আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমানবিক

Let the wind blow out the candles

ধুম করে ক্লাসের দরজাটা খুলে মার্কামারা চেহারাটা এগিয়ে ছেলেটা বলল, এক্সকিউজ মি? অন্য আর দশটা ক্লাসের মত এই ক্লাসটাও গতানুগতিক লেকচার ক্লাস হলে হয়তো ঘটনাটা একটু আকর্ষণীয় হতে পারতো, কিন্তু কেউ ঘুরেও তাকালো না রেজরের দিকে। কারণ দু'টি, প্রথম কারণটা হল, সবাই নিজেদের কাগজ গুছাতে ব্যস্ত, দীর্ঘ দেড় বছরের টেকনিক্যাল রিসার্চের আজকে ফান্ডিং ডে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মন:পুত না হলে গবেষণার জন্য পুরো বরাদ্দ বাতিল হবে আজকে আর মোটামোটি ৬০% গ্রুপেরই ফান্ড এই দিনেই বাতিল হয়! সবাই তাই কমবেশি চিন্তিত, শেষ মুহূর্তে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিচ্ছে, তাই রেজরের দিকে কেউ ফিরে তাকালো না। দ্বিতীয় কারণটা হল, রেজর অতিরিক্ত রকম প্রতিভাবান এবং প্রতিভার উচ্চমূল্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে রেজর কার্পণ্য করে না। সাধারণ ছেলেমেয়েদের সাথে তার দূরত্বটা তৈরি হয়েছে এভাবেই। রেজর হালকা স্বরে শিষ দিতে দিতে বান্ধবী জিনির পাশে গিয়ে বসে পড়লো।

জিনি রেজরের ঠিক উল্টো ব্যক্তিত্ব, কিভাবে যে এ দুজনের মিল হল সেটা একটা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। ছেলেপেলেরা অবশ্য বলে বেড়ায় জিনি'র সৌন্দর্য আর রেজরের মস্তিষ্ক - এ দুটোই তাদের সম্পর্কের জ্বালানি। আর দশজনের মত জিনি'র চেহারায় দুশ্চিন্তার ছায়া ছিলো না, কারণ রেজর কখনো কিছুতে বিফল হয়নি, কাজেই আজও যে সে রেকর্ড পরিমাণ ফান্ডিং পেয়ে দিনশেষের লুজারদের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে গাড়ি হাকিয়ে জিনি'কে নিয়ে দীর্ঘভ্রমণে বেড়িয়ে পড়বে, এটা মোটামোটি ধ্রুবসত্য। জিনি রেজরের দিকে তাকিয়ে বললো, রেজর, দোহাই লাগে স্রষ্টার, এই রিসার্চ নিয়ে তুমি আর এগুবে না! আমার ভালো লাগছে না বিষয়টা মোটেই, দোহাই লাগে তোমার! রেজর মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে জিনি'র চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, জিনি তুমি সারাজীবন বোকামীই করে গেলে! শুধু দোয়া কর আজ যাতে বুড়ো হাবড়া প্রফেসর গুলো ফান্ডিং কমিটিতে না থাকে, ওরা সবসময়ই কোনো না কোন ক্যাচাল বাধিয়ে রাখে। বুড়োগুলোকে কেন যে ভার্সিটি থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়না এটা মাথায় ঢুকে না আমার।

জিনি রেজরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে চাইছিলো, যেন প্রবীন প্রফেসরদের একটা দল আজ ফান্ডিং কমিটিতে থাকে। পরমূহুর্তেই সে সজাগ হল, প্রাচীন হলরুমটায় তাদের ডাক পড়েছে। ২ আরামদায়ক চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেও রেজর ভেতরে ভেতরে বিরক্তিতে জ্বলে যাচ্ছিল। বুড়ো হাবড়া প্রফেসর আর প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ একাডেমীর সদস্যদের প্যানেলটাই তার কপালে পড়েছে।

সবার মাঝে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক লোকটি রেজরের পেপারগুলো সামনে বাড়িয়ে বললো, তার মানে তুমি প্রজেক্টের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশান্বিত? গলা খাকড়ে রেজর বলল, জ্বি, জনাব। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, কারণ গবেষণার ফলাফল খুবই উচ্চমাত্রার ম্যামেলদের ওপর পজেটিভ, আর ফান্ডিং পেলে সামনের সিজনের আগেই স্যাম্পল ট্যাবলেটস তৈরি করে ফেলা সম্ভবপর হবে। খোচাখোচা দাড়িওয়ালা লোকটা গাল চুলকে বললো, তুমি বলছো তোমার আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীর খাদ্য সমস্যা দূরীভুত হবে। কিন্তু আমার তো মনে হয় সমস্যা বাড়বে আরো। রেজর গলা নরম করে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কিরকম? মধ্যবয়স্ক লোকটি বললো, কেন সমস্যা হবে না তুমিই বল না! রেজর গলা খাকড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো, আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর সব সমস্যার অন্যতম মূল সমস্যাটি হল খাদ্যসমস্যা।

খাবারের উচ্চমূল্য আর পুষ্টিহীনতাই গরীব দেশগুলোর সব সমস্যার মূলে দায়ী। তাই আমরা যদি এই সমস্যাটির সমাধান করি, তাহলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে অনেক। এই রিসার্চের ওপর বেইস করেই আমি গবেষণা শুরু করেছি, খাদ্যদ্রব্যের সাথে মানব রুচি, স্বাদ এর সম্পর্ক আর এর জন্য দায়ী হরমোনসহ জৈব রাসায়নিক ব্যাপারগুলো নিয়ে। পুষ্টিমান সম্মত ক্যাপসুল অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে, যা গ্রহণ করলে মানব পুষ্টির মোটামোটি সকল চাহিদা মেটানো যায়। তবে সেই প্রজেক্ট সফল হয়নি, কারণ ক্ষুধার উদ্ব্রেক আর মানুষের স্বাদপ্রীতি।

আমাদের গবেষণার মাধ্যেম আমরা এই সমস্যাগুলোর সফল সমাধানে আসতে সক্ষম হয়েছি। চোখ কপালে তুলে বৃদ্ধ বিজ্ঞানীটি প্রশ্ন করলো, অর্থাৎ তোমার ক্যাপসুল খেলে মানুষের আর ক্ষুধা লাগবে না বা যেকোন স্বাদের অনুভূতি দেওয়া যাবে- ব্যাপারটা এরকম? রেজর হেসে বললো, অনেকটা এরকমই। পুষ্টিবর্ধক ক্যাপসুল খেয়েই যেখানে দেহের সবরকম চাহিদা মেটানো যায়, সুস্বাদু খাবার খাওয়াটা সেখানে অবান্তর, বিশেষ করে যখন আমরা গরীব জনগোষ্ঠীর কথা বলছি। আমরা ক্ষুধার উদ্ব্রেকের অনুভূতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি, পুষ্টিবর্ধক ক্যাপসুলের সাথে এই পোশন যোগ করে দিয়ে আমরা মানুষের ক্ষুধার অনুভূতি বাতিল করে দিতে পারি! খাবারদাবারের সমস্যার সমাধানটাও হয়ে যাবে এতে। কিন্তু, কিন্তু, - মধ্যবয়স্ক লোকটি রেজরকে থামিয়ে দিয়ে বললো, পুরো পৃথিবীর চালিকাশক্তির বড় একটা অংশ এই ফুডচেইন আর শিল্প।

তুমি পুরো ফুড ইন্ডাস্ট্রিটাই বাতিল করে দিতে চাইছো, পৃথিবীর হর্তাকর্তারা এটা কখনোই মেনে নেবে না। রেজর হেসে বললো, স্যার এ বিষয়টা আমিও ভেবেছি। এজন্য সমাধানও আছে। হাতের এক্স-কেইসটা খুলে একটা ত্রিমাত্রিক অবয়ব ছড়িয়ে দিয়ে রেজর বলতে লাগলো, আমার প্ল্যানটা দেখুন, ফুড ইন্ডাস্ট্রি থেমে গেলে পুরো মানবজীবনই অর্থহীন হয়ে যাবে। চিন্তা করেন তো, পৃথিবীতে মানুষের চাহিদা কি? যারা গরীব - তাদের চাহিদা টিকে থাকা, ভালো বিনোদন, চিকিৎসা সেবা এসব।

আর যারা ধনী, তারা কিন্তু এসব আগে থেকেই পেয়ে আসছে, তাই তাদের দরকার আরো অনেক অনেক বেশি বিনোদন। ফুড ইন্ডাস্ট্রি যার মাঝে একটা, খাবার দাবারের বৈচিত্র্য না থাকলে এদের জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য থাকবে না। এজন্য, আমার প্রস্তাবনা অনুসারে, আমাদের ক্যাপসুল শুধু তৃতীয় শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মাঝেই বিতরণ করা হবে। এতে যেটা হবে, এদের আর খাদ্যচাহিদা থাকবে না, তাই এদের জীবনের প্রধান সমস্যা দূর হয়ে গেল। এখন এদের চাহিদা হবে ভালো মানের বিনোদন, বস্ত্র, চিকিৎসাসেবা এইসব, এসবের লক্ষ্যে এদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে।

ফসল উৎপাদন করবে এরাই, আরো ভালো লাইফস্টাইলের জন্যই এরা উৎপাদন চালিয়ে যাবে। আর যারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, তাদেরও সমস্যা হবে না, কারণ খাবারের উৎপাদন তো চলছেই! সবাই চুপ করে রইলো অনেকক্ষণ। রেজর মনে মনে ভাবলো, কেল্লাফতে! বিজ্ঞানীরা তাকে থামানোর মত যুক্তির চিন্তা করছেন এখন। হিসেব করে রেজর বলে ফেললো, স্যার, আমার মাথায় আরো একটা পরিকল্পনা আছে, যেটা কর্পোরেট ফুড ইন্ডাস্ট্রি লুফে নেবে যে কারণে আমাদের গবেষনা ব্যর্থ হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই! সবাই রেজরের দিকে তীব্রভাবে তাকালো চশমার ফাক দিয়ে। চশমা বস্তুটার প্রচলন কয়েক যুগ আগে উঠে গেলেও ফ্যাশনের অংশ হিসেবে এখনো বিজ্ঞানীরা অর্ধচন্দ্রাকৃতিরর গ্লাস ব্যবহার করেন।

মধ্যবয়স্ক লোকটা জিনি'র কাছ থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে বললো, কিরকম প্ল্যান? রেজর গলা খাকড়ে বললো, ফুড ইন্ডাস্ট্রি আমাদের প্রজেক্টের অনিশ্চয়তাগুলো নিয়ে সমস্যা তৈরি করতে পারে, এজন্য আমরা পুরো সিস্টেমের বিতরণ নিয়ে নতুন একটা আইডিয়া পরিকল্পনা আছে। তৃতীয় শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর ক্ষুধার উদ্ব্রেক আমরা নিষ্ক্রিয় করতে পারি ড্রাগসের মাধ্যমে। এতে করে খাবারের প্রতি মানুষের অধিকার উচ্চমূল্য হবে। প্যাকেজ হিসেবে আমরা আবার মানুষের ক্ষুধাবর্ধক ড্রাগস তৈরি করতে পারি, যেটা বাজারে পাওয়া যাবে খুবই উচ্চমূল্যে! তাই পর্যায়ক্রমে এই তৃতীয় আর দ্বিতীয় শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর জীবনের পরম লক্ষ্য হবে হারানো ক্ষুধার অনুভূতি আবার ফিরে পাওয়া! কর্পোরেট আর ইন্ডাস্ট্রিগুলো এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে, কাজেই তাদের ক্ষতির কোন সম্ভাবনা তো নেই, বরং তৈরি হবে নতুন মার্কেট ধরার সম্ভাবনা। রেজর আস্তে আস্তে বললো, আমি কি প্রজেক্টের জন্য পর্যাপ্ত ফান্ডিং আশা করতে পারি? সবার মাঝের চেয়ারটায় বসা বিজ্ঞানীটি চুপ করে থেকে বললো, তুমি এখন যাও, আমরা বিবেচনা করে দেখবো।

৩ রেজর বাইরে এসেই লাফ দিলো একটা। জিনি হেসে বললো, এত খুশি কোথায় রাখবে? মেটাক্যাফেতে গিয়ে ভালো দেখে এয়ারটাইট বোতল কিনে ওতে ভরে রাখো! রেজর খুশির চোটে জিনিকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পকেটে রাখা লোকাল কমিউনিকেশন কার্ডটা কেপে ওঠায় বিরক্ত হয়ে ওটা বের করলো। কার্ডটা দেখে ওর চোখমুখ আরো কুচকে গেল, জিনি জিজ্ঞেস করলো, কার মেসেজ? রেজর বিরক্ত ভাবে কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে বললো, একাডেমিক কাউন্সিলারের। ভাবতে পারো জিনি, কোন বিষয়ে খারাপ করার জন্য কাউন্সিলারের রুমে এই রেজরের ডাক পড়েছে! চিন্তা করতে পারো জিনি, চিন্তা করতে পারো? বিরক্তির শেষ সীমায় পৌছে রেজর কন্ঠস্বর নাটকীয় হয়ে গিয়েছিল যেন। জিনি মুখ টিপে হেসে বললো, চিন্তা করতে পারবো না কেন! হিউম্যানিটিজে আবারো খারাপ করেছ, এইজন্য কাউন্সিলার ডেকেছে।

রেজর একটা খারাপ গালি দিয়ে বললো, এইসব হিউম্যানিটিজ বিষয়গুলো যে কোন দু:খে আমাদের পড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা ওয়েজার দিয়ে হিউম্যানিটিজ ডিপার্টমেন্ট টা উড়িয়ে দেই। জিনি রেজরের হাত ধরে বললো, মুড নষ্ট করো না। তোমার রিসার্চের টপিকটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি, তবে আমার মনমেজাজও ভালো এখন অনেকটা। কেন জানি মন বলছে, সামনের দিনগুলো খুব ভালো কাটবে।

হাত ধরে ওরা পাশাপাশি হাটতে লাগলো মেটাক্যাফের দিকে। শেষকথা জিনির মন মিথ্যে বলে নি। হিউম্যানিটিজে অকৃতকার্য হওয়া এবং পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টের সাথে ছাত্রসুলভ আচরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রেজরের পুরো একাডেমিক সেশনই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাতিল ঘোষণা করেছে, রেজরের রিসার্চের ফান্ডিং ও বাতিল করা হয়েছে একই সাথে। _______________________________________ অনান্য কল্পগল্প

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।