হঠাৎ শুন্যতা ...................
ঘরে জানালার কাছাকাছি একটা যায়গাতে রাখলেন। তার বসার ঘরের সবুজ কোন টায় দিব্বি অলঙ্কারের মত শোভা দিতে লাগলো বনসাই টা।
রাহেলা বেগমের এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটা বিয়ে হয়ে দেশের বাইরে থাকে। ছেলেটারও বিয়ে দিয়েছেন।
ছেলে তাদের সাথেই থাকে। বাবার ব্যবসা দেখে। পুত্রবধূ একটা চাকুরী করে। সে আধুনিক মন মানুষিকটার। নিজে স্বাবলম্বী হতে চায়।
কিন্তু সংসারের বিষয়ে কিছুটা উদাসীন মনে হয়। তার কিছু বিষয়ে রাহেলা বেগমের খটকা লাগলেও কিছু বলেন না। ছেলে-বউ নিজেরা ভালো থাকলেই হল। তার স্বামী বেশ রাশভারী মানুষ। তিনি তার জগত নিয়েই থাকেন।
পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুধু মাত্র মতামত দেন এবং সেটাই বাস্তবায়িত করেন।
রাহেলা বেগম অপেক্ষা করছেন। বাড়ীর সকলের ফিরে আসার জন্য। বনসাই আবিষ্কারের উত্তেজনা যেন তিনি আর চেপে রাখতে পারছেন না। সকলের প্রথমে ফিরলেন স্বামী।
রাহেলা বেগম তাকে বসার ঘরে এনে সবুজ কোন টা দেখিয়ে জীঞ্জাসা করলেন কেমন হয়েছে। রাহেলা বেগমের স্বামী গাছ-পালা গুলোর দিকে তাকিয়ে কোন বিশেষ কিছু আবিষ্কার করতে পারলেন না। আসলে গাছপালার বিষয়ে কোন আগ্রহ-ই তার নেই। বসার ঘরে কিছু গাছ তার স্ত্রী এনে রেখেছেন তা তিনি জানেন কিন্তু কখনও মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি। তিনি মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে রাহেলা বেগমের দিকে তাকালেন।
রাহেলা বেগম, “আরে...এটা...বনসাই...নিম গাছের...বামন আকৃতির”। “ওহ্...ভালো...খাবার কিছু আছে?...বেশ খিদে পেয়েছে”। রাহেলা বেগমের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে। আশ্চর্য! এমন অদ্ভুত একটা জিনিষ দেখে তাঁর কোন ভাবান্তর হল না! রাহেলা বেগম নিজেকে সামলে নেন। রান্নাঘরের তদারকিতে মন দেন।
মানুষ টা কি চিরকালই এরকম থাকবে? আনমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
কিছু পরে ছেলে ফিরলে তিনি তাকে ডেকে দেখালেন। অবশ্য খুব বেশি উচ্ছ্বাস নিয়ে নয়। ছেলেটা তো বাপের কার্বন কপি হয়েছে। তবে ওটা যে বনসাই তা সে চিনতে পারলো।
“কত দিয়ে কিনলে মা?” ছেলের এই এক চরম বদ অভ্যাস। সব কিছুর দাম তার জানা থাকা চাই। কেউ উপহার দিলেও সে দাম জীঞ্জাসা করে বসে...ব্যবসায়ীর ছেলে বলে কিনা কে জানে। “আঠার’শ টাকা”। “বল কি?...প্রিটি এক্সপেন্সিভ...গাছ-পালার দাম এতো! কোন দরকার ছিল?” ছেলে নিজের ঘরের দিকে হাটা ধরেছে।
রাহেলা বেগম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।
আরও ঘণ্টা খানেক পরে বউমা ফিরল। রাহেলা বেগমের বনসাই সম্পর্কিত যাবতীয় উচ্ছ্বাস উবে গেছে। তিনি বনসাই সম্পর্কিত বইটা বসার ঘরে বসে পড়তে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে বউমা ফ্রেস হয়ে বসার ঘরে এসে জীঞ্জাসা করলো, “মা, আপনি নাকি একটা বনসাই গাছ এনেছেন?”... “হ্যাঁ” নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন তিনি... “বাহ্! বেশ তো! কি গাছ মা? বনসাই কিন্তু বেশ যত্ন করতে হয়...আপনার দৈনিক একটা কাজ বেড়ে গেল কিন্তু”।
রাহেলা বেগম অবাক হলেন। এই মেয়ের বনসাই সম্পর্কে আগ্রহ থাকবে তা তিনি আশাই করেন নি...অথচ...পুরো বাড়ীতে একমাত্র সেই বেশ আগ্রহ নিয়ে গাছটা দেখছে। রাহেলা বেগমে উবে যাওয়া উচ্ছ্বাস আবার ফিরে এলো। তিনি বিস্তারিত বলতে লাগলেন পুত্রবধূ কে।
বনসাই এর খুব যত্ন করতে হয়।
নিয়ম করে আলোতে আনা, পাতা ছেঁটে দেয়া, ডাল ভেঙ্গে দেয়া, তার দিয়ে পছন্দ মত শাখা-প্রশাখা গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা, মাটিতে সার দেয়া, শিকড় বেড়ে গেলে নতুন পটে স্থানান্তর করা, পাতা মুছে দেয়া। আসলে এটা একটা শিল্প। যত্ন ও ধৈর্যের সাথে এই শিল্পকে ধরে রাখতে হয়। বেশ সময় সাপেক্ষ কাজ। রাহেলা বেগমের এখন দিনের কিছু সময় কাটে এই বনসাই কে নিয়ে।
মাঝে মাঝে বনসাই টার দিকে তাকিয়ে তিনি তিনি কেমন জানি উদাস হয়ে যান। ... কলেজ পাশ করার পরে ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। কলেজে তার ফলাফল ভালো ছিল। পরীক্ষা দিলেই টিকে যেতেন। কিন্তু বাবা দিলেন না বরং তার বিয়ে দিয়ে দিলেন।
স্বামীর ঘরে এসে পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তিনি হবে হবে বলে সময় ক্ষেপণ করলেন শুধু। এর পর পেটে এলো ছেলে আর তার তিন বছর বাদে মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা তখন সুদূর পরাহত। ছেলে-মেয়ে মানুষ করো...স্কুলে নিয়ে যাও...নিয়ে আসো...তাদের দেখ-ভাল করো। সময় কোন দিক দিয়ে বয়ে যায়।
মেয়ের বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে স্বামী তাকে জানালেন। মেয়ে যেন তার একার। মায়ের কোন স্বপ্ন থাকতে পারে না। ছেলের বিয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দীর্ঘ সংসার জীবনে তার সাধ-আহ্লাদ ছেঁটে ফেলে সবার প্রয়োজন মত আকৃতি দেয়া হয়েছে শুধু।
মনের সবুজ কোন গুলো আলোর অভাবে ফিকে হয়ে সবুজ করেছে ঘরের কোন। ...ছেলের বৌ কে হঠাৎ নতুন করে আবিষ্কার করেন তিনি...মেয়েটাকে এবার বুঝতে পারেন তিনি।
রাহেলা বেগম ভালো করে তাকান বনসাই টার দিকে। দিন দিন ওটা পরিণত হচ্ছে। উঠে গিয়ে জানালার পর্দা টা তিনি সরিয়ে দেন।
দিনের উজ্জ্বল আলো এসে পড়ে বনসাই এর উপর।
আগের কিছু লেখা...
নাগরিকঃ অণু গল্প
এ্যাকাউন্টসঃ অণু গল্প
ডুবঃ অণু গল্প
ফেরাঃ অণু গল্প
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।