আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রন্থ আলোচনা: পরার্থপরতার অর্থনীতি



বইয়ের নাম: পরার্র্থপরতার অর্থনীতি লেখক: আকবর আলি খান প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রথম প্রকাশ : আগস্ট ২০০০ মূল্য: ২২৫ টাকা ISBN : 984 05 0223 9 অর্থনীতির আলোচনা একটি গুরুগম্ভীর, জটিল, গভীর, বিশেষায়িত জ্ঞানের বিষয়- এ রকম মত প্রকাশ করলে নিশ্চয়ই খুব বেশি আপত্তি কেউ করবেন না। কিন্তু অর্থনীতিকে যদি রসালো, মজার, চমকদার পাঠের বিষয় বলি, যে পাঠের আনন্দ কোন রম্য রচনা পাঠের আনন্দের চেয়েও কম নয় এমন কথা বললে পাঠকেরা তৎক্ষণাৎ একমত হবেন এমন আশা করা যায় না। তবে আকবর আলি খানের লেখা ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইটি পড়ে তাই মনে হয়েছে- এর পাতায় পাতায় হাসির উপাদান ছড়ানো, কিন্তু পাঠ শেষে পাঠকেরা একই সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অনেক গভীর চিন্তার খোরাক পাবেন। বইটির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পূর্বে লেখক সম্বন্ধে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। আকবর আলি খান একজন সরকারী উচ্চপদের আমলা, যখন এ বইটি প্রকাশিত হয় তখন তিনি সরকারী চাকুরিরত ছিলেন।

ঔপনিবেশিক উত্তর যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা আমরা পেয়েছি তাতে একজন সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা খুব গম্ভীর, রসকষহীন, প্রতাপশালী মনোভাবের ব্যক্তি হবেন এবং একইসাথে রাষ্ট্র পরিচালক ও পরিচালনা ব্যবস্থার গুরু সমর্থক হবেন (অন্ততঃ প্রকাশ্যে সমালোচনা করবেন না) এমন একটি ধারণা আমরা ধারণ করি। ব্যক্তিগত জীবনে আকবর আলি খান কেমন জানি না, তবে কোন বই পাঠ করে লেখকের চরিত্র সম্বন্ধে একটি চিত্র আমাদের মনে ভেসে ওঠে। ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ পাঠ করলে মনে হয় লেখক এহজন তীব্র রসবোধপূর্ণ, বিবেকবান, সাহসী, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব এবং যার নানা রকম বিষয়ে গ্রন্থ পাঠের নেশা রয়েছে। বইটির প্রতিটি প্রবন্ধের মাঝের ঊদ্ধৃতি এবং মূল প্রবন্ধ শেষের রেফারেন্স পড়লে দেখতে পাই কেবল অর্থনীতি নয়, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস নানা বিষয় এসেছে। অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করতে হলে যে কেবল অর্থনীতি যথেষ্ট নয় এ বিষয়টি এ বইয়ের প্রবন্ধগুলো পাঠ করলে অনুধাবন করা যায়।

বইটিতে মোট পনেরটি প্রবন্ধ রয়েছে। অধিকাংশ প্রবন্ধগুলো নানা সময়ে বিভিন্ন পত্রিকা, সেমিনার. প্রকাশনায় প্রকাশিত বা উপস্থাপিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর বাইরেও তিনি একটি ইংরেজি থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে ইংরেজি অর্থনীতি বিষয়ক দুইটি পরিভাষা কোষ প্রণয়ন করেছেন- যা গবেষক, পাঠকদের জন্য সহায়ক হতে পারে। বইটির কয়েকটি প্রবন্ধগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। দান-খয়রাতের অর্থনীতিকে অর্থনীতিবিদরা নাম দিয়েছেন পরার্থপরতার অর্থনীতি (economics of altruism)।

‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ প্রবন্ধটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে গরীবের ভাল করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থনীতির মৌল উপাদানসমূহকে অস্বীকার করে দান-খয়রাত করে খুব সুফল পাওয়া যায় না। প্রবন্ধটি খুব হালাকাভাবে আরম্ভ করে তিনি ধীরে ধীরে এমন তাৎপর্যপূর্ণ একটি বক্তব্যে এসেছেন। তিনি বলেছেন, “...কাজ শুধু আবেগের ভিত্তিতে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা । বাজারের অদৃশ্য হাতকে অগ্রাহ্য করে যে নীতি প্রণীত হয় তার সাফল্যের সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত।

বাজার-অর্থনীতির তিনটি অনুশাসন কখনো ভুলে গেলে চলবে না। প্রথমত, গরীবদের এমন সাহায্য দেওয়া সঠিক হবে না যা তাদের কাজ করতে নিরুৎসাহিত করবে। এ ধরনের ব্যবস্থা টেকসই হবে না। যে সমাজে অলসতা পুরষ্কৃত হয় সে সমাজে সবাই ফাঁকি দিতে চাইবে। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে বিত্তবানদের আধিপত্য রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত গরীবদের জন্য নিকৃষ্ট পণ্য ত্রাণ সামগ্রী হিসাবে অধিকতর উপযোগী হবে।

নিকৃষ্ট পণ্য গরীবদের ক্ষুধা মেটায় অথচ ধনীদের আকর্ষণ করে না। তৃতীয়ত, গরীবদের কর্মসূচী সমাজের অন্যান্য কর্মসূচী হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে। সকলের জন্য অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলে গরীবরা তার সুফল পাবে না। ”(পৃ. ৮-৯) লেখক যুক্তি ও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন এবং প্রচলিত আদর্শগত সুবচনের বিপরীতে বেশ সহজ,সাবলীল ও বাস্তবভিত্তিক মন্তব্য ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। “শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি’ নামটি একটু খটকা লাগলেও পড়তে থাকলে পাঠকরা ক্রমে ক্রমে “শুয়র কা বাচ্চাদের” মর্মার্থ বুঝতে পারবেন।

তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক ব্রিটিশ শাসিত ভারতের একজন প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটের স্মৃতিকথা থেকে অনুবাদ করেছেন, “..এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছেন সজ্জন যাঁরা ঘুষ খান না, ...। আছে যারা ঘুষ খায় এবং ....আছে শুয়রের বাচ্চারা যারা ঘুষ খায় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকেরকোন সাহায্য করে না। ”(পৃ. ১২) আইন অনুসারে দুর্নীতিপরায়ণদের সাজা দেওয়া যে অনেক সময়ই সফল হয় না বরং বেশিরভাগ দেশে উন্নয়নশীল দেশেই দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। লেখক মন্তব্য করেছেন যে, “আধুনিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, আজকের রাজনীতিবিদ্গণ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে রাজনৈতিক সমাধান দিতে চান আর রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না করে আর্থিক সমাধান দিতে চান।

এর কারণ হল রাজনীতিবিদ্গণ অত্যন্ত অসহিষ্ণু। ক্ষণভঙ্গুর হলেও তাঁরা চটজলদি যাদু দেখাতে চান। ভোটারদের দেখাতে চান যে, তাঁরা সব সমস্যার সমাধান জানেন। অথচ বাস্তবে এখন অনেক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা রয়েছে যার কোন নিশ্চিত সমাধান নেই। এর ফলে হিতে বিপরীত হয়।

” (পৃ.১৯) নিজে সরকারী কর্মকর্তা হয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন যে সরকারী কর্মচারীরা অনেক সময়ই দুর্নীতির প্রধান পোষক হন, দুর্নীতি হ্রাসে তারা খুব আগ্রহী হন না। অনেক সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দুর্নীতি দূর করতে চাইলেও সরকারী কর্মকর্তাদের প্রতিরোধের সামনে তাঁরা অকার্যকর হয়ে পড়েন এবং নিজেরাও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। দুর্নীতি দূর করার কঠিন কাজটির জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় সংস্কার আর এই সংস্কার বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে খুব প্রাণবন্ত ও তথ্যবহুল আলোচনা রয়েছে ‘সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধে। এ সম্পর্কে লেখক লিখেছেন,“সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাই যথেষ্ট নয়।

সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সৃদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কিন্তু ভাল অর্থনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল রাজনীতি নয়। যে ধরনের সংস্কার ভোটারদের আকৃষ্ট করে না, সে ধরনের সংস্কার রাজনীতিবিদ্দেরও আশীর্বাদ লাভ করে না। রাজনীতিবিদ্দের পক্ষে সংস্কার সম্ভব নয়, সংস্কারের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের। রাজনীতিবিদ্দের চিন্তা আগামী নির্বাচনের সীমাবদ্ধ, একমাত্র বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কেরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত।

”(পৃ.২৫) সংস্কার বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। একনায়কদের পক্ষে সংস্কার করা সম্ভব, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়- এমন যে একটি প্রচলিত ধারণা আছে তা তিনি বিরোধিতা করে বলেছেন যে স্বৈরাচারী সরকার অনেক সময়ই ‘দস্যু-সরকারে’ পরিণত হয়, যেমন, হাইতির ডুভালিয়র, উগান্ডার ইদি আমিন, জায়ারের মবুতু। অন্যদিকে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকার সাফল্যের সাথে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। উপসংহারে লেখক বলেছেন যে সংস্কার একটি যুদ্ধের মতোই, এতে বিপদের আশংকা বা ঝুঁকি থাকবে- এবং সাহসের সাথে তাকে মোকাবেলাও করতে হবে। ‘ মোল্লা নসরুদ্দীনের অর্থনীতি’ প্রবন্ধটির অতি কৌতুককর বিষয় হল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কে জন্মগ্রহণকারী সুপণ্ডিত, সুকবি, ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ইমাম যাঁর মস্করা আর মজার গল্পের সাথে আমরা পরিচিত তাঁকে লেখক একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত করিয়েছেন।

মোল্লা নস্রুদ্দীনের গল্প দিয়েই লেখক উচ্চফলনীশল বীজের আগ্রাসন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক বা দাতা সংস্থার মনোভাব, জীব বৈচিত্র্য হ্রাসের ভয়াবহতা এমন সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আলোচনা করেছেন। লেখক নিজে অর্থনীতিতে পিএইচডি করলেও তিনি মন্তব্য করেছেন যে, “ . . . যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ যে শুধু সেনানায়কদের কাছে যুদ্ধ সম্পর্কে সকল সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। অর্থনৈতিক সমস্যাও এত গুরুত্বপূর্ণ যে তা শুধু পেশাদার অর্থনীতিবিদ্দের কাছে ছেড়ে রাখা সম্ভব নয়। মোল্লা নসরুদ্দীনের মত চিন্তাবিদদের আজকের দিনেও তাই আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। ” (পৃ.৪২-৪৩) স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ হচ্ছে, ’বাঁচা-মরার অর্থনীতি’।

বর্তমানে তো বটেই সব সময়ই বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক চীন, সৌদি আরব, শ্রীলংকা, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু ব্যয় বৃদ্ধিই স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা বাড়াতে পারে না। এ প্রসঙ্গে লেখক একবিংশ শতাব্ধীতে স্বাস্থ্যখাতের যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে; “চিকিৎসা শাস্ত্রের অভাবনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের জনসংখ্যার সিংহভাগ নূন্যতম স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। ... যেখানে জনগোষ্ঠী চিকিৎসার যথাযথ সুযোগ পাচ্ছে সেখানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের প্রচুর অপচয় হচ্ছে। ” (পৃ.৪৭) এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে লেখক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে একবিংশ শতাব্দীতে স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ শুধু ডাক্তারদের নয় - অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।

“অর্থনীতিবিদ হচ্ছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ যিনি আগামীকাল জানবেন তিনি গতকাল যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আজ তা কেন ঘটেনি। ” (পৃ.৫৭) - অর্থনীতিবিদের পরিচয় সম্পর্কে এই মতটি উল্লেখ করেও নিজেই অর্থনীতিবিদ হিসেবে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে: অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত’ প্রবন্ধে। আশাবাদী, নিরাশাবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের কথা আলোচনা করে লেখক উপসংহারে উল্লেখ করেছেন যে একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা অর্থনৈতিক নয়, সবচেয়ে বড় সমস্যা হল রাজনৈতিক ও সামাজিক এবং এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন “....সমস্যার সমাধান করতে হলে সামাজিক পুঁজি (social capital) গড়ে তুলতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষে মানুষে সহযোগী ও সৃষ্টিশীল সম্পর্ক গড়ে তোলার উপরই নির্ভর করছে সামাজিক পুঁজির সরবরাহ। ”(পৃ.৬৫) ‘শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধটি লেখক আরম্ভ করেছেন তাঁকে ছোটবেলায় শেখানো কথা, “পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা যেখানে মানুষ শোষণ করে মানুষ, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল তার সম্পূর্ণ উলটো।

” (পৃ.৬৯) তিনি মন্তব্য করেছেন যে অনেক পড়ে তিনি বুঝেছেন যে “মানুষ শোষণ করে মানুষ” কথাটি উল্টালেও একই অর্থই বহন করে এবং লেখক মন্তব্য করেছেন যে সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদের ‘‘নির্যাস অভিন্ন’’। তিনি এই প্রবন্ধে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শোষিতের স্বরূপ এবং মার্কসীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা দুইটি বিষয়ই আলোচনা করেছেন। তবে উপসংহারে তিনি মন্তব্য করেছেন যে “অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ একটি মৌল ধারণা। কমিউনিজমের আতঙ্ক অপসৃত হলেও সাম্যের দাবি থামবে না। নতুন নতুন রূপে অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেবে।

”(পৃ. ৭৮) জীবনানন্দের বনলতা সেনকে নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করে ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’ আলোচনায়। প্রবন্ধটির আলোচনা অনেক গভীর। নারীদের প্রতি বৈষম্য হ্রাস যে কেবল নারীদের জন্য প্রয়োজন তা নয়, মানব উন্নয়ন বা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটি অপরিহার্য। লেখক অনেক পরিসংখ্যান, তথ্য, উপাত্ত, যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, “লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুধু সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যই প্রয়োজন নয়। অবহেলিত নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

” (পৃ.৯১) ‘খোলা ম্যানহোলের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধটি বাংলাদেশের সুশাসনের অভাবের একটি করুণ চিত্র তুলে ধরে। তিনি অনেকটা বিদ্রƒপ করেই বলেছেন যে রাস্তার ম্যানহোলের ঢাকনার অবস্থা দেখে তিনি উন্নয়নের স্বরূপ বুঝবার চেষ্টা করেন। বিদ্রƒপ হলেও তার বক্তব্যের তাৎপর্য অনেক গভীর। অদক্ষতা ও দুর্নীতির জন্য জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, জল সরবরাহ, সেচ, আর্থিক ব্যবস্থায় আমাদের কী বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এ প্রবন্ধে। বন্যা বাংলাদেশের একটি নিয়মিত সমস্যা।

কিন্তু এই বন্যা নিয়ে কত রকম রাজনীতি হয় তা আলোচনা করেছেন ‘বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ রচনাতে। আমাদের দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত বিভিন্ন জনপ্রিয় উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নিয়ে নতুন করে ভাববার খোরাক যোগাবে এই প্রবন্ধটি। শিক্ষাকে বিপণনযোগ্য পণ্য বা শিক্ষা ও অর্থ নিয়ে যে তর্ক তা-ই নিয়ে লেখকের প্রবন্ধ ‘শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অসাম্য’। শিক্ষার লক্ষ্য কি শুধুই জ্ঞানার্জন নাকি শিক্ষা অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার এই নিয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগে গ্রীস, চীন, ভারতবর্ষে যে তর্ক আরম্ভ হয়েছিল তা নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন। এইসব আলোচনা করে তিনি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ গড়ে তুলতে বাংলাদেশের জন্য যেসব জরুরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার (যেমন, ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে মনোভাবের পরিবর্তন, মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপক পরিবেশ তৈরী, যোগ্যতরদের জন্য উচ্চতর আয় ব্যবস্থা) সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

রচনাটির তিনি শেষ কথাটি হচ্ছে, “যে অর্থব্যবস্থায় বিদ্যা বিপণনযোগ্য পণ্য সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। ” (পৃ.১২৬) ‘সোনার বাংলা: অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত’ আমাদের জন্যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ বলে মনে করি। আমরা আমাদের অতীতের অর্থনীতি কোন কোন ক্ষেত্রে অতি কল্পনা বিলাসী হয়ে উঠি কিন্তু সম্পদের প্রাচুর্য থাকবার পরেও সাধারণ মানুষের জীবনে অনাহার, অভাব ছিল সে সম্পর্কে খুব বেশি ভাবি না অথবা ভাবতে চাই না। এ সম্পর্কে নানা তথ্য, উপাত্ত দিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন এবং উপসংহারে বলেছেন, “যতদিন পর্যন্ত দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে তারা জর্জরিত হবে, ততদিন পর্যন্ত বাঙ্গালীরা অতীতের ইতিহাসে এবং পরকালে সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াবে। ”(পৃ.১৩৭) ভারত এখন একটি উদীয়মান অর্থনীতি।

ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা প্রায়ই আলোচনা করে থাকি। ভারতের অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিতর্ক, গত কয়েক দশকে ভারতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন উদ্যোগ এবং নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে “ভারতীয় অর্থনীতির”উত্থান ও পতন’ রচনায়। অর্থনীতির ব্যবহারিক দিকের বাইরেও তাত্ত্বিক, দার্শনিক আলোচনা করা হয়েছে “অর্থনৈতিক মানুষ” ও মানুষ হিসাবে অর্থনীতিবিদ’ এবং ‘অর্থনীতির দর্শনের সন্ধানে’ এই দুইটি প্রবন্ধে। খুব গভীর কিন্তু সুখপাঠ্য এ রচনা দু’টি। আর, বাংলাভাষায় যারা অর্থনীতি নিয়ে লেখালেখি করতে চান তাদের জন্য বইটিতে সংযোজিত পরিভাষা কোষটি (ইংরেজি থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংরেজি) খুবই সহায়ক হবে।

আমাদের একটি সহজাত প্রবণতা আছে যে আমরা সহজেই যে হ্যাঁ বা না জবাব খুঁজি এবং সেই মানদণ্ডে আমরা সমাধান দিতে চাই। অর্থনীতি বিষয়টি আলোচনা করার জন্য হ্যাঁ অথবা না জবাবটিই যথেষ্ট নয়। এখানে সুযোগ মূল্য (অপরচুনিটি কস্ট), অন দ্য আদার হ্যান্ড এ জাতীয় বিষয়গুলো এসে যায়। তা নিয়ে খুব সহজ ও প্রাণবন্ত আলোচনা রয়েছে এর প্রতিটি প্রবন্ধে। তবে লেখক কোন একটি বিশেষ পক্ষ নেন নি।

কখনও কখনও মনে হয়েছে, তিনি বাজার অর্থনীতির সমর্থক, আবার দেখা গেছে যে বাজার অর্থনীতির সমস্যাও তার আলোচনাতে পরোক্ষভাবে এসেছে। সে কারণে এ বইটি পড়ে অর্থনীতি সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। বইটির প্রবন্ধগুলোতে রাজনৈতিক অর্থনীতির নানা বিষয় এসেছে। বিষয়ের মাঝে বৈচিত্র্যও এসেছে। সুশাসন, বন্যা সমস্যা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মানব সম্পদ উন্নয়ন, লিঙ্গ বৈষম্য এমন বিভিন্ন দিক উল্লেখ করা হলেও এই বইটির প্রকাশকালে (২০০০ সাল) অন্যতম আলোচিত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের জ্বালানি ইস্যু, তেল-গ্যাস রপ্তানি বিতর্ক নিয়ে লেখক প্রায় কিছুই বলেন নি।

এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখকের সুদক্ষ, প্রাণবন্ত, তথ্য বহুল ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন লেখা আমাদের পাঠকদের জন্যে খুবই প্রয়োজন ছিল এবং এখনও আছে। আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে জড়িত। সাধারণত অতি তাত্ত্বিক এবং গণিতের বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতি বিষয়টি সাধারণের বোধগম্য বিষয় নয় এমন করে উপস্থাপন করার একটি প্রবণতা রয়েছে। আকবর আলি খান তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইটিতে সেই প্রবণতার বিপরীতে একটি অবস্থান নিয়েছেন। তিনি প্রতিটি প্রবন্ধেই একটি তাত্ত্বিক আলোচনা রেখেছেন কিন্তু তার ভাষা অতি সরল ও সকলের জন্য বোধগম্য।

পেশাদার অর্থনীতিবিদদের মাঝে কখনও কখনও অর্থনীতি বিষয়টিকে রাজনীতির বাইরে রাখার একটি প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু অর্থনীতির সাথে রাজনীতি যে খুবই নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত তা প্রকাশ পেয়েছে এ বইটির আলোচনাতে। বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্যে অর্থনীতি বিষয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.