ক্লিন'স অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড
বাংলাদেশের প্রথম হিমালয় আরোহী মুসা ইব্রাহিম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, হিমালয় জয় করার চেয়ে বাংলাদেশে কিছু করা কঠিন (প্রথম আলোর উক্তি)। সুতরাং এই বাংলাদেশে যারা বড় কিছু অর্জন করেন তারা হিমালয় জয়ের চেয়ে বড় কিছু করেন নিঃসন্দেহে। এরকমই এক অভাবনীয় অর্জনের ঘোষণা পাওয়া গেলো আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ (১৬.০৬.২০১০) সংসদে ঘোষণা করলেন- পাটের জিনোম রহস্য উদঘাটন করেছে বাংলাদেশ। অনেকেই হয়তো খবরটার গুরুত্ব অনুধাবনে অসমর্থ হবেন- প্রথমত. জিনোম নকশা কী এবং তা উদঘাটন প্রয়োজন কেন তা না বুঝার কারণে, দ্বিতীয়ত. এই আবিষ্কার বাংলাদেশের জন্য কী কী সুবিধা নিশ্চিত করবে সে সম্বন্ধে অনবহিত থাকার কারণে।
দ্বিতীয় বিষয়টি থেকে আলোচনা শুরু করা যাক।
পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাট উৎপাদিত হলেও বাংলাদেশের পাটের গুণগত মান এবং বৈচিত্র বিশ্বব্যাপী বিশেষ কদর পেয়ে আসছে বহুকাল থেকে। আমাদের স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তায় একটা আশার নাম ছিলো সোনালী আঁশ খ্যাত এই পাট। নানা কারণে পাটের সে ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে।
বাংলাদেশ হারাচ্ছিল তার সুনাম এবং আন্তর্জাতিক বাজার। পাট নিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য পাটের প্রকরণ উন্নয়ন, এর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে একটা সম্মানজনক অবস্থানে উপনীত করার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক গবেষণা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। এবার বাংলাদেশের গবেষকরা সেটা করেছেন এবং অর্জন করেছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। এ গবেষণায় প্রতিবেশী দেশ ভারত কিংবা বর্তমান বিজ্ঞান পরাশক্তি চীনকে টপকে সবার আগে পাটের জিনোম তথ্য উদঘাটন করে বাংলাদেশে প্রমাণ করেছে- সবার আগে এগিয়ে যাবার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। প্রয়োজন কেবল সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা আর সঠিক নেতৃত্ব।
পাটের জিনোম রহস্য উদঘাটিত হওয়ায় বাংলাদেশ অনেকভাবে লাভবান হবে। যেমন, বর্তমান বিশ্বে সিনথেটিক তন্তুর তুলনায় প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে পাট সবার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। কিন্তু পাটের তন্তুর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে এই তন্তুর মান উন্নয়ন জরুরী বিষয়। আর এ কাজটি করার সর্বোত্তম এবং দ্রুততম পদ্ধতি হচ্ছে পাটের ডিএনএ নিয়ে কাজ করা এবং ডিএনএকে এমনভাবে পরিমার্জন করা যাতে পাটের তন্তুকে আরো ব্যবহার উপযোগী করা যায়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে পাটের রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো।
পাটের অত্যন্ত সাধারণ শত্রু ছ্ত্রাক এবং অন্যান্য পেকামাকড়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধি জাত উদ্ভাবন পাটের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করবে। আর পরিবেশ বিপর্যয়মুখর আগামী দিনগুলোতে পাটের উৎপাদন অব্যহত রাখতে হলে প্রতিকুল পরিবেশ সহনশীল পাটের প্রকরণ উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরী। এসকল বিষয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে পাটের জিনোম সিকুয়েন্স।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পাটের ওষধি ব্যবহার এবং পাটের ওষধিগুণ সম্পন্ন জিন চিহ্নিত করে এগুলোর মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ। পাটের মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান আছে এটা অনেককাল থেকেই জানে মানুষ।
কিন্তু ঠিক কী উপাদান এবং কীভাবে এ উপাদান তৈরী হচ্ছে তা অজানা। জিনোম সিকুয়েন্স এ সম্বন্ধে মৌলিক ধারণা দেবে। এবং এ উপাদানগুলোকে কীভাবে আরো কার্যক্ষম করা যায় কিংবা সংশ্লেষণ করা যায় তা জানা যাবে।
সুতরাং আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশকে আবরো পাট শিল্পে, বাণিজ্যে এবং ব্যবহারে বিশ্বের শীর্ষস্থানে আসীন করতে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে পাটের জিনোম সিকুয়েন্স।
এবার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আসি।
উপর্যুক্ত আলোচনায় যারা জিনোম, জিন এবং ডিএনএর বিষয়টা বুঝতে পারেন নি তাদের জন্য এই তথ্য।
পৃথিবীতে এক এক ধরনের জীব একেক রকম। জীবের এই স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে মূল ভূমিকা পালন করে যে অণু তার নাম ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড)। ডিএনএ থাকে কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াসে। এক একটি ডিএনএ একেকটি ক্রোমোজম আকারে অবস্থান করে।
বেশীরভাগ উন্নত জীবে প্রতিটি ক্রোমোজমের দুটো করে কপি থাকে। একটি জীবে আলাদা আলাদা যত রকম ক্রোমোজম রয়েছে তাদের ডিএনএ সমগ্র নিয়ে গড়ে ওঠে ওই জীবের জিনোম। অর্থাৎ জিনোম বলতে একটি জীবের অনন্য ক্রোমোজমে অবস্থিত সমগ্র ডিএনএকে বোঝায়। যেমন, মানুষে মোট ২৪ টি অনন্য ক্রোমোজম আছে। সুতরাং মানুষের জিনোম গড়ে উঠেছে ২৪ টি অনন্য ক্রোমোজমে অবস্থিত ডিএনএ নিয়ে।
অপরদিকে জিন বলতে বুঝায় ডিএনএর সেই সব অংশকে যারা জীবের জন্য কোন নির্দিষ্ট কোন কাজ করে।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত বুঝা যায়, একটি জীবের জিনোম তথ্য জানা গেলে তার সম্পূর্ণ ডিএনএ সিকুয়েন্স জানা হয়ে যায়। তখন জিনগুলো খুজে নিয়ে তাদের বৈশিষ্ট্যায়ন সহজ হ । এ কারণেই যেকোন জীবের জীবন রহস্য জানা এবং তার উন্নয়ন ও ব্যবহার বাড়ানোর জন্য জিনোম সিকুয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ পাটের এই জিনোম তথ্য উদঘাটন করলো।
কেন এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তার জবাব আগেই দেয়া হয়েছে। এই অর্জন বাংলাদেশকে বিজ্ঞান জগতে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। এখন থেকে বিশ্বের যে কেউ পাট নিয়ে কাজ করতে গেলে বাংলাদেশের এই জিনোম তথ্য কাজে লাগাবে। ফলে বাংলাদেশ এক অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত হবে তাদের কাছে।
যাদের নেতৃত্বে এ অসাধারণ অর্জন সম্ভব হলো তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন ড. মাকুসুদুল আলম (অধ্যাপক, হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র), ড. হাসিনা খান (অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন এবং অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং মি. মাহবুব জামান (পরিচালক, ডেটাসফট)।
গবেষণা কাজে মূল ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক গ্রাজুয়েটবৃন্দ, বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিউট এবং ডেটাসফট এর গবেষকবৃন্দ। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত হয় গবেষণাটি।
এ সম্বন্ধে আরো জানুন এখানে-
Click This Link
http://www.jutegenome.org/
এ গবেষণায় ভুমিকা রাখা জানা এবং না জানা প্রত্যেকটি মানুষকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন আর ভালোবাসা। কেবলই নিরন্তর ভালোবাসা।
এম আই আয়ূব
রাত ২.২০
১৭.০৬.২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।