ব্যবসার কথা বলে এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করলে রত্না বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ফের শুরু হয় নির্যাতন। এবার আর পারলেন না রত্না। দেড় বছরের ছেলেসহ শ্বশুরবাড়ির সবার সামনেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিলেন। ঘটনাটি গত মঙ্গলবার দুপুরের। বগুড়ার গৃহবধূ রত্না এখন জীবন-মৃৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন।
গতকাল শনিবার বেলা ১২টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, রত্নার মুখমণ্ডলসহ সারা শরীরের বেশির ভাগ অংশ সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। দেখে চেনার উপায় নেই। কথা বলার শক্তিও যেন ফুরিয়ে আসছিল। পোড়া, দগ্ধ শরীর নিয়ে কালের কণ্ঠকে রত্না নিজেই বলছিলেন আত্দহনন চেষ্টার কথা। সন্ধ্যার পর বার্ন ইউনিটের প্রধান ও প্রকল্প পরিচালক ড. সামন্ত লাল সেন বলেন, 'রত্নার শরীরের ৯৫ ভাগই পুড়ে গেছে।
সে আশঙ্কামুক্ত নয়। ' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিটের এক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, রত্নার বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
রত্না রানী দত্ত (৩০) দিনাজপুর আদর্শ কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। বাবার বাড়ি দিনাজপুর সদর উপজেলার রামনগরে এবং স্বামীর বাড়ি বগুড়ার আদমদীঘি থানার সান্তাহার নতুন বাজার গ্রামে। বছর তিনেক আগে নীহারের সঙ্গে রত্নার বিয়ে হয়।
গৃহবধূ রত্নাকে মারাত্দক দগ্ধ অবস্থায় পাঁচ দিন আগে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসে তাঁরই স্বামী নীহার ঘোষ। খবর পেয়ে রত্নার বাবার বাড়ির লোকজন হাসপাতালে এলে নীহার পালিয়ে যায়। অবশ্য তাকে বগুড়ার আদমদীঘি থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
রত্নার শয্যাপাশে উপস্থিত তাঁর মেজ ভাই মানিক দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, সবকিছুর জন্য নীহারই দায়ী। মানিকের অভিযোগ_নীহারই যৌতুকের টাকা না পেয়ে পরিবারের সবার সামনে স্ত্রীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ ঘটনায় রত্নার বড় ভাই স্কুলশিক্ষক হিরণময় দত্ত বগুড়ার আদমদীঘি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় আসামি করা হয় রত্নার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবরসহ আটজনকে। আদমদীঘি থানার ওসি মো. মোজান্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ গতকালই সকালে আদমদীঘি এলাকা থেকে নীহারকে গ্রেপ্তার করে। অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
ওসি আরো বলেন, একটা মেয়ে নির্যাতিত না হওয়া পর্যন্ত কখনোই এ ধরনের পথ বেছে নিতে পারে না।
মেয়েটির বাবা নেই। ভাইয়েরা তাঁকে দেখাশোনা করতেন। তাঁরাই পারিবারিকভাবে বিয়ে দিয়েছেন। রত্নার স্বামী আগে ছিল মুদি দোকানদার। দোকানদারি বাদ দিয়ে একপর্যায়ে বেকার হয়ে গেলে যৌতুক দাবি করে।
ওসি জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, 'যৌতুক দাবি করিয়া হত্যার উদ্দেশ্যে কেরোসিন তেল ঢালিয়া পুড়িয়ে গুরুতর জখম করা হয়েছে। '
রত্নার ভাই মানিক দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিয়ের পর থেকেই নীহার ব্যবসা করার নাম করে এক লাখ টাকা দাবি করে আসছিল। টাকা না দেওয়ায় রত্নাকে বিভিন্ন সময় শারীরিকভাবে নির্যাতন শুরু করে সে ও তার মা-বাবা। এ নির্যাতনের কথা কোনো দিন আমাদের জানাত না।
মুখ বুজে সহ্য করে যেত। ১৫ জুন আবারও যৌতুকের টাকা দাবি করেছিল। দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন রত্নাকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়। '
মানিক দত্ত জানান, অগি্নদগ্ধ রত্নাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়া সদর হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি ঘটলে ওই দিনই গভীর রাতে রত্নাকে তাঁর স্বামী ও পরিবারের লোকজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে।
মানিক বলেন, 'আমাদের আসার খবর পেয়ে রত্নার স্বামী ও তার লোকজন হাসপাতাল থেকে সটকে পড়ে। এরপর থেকে তারা রত্নার আর কোনো খোঁজখবর রাখেনি। '
রত্নার ভাই জানান, পাঁচ বছর আগে বাবা জগদীশ দত্ত মারা যান। তিনি ও তাঁর বড় ভাই পেশায় স্কুলশিক্ষক। মানিক অভিযোগ করেন, এ ঘটনায় মামলা করায় আসামি পক্ষের লোকজন মোবাইল ফোনে তাদের হুমকি দিচ্ছে।
বলছে, মামলা তুলে না নিলে পরিনতি ভালো হবে না।
আমাদের বগুড়া অফিস জানায়, রত্নার বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয় নগদ পৌনে দুই লাখ টাকা ও চার ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার। পরে আরো তিন লাখ টাকা যৌতুক দাবি করা হয়। গত মঙ্গলবার ফের যৌতুক দাবি করে রত্নাকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তাঁর স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি রত্নার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় রত্নার ভাই হিরণময় দত্ত গত শুক্রবার রাতে বাদী হয়ে রত্দার স্বামী নীহার রঞ্জন ঘোষ, শ্বশুর মানিক লাল, শাশুড়ি শেফালী ঘোষ, দেবর লিপু ঘোষ, জা শিপ্রা ঘোষসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদমদীঘি থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলার পর রাতেই পুলিশ নীহারকে গ্রেপ্তার করেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।