প্রশ্ন করেই যাব অবিরত
[১। কেউ যদি কোরানকে আল্লার বাণী বলে প্রমাণ করতে পারেন তবে আমি অবশ্যই তা মেনে নিতে রাজি আছি, আর হ্যা, প্রমাণিত একটি বিষয় কারো মেনে নেয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে না। তাই মুসলিম ধর্ম-বাদীরা কোরানের অলৌকিকত্ব প্রমাণের সব চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আমি কাউকে ব্লক করি নি, যে কেউ আমার লেখায় মন্তব্য করতে পারবেন ও মন্তব্যগুলো সরাসরি প্রকাশিত হবে।
২।
যে কেউ আমার এ লেখার বিপরীতে ইচ্ছেমত নিজস্ব যুক্তি/অভিমত দিতে পারবেন। তবে দয়া করে কেউ গালিগালাজ পূর্ণ মন্তব্য করবেন না। আমি যে গালিগালাজকে ভয় করি তা না তবে আমি মনে করি এর আসলে কোনো মানে হয় না, এবং অহেতুক তা অসুস্থ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কেউ যদি ঠিক এই মূহুর্তে নাও পারেন তবে তিনি পরবর্তীতে সময় নিয়েও এ পোস্টের জবাব দিতে পারেন। এটা হারিয়ে যাচ্ছে এমন তো নয়।
সুস্থ বিতর্কই পারে আমাদেরকে সত্যের কাছাকাছি পৌছাতে।
৩। যেহেতু এ লেখাটি একজন কোরানের অলৌকিকতায় অবিশ্বাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে তাই আপনার যদি ধর্ম-বিরোধি লেখা সহ্য না হয় তবে অবশ্যই তা নিজ দায়িত্বে পড়বেন। পরবর্তীতে কোনো অভিযোগ গ্রহণ যোগ্য হবে না।
৪।
আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি লেখাটায় এমন কোনো বাক্য ব্যবহার না করতে যা কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়। তারপরো কোনো বাক্য যদি অপ্রয়োজনীয়ভাবে/ অতিরক্ত রূঢ় মনে হয় তবে আমাকে জানাতে পারেন, চেষ্টা করব ঠিক করে দিতে।
৫। আমি মনে করি কোনো ধর্মই কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কারো যেমন অধিকার আছে একে পরম বিশ্বাস করার, ইচ্ছেমত ধর্মের গুণকীর্তন করার তেমনি আরেক জনেরো অধিকার আছে এর নিন্দা করার/খণ্ডন করার।
ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মকে আক্রমণ করা ব্যক্তি আক্রমণ নয়। ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার না থাকলে মানুষ সঠিক ধর্ম বলে কিছু থাকলে এর সন্ধান পাবে কিভাবে?]
মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান। তারা বিশ্বাস করেন এটি স্বয়ং আল্লাহ নবী মুহাম্মদের কাছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নাযিল করেছেন। প্রায় সকল মুসলমানই বিশ্বাস করেন যে কোরান অবতরণের পর থেকে তাতে আজ পর্যন্ত কোনো বিকৃতি ঘটে নাই এবং তা লওহে মাহফুজে যেমন রয়েছে ঠিক সেই অবস্থায় বর্তমানে রয়েছে – এসব বিশ্বাসের সমর্থনে কোরানে অজস্র আয়াত রয়েছে। এটা হল কোরানের অলৌকিকতায় বিশ্বাসীদের কথা।
এবার কোরানের অলৌকিকতার দাবি কতটা যৌক্তিক সে আলোচনায় আসা যাক।
কোরানের অলৌকিকতাঃ প্রমাণের দায়িত্ব কার
"Extraordinary claims require extraordinary evidence" - Dr. Carl Sagan.
ধরুন, আকমল সাহেবের কাছে একশ’টি বই আছে। এবার তিনি এর মধ্য থেকে একটি বই বের করে বললেন, ‘এই বইটি আল্লাহ দ্বারা রচিত আর বাদবাকি নিরানব্বইটি মানুষের দ্বারা রচিত’। এখন একটু ভাবুন- এর প্রত্যুত্তরে আকমল সাহেবকে কি বলা যেতে পারে। একজন যুক্তিবাদী প্রথমেই তার কাছ থেকে জানতে চাইবেন তিনি কিভাবে ওটা আল্লাহ প্রদত্ত বলে নিশ্চিত হলেন।
এটা জানতে চাইলে আকমল সাহেব উল্টো বলতে পারেন ‘আপনিই বরং প্রমাণ করুন ওটা আল্লাহ রচিত নয়’। আমরা প্রায়ই ধর্মবিশ্বাসীদের কাছ থেকে এধরণের হাস্যকর উদ্ভট কথাবার্তা শুনে থাকি। তাদের কথা হলো আমরা নাস্তিকরা যেহেতু আল্লাহতে বিশ্বাস করি না, ধর্মে বিশ্বাস করি না তাই আমাদেরকেই এগুলো অপ্রমাণ করতে হবে। কিন্তু যা প্রমাণ করা যায় নি তা তো এমনিতেই অগ্রহণযোগ্য, একে কি আলাদাভাবে অপ্রমাণ করার প্রয়োজন আছে? ধরুন, কোথাও অতি দুর্বোধ্য রহস্যময় একটা গ্রন্থ পাওয়া গেল, এখন আমরা নিশ্চয়ই একে অলৌকিক বা ঈশ্বর প্রদত্ত বলে বিশ্বাস করে ফেলব না। হ্যা, যদি কেউ একে অলৌকিক বলে দাবী করেন আর এর স্বপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেন তাহলে একে অলৌকিক বলে মেনে নিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
অর্থাৎ কেউ যদি কোনো গ্রন্থের অলৌকিকতার দাবী করেন তবে স্বাভাবিকভাবেই তা প্রমাণ করার দায়িত্ব ঐ দাবীকারকের। প্রথমেই সেটা যে অলৌকিক নয় এ ব্যাপারটা প্রমাণের দায়িত্ব অন্য কারো উপরে পড়ে না।
এবার কোরানের ক্ষেত্রে আসি। বই মানুষ লিখবে এটাই স্বাভাবিক। একজন আকমল সাহেব বা অন্য কেউ কোনো একটা গ্রন্থকে আল্লাহ প্রদত্ত বলে দাবি করলে তা অপ্রমাণের দায়িত্ব অন্য কারো উপর পড়ে না এবং তিনি যদি তার দাবি প্রমাণে ব্যর্থ হোন বা তার দেয়া প্রমাণ ভুল বলে প্রমাণিত হয় তবেই তার দাবি অগ্রহণযোগ্য – এ সহজ কথাটি বুঝার জন্য যদিও গভীর চিন্তার প্রয়োজন নেই তারপরেও ধর্মবাদীরা বরাবরই তা না বুঝার ভান করেন এবং নিজের প্রমাণের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চেপে দিয়ে নিরাপদ থাকতে চান।
আপনিই বরং প্রমাণ করুন ওটা আল্লাহ প্রদত্ত নয়- এ ধরণের অজুহাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় কেননা এতে করে যে কেউ নিজের রচিত বই বা অন্য কারো লেখা বইকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা অন্য কোনো কারণে ঈশ্বরপ্রদত্ত বলে দাবি করতে পারেন এবং তা প্রমাণ করতে না পেরে এ ধরণের ছুঁতো ধরতে পারেন এবং সবচেয়ে বড় কথা – কোনো ধর্মগ্রন্থ আল্লাহ প্রদত্ত নয় তা প্রমাণ করা যুক্তিবাদীদের দায়িত্ব নয়; যুক্তিবাদীদের দায়িত্ব হলো এ পর্যন্ত ঐ গ্রন্থকে আল্লাহ প্রেরিত বলে প্রমাণের জন্য প্রদত্ত যুক্তিগুলো খণ্ডনের চেষ্টা করা। তবে কোরানের যেহেতু বস্তুগত অস্তিত্ব আছে তাই যুক্তিবাদীদের কাছে কোরানকে আল্লাহ প্রদত্ত নয় বলে প্রমাণের পন্থা উন্মুক্ত রয়েছে।
মোট কথা, কেউ যদি কোরানকে আল্লাহর দ্বারা রচিত বলে দাবি করেন তবে-
১। এ দাবি প্রমাণ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ তারই। তাকে কোরানের সব বাক্য ও শব্দ আল্লাহ রচিত এবং কোরানের সাথে অন্য কিছুর সামান্যতম মিশ্রণও ঘটে নি বলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে।
২। যেহেতু তিনি কোরানকে আল্লাহর রচিত বলে দাবি করছেন তাই সর্বাগ্রে তাকে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে, বলা বাহুল্য এ পর্যন্ত আল্লার আস্তিত্বের স্বপক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে তার সবগুলোই খণ্ডিত হয়েছে। এ নিয়ে অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে।
৩। আল্লাহ ঠিক কোন্ প্রক্রিয়ায়, কখন, কিভাবে কোরান মানুষের কাছে পাঠালেন এবং কেন পাঠালেন, তা যে উদ্দেশ্যে পাঠালেন তা কতটা সফল হয়েছে এগুলোর উপযুক্ত ব্যাখ্যা তাকে দিতে হবে।
৪। মানুষ নবী ও রাসূল হতে পারে আর মুহাম্মদ নবী ও রাসূল ছিলেন –এ বিষয়টিও তাকে প্রমাণ করতে হবে। আরো প্রমাণ করতে হবে- মুহাম্মদ দীর্ঘ ২৩ বছর পুরো মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন এবং কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে বা বাধ্য হয়ে বা পরিস্থিতির শিকার হয়েও নিজের বা অন্য কারো রচনাকে ওহী বা প্রত্যাদেশ বলে ঘোষণা দেন নি।
৫। যেহেতু কোরান অবতীর্ণ হওয়া একটি অলৌকিক ঘটনা তাই অলৌকিক ঘটনা বাস্তবে ঘটতে পারে তা তাকে প্রমাণ করতে হবে।
এছাড়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন জিবরাইল ফেরেশতা আল্লার কাছ থেকে মুহাম্মদের কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। তাই জিবরাইলের অস্তিত্বও তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোসহ কোরানের অলৌকিকতা সম্পর্কিত সবগুলো বিষয় যতক্ষণ কোরানের অলৌকিকতার দাবিদাররা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারছেন ততক্ষণ একজন যুক্তিবাদীর কোরআনকে অলৌকিক বলে মেনে নেয়ার কোন সংগত কারণ নেই।
ওহী অবতরণ পদ্ধতি ও কিছু কথা
কোরান আল্লার বাণী? ভালো কথা, ওটা তবে মুহাম্মদের কাছে এলো কিভাবে? এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর কিভাবে কোরানের অলৌকিকতায় বিশ্বাসীরা দিতে চেয়েছেন তা আলোচনা প্রয়োজন।
কোরান নাকি পুরো ২৩ বছরে মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ(?) হয়েছে।
কিভাবে অবতীর্ণ হয়েছে তার বিচিত্র বিবরণ রয়েছে ইসলামে। এগুলো এতই উদ্ভট যে একজন যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে তা ‘ফেয়ারি টেল’ ব্যতীত আর কিছু মনে হওয়ার অবকাশ নেই। আমরা এখন কোরান নাযিলের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানব। এখানে এ, বি, এম, আব্দুল মান্নান মিয়া ও আহমদ আবুল কালামের লেখা “উচ্চ মাধ্যমিক ইসলাম শিক্ষা, দ্বিতীয় পত্র” – এ বর্ণিত বিভিন্ন প্রকার ওহী অবতরণ পদ্ধতি ও তার ব্যাখ্যা নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো-
“১। সত্য স্বপ্ন
নবী রাসূলগণের স্বপ্নও ওহী।
বিশেষ করে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর অনেক প্রত্যাদেশ বা ওহী লাভ করেছেন স্বপ্নের মাধ্যমে। এই স্বপ্নকে বলা হয় সত্য বা বাস্তব স্বপ্ন। এ এমনই স্বপ্ন যা অবাস্তব হয় না বা বিফলে যায় না। হযরত আয়েশা (রা) ইরশাদ করেন, রাসুলুল্লাহ (স) এর উপর ওহীর সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তাঁর জাগতিক পর্যায়ের স্বপ্ন দ্বারা তিনি অবহিত হতে পারেন যে যথাশীঘ্র তার উপর আল্লাহর প্রত্যক্ষ ওহী কুরআন অবতীর্ণ হবে।
রাসূলুল্লাহ (স) মাদানী জীবনে যে স্বপ্ন দেখেন তা কুরআনে এসেছে এভাবেঃ
আল্লাহ তার রাসূলের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন যে তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে……(সূরা আল ফাতহ)
হযরত ইব্রাহিম (আ) তার পুত্র ইসমাঈল (আ) কে কুরবানী করার আদেশও লাভ করেছিলেন স্বপ্নের মাধ্যমে। আরো অনেক নবী স্বপ্নের মাধ্যমে ওহী লাভ করেছেন বলে জানা যায়।
২। ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতি
ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতিতে মহানবী (স)- এর উপর ওহী নাযিল হত। ওহী নাযিল হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত হতে তাঁর কানে এ ঘন্টা ধ্বনি বাজতে থাকত।
তাঁর কাছে উপস্থিত কোন কোন সাহাবীও এ ঘন্টা ধ্বনি শুনেছেন বলে জানা যায়। হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত হারিছ ইবনে হিশাম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করেন-
হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট কিভাবে ওহী আসে? এর উত্তরে তিনি বলেন-
কখনও কখনও আমার নিকট ওহী আসে ঘন্টা ধ্বনির মত। এ প্রকার ওহী আমার খুবই কষ্টকর মনে হয়। তবুও সে (জিবরাঈল আ) যা বলে আমি তা তাৎক্ষণিক আয়ত্ত করি।
এই ঘন্টা ধ্বনি কিসের ধ্বনি সে বিষয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়।
কেউ বলেছেন, এটি আল্লাহর কথা বলার ধ্বনি। কেউ বলেছেন, এটি জিবরাঈল (আ)- এর পা বা ডানার ধ্বনি ইত্যাদি। শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ) বলেছেন, মানুষের বাহ্য ইন্দ্রীয় পার্থিব জীবন হতে পৃথক করা হলে নৈসর্গিকভাবেই উক্তরূপ ঘন্টা ধ্বনি শোনা যেতে পারে।
৩। অন্তর্লোকে ঢেলে দেওয়া পদ্ধতি
রাসুলুল্লাহ (সা)- এর ‘ইলক্বায়ি ফিল ক্বালব’ বা অন্তরে ওহী সঞ্চারণ পদ্ধতি নামেও অভিহিত করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা) এ বিষয়ে ইরশাদ করেন,
রুহুল কুদুস জিবরাঈল (আ) আমার অন্তর্লোকে ঢেলে দিয়েছেন বা সঞ্চারিত করেছেন বা ফুঁকে দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা)- এর অন্তরে তার ওহী সরাসরি সঞ্চার করেন নিজ ক্ষমতা বলে। যেভাবেই হোক রাসূল (সা) খুবই কম কসরতে এ প্রকার ওহী তার অন্তর্লোকে আপনা আপনি প্রস্তুতভাবে লাভ করে থাকেন।
৪। ফেরেশতার মানবাকৃতিতে আগমন
ফেরেশতাগণের নিজ নিজ আকৃতি রয়েছে।
হযরত জিবরাঈল নিজ আকৃতিতে প্রকাশিত হন আবার কখনও কখনও মানব আকৃতিতেও প্রকাশিত হন রাসূল (সা)এর নিকট। সহীহ হাদীস দ্বারা জানা যায় হযরত জিবরাঈল (আ) মানুষরূপে রাসূলুল্লাহ (সা) –এর নিকট এসে আল্লাহর ওহী পৌঁছে দিতেন। সিংহভাগ ক্ষেত্রে সাহাবিগণ উক্ত মানুষটি দেখতে পেতেন কিন্তু বুঝতে পারতেন যে উক্ত মানুষটি আসলে মানুষ নয় ফেরেশতা। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত দাহিয়াতুল কালবী (রা) এর আকৃতিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফেরেশতে ওহী নিয়ে আসতেন। অন্য সাহাবী বা অপরিচত লোকের আকৃতিতেও ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসতেন।
৫। নিজ আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন
আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈল (আ) –কে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছে সে আকৃতিতেও তিনি রাসূল (সা) –এর নিকট ওহী নিয়ে আসতেন বলে জানা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা) কুরআনের প্রথম ওহী যখন গারে হেরায় লাভ করেন তখন হযরত জিবরাঈল (আ) নিজ আকৃতিতে আগমন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) দুবার বা তিন বার তাঁকে তাঁর নিজ আকৃতিতে দেখেছেন বলে জানা যায় (১) একবার গারে হেরায় (২) একবার মিরাজকালে সিদরাতুল মুনতাহায় (৩) আরেক বার ওহী বন্ধের পরে পুনঃ ওহী চালুর সময়।
৬।
পর্দার অন্তরাল হতে
মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (স) –এর প্রতি তার জাগ্রতকালে পর্দার আড়াল হতে সরাসরি ওহী করেছেন। পর্দার অন্তরালে আল্লাহ কথা বলেছেন পর্দার বাইরে মুহাম্মদ (স) –এর সংগে। মিরাজ রজনীতে আল্লাহ এরূপ রাসূল (স) –এর সংগে কথা বলেছেন বলে জানা যায় এবং এ পদ্ধতিতেই তার প্রতি প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত এবং পরবর্তী পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান অবতীর্ণ ও ফরজ হয় এই মিরাজ রজনীতে।
৭। তন্দ্রাকালে ওহী লাভ
রাসুলুল্লাহ (স) যেমন জাগ্রত অবস্থায় ওহী পেয়েছেন তেমন পেয়েছেন নিদ্রিত অবস্থায়।
একটি রিওয়ায়াত হতে জানা যায় যে রাসূল (স) এ পদ্ধতিতে সাতবার ওহী পেয়েছেন।
৮। হযরত ইসরাফীল (আ) –এর মাধ্যমে ওহী লাভ
আল্লাহ তাআলা কখনও কখনও হযরত ইসরাফীল (আ) –এর মাধ্যমে রাসূল (স)-এর নিকটে ওহী পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়। খুব কমই তিনি ওহী নিয়ে এসেছেন।
ওহী অবতরণ পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন,
কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যে আল্লাহ তার সংগে বাক্যালাপ করবেন সরাসরী ওহী ব্যতীত কিংবা পর্দার অন্তরাল ব্যতীত কিংবা দূত প্রেরণ ব্যতীত অতঃপর উক্ত দূত (মানুষের নিকট) তাঁর ইঁচ্ছা মাফিক তার প্রত্যাদেশ পৌছে দিবে তার অনুমতিক্রমে।
হযরত হারিছ ইবন হিশাম (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) –এর নিকট ওহী আসার পদ্ধতি জিজ্ঞাসা করলে রাসূল (স) বলেনঃ
"কখনও আমার নিকট ওহী আসত ঘন্টা ধ্বনির মত। এটি আমার উপর অত্যন্ত কষ্টকর মনে হয়। এতে আমার ঘাম বেরিয়ে যায়। তবুও ফেরেশতা যা বলে আমি তা তাৎক্ষণিকভাবে আয়ত্ত করে লই। কখনও কখনও ফেরেশতা আগমন করে পুরুষের আকৃতিতে।
অতঃপর সে আমার সংগে বাক্যালাপ করে। সে যা বলে আমি তা তাৎক্ষণিকভাবে আয়ত্ত করে লই"।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি দেখেছি যে তাঁর (রাসূল (স)-এর) উপর ওহী আসে কঠিন শীতের দিনে, এতে তাঁর কষ্ট ও উষ্ণতাপ অনুভূত হয় আর তখন তাঁর ললাট হতে টপ টপ করে ঘাম ঝরে পড়ে। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)”
(পৃষ্টা ২৬-২৮; চতুর্থ সংস্করণঃ জুন,২০০৫; প্রকাশকঃ হাসান বুক হাউসের পক্ষে ডঃ মোহাম্মদ আবুল হাসান, ৬৫, প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০)
ওহী অবতরণের উক্ত পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। উপরের বর্ণনায় দেখলাম মুহাম্মদ স্বপ্নকেও ওহী বা প্রত্যাদেশ বলে মনে করেছেন বা চালিয়ে দিয়েছেন।
এটি অবশ্য খুব নিরাপদ একটা পদ্ধতি – কেউ কোন প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। কেউ যদি নিজে কিছু রচনা করে তা স্বপ্নের মাধ্যমে ওহী হিসেবে পেয়েছেন বলে দাবী করেন তবে তা প্রমাণিত হবে কিভাবে? (আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা কবিরাজ যারা স্বপ্নে পাওয়া গাছ-গাছড়ার সাহায্যে চিকিৎসা করেন তাদের কাছে গেলে হয়ত বিষয়টি বোধগম্য হয়ে উঠত!)
ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। যারা মানসিকভাবে অসুস্থ, মৃগী রোগী বা হিস্টিরিয়াগ্রস্থ তাদের এরকম হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তখনকার সময়ে মৃগী রোগকে পবিত্র বলে মনে করা হত। তাই মুহাম্মদ যদি মৃগী রোগ বা এ ধরণের কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে তা তাকে নবী হওয়ার ক্ষেত্রে এবং কোরানকে অলৌকিক বলে প্রচার করতে সহায়ক হয়েছিল।
আরো কিছু বিষয় মুহাম্মদের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে, যেমন- সিনা সাকের ঘটনা- ফেরেশতারা তার বুকের রক্ত যা শয়তানি প্রণোদনার উৎস তা নাকি বুক চিরে কয়েকবার পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েছিলেন(বলাবাহুল্য ধারণাটি হাস্যকর, সিনাসাক করে পাপচিন্তা দূর করা অসম্ভব, এর জন্য প্রয়োজন ব্রেন সাক!!), কথিত ওহী নাযিলের সময়ে অস্বাভাবিক আচরণ- অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া তারপর সবাই তাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিত ইত্যাদি। এছাড়া ওহী নাযিল পদ্ধতিটি যদি আল্লাহ নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে তাতে মুহাম্মদের কষ্ট বা বিভিন্ন ধরণের বিপত্তি হওয়ার কারণ কি? দেখেন ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতিটি তার কাছে নাকি খুব কষ্টকর ছিল। কোরান যেহেতু বরকতময় এবং প্রশান্তিদায়ক তাহলে ওটা নাযিল হলে মুহাম্মদের আরাম অনুভব হওয়াই যৌক্তিক ছিল। শোনা যায়, কোরান যদি পাহাড়ে নাযিল হত তবে তা নাকি ধ্বংস হয়ে যেত আর কোরান নাযিল হওয়ার সময় মুহাম্মদ উটের উপরে থাকলে তা নাকি ভারের আধিক্যে অস্থির হয়ে উঠত। কোন গ্রন্থকে মহিমান্বিত করতে এত বিচিত্র প্রচার আসলেই অনন্য।
উপরের বর্ণনায় ঘণ্টা ধ্বনিটি কিসের তার যে বিবরণ বিভিন্ন বুজুর্গ দিয়েছেন তা বড়ই মনোরম। কোরান অবতরণের ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতিটি শুরু থেকেই অমুসলিমদের হাসির খোরাক যোগিয়ে আসছে।
অন্তর্লোকে ঢেলে দেয়া পদ্ধতিটি আরো চমৎকার। কারো যদি হঠাৎ কিছু মনে আসে আর তারপর তিনি মনে করেন তা আল্লাহর ওহী এবং তা পরবর্তীতে কাব্যে রূপ দিয়ে উপস্থাপন করে একে ওহী বলে দাবী করেন তবে তা নিয়ে কিছু বলার নেই। এ পদ্ধতিটিও পরম সুবিধাজনক।
কারণ সত্যি সত্যি ওহী নাযিল হয়েছে কি না তা প্রমাণ করার কোনো ঝামেলা আর রইল না।
আরেকটি উদ্ভট পদ্ধতি হল ‘ফেরেশতার মানবাকৃতিতে আগমন’। ফেরেশতারা মানবাকৃতি ধারণ করে নাকি মুহাম্মদকে বিভিন্ন মেসেজ দিতেন। আমাদেরকে দেখতে হবে এ মানুষগুলো কারা ছিল। একজন সম্পর্কে জানলাম যার নাম ছিল দাহিয়াতুল কালবী।
লোকটির সাথে মুহাম্মদের কি বিশেষ সম্পর্ক ছিল? ফেরেশতার মানবাকৃতিতে আসার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল আর মাঝে মাঝে দাহিয়ান কালবী এর রূপ ধারণের কারণ কি ছিল তা কিছুটা ভাবলেই আঁচ করা সম্ভব।
এবার নিজ আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন। ফেরেশতাদের নাকি নিজস্ব আকৃতি রয়েছে যদিও তারা যেকোন কিছুর আকৃতি ধারণ করতে পারেন। ফেরেশতাদের নিজস্ব আকৃতির রকমারি বর্ণনা শুনতে পাওয়া যায়। কারো কারো আকার নাকি এত বড় যে পৃথিবীর সব জল ঢেলে দিলেও একফোটা জল দেহ থেকে বেয়ে পড়বে না, কারো কারো রয়েছে হাজার হাজার ডানা, কারো আবার প্রতিটি পশমেই মাথা, হাত, পা সংযুক্ত ইত্যাদি।
ফেরেশতারা ডানা দিয়ে কি করে তা বুঝা বেশ মুশকিল, কারণ বায়ুমণ্ডলের পরেই তো আর বাতাস নেই। বলাবাহুল্য ইসলামে এত অতি উদ্ভট ‘ফেরেশতা’ ধারণাটি কিভাবে আসল তা জানতে খুব একটা গবেষণা প্রয়োজন নেই; জ্বিন, ভুত, ফেরেশতা – এগুলোর ধারণা আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে আরবে বহুল প্রচলিত ছিল।
জিবরাইলকে রেখে ইসরাফিল ওহী নিয়ে কেন আসত তা বুঝা দুষ্কর। ইসরাফিল তার শিঙ্গার ডিউটি রেখে ওহী নিয়ে আসলেন –বিষয়টি কি অস্বাভাবিক নয়?
পর্দার অন্তরাল হতে কেনো ওহী নাযিল করতে হয় ওটাও বোধগম্য নয়। মুহাম্মদের সম্মুখে আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করলে সমস্যা কি ছিল? অনেকে হয়ত বলবেন মুহাম্মদ তা সহ্য করতে পারবেন না।
কিন্তু কথা হলো –আল্লাহ তো ইচ্ছে করলেই সে ক্ষমতা মুহাম্মদকে দিতে পারতেন। আরেকটি ব্যাপার ঠিক পরিষ্কার হলো না- এ পর্দাটি কিসের পর্দা? আর পর্দার অন্তরাল হতে আল্লাহ যদি ওহী পাঠাতে পারেন তবে জিবরাইলকে দিয়ে পাঠালেন কেন? আল্লাহ যদি সব জায়গায় আছেন তবে মুহাম্মদকে কেন মেরাজে রজনীতে উর্ধ্বলোকে নিয়ে গিয়ে আল্লাহ পর্দার অন্তরাল হতে তার সাথে আলাপ করলেন তা বুঝা একদম অসাধ্য ব্যাপার!(মেরাজ কিন্তু রাতের বেলায়ই হয়, দিনের বেলায় যদি হয় আর মানুষ দেখে ফেলে তবে তার আর মাহাত্ম্য থাকল কোথায়?)
তন্দ্রাকালে ওহী লাভ? মাঝে মাঝে জটিল চিন্তায় আচ্ছন্ন হলে যদি তন্দ্রা ভাব আসে আর তখন যদি কিছু নতুন আইডিয়া মাথায় আসে তাহলে এগুলোকে কি ওহী বলতে হবে?
আরো বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় এসে ভর করে। যেমন- আল্লাহ সরাসরি বা জিবরাইলের মাধ্যমে নবী-রাসূলদের সাথে যেমন যোগাযোগ করতেন সেরকমভাবে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করলে সমস্যা কোথায়? অনেকে বলবেন, তাতে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা ব্যাহত হবে। আমরা বলব, তাতে বরং মানুষের পরীক্ষা নেয়া বাস্তবসম্মত হত কেননা এতে করে মানুষ আল্লার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ধর্মসংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর সমাধান পেত ও আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার একটা উপায় খূঁজে পেত এবং এতে করে ধর্ম না মানার জন্য পরকালের অবর্ণনীয় শাস্তির কিছুটা হলেও যৌক্তিকতা থাকত।
(ওহী অবতরণ সম্পর্কিত বেশ কিছু হাদিস পাবেন প্রধান হাদিসগ্রন্থ বোখারিতে; লিংক-http://www.usc.edu/schools/college/crcc/engagement/resources/texts/muslim/hadith/bukhari/
বোখারি এর ওহী অবতরণ সম্পর্কিত হাদিসগুলোঃ
Volume 1, Book 1, Number 2; Volume 1, Book 1, Number 3; Volume 1, Book 1, Number 4; Volume 4, Book 52, Number 95; Volume 4, Book 54, Number 438; Volume 4, Book 54, Number 458; Volume 4, Book 54, Number 461; Volume 5, Book 59, Number 618; Volume 5, Book 59, Number 659; Volume 6, Book 60, Number 447; Volume 6, Book 60, Number 448; Volume 6, Book 60, Number 478; Volume 6, Book 60, Number 481; Volume 6, Book 61, Number 508;
এগুলো ভিন্ন ওহী অবতরণ সম্পর্কিত আরো অনেক হাদীস বোখারি সহ সিহাহ সিত্তাহ এর অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে পাওয়া যাবে।
অন্যান্য হাদিসগ্রন্থ পাবেন- Click This Link
বোখারি এর বাংলা অনুবাদ –
http://www.banglakitab.com/BukhariShareef.htm]
লেখাটি পূর্বে মুক্ত-মনায় প্রকাশিত।
আমার আরো কিছু লেখার লিংক দিলাম –
ঈশ্বর ও ধর্মঃ আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন?
ঈশ্বরবাদ খণ্ডন - ড্যান বার্কার
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও রায়হানের তিন যুক্তি
কোরানের ‘মিরাকল ১৯’-এর উনিশ-বিশ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।