গাছ লাগানোর সেরা সময় ছিল ২০ বছর আগে। আর দ্বিতীয় সময় হলো আজ, এখনই।
বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা এই আফ্রিকান প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত কি না আমার জানা নেই, তবে সে কথার মর্ম যে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে যে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা দেখে সে কথা মনে হয়েছে। কিন্তু শুধু কথায় নয়, কাজেও সে কথার প্রমাণ দিতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
কোনো কোনো পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ অবশ্য মনে করেন, এখন গাছ লাগিয়ে অর্থাৎ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে বাঁচানো যাবে না। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর অ্যান্ড্রু ওডে গত সপ্তাহে জানিয়েছেন, পশ্চিমা খুচরা ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বাদে অন্যত্র তৈরি পোশাকের বাজার খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসও একই কথা বলেছে। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশের বদলে সবাই এখন যে দেশে ছুটছে সেটি হলো ইন্দোনেশিয়া।
সন্দেহ নেই, রানা প্লাজার দুর্ঘটনা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য অশনিসংকেত হয়ে এসেছে।
অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ বিপদে পড়বে। এখন সত্যি সত্যি সে ঘটনাই ঘটল। একের পর এক বিদেশি আমদানিকারক বাংলাদেশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকা হুমকি দিয়েছে, তারা বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার সুবিধা দিচ্ছে, তা বাতিল করবে। তেমন কিছু ঘটলে বাংলাদেশের দেড় কোটি গার্মেন্টস শ্রমিক, তার সঙ্গে আরও এক কোটি সরবরাহকারী ও ছোট ব্যবসায়ী পথে বসবেন।
বাংলাদেশ এমনিতেই গরিব। তৈরি পোশাকশিল্প মুখ থুবড়ে পড়লে সবচেয়ে গরিব, সবচেয়ে প্রান্তবর্তী মানুষগুলো বিপদে পড়বে সবচেয়ে বেশি। এদের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি যে জায়গা করে নিতে পেরেছে, তা-ও তৈরি পোশাকশিল্পের কারণ। নারী-পুরুষের এই বৈষম্য কমার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাবও কমে এসেছে।
এর সবকিছুই বিপদগ্রস্ত হবে যদি তৈরি পোশাকশিল্প খাতের চলতি সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে না পারি।
আরও এক বিপদের আশঙ্কা রয়েছে, যার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। তা হলো মৌলবাদের উত্থান। সহিংস মৌলবাদ অনেক দিন থেকেই তক্কে তক্কে রয়েছে বাংলাদেশে তার শিকড় বিছাতে। গণতান্ত্রিক বহুপাক্ষিকতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যত স্থিতিশীল হয়েছে, মৌলবাদের অবস্থান তত শিথিল হয়েছে।
কিন্তু মাঠ সে কখনোই পুরোপুরি ত্যাগ করেনি। তার কারণ অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষীণদৃষ্টি। নিজের ‘ট্রাম্প কার্ড’ ভেবে তারা সবাই মৌলবাদী শক্তির মাথার ওপর ছাতি ধরে রেখেছে, মৌলবাদের চারা গাছে সময়-অসময় পানি ঢেলে তার রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি যদি অর্থনৈতিক সংকট গভীর হয়ে আসে, তাহলে থলের সে বিড়ালই হালুম বলে লাফিয়ে বেরোবে। কোনো কোনো পশ্চিমা ভাষ্যকার সে বিপদের আশঙ্কা মাথায় রেখে আবেদন করেছেন, চলতি সংকটের সূত্র ধরে বিদেশি কোম্পানিগুলো যেন তাদের মুখ ঘুরিয়ে না নেয় অথবা বাংলাদেশে বাণিজ্যিক অগ্রাধিকার তুলে না নেওয়া হয়।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় টিম হার্টফোর্ড এক সাম্প্রতিক মন্তব্য ভাষ্যে লিখেছেন, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। একসময় যে দেশ ছিল দারিদ্র্যের ভারে কুঁজো, এখন সে মাথা উঁচু করে হাঁটছে। দারিদ্র্য সেখানে আছে বটে, কিন্তু সেখানে গরিবি দ্রুত কমে আসছে। শিক্ষার হার বাড়ছে, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিশুর মৃত্যুহার কমছে। সব অর্থেই বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি ‘সাকসেস স্টোরি’।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সূত্রে বাংলাদেশে শ্রমিক নিরাপত্তা বাড়ার বাস্তবিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাতে হাত না লাগিয়ে যদি বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় বা বাণিজ্যিক অগ্রাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে সে সংস্কার তো বাস্তবায়িত হবেই না, উল্টো আরেক ‘ভয়াবহ বিপদ’ ডেকে আনা হবে।
একই কথা লিখেছেন ফোর্বস ম্যাগাজিনের টিম ওয়াস্টল। পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ‘বাংলাদেশকে বয়কট করবেন না’ শিরোনামে এক ব্লগ পোস্টে তিনি মন্তব্য করেছেন, গত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার বড় কারণই হলো তার তৈরি পোশাক খাত। এখন যদি উল্টো যাত্রা শুরু হয় অর্থাৎ তাকে ধাক্কা মেরে সড়কের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে শুধু যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, যে শ্রমিক নিরাপত্তার নামে ইউরোপ-আমেরিকা কড়াকড়ি আরোপের কথা ভাবছে, সেই শ্রমিক নিরাপত্তাও লাটে উঠবে।
অতএব, শ্রমিকস্বার্থ বিবেচনা করেই বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করা উচিত হবে না।
মজার কথা কি জানেন, বিদেশিরা আমাদের সংকটের সময় পাশে দাঁড়ানোর আবেদন করছে অথচ বাংলাদেশের ভেতরে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাকে ক্ষমতা দখলের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকার এখন বিপদে, তার গলাটা আরেকটু টিপে ধরো, তাহলে সে বাপ-বাপ বলে দৌড়ে পালাবে। অতএব আরও ধর্মঘট, আরও হরতাল, আরও আলটিমেটাম। কোনো কোনো ভাষ্যকার (যেমন: ইনাম আহমদ চৌধুরী, উপসম্পাদকীয়, প্রথম আলো, ২০ মে) ধরেই নিয়েছেন, এসবই হবে, আর তার ফলে বাংলাদেশ অবিলম্বে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
তিনি লিখেছেন: ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কার উচ্চকিত পদধ্বনি আমরা শুনছি, যার সাবধানী ঘণ্টা আজ দেশে-বিদেশে ‘আলটিমেটাম’ বা চরম পর্যায়ে বাজানো হচ্ছে, তাতে কি সরকারের টনক নড়বে না? জাতির ভাগ্যাকাশে আজ জারি হয়েছে ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেত।
মাথায় ঢুকছে না হঠাৎ দেশ-বিদেশে বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বানানোর বিপদ-ঘণ্টা কে বাজালেন? আমি যত দূর বুঝি, বাংলাদেশের ভেতর হতে পারে, কিন্তু বিদেশে কেউ বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হোক, তা চান না। তেমন কোনো ঘণ্টাধ্বনিও কেউ কোথাও বাজাননি। কারণ ‘ব্যর্থ’ হলে বাংলাদেশের যেমন বিপদ, বহির্বিশ্বেরও। মৌলবাদ নামক মেনি বিড়াল ঘাপটি মেরে বসে থাকে কখন কোন দেশ ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়, সে অপেক্ষায়।
বাংলাদেশে কোনো কোনো নেতা-নেত্রীর হেফাজতেই এখন মৌলবাদ জামা বদলিয়ে দিনক্ষণ গুনছে। তারা হয়তো মনে মনে আশা করছে, দেশটা যত দ্রুত ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, ক্ষমতাসীন দলকে কান ধরে নামানোর সুযোগ তত বাড়বে। যারা দেশটাকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে চান তাঁরা দিবাস্বপ্ন দেখুন, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু বাকি সবার দায়িত্ব দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সংস্কারের চারা গাছ লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে।
সে গাছ যাতে বাড়ার আগেই মরে না যায়, সে চেষ্টায় হাত লাগানোই এখন প্রধান কাজ।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।