সত্যানুসন্ধিৎসু
আমাদের চেম্বারের অভ্যর্থনাকক্ষের সাইড টেবিলের চেয়ারে বসে সেদিনের খবরের কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ রিনিঝিনি শব্দে মুখ তুলে তাকাই। সামনে এক তরুণী বসে, হাতে রেজিস্টার খাতা আর কলম, তারপর আছে কম করে হলেও দু’ডজন কাঁচের চুড়ি। শব্দটা ওই চুড়ির ঠোকাঠুকি থেকেই আসছিল।
তারপর থেকে আমার সকল মনোযোগ ওই চুড়ি আর চুড়ির মালিকের দিকে। প্রতিদিনই চুড়ির রঙ বদলায় আমি তা লক্ষ্য করি।
কিন্তু' শব্দটা একই রকম মিষ্টি রয়ে যায়। বুঝলাম চুড়ি তার খুব প্রিয়। কাঁচের চুড়ির দাম বেশি না ভেবে মনটাকে আশ্বস্ত করে তুলি। বেলোয়ারী, রেশমী, পার্বতী কত রকমের চুড়িই তো আছে জানি, কিন্তু কোনটা কি চুড়ি তা বলতে পারিনা। সঙ্কোচ ভেঙে কিছু জিজ্ঞেস করাও হয় না।
এই হচ্ছে আমাদের নতুন রিসিপশনিষ্ট, নাম ঊষা।
ক’দিন যেতেই ছিটেফোঁটা কথাও শুরু হয় ঊষার সঙ্গে। দিন যতই যায় তার সম্পর্কে আমার ভাবনাও ততই বেড়ে চলে। জীবনের যে অধ্যায়টা গত হয়েছে, যে ভাবনাটা সজোরে দূরে নিক্ষেপ করে নিজেকে নিজের মধ্যে শামুকের মতো গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার মধ্যে কেমন যেন পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
এখন আমার মনে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে গোপন সব ইচ্ছা। সেই ইচ্ছেগুলো পাখা মেলে ধরে, দেখে অবাক হই, ভয়ও লাগে।
এই মুহূর্তে ঊষা নামের মেয়েটিকে বর্ণনা করতে কোন বিষয়টি বেশি প্রয়োজনীয় - ওর রূপ না গুণ?
মেয়েদের প্রধান আকর্ষণ তার চেহারা। যা সহসা সকলের চোখে পড়ে। মানুষের মেধা কিংবা মননকে পরিমাপ করার যোগ্যতা সবার থাকে না অথবা যথার্থভাবে তা করার ক্ষমতাও সবার নেই।
কিন্তু মেয়ে মানুষের রূপ বুঝতে বিশেষ ব্যুৎপত্তির দরকার নেই। চোখ থাকলে যে কেউ তা পারে।
অনেকে বলে লক্ষ্ণী আর সরস্বতী কখনো এক দেহে থাকে না। যারা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী তাদের কাছে ঊষা অপার বিস্ময়। সুন্দরীদের কাতারে ওকে দাঁড় করানো যাবে না।
বেঁটে-খাটো শ্যামলা রঙের নিতান্তই সাধারণ চেহারার মেয়ে ঊষা; আর দশজন মেয়ে থেকে তফাৎ খুঁজে বার করবার মতো কিছু নেই। আক্ষরিক অর্থে ও সুন্দরী নয়। যথার্থ দীর্ঘাঙ্গীও নয়। তবে চেহারায় একটা চাপা শিখা ছড়িয়ে আছে সর্বাঙ্গে। শরীরের পথ চিনে যৌবনের ঢল নেমে এসেছে দেহের সবখানে।
চোখদুটো বড় বড় আর তা দীঘির জলের মতো টলটলে। কমনীয় মুখের ডৌলটির সাথে চৌকস গায়ের রং। কপাল থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নিটোল মসৃণতা। সুন্দর গড়ন, কালো কুচকুচে চুল, ধনুকের মতো বাঁকানো ভ্রু দুটি, ধারালো চিবুক, উন্নত বুক, সুললিত দু’বাহু, ফিলফিলে দু'ঠোঁট কি নেই ওই শরীরে? ঊষা যথার্থ তন্বী নয় তবে অতিশয় তীক্ষ্ণ। দূর থেকে ওকে দেখলে কোনোভাবেই বয়স আন্দাজ করা যাবে না।
তবে নিজে সুন্দরী নয় বলে ঊষার কোনো হীনমন্যতাবোধ নেই। বরং যে সব মেয়েরা সুন্দরী বলে অহংকারী তাদের ব্যাপারে ঘোর আপত্তি। ওর বিশ্বাস সুন্দরী বলে কোনো মেয়ে যদি অহংকারবোধ করে তাহলে প্রকারান্তরে সে পুরুষের ভোগের পণ্যই ভাবলো। নিজেকে পুরুষের জন্য সুখাদ্য ভেবে আত্মতৃপ্তি পাওয়াকে ঊষা মনেপ্রাণে ঘৃণা করে।
এখন আর আমার মন ভরে না ওই চুড়ির শব্দে।
আমি তার কথা শুনি, হাসি দেখি, অনেকক্ষণ না হাসতে দেখলে হাসাতে চেষ্টা করি, ওর প্রতিদিনের যাওয়া-আসাটা আমার মনে আরেক করম আনন্দ দেয়। পায়ে পায়ে যখন চোখের আড়ালে যায় তা দেখলেও মনে সুর বাজে।
সে হাঁটে না, দুলে দুলে চলে। গোটা শরীর তার একটা ছন্দের তালে সাড়া দেয় চলার সময়। এতদিন এই টেবিলের সামনে কতজনকে বসতে দেখেছি; এমন তো হয় নি কোনোদিন।
ও যেদিন আমার অফিসে জয়েন করেছিল নামটা সেদিনই জেনেছিলাম, ঊষা। নামের সঙ্গে গুণের মিল খুঁজে আমি কতদিন কতবার ক্লান্ত হয়েছি তার হিসেব রাখি নি।
ঊষা আমার কল্পনা বোধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এক অসাধারণ কম্পনের সৃষ্টি করেছিল। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার মৃদু আঘাতে কচু পাতাটা যেভাবে কেঁপে ওঠে, ওকে ভাবলে আমারও তেমন বুকের মধ্যে কেঁপে উঠতো। পরিচিত এক শিহরণ অনুভব করি।
বহুদিন আগে ঠিক এরকমই একটা অনুভূতি জেগেছিল আমার, কিন্তু তা প্রায় মরেই গিয়েছিল। ও আবার তা জাগিয়ে তুললো, বাঁচিয়ে দিল। তখন ভেবেছিলাম সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু শেষ হয় না কিছুই। সময় শুধু বোধের উপর একটা নরম আস্তরণ দিয়ে ঢেকে রাখে। কী যে এক অপ্রতিরোধ্য সেই শক্তি আছে তার কাছে টানার, সেই টান সহ্য করা যায় না।
সারাক্ষণ একটা অশরীরী ছায়ার অস্তিত্ব টের পায় মন। যেদিকেই যাই, যেখানেই যাই, যা কিছু করি মনে হয় এখনি সে কথা বলে উঠবে। এখনই তার চুড়ির শব্দ শুনতে পাবো। এভাবে চলতে চলতে কখন যে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম তা বলতে পারবো না। দিন যতই গড়িয়ে যায় ততই মন আমার বদলায়।
এখন আমার চোখে সবকিছুই যেন নতুন মনে হয়। নতুনের আয়োজনে মনের ভেতর কীসের যেন ঝাঁপি খুলে বসে।
এখন আমি ওকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাই, খানিকক্ষণ এক সঙ্গে কাটাই, খুব মনোযোগ দিয়ে ওর টুকরো টুকরো কথা শুনি। যখন আমি একা থাকি তখনো ঊষা আমার কাছে থাকে। আমি কল্পনায় ঊষার ছবি দেখতে পাই।
সেই কল্পনা বাস্তব সত্ত্বার চেয়ে ঢের সাহসী। কারণ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধৈর্য ধরার মতো অবস্থা আমার ছিল না। স্বপ্নিল বারোয়ারি চোখে আমি যেন নতুন কিছু দেখি। মওসুমি বাতাসে দুলে ওঠে মন, আর আমার কষ্টগুলো এক এক করে ঝরে পড়ে কোনো এক ক্লান্ত সন্ধ্যায়।
অফিসিয়াল কাজের স্বার্থে অবসর পেলেই ওকে আমি প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কর্মপদ্ধতি আর নিয়ম-কানুন বাৎলে দিই।
এগুলোর কতটুকু সে মনে রাখে তা আমি জানি না। তবে লক্ষ্য করে এটা বোঝা যায় - কাজের প্রতি ঊষার সিনসিয়ারিটির অভাব নেই।
রিসিপশন রুমে দুটো টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার, কিছু খাতা-পত্র আর একসেট ইন্টারকম টেলিফোন নিয়ে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে সাজান। এক টেবিলে ঊষা বসে কাজ করে, অন্যটা খালি পড়ে থাকে, আমরা কখনো-কখনো এসে বসি। আর এখানে এসে যখন বসি তখন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঊষার সঙ্গে কথা বলি।
ঊষার মধ্যে লক্ষ্য করি কেবলি হতাশা আর হতাশা।
ঊষা বললো, কিছুই ভালো লাগে না। সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। মনে হয় এই বেঁচে থাকাটাও নিরর্থক।
-তুমি হয়তো ডিপ্রেশনে ভূগছ।
আর ডিপ্রেশন একটি মানসিক রোগ।
আমি জানি যে ডিপ্রেসনের কোনো পর্যায়েই ঊষা নেই, তবু পারিপার্শ্বিকতার বিচারে কথা বলতেই হয় তাই বলা।
ঊষা চিন্তিত স্বরে বললো, রোগ হলেও হতে পারে, আমি অতোসব বুঝি না।
আমি বলে যাই, তুমি তোমার দিব্যজ্ঞান দিয়ে ভাবছো যে, জীবনটাই ফাঁকা, সেখানে আর কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃতই কি জীবন এতটা ফাঁকা? বেঁচে থাকা কি এতই নিরর্থক? আমি মনে করি কিছুই ভালো না লাগার মতো অবস্থা জগতে নেই।
-সবই তো দেখলাম, কিন্তু ...।
-না, সবকিছু তুমি দেখো নি। ভালো লাগা, ভালোবাসা যা-কিছুই বলো না কেন সবকিছু তো এখানেই। এই জীবনকে ত্যাগে-ভোগে নিজের করে নেয়ার জন্যে উদ্বেগ ও ইচ্ছের প্রয়োজন। যিনি তা পারেন না ভালো লাগা তার নিয়তি।
ঊষা দৈনন্দিন জমা-খরচের হিসেব করছিল খাতায়। সে খাতাটা বন্ধ করে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। আমি সন্দিহান ছিলাম যে, সে হয়তো আমার কথাগুলো ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারবে না। তবু একজন খাঁটি মনোবিজ্ঞানীর মতো ভাব নিয়ে বলে চললাম:
আসলে ঊষা, জীবন একটি সাগরের মতো। সেটি মন্থন করে অমৃত তুলে নিতে হয়।
অনেকে তা পারে না। কি সব জটিল কারণে চারপাশ থেকে তারা কুঁচিয়ে নেয় নিজেকে। এ এক সাংঘাতিক ব্যর্থতা। যার প্রকাশ তাদের ভাষায়, কোনো কিছুই ভালো লাগে না। কিছুই ভালো না লাগার একটি রোগ যার নাম ডিপ্রেশন।
এই ধরনের অসুখী মনোবৃত্তি থেকে এই অসুখের জন্ম। এর কোনো সীমা-চৌহদ্দি নেই। শুধু ধূসর বিষন্নতার আবহে বেঁচে থাকা। যিনি এই ব্যধির শিকার তিনি নিজেও ভালো করে জানেন না কেন ভালো লাগে না। ভালো হয়তো কিছু লাগে।
কিন্তু মন্দ লাগার কিছু ঘটনা সেই ভালো লাগাকে মলিন করে দেয়। তখন দূর্লক্ষণ অলসদেহ নিরুপায় হয়, আর উচ্চারিত হয় একটি নিরীহ শব্দ- কিছুই ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু না কিছুকে ভালো লেগেই তো জীবন। বেড়ে ওঠা মানেই তো কোনো কিছুর টান। তা হলে এত বিরাগ কেন? কেন এত নষ্ট চিন্তা, কষ্টকর অনুভব? মানুষের চারপাশে রূপ-রস-গন্ধের ছড়াছড়ি।
তোমার চারপাশেও স্বজনের ভালোবাসা আছে। ভোগের উপকরণ আছে, আছে অগুনতি আনন্দের উপাদান। যার সবকিছুই পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না বাজার থেকে। তুমি যদি বলো, তুমি ভালোবাসা পাওনি। বিনোদিত হওনি ভুলেও।
ভোগ আসেনি তোমার জন্যে। আনন্দের কোনো সংবাদ তোমার জানা নেই। হতে পারে তা সত্যি। কিন্তু তার পরেও যে আশা শেষ হয়ে গেছে এটা ভাবা উচিত হবে না। কারণ এখানে স্বপ্নের ইতি ঘটে না।
অন্তত ভালোলাগার জন্যে অনেক কিছুই অবশিষ্ট আছে। তাই যদি না হবে তবে মানুষ দুঃখের বিরুদ্ধে বুক টান করে দাঁড়ায় কিভাবে? জরাব্যধি এড়িয়ে বাঁচার কামনা করে কোনো শক্তি বলে?
-আমি তো বাঁচতে চাই না, আমি মরে গেলে পৃথিবী থেকে মস্তবড় একটা আপদ দূর হয়ে যাবে, সবাই সুখী হবে।
নিঃশব্দে টানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঊষা বললো।
আমি বুঝতে পারলাম না ঊষা এসব কথা বলছে। তবু জ্ঞানী লোকের মতো করে বললাম, এটা তোমার একান্ত নিজস্ব ভাবনা।
মৃত্যু সংহারক রূপটি একান্তই অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিজনিত। তুমি মরে গেলে কারো কোনো আসে যাবে না। যাবে কি?
ঊষা আমার দিকে সাদা চোখদুটো তুলে তাকায়।
রবী ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়লো, জরা হলো ধরিত্রীর পেছনের দিক, সামনের দিকটা হলো যৌবন।
বললাম, যৌবন তো মানুষকে বাঁচতে শেখায়, মরতে নয়।
একজন কারখানার শ্রমিক অনাহারে, চরম দৈন্যের গ্লানি আর সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে। অত্যাচারিত গৃহবধু ইহজীবন থেকে মুক্তি খুঁজেছে আত্মনিধনের পথে। কখনো বা দুঃস্থ মা সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে তাদের বিষ খাইয়ে নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে। এমনকি প্রেমিকের কাছে সর্বসমর্পন করেও তাকে না পেয়ে প্রেমিকা বাঁচার আর কোনোই সার্থকতা খুঁজে না পেয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছে। আবার কখনো বহু প্রচেষ্টার পরও পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অপমানের যাতনা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী।
এসবরে পেছনে আছে সমাজের বিষম পাল্লার নানা ঘাত-প্রতিঘাত। জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে এইসব মানুষ উপলব্ধি করেন, বাচার আর কোনোই মূল্য নেই। তাই আত্মহত্যাই তাদের মুক্তি দিতে পারে জীবন-যন্ত্রণার এই বেড়াজাল থেকে। যখন উন্নততর ভবিষ্যতের যাবতীয় আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়, বেঁচে থেকে জ্বালা সহ্য করা যখন সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে তখনই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বেছে নেয় আত্মহননের পথ। সমাজ ব্যবস্থার জটিল নাগপাশ তাকে এই পরিস্থিতিতে পৌঁছে দেয়।
অর্থনৈতিক দুর্দশা বা বিশ্বাসহীনতা এবং একাকীত্বের বোধ আত্মহননকারী ব্যক্তিকে ওই চরম অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় নিজেকে শেষ করার জন্য। জীবন চলার পথে নানা রকম সঙ্কট আসতে বাধ্য। এমন মানুষ কেউ নেই, তিনি কোনো প্রতিকূলতাকে অতিক্রম না করেই সাফল্যের পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তবে সঙ্কটকালে সবার প্রতিক্রিয়া সমান হয় না। পৃথক মানবিক ধর্মের অনুষদেই একজন মানুষ হয়তো ভেঙে পড়তে পারেন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
তখন তার সামনে কোনও বিশ্বাসস্থল বা আশ্রয়ের ক্ষেত্র থাকে না। চরম দূর্বিপাকের প্রতিরোধ করতে না পেরে তখন সে নিজেকে শেষ করার জন্য ভাবে। এটা সত্য যে, তার অপরাধ বা ক্ষোভ তার ধর্ম বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, তিনি একান্ত ব্যক্তিগতভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন, যদিও সামাজের অন্যায় অসাম্যই তাকে ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। আত্মহত্যার অধিকার তো একান্ত ব্যক্তিগত চৌহদ্দির মধ্যেই পড়ে। সেই চৌহদ্দি যতই ছোট হয় মানুষ তত বেশি নিজেকে অসহায় ভাবতে থাকে।
ঊষা বললো, কিন্তু আমার আর বাঁচতে ভালো লাগে না।
-কিন্তু মানুষের মনের ভেতরে একটি নিজস্ব ভুবন আছে। পৃথিবী ফিরিয়ে দিলে সেখানেও বিচরণ করে কিছুকাল কাটানো চলে সানন্দে। আমি বললাম।
এতসব থাকতেও যখন একজন বলে, ভাল্লাগে না কিছুই - তখন সে সচেতন বা অবচেতনভাবে মিথ্যে বলে।
ভালো নাও লাগতে পারে; কিন্তু সবকিছুকেই নয়। এটা হতে পারে না। আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক, পরিবেশগত তথা একান্ত ব্যক্তিগত কারণে দেহ-মনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। ফলে কল্পনামাত্রেই বাস্তবায়িত হয় না। অংকুরিত হয় না সকল স্বপ্নের বীজ।
ঘোর বিপন্ন মানুষও বেঁচে থাকতে ভালোবাসে, বঞ্চিত মানুষও প্রতিবাদী হতে ভালোবাসে। যিনি নিঃসঙ্গ তিনি ভালোবাসেন প্রিয়জন সন্ধান করতে। কাজেই ভালোলাগা ভালোবাসার মতোই অনিঃশেষ। এর অবসান শুধু মৃত্যুতে। যাদের কিছুই ভালোলাগে না তারা নিজেই নিজের কাছে আড়াল এবং অচেনা।
তবে হ্যাঁ, একথাও সত্য যে জীবন কখনো ভার বোধ হয়। কোনো সময় দুঃখ আর সুখ ছাপিয়ে, শান্তির ছাদ ছিঁড়ে নেমে আসে দুর্বিপাক। তখন হতাশ মানুষ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। বিজ্ঞান প্রমান করেছে, বিশেষ কোনো আবেগে স্বেচ্ছামরণ বেছে নিলেও প্রাণবায়ু বের হবার সময় সে বাঁচতে চায়, ডুবন্ত কোনো মানুষ তাই সামনে ভাসমান খড়কুটো যা হাতের কাছে পায় তাই ধরে বাঁচার চেষ্টা চালায়। এরপরে বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কিছুই ভালো লাগে না কথাটি মিছে।
জীবন বিশাল। এখানে ভালোলাগা বাস করে পাশাপাশি। আশা-নিরাশা, সাফল্য-ব্যর্থতার বৈপরিত্যের নামই জীবন। আর এটাই হচ্ছে জীবনের মহিমা। হয়তো কোনো কারণে, কোনো সময়ে ভালোলাগার মাত্রা কমতে পারে।
কিন' তার অর্থ এই নয় যে, কোনো কিছুই ভালোলাগার মতো নেই। যাহোক, মানুষের জীবনে ভালো না লাগার সুনির্দিষ্ট কারণ বের করা আমার পক্ষে একটা জটিল কাজ। মনে হয় বিষয়টি বহুমুখী ও বিচিত্র। ব্যক্তিবিশেষে এর কারণ বিভিন্ন রকমের। তুমি যে পরিবার থেকে আসছো সেখানকার কথাই যদি বলা যায় তবে আমি মনে করবো যে সেখানে আছে অহরহ না পাওয়ার বেদনা, আর বেদনা থেকে আসা হতাশা।
এই হতাশা এক ধরনের দুঃখবাদী চেতনা। বিষয়টি মূলতঃ মানসিক। চাওয়ার সাথে পাওয়ার আকাশ-পাতাল ফারাক হলে হতাশার জন্ম হতে পারে। মানুষের স্বাচ্ছন্দ নিয়ে জীবনযাপনের আকাঙ্খা আছে। এই আকাঙ্খা পূরণের জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়।
এক সময় হয়তো দেখা যায়, ত্যাগ-তিতিক্ষা সবই উপেক্ষিত হয়েছে। ন্যায্য পাওনা থেকে সে হয়েছে বঞ্চিত। এই বঞ্চনা হতে পারে ব্যক্তি থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত। সময়ে পুঞ্জিভূত হতাশা গ্রাস করতে পারে সমস্ত উদ্যম। তখন কারও প্রেরণা পছন্দ হয় না।
প্রেরণা উচ্চারণ করে কোনো কিছু ভালো লাগে না। আবার অতৃপ্তি বা মোহেরও কোনো সীমা নেই। কেউ তা বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারে। কেউ পারে না। সোনার হরিণ বলে কিছু নেই।
এর পেছনে ছুটলে অতৃপ্তি থেকেই যাবে।
আমি লক্ষ্য করি যখন আমি কথা বলি তখন ঊষা নির্লিপ্ত হয়ে সেগুলো শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। এইসব ব্যাপারে সে কোনো যুক্তিতর্কেও যায় না। সে কি ভাবে যে, আমি খুব বুদ্ধিমান শ্রেনীর একজন মানুষ, আর আমি যা কিছু বলি তা তার মঙ্গলার্থেই বলি? নিশ্চিত হতে পারিনা আসলে আমি কী বলি আর ঊষাই বা কী ভাবে মনে মনে।
ঊষা এখন একমাত্র মেয়ে যে আমার ভক্ত।
ঊষা আমাকে পরিবৃত করে রাখে সব সময়। সৌরবলয়ের মহা আকর্ষণের মতোই ঊষা আমার সম্মোহক প্রভাব ও ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ অনুভব করে। কখনো কখনো আমার মনে হয় ঊষার জীবন ও আত্মজিজ্ঞাসা এবং জীবনপিপাসাকে আমি নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছি। এটা সত্য যে, পৃথিবীতে অনেকে জন্মগতভাবে সুখী, তাই বলে সবাই সুখী- একথা বলা যাবে না। অনেকে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে অসুখী জীবন-যাপন করেন।
আমি নিজেও বিষন্ন অনুভব করি, মুখ নিচু করে চিন্তাযুক্ত থাকি, অন্যদের থেকে পৃথক থাকতে ভালোবাসি, আমি একাকী নীরবে নিভৃতে থাকতে ভালোবাসি - তাতে কেউ ধরে নিতে পারে আমিও বিষন্নতায় ভুগছি। এটা সত্য যে, সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী-পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এ পৃথিবীর সংগ্রামময় জীবনে কমবেশি বিষন্নতার শিকার। মনে হয় বিষন্নতায় আক্রান্ত হন তারাই যারা আমার মতো একাকীত্ব জীবন-যাপন করেন। আমি যেমন একটি ভালোবাসাহীন জগতে বসবাস করি, যেখানে কোনও সহমর্মিতার কোনও বালাই নেই, পারস্পারিক সমঝোতা বলে কিছু নেই, কারো প্রতি কারো দরদ নেই, মায়া-মমতা নেই; আছে কেবল নির্ভেজাল কিছু বৈসয়িক স্বার্থ সেই সাথে জঘন্ন কিছু স্বার্থপরতা, কুটিল রক্তচক্ষু, নিকৃষ্ট অনুভূতি - এইসব।
আমি জানি না, আমি নিজেকে কেন অবনমিত মনে করি! মনোবিজ্ঞানের গবেষকগণ এ সত্য যথার্থই উপলব্ধি করেছেন যে, মস্তিষ্কের মধ্যে সেরোটনিন নামক যে বিশেষ রাসায়নিক উপাদানটি তৈরি হয় সেটাই মানসিক ও আবেগপ্রবণতার জন্য দায়ী।
কোনো কারণে মস্তিষ্কে সেরোটনিনের মাত্রা কমে গেলে তখন একজন বিষন্নতায় আক্রান্ত হন। আর যখন সেরোটনিন-এর মাত্রা বেশি হয় তখন নিজেকে সুখী অনুভব করবেন। আনন্দময়, প্রফুল্ল, উৎফুল্ল হবেন, প্রশান্তি পাবেন, চমৎকার অনুভব করবেন। এই মাত্রা আমার ক্ষেত্রে বোধহয় কখনো বেশি হয়নি! আমার ভেতরের প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও আমার মধ্যেও বিষন্নতা কিভাবে যেন ঢুকে পড়েছে তা আমি জানি না। আমার সহায়-সম্বল বলে আর কিছু নেই।
বাকি আছে শুধু সংসারের একটা বড় বন্ধন। সুতোটা সরু হতে হতে এখন একেবারেই ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। তাই এখন আঁকড়ে ধরার জন্য বই আর কম্পিউটার ছাড়া আর কিছু সামনে পাইনা। তিন বছর ধরে কম্পিউটার-টেবিলে বসে মুখ গুঁজে পড়ছি, লিখছি। করা হয় নি কিছুই।
তবুও ওরই মধ্যে স্বান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। সযত্নে একটু-একটু করে নিজের চারপাশে একটা বলয় তৈরি করে নিয়েছি। সেটাও ভেঙে পড়ার জোগাড় হয়েছে এখন। এখানে নিঃসঙ্গতার ব্যাপারটাই মুখ্য। তবে আমি মনে করি না যে, বিষন্নতা ভর করেছে বলেই আমার জীবন আজ দুর্বিসহ।
এজন্য আমি কিন্তু নিজের মধ্যে অসুখী বোধ করি না। ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, মনের মধ্যে অশান্তি ও উত্তেজনার বৃদ্ধি, মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বিনষ্ট হওয়া, খাওয়া-দাওয়ায় অনিহা অথবা উল্টোটি, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, যে কোনো বিষয়েই অমনোযোগিতা, দেহের এ জায়গা সে জায়গায় ব্যথা, আত্মহত্যার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা, জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাবোধ, ভয় বা অপরাধবোধ মনের মধ্যে কাজ করা, সর্বক্ষণ পরিবারে সবার সাথে ভুল বুঝাবুঝি ও মনোমালিণ্য, খটখটি লাগা, নিজেকে অসহায় মনে করা, কোনোকিছু ভালোবাসার প্রবণতা কমে যাওয়া - এসব আমার মধ্যে প্রচন্ডভাবে ক্রিয়াশীল থাকলেও আমি টের পাই না।
সামাজিক কাজকর্মে আমি কখনো নিরানন্দবোধ করি না। আমোদ-প্রমোদ, বিনোদন ভালোই লাগে, ভালোবাসা ও মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায় নি। সখ সাধ যেটুকু কমে গেছে সেটা আমার সাধ্যের অক্ষমতার জন্যে, নিঃসহায় বোধ আমার মনের মধ্যে কাজ করে না।
আমি এখনো বন্ধুত্বের মূল্য দেই এবং বন্ধুত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করি, কথা দিয়ে কথা রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমার মধ্যে যৌন অক্ষমতাও দেখা দেয় নি। আমি যতটুকু সম্ভব নিজেকে বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করি। নতুন কিছু লিখতে চাই, সংসারের সব দায়দায়িত্ব নিজের ঘাড়েই রয়ে গেছে। ঘুম না এলে বিছানায় যাই না বা শুয়ে থাকি না।
ভালো বই পেলে এখনো পড়ি, যে চিন্তা মনে আনন্দ যোগায় সে ধরনের চিন্তাই করি। কর্মহীন থাকলে শরীর থেকে বিষন্নতারোধী এন্ডরফিনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি বলেই আমি মনে করি। কোনো ব্যাপারে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি না। বরং এমন কিছু ব্যাপার এসে পড়ে যখন আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা।
আমাকে অনেক ভাবতে হয়। আমি মনে করি, অন্য লোকের চাহিদা অনুধাবন করা উচিত। প্রভাব বিস্তার করতে গেলে প্রথমে অন্য লোকের বক্তব্য অধীর আগ্রহে শোনা উচিত এবং সে ব্যক্তিকে ভালো করে বোঝা উচিত। সে ব্যক্তির চাহিদা অনুধাবন ও পুরণ করতে পারলে তবেই তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা সফল হতে পারে।
হঠাৎ একদিন ঊষা বললো, আপনাকে একটা ছেলে দেখাবো।
মাত্র ক’দিন ধরে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। প্রায় প্রতিদিনই সে এখানে আসে, সামনে বসে কথাবার্তা বলে। প্রথমদিন অন্যান্য রোগিদের মতো এসে চিকিৎসার ব্যাপারে আলাপ করে গেলো। তারপর থেকে সে প্রায়ই আসে। যখন কেউ না থাকে তখন সে আমার সামনের চেয়ারে বসে টুকটাক কথা বলে চলে যায়।
এখন দেখছি ছেলেটির উদ্দেশ্য ভিন্ন রকমের। বলে, চলেন না একটু বাইরে যাই, অন্যকোথাও গিয়ে বসি, কথা বলি, গল্প করি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে ... এই সব আর কি।
(ক্রমশ)
পরের সংযুক্তিগুলি:
-সব নষ্টের মূল
-বউ বললো: তোমার হাড়-মাংস খেয়ে তারপর যাব
-ঊষা বললোঃ মদ খাবো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।