আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ রূপার কাঁকন



১. - ও ময়না! মেল টেরেন জাতিছে না কি রে! কিসের শব্দ হতিছে ভাল কইরে শুইনে দ্যাকদিনি! চুলোতে শুকনো পাতা গুজে দিতে দিতে বলে চলে মমতা। লিচু গাছটার ছায়ায় বসে একমনে পুতুল খেলছে তাঁর চার বয়সী মেয়ে ময়না। - দেকতি দেকতি কেমন কইরে দুটো বেঁইজে গেইল। কালের দিনে বেলা মেলা তাড়াতাড়ি ছুইটে যায়। ময়না মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকায়।

-মা! আমারে কি ডাকিছেন? -হ। তর কি বেশি খিদা লাগিছে? একনও তো ভাত ফুটে নাইরে মা! ময়না আবার পুতুল খেলায় মনোযোগ দিয়েছে। রতন কাল মেলা থেকে নতুন পুতুল কিনে এনেছে বোনের জন্য। বোনটাকে খুব ভালোবাসে সে। কাল ছিল মেলার শেষদিন।

গত ছয়দিন ধরে একটানা দোকানটায় গিয়েছে পুতুলটা কেউ কিনে নিল কিনা দেখার জন্য। পুতুলটার দাম দশ টাকা। ও মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। এত টাকা কোথায় পাবে সে। তিন চারদিন টাকার জন্য বাবার কাছে ধরনা দিয়েছে।

তার কাছেও টাকা নেই। অভাবের সংসার, দুই বেলা দু’মুঠো ভাতের চাল যোগার করাই যেখানে বড় দায়!ভিটে-বাড়ি বন্ধক রেখে হরিপদ মহাজনের কাছে থেকে যে টাকা এনেছিল, সবই তো গেছে সার, বীজ আর কীটনাশক কিনতে। এখন সেচের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে, তা চিন্তা করেই কূল কিনারা পাচ্ছে না। মাকে খুব ভয় পায় রতন। মায়ের কাছে টাকা চাইতে সাহস পায় নি সে।

টাকা চাইলেই পিঠে জুটতো দুইটার কুঞ্চির বাড়ি। মমতা ঘরে ষোলটা ডিম রেখেছিল মুরগীর বাচ্চা ফুটানোর জন্য। সেখান থেকে তিনটা চুরি করে বেচে দিয়ে কাল পুতুলটা কিনে এনেছে রতন। চুপি চুপি ময়নাকে ডেকে পুতুলটা দিয়ে সারাদিন এদিক ওদিক পালিয়েছিল। আহা বেচারা!রাতে ফিরতে হয়েছে নিতান্ত বাধ্য হয়েই।

এতটুকু মানুষ, আর কোথায় যাবে রাতের বেলায়। পিঠে কুঞ্চির বাড়ি খাওয়ার নিয়তি তাই মেনে নিতে হয়েছে। তবুও তো ছোট্ট মানুষটার মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটবে। বড়দের অনেক কিছুই রতন বুঝে না। কাল মা তাকে মারে নি, এমনকি কিছুই বলেনি, ব্যপারটা রতনের কাছে খুব আশ্চর্য ঠেকেছে।

-ময়না, মাঁচালির পাড় ছোট একটা হাড়ি দেকপি। ওয়ের মদ্দি চাল ভাজা রাখিছি। তুই খানিক খা, আর খানিক রতনের জন্যি রাইখে দিস। -মা, ভাইজানের ইশকুল ছুটি হবেনে ককন?ভাইজান আলি পরে খাবানে? -রতনের ইশকুল তো মেলা আগেই ছুটি হয়েছে। দেক কনে খেলতিছে? -মা!তালি পরে কি আমি দেইকে আসপো? ভাইজানকে ডাইকে নিইয়ে আসপো? মমতা মৃদু হাসে।

যেমন ভাই, তেমন তার বোন! -যা দেকগে! ছাওয়ালটা কনে কনে যে যায়! তুই কিন্তু আবার খুঁজপের জন্যি বেশি দূর যাবি না কতিছি। ২. বাহির বাড়ি এসেই রতনকে খুঁজে পায় ময়না। উকি ঝুকি মেরে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে মায়ের মন বুঝার চেষ্টা করছিল রতন। সারা গায়ে কাদা মাখামাখি, দেখে মনে হচ্ছে কাদার সাথে বড় একটা যুদ্ধ করে এসেছে। একবার ভাবছে বাড়ির ভিতরে ঢুকবে, কুঞ্চির বাড়ির ভয়ে আবার পিছিয়ে আসছে।

ময়না অবশ্য ভাইকে এভাবে দেখে অভ্যস্ত। -ভাইজান, আপনে একানে দাঁড়ায়ে রইছেন, মা খাতি ডাকতিছে আপনেরে। হঠাৎ ভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে ময়না বলে, -ও আল্লা! এত বড় কাতলা মাছ কনে পাইছেন ভাইজান? বোনের খুশি দেখে রতনের মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। মৃদু হেসে বলে, -তুই বড় মাছ খাতি চাইছিলি না ওদিন? তাই ধইরে নিইয়ে আলাম। -কনে থেকে ধরিছেন? ময়নার বিস্ময় যেন কাটতে চায় না।

-তুই মাছটা নিইয়ে ভিতরে চইলে যা একন। পরে সব কবানে। -আপনে একন যাবেননানে? -হু, মা কি মারতি পারে? -কতি পারি না, মারলিও মারতি পারে। -তুই তালি পরে আগে যা, আমি আসতিছি। রতনকে দেখেই মমতা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসে।

-আয়িছিস! আয় আইজকে। আয়নার দিকে একবার তাকিয়ে দেকদিনি চেহারার কি ছিড়ি করিছিস? রতন ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে যায়। তার গলা শুকিয়ে আসছে। আজ মনে হয় আর রক্ষা নাই। পালিয়ে যাবে কি না দ্রুত ভাবল রতন।

মন কিছুতেই সায় দিল। রাতে তো ফিরতেই হবে, এখন যা শাস্তি হবার হয়ে যাক। তা না হলে রাতে দ্বিগুন শাস্তি পেতে হবে। -কি রে পিছোয়ে যাচ্ছিস কি জন্যি? কাইলকে যে কান্ড ঘটাইয়েছিস, কিছু কলাম না দেইকে ভাবিছিস আইজকেও কিছু কবনানে? রতন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আশু শাস্তি বরণের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি করার আছে তার? -কি রে কথা কতিছিস না কি জন্যি? আর কত জ্বালাবী আমারে?কোতা থেইকে মাছ চুরি কইরে আনিছিস? যা তাড়াতাড়ি ফিরোয়ে দিয়ে আয়।

রত্ন মৃদুভাবে মায়ের কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করে। -মাছ চুরি কইরে আনি নাই মা। আমারে দেছে। -কে তোরে মাছ দিল ক’দেকেনি? -চৌধুরী সাবের পুকুরে পানি সেইচে জাইলেরা মাছ ধরতিছিল,তাগের সাথে গ্রামের মানুষরাও মাছ ধরিছে। আমিও কয়টা ধইরে দিছি।

চৌধুরী সাবের বিবি খুশি হইয়ে আমারে এইটা দেছে। -তুই মাছ ধরতে গেইলি কেন? সাপে কাটলে কী করতি? -ময়না ওইদিন বড় মাছ খাতি চাইছিল। ওর কথা মনে পড়তিই নাইমে পড়িছি মাছ ধরতি। ছেলের কথা শুনে মমতা হতভম্ব হয়ে যায়। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, -তোর বই খাতা কনে রাখিছিস? -মামুনের কাছে রাখিছি।

বৈকাল বেলা যাইয়ে নিইয়ে আসপানে। -ঠিক আছে। একনি কল পাড়ে যা। আমি বাসনা সাবান নিইয়ে আসতিছি। রতন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

এ যাত্রায় মনে হয় বেঁচে গেল সে। মমতা নিজ হাতে সাবান ঘসে ঘসে ছেলেকে গোছল করায়। -বাপজান! ইশকুলে আজ পড়া পারিছিস? -পারিছি মা। অমল ছাড় কঠিন দেকে তিনটা অঙ্ক দিছিল। কেউ পারে নাই।

আমি পারিছি দেকে ছাড় খুব খুশি হয়েছে। -কী কল তোর ছাড়? -ছাড় আমারে কাছে ডাইকে নিইয়ে অনেক আদর কইরে দেছে। আমার খুব ভালো লাগিছে মা। মমতা ছেলের কথা শুনে মৃদু হাসে। -বাপজান! মন দিইয়ে লেকাপড়া করবি।

তালি পড়ে সপ সময় ছাড়গের দুয়া পাবি। -ছাড় কল, আমি বড় হলি পরে নাকি ডাকা ইনভার্সিটি চানেস পাব। মা,ডাকা ইনভার্সিটি কি অনেক বড় ইশকুল? -কী জানি বাপ, কতি পারি না, হবার পারে। -মা! চৌধুরী সাবের বিবির দুই হাত ভরা সোনার চুড়ি। আমি বড় হলি পরে আপনের জন্যি সোনার চুড়ি কিনে আনবো।

রতন মায়ের দুই হাতের রূপার চুড়ি দুইটিতে হাত বুলায়। ছেলের পাগলামী দেখে মমতা হাসে। -মা, রূপার চুড়ি হলি পরে কি হবি, আপনের হাত চৌধুরী সাবের বিবির চাতিও অনেক বেশি সুন্দর। মমতার চোখে পানি চলে আসে। -বাপ আমার! বাঁইচে থাক তুই।

৩. বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই রতনের জ্বর চলে আসে। মমতা বিকেল থেকেই মাথায় পানি ঢালছে, গা মুছিয়ে দিচ্ছে, মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। তবুও্ জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই। পাল্লা দিয়ে জ্বর বেড়েই চলছে। ঘরে একটা কানা-কড়িও নেই।

এবাড়ি-ওবাড়ি করেও একটা পয়সা যোগার করতে পারে নি রতনের বাবা। ওদিকে ছেলেটা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে বকে ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতা ছেলেকে বুকের কাছে নিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে। ময়না ভাইয়ের পা বারে বারে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাহির বাড়ির বেঞ্চিতে রতনের বাবা মন মরা হয়ে বসে আছে।

নিজের চোখের সামনে ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, জ্বরে কাতরাচ্ছে, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। বুকটা ক্রমশ ভারী হয়ে ওঠছে কষ্টে। মমতা রতনের বাবার পিছনে এসে দাঁড়ায়। স্বামীর পিঠে হাত রাখে। রতনের বাবা ফুঁপিয়ে কেদে ওঠে।

মমতা হাতের চুড়ি দুইটা খুলে দিয়ে রতনের বাবার সামনে ধরে আকুতি জানিয়ে বলে, আপনে আমার ছাওয়ালরে বাঁচান। চুড়ি দুইটা বেইচে তাড়াতাড়ি ডাক্তর নিইয়ে আসেন। রতনের বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকে মমতার দিকে। -আপনে কথা কতিছেন না ক্যান? তাড়াতাড়ি যান, আমার ছাওয়ালরে বাঁচান। ওর কষ্ট আমি আর সইয্য করতি পারতিছি না।

-বউ, আমারে তুমি এই চুড়ি নিইয়ে যাতি কইয়ো না। এই চুড়ি আমাগের বংশের পেতিক। -দোহাই আপনের, আপনি একনি যান। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মমতা। -আমার রতনরে বাঁচান।

এশার আযানের সময় রতনের ঘুম ভাঙে। অনেক কষ্টে চোখ খুলে মাকে ডাকে, -মা, আমার খুব পানির তিয়াস পাতিছে। একটু পানি দিবেন? দাঁড়া বাজান, আমি পানি দিতেছি। মমতা রতনকে আধ-শোয়া করে পানি খাওয়ায়। -মা, বাপজান কনে গেছে? -তোর জন্যি ডাক্তর আনতি গেছে।

-মাছটা কি রান্না করিছেন? -হ বাপ! তোর কি খিদা লাগিছে?ভাত নিইয়ে আসপো? -বাপজান আসলি একসাথে খাবানে? মা! মাথাখান কিন্তু ময়নারে দিবেন। মমতা অনেক কষ্টে হাসে। -ঠিক আছে বাপজান। মা! আপনের হাতখান একটু দেন, ধরতি ইচ্ছে করতিছে। মমতা ছেলের দিকে হাতদুটি বাড়িয়ে ধরে।

-মা, আপনের চুড়ি কনে? -খুইলে রাখিছি বাপ! মমতার চোখে জল চলে আসে। -ভাইজান! বাপজান মার চুড়ি বেচতি নিইয়ে গেছে। বাপজানের কাছে আপনের ওষুদ কিনার টাকা ছিল না। -ময়না তুই চুপ কইরবি। মমতা ফুঁপিয়ে কাঁদে।

ময়নাকে কে বুঝাবে, ওরা যে তার কাছে দুই দুইটা হিরার চুড়ি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।