আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিপাইমুখ বাধ: আরো একধাপ এগুলো ভারত, সরকার নিরব



গত ২৮ এপ্রিল ২০১০ তারিখে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি স্থাপনের জন্য ভারতের ন্যাশানাল হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (এনএইচপিসি), সাটলুজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড(এসজেভিএন) এবং মনিপুর সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত সরকার বিতর্কিত টিপাইমুখ বাধ নির্মানে আরো একধাপ এগিয়ে গেল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশাল হিমালয় এবং বরাক অববাহিকা অঞ্চলের প্রকৃতির উপর পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে উদগ্রীব ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির মুনাফা-নজর দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের অমলসিদ পয়েন্ট থেকে ২০০ কিমি দূরে মণিপুরের তুইভাই এবং বরাকনদীর সংগম স্থলের ৫০০ মিটার ভাটিতে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মানের মাধ্যমে আসামের কাছার অঞ্চলের বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং ১৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি সেই বৃহৎ পরিকল্পনারই অংশ। টিপাইমুখ বাধের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কিংবা সেচ প্রদান ইত্যাদি ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরে রয়েছে বিশাল ও সম্পদশালী কিন্তু স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে অস্থিতিশীল উত্তরাঞ্চলের জলজ শক্তি, গ্যাস, ইউরোনিয়াম ইত্যাদির উপরে দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একই সাথে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বাসনা।

এনএইচপিসি প্রচারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিতে এনএইচপিসি, এসজেভিএন এবং মনিপুর সরকারের শেয়ার নির্ধারিত হয় য়থাক্রমে ৬৯%, ২৬% এবং ৫%। উক্ত অনুষ্ঠানে এনএইচপিসি’র পক্ষ থেকে শ্রী এস কে গার্গ, এসজেভিএন এর পক্ষ থেকে শ্রী এস কে শর্মা এবং মনিপুর সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ সচিব শ্রী এল পি গোনমেই উপস্থিত ছিলেন। ছবি: সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর এস কে গার্গ(মাঝে), শ্রী এস কে শর্মা(সর্ব ডানে), শ্রী এল পি গোনমেই(সর্ব বামে) (সূত্র: এনএইচপিসি) অথচ এর আগে গত জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর প্রাক্কালে ভারত বাংলাদেশ যৌথ ইসতেহারের আর্টিক্যাল তিরিশ এ বলা হয়েছিল ”ভারতীয় প্রধামন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ার আশ্বাস পূনর্ব্যক্ত করেছেন। ” এছাড়াও ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ আশ্বাস দিয়েছিলেন: ”বাংলাদেশ ও মণিপুরবাসীদের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার টিপাইমুখ বাধের বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখবে। ” বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হলেও এই ধরণের প্রতিশ্র“তি দান ও ভঙ্গ করা ভারতের জন্য নতুন নয়।

১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে এই ১০ দিনের জন্য ৩১১ কিউমেক থেকে ৪৫৩ কিউমেক পানি পরীক্ষা মূলক ভাবে প্রত্যাহারের কথা বলে বাস্তবে ১১৩৩ কিউমেক পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করে এবং গঙ্গা থেকে এভাবে পানি প্রত্যাহার সেই যে শুরু হয়েছে এখনও তা চলছে। বাস্তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে যৌথভাবে বয়ে যাওয়া ৫৪ টি নদীর মধ্যে ৪৮ টির উপরই বিভিন্ন ভাবে একতরফা হস্তক্ষেপ করে চলেছে ভারত। অবশেষে এই সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত সরকার টিপাইমুখ বাধের ব্যাপারেও তার ”প্রতিশ্র“তি রক্ষার” নমুনা প্রদর্শন করল। কিন্তু এই খবরে মণিপুর ভিত্তিক সংগঠন অ্যাকশান কমিটি এগেইনস্ট টিপাইমুখ ড্যাম(এসিটিআইপি) সহ মনিপুর মিজোরামের বিভিন্ন সংগঠন এই সমঝোতাকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়া প্রতিবাদ করলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোন প্রতিবাদ জানানো হয় নি। বাংলাদেশ সরকার যে এই বিষয়টি জানে না এরকম নয়।

কারণ ২৮ এপ্রিলের সম্ভাব্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের খবর আগেই প্রকাশিত হয়েগিয়েছিল। ফলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কমিটি অন পিপুলস এন্ড এনভাইরনমেন্ট(কোপ) এর আয়োজনে বাঙালি, মনিপুরী, নাগা, খাসিয়া সহ দক্ষিণ আসামের কয়েক হাজার অধিবাসী আসামের সিলাচর জেলার ডিসি অফিসের সামনে বিক্ষোভ করে এবং তার পৃথক পৃথক ভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা দেবী সিং পাতিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ, আসামের মুখ্য মন্ত্রী তরুণ গোগয় বরাবর স্মারক লিপি পেশ করে। গত ১৩ ই এপ্রিল এই খবর আসাম টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশী হাইকমিশনার জনাব তারিক ই করিম টিপাইমুখ বাধ রিভিউ করার নামে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে তিন দিনের সফরে গমন করেন। ফলে হাইকমিশনারের এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিষয়টি না জানার কথা নয়।

কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে হাইকমিশনার এবং বাংলাদেশ সরকার মণিপুর রাজ্য সরকার এবং ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে বাংলাদেশের মতামত ছাড়া টিপাইমুখ বাধ নির্মাণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ না করে নিরবতা পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ফলে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যেখানে ১০ সদস্যের বাংলাদেশী সংসদীয় বিশেষজ্ঞ দল গত বছরের জুলাইয়ে টিপাইমুখ বাধ পরিদর্শন করে এসেছে সেখানে এ বিষয়ে একজন অবিশেষজ্ঞ হাইকমিশনার তারিক ই করিম এর কেন হঠাৎ সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সাত দিন আগে টিপাইমুখ বাধ রিভিউ করার দরকার পড়ল, নাকি তাকে পাঠানো হয়েছিল এই সমঝোতা স্মারকের ব্যাপারে সম্মতি দিয়ে এর বৈধতা প্রতিষ্ঠতার জন্য! অথচ বরাক নদীর উপর এই টিপাইমুখ বাধ সময় মতো প্রতিরোধ করা না গেলে তা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র, গাছপালা-বনভূমি, নদীর উপর নির্ভরশীল দুপারের মানুষের জীবন-জীবিকা ইত্যাদির উপর ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া তৈরী করবে। বরাক নদী সিলেটের অমলসিদ পয়েন্টের কাছে দুভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মোট জলপ্রবাহের উৎসের শতকরা ৯ ভাগ জল আসে এই নদী দিয়ে। টিপাইমুখ বাধের মাধ্যমে এই জলপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেলে বরাক নদী থেকে অমলসিদ পয়েন্টে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর দিকে পানি প্রবাহ জুন মাসে ১০%, জুলাই মাসে ২৩%, আগষ্ট মাসে ১৬% এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৫% কমে যাবে।

এ অঞ্চলের প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরণ, মৌসুম এবং প্লাবিত হওয়ার পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্ষা মৌসুমে সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুস্ক করার ফলে কমপক্ষে ৭ টি জেলা- সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাম্মনবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার ধান উতপাদন ব্যহত হবে- যে জেলাগুলোতে দেশের উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকাতেই প্লাবনভূমির পরিমাণ কমে যাবে যথাক্রমে ৩০,১২৩ হেক্টর(২৬%) এবং ৫,২২০ হেক্টর( ১১%)। আবার ভারতের কথা মত শুকনো মৌসুমে অমলসিদ পয়েন্টে ১২১% পানি বাড়বে। আর তার ফলে হাওর অঞ্চলের পরিবেশ ও জীবিকার উপর ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া তৈরী হবে।

বছরে বেশির ভাগ সময় পানির নীচে থাকা ২৫০০০ বর্গকিলোমিটারের হাওর অঞ্চলের উপর কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি লোকের জীবিকা নির্ভরশীল। এ অঞ্চলের লোকজন জীবিকার জন্য মূলত মাছ ধরে এবং শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজ করে। শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজ বলতে হাওর অঞ্চলে বোরো ধান চাষ। হাওর অঞ্চল ছাড়া এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় তেমন কোন ধান চাষ করা যায় না। যেকারণে আশুগঞ্জ, ভৈরব এবং অন্যান্য অঞ্চলের চাল-কলগুলো ধানের জন্য এ অঞ্চলের উপর নির্ভরশীল।

শুকনো মৌসুমে যখন হাওরের পানি কমে যায় তখন তারা বোর আবাদ করে আর বর্ষা আসার আগেই সে ফসল ঘরে তোলে। বর্ষায় পলি জমে উর্বর হাওরের বুকে তখন সহজেই বোরর বাম্পার ফলন ঘটে। এখন টিপাইমুখ বাধের ফলে শুকনো মৌসুমেও যদি ভারতের "বদান্যতায়" হাওর অঞ্চল পানিতে পূর্ণ থাকে তাহলে কৃষক আগের মত আর বোর ধান আবাদ করতে পারবে না। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের একেবারে অক্ষ বা অ্যাক্সিসটিই অবস্থিত হলো বহুল পরিচিত তাইথু ফল্টের উপর অবস্থিত যা সম্ভাব্য ক্রিয়াশীল একটি ফল্ট এবং ভবিষ্যতের যে কোন ভূমিকম্পের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ভারত এবং বার্মার টেকটোনিক পে−ট এর সংঘর্ষের জন্য এলাকাটি দুনিয়ার অন্যতম একটি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা।

কাজেই এরকম একটি এলাকায় ১৬৮.২ মিটার উচতার একটি জলাধার নির্মাণ করা মানে বাংলাদেশ ও ভারতের পুরো এলাকার জন্য সেধে ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং তার ফলে বাধ ভাঙার বিপদ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু না। আর বাধ ভেঙে গেলে ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে বাধের পানি মোটামুটি ৫ মিটার উচতা নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হবে এবং ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে পানি তার সর্বোচ্চ উচতা ২৫ মিটারের পৌছাবে যা প্লাবনভূমির উচতার চেয়ে ৮ মিটার বেশী উচু, ফলে প্লাবনভূমিকে ৮ মিটার পানির নীচে তলিয়ে রাখবে ১০ দিন বা তারচেয়েও বেশী সময় ধরে! কাজেই এসমস্ত বিপদ বিবেচনা করে বাংলাদেশের উচিত ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তিতে উল্লেখিত “উভয় দেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানির অংশীদ্বারিত্ব পারস্পরিক সমোঝতার মাধ্যমে করা”র প্রতিজ্ঞা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন যেমন হেলসেংকি রুল(লন্ডন, আন্তর্জাতিক আইন সংস্থা,১৯৬৭) কিংবা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদী ব্যাবহারের কনভেনশন(১৯৯৭) ইত্যাদির আওতায় টিপাইমুখ বাধের ব্যাপারে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবাদ করা এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়া। অথচ বাংলাদেশের নতজানু শাসক শ্রেণীর সেদিকে কোন নজর তো নেই-ই বরং বাংলাদেশের বন্দর, স্থল ও নৌ-ট্রানজিট এর চুক্তি থেকে শুরু করে একের পর এক বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক দ্বাসত্ব মূলক বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.