আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফুটবল পুঁজিবাদ

সাংবাদিক

ফুটবল পুঁজিবাদ শান্তনু দে সত্তরের দিন আর নেই। ডারবি, নটিংহ্যাম ফরেস্টের মতো দলগুলির লিগ জয়ের স্বপ্ন এখন ভেঙে চুরমার। ফুটবলে এখন মুক্ত বাজার। ফুটবলেও এখন আগ্রাসী পুঁজিবাদ। ঘুরছে ‘পর্ণোগ্রাফির অঙ্কের অর্থ’।

খেলার গুণমান বাড়ছে ঠিকই, তবে তাকে কিনতে পারছে একমাত্র ধনী অভিজাত ক্লাবগুলি। সম্পদে এরকম প্রকট বৈষম্য অতীতে কখনও দেখা যায়নি। ‘বন্য পশ্চিমী-ধাঁচের পুঁজিবাদ’ গলা টিপে হত্যা করছে এই খেলাকে। বলেছেন খোদ ফিফা’র সভাপতি সেপ ব্লাটার। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে।

সেকারণে এখন শুধুই চেলসি, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের একচেটিয়া দাপট। অবাধ বাজারের নামে সীমান্তের অবসান আজ শুধু ধ্রুপদী অর্থনীতির বিশুদ্ধ তত্ত্বায়ন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ফুটবলের শৃঙ্খলাও। বিশ্বায়িত অভিমুখকে ছুঁতে কভারেজ ও ক্লাবের ব্যাপ্তি বাড়ানোর মরিয়া পদক্ষেপ ইদানীংয়ের বিশ্বের প্রবণতা। সীমান্তের কাঁটাতারের অবসান যদি হয় আজকের ফেনোমেনন, তবে এক জায়গা থেকে অন্যত্র পরিযায়ী খেলোয়াড় — আজকের দুনিয়ার আটপৌরে ফেনোমেনন। আমাদের প্রিয় ফুটবল মার্কিনীদের কাছে ‘সকার’।

অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এই ‘সকার’ শব্দটি ঢুকে পড়েছে বিশ্ব ফুটবলের ময়দানে। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি আজ ‘সকার ইন্ডাস্ট্রি’তে রূপান্তরিত। পরিণত বিনোদন শিল্পের লাভজনক পণ্যে। ২০৪টি দেশ এখন ফিফা’র গভর্নিং বডির সদস্য, রাষ্ট্রসঙ্ঘের চেয়েও যাদের সদস্য সংখ্যা বেশি। তবে ফুটবল শুধু বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাই নয়, খুব সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বায়িত পেশা।

ব্রাজিল, ক্যামেরুন অথবা জাপানের ডাক্তার, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ব্লু-কলার শ্রমিক কিংবা ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের তুলনায় সেদেশের প্রতিভাবান ফুটবল খেলোয়াড়রা অনায়াসেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করেন। বলেছেন বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ ব্র্যাঙ্কো মিলানোভিচ। দীর্ঘ গবেষণার শেষে এনিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ — ‘ফুটবল থেকে বিশ্বায়নের শিক্ষা’। প্রিমিয়ার লিগের সমর্থক-অনুরাগীরা এতদিন যে সন্দেহ করেছিলেন, ফুটবলের মুক্তবাজার নিয়ে মিলানোভিচের গভীর সমীক্ষা তাকেই নিশ্চিত করেছে। বিদেশী তারকাদের অবাধ অনুপ্রবেশ দক্ষতার স্তরকে নিশ্চয় বাড়িয়েছে, তবে তা অভিজাত ক্লাবগুলি ও বাকিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মূল্যে।

আর্সেনালকে এখন আর কেউ ব্রিটিশ ক্লাব বলে না! বস্তুত, লন্ডনের আর্সেনাল ক্লাবের পুরো টিমটাই বিদেশীদের নিয়ে তৈরি। গত মরসুমে ২৯জনের মধ্যে মাত্র তিন জন ছিলেন ব্রিটিশ। কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার বিদেশী। ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গের বাসিন্দা। এমনকি দলনায়কের জায়গাটিও এখন দেশীয় খেলোয়াড়দের জন্য সংরক্ষিত না।

যেমন সেস ফ্যাব্রেগাস, স্পেনের মানুষ, আর্সেনালের ক্যাপ্টেন। আর্জেন্টিনার জেভিয়ার জানেত্তি ইন্টার মিলানের সুপ্রিমো। একইভাবে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার বহু খেলোয়াড় খেলছেন রাশিয়া, তুরস্ক, পোল্যান্ড-সহ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন লিগে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে ধরে ফুটবল দুনিয়ার বিস্তারের সূচনা। দ্রুতই ফুটবলকে আপন করে নেয় ভিনদেশী সমাজ।

বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা — তার সহজ সাদাসিধেভাব এবং সমবেত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। দরকার শুধু একটা বল। খেলা যায় যে কোনও মাঠে। একসঙ্গে বাইশজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে সুতাকলের শ্রমিক।

শুরুতে খেলোয়াড়দের ছিল আর পাঁচটা কাজ। ফুটবল তাঁকে টাকা দিত না। পরে স্টেডিয়াম হল। ফুটবল পরিণত হল বিনোদনে। পরে, বহু পরে পুঁজিবাদের বিকাশে ফুটবল পরিণত হলো সীমান্তপার ব্যবসায়িক লেনদেনে।

ফিফা’র ২০০৬সালে প্রকাশিত সমীক্ষা জানাচ্ছে, দুনিয়াজুড়ে রয়েছে ৩লক্ষ ফুটবল ক্লাব। ২৬কোটি ৫০লক্ষ নিয়মিত খেলোয়াড়। ২০৮টি অ্যাসোসিয়েশনে নথিভূক্ত ৩কোটি ৮০লক্ষ সদস্য। বিশ্বায়িত লক্ষ্যকে ছুঁতে কনফেডারেশন গঠনের মধ্যে দিয়ে ফিফা করেছে বিকেন্দ্রীকরণ। এই কনফেডারেশনগুলি মহাদেশীয় স্তরে ক্লাব ও জাতীয় ফুটবলের আয়োজন করে থাকে।

টেলিকমিউনিকেশনের তাক লাগিয়ে দেওয়া অগ্রগতির সদ্ব্যবহার, ইউরোপে বসম্যান আইনের প্রয়োগ, ক্লাবগুলির পেশাদার পরিচালন ব্যবস্থা — এসবই ফুটবলের বিশ্বায়নকে গতি দিতে বাহারি আয়োজন। মুক্ত বাজার, বিশ্বজোড়া টেলিভিশান নেটওয়ার্ক — ফুটবলকে এখন দেখা যায় বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে বসে। লাইভ। সরাসরি। উয়েফা চাম্পিয়ানস্‌ লিগ, কোপা আমেরিকা কাপ, ব্রিটিশ প্রিমিয়র লিগ, স্প্যানিশ লিগ, ইতালির সিরি-এ কাপের দর্শক এখন বিশ্বের সর্বত্র।

বিশ্বায়িত ফুটবলে ইদানীংয়ের দর্শক শুধু মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলেরই ভক্ত নয়, একইসঙ্গে ম্যান ইউ, রিয়াল মাদ্রিদের ঘোর সমর্থক। ফুটবলের বিপণনে এখন টেলিভিশন রাইটস। মাঠের টিকিট বিক্রির তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ টেলিভিশন রাইটস। বাজার মানে স্টেডিয়ামের এক লক্ষ দর্শক নয়, তার বাইরে টেলিভিশনের কোটি কোটি দর্শক। কী ঘটেছিল ২০০৬এ, জার্মানিতে শেষ বিশ্বকাপে? ৩৭৬টি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ফাইনালের লাইভ দেখেছিল ২১৪টি দেশের ৭১কোটি ১৫লক্ষ মানুষ।

১৯৯৫, বসম্যান আইন। ফুটবলের বিশ্বায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক অনন্য অবদান। ক’দিন আগেও কোনও ক্লাব একটি খেলায় দু’জনের বেশি খেলোয়াড় নামাতে পারতো না। আটের দশকে মাঝামাঝি এটাই ছিল দস্তুর। পরে তা বাড়িয়ে ‘তিন’ করা হয়।

কিন্তু বসম্যান আইন সব ভেঙে দেয়। অবসান ঘটে ঊর্ধ্বসীমার। এক সকালেই ইউরোপের ধনী অভিজাত ক্লাবগুলির কাছে চলে আসে দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়দের কেনার মহার্ঘ সুযোগ। তা সে দুনিয়ার যেখানেই তাদের দেখা যাক না কেন! ব্রিটেনে পেশাদার ফুটবল ক্লাবে খেলতে বস্তুতই নেই কোনও বাধা। ইউরোপের বাইরের খেলোয়াড়দের জন্য এখন দরকার শুধু একটা ‘ওয়ার্ক পারমিট’।

অভিজ্ঞতা কী? ১৯৯২-’৯৩তে নতুন করে যখন প্রিমিয়ার লিগ শুরু হয়, তখন বিদেশী খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল মেরেকেটে ১১। আর এখন, ৬৬টি দেশ থেকে আসা বিদেশী খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৩৩৭। এক আর্জেন্টিনার নথিভূক্ত ১০০০খেলোয়াড় খেলেন দুনিয়ার বিভিন্ন লিগে। যেমন, গত মরসুমে শুধু স্প্যানিশ লিগেই খেলেছিলেন ৩৬জন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়। ‘আজ অর্থের লালসা শাসন করছে ফুটবলকে।

’ অসহায় আর্তনাদ ব্লাটারের গলায়। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘অল্প কিছু সংখ্যায় সৌভাগ্যবান ক্লাব আগের চেয়ে অনেক ধনী হয়েছে। তা-তো হতেই পারে। কিন্তু, দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওইসব ক্লাবের উৎস এমন কিছু লোক, যাদের না আছে ফুটবল খেলার সঙ্গে এতটুকু যোগসূত্র, না আছে ওই খেলা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ। আসলে এরা নিজেদের গোপন লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্য হিসেবেই বেছে নিয়েছে ফুটবলকে।

’ ‘গোপন লক্ষ্য’ আসলে কী, ব্লাটার সরাসরি না বললেও, তা যেমন স্পষ্ট, তেমনই পরিষ্কার ফিফা’র সভাপতি ঠিক কাদের কথা বলতে চাইছেন। কে না জানেন, রুশ তেল ব্যবসায়ী রোমান আব্রামোভিচ এখন চেলসির মালিক। ফুলহ্যাম ক্লাব কিনে নিয়েছেন মিশরের ধনকুবের মহম্মদ আল-ফায়েদ। এ সি মিলানের মালিক মিডিয়া ব্যারন, ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনি। ফুটবলে আজ একদিকে বৈভবের প্রাচুর্য, অন্যদিকে চরম দারিদ্র্য।

‘সব কিছু আছে’ আর ‘কিছুই নেই’-এর মুখোমুখি আজ ফুটবল সমাজও। কীরকম? কোনও কোনও খেলোয়াড় যখন বছরে ৬০-৮০লক্ষ পাউন্ড রোজগার করছেন, তখন উয়েফা চ্যাম্পিয়ান লিগের বহু ক্লাবেরই বার্ষিক বাজেট তার অর্ধেকের কম। সোজা সরল ভাষায়, কেন্দ্রীভবন। ব্র্যাঙ্কো মিলানোভিচের তত্ত্বায়ণ, ‘যেখানে বিশ্বায়ন ও পূর্ণ বাণিজ্যিকীকরণের আধিপত্য, সেখানেই নির্ভুলভাবে হয়েছে সাফল্য ও গুণমাণের এই কেন্দ্রীভবণ। ’ কীরকম? ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানস লিগের শীর্ষ আটে ওঠার ক্ষেত্রে ক্লাবগুলির যোগ্যতার কথাই ধরুন।

আমরা যদি পাঁচ বছরকে একটি পর্যায় ধরি — তবে, ১৯৬৭ এবং ১৯৮৬’র মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে এমন টিমের সংখ্যা ছিল ২৮ ও ৩০। পরবর্তী দু’টি পাঁচ বছরে এই সংখ্যাটা কমে হয়েছে ২৬। আর সম্প্রতি তা আরও কমে হয়েছে ২১টি। প্রবণতা স্পষ্ট। অল্প, একেবারেই অল্প কিছু ক্লাব ঢুকতে পারছে ইউরোপের অভিজাত ক্লাবগুলির মধ্যে।

বাকিরা হারিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, বেশ তো, এতে তো খেলার গুণমাণই বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, পাওয়া যাচ্ছে আরও ভালো ‘রিটার্ন’। এটা ঠিক, সেরা খেলোয়াড়রা যখন একসঙ্গে খেলেন, তখন তাদের প্রত্যেকের দক্ষতার যোগফলে সামগ্রিকভাবে দলের দক্ষতা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যখন রোনাল্ডিনহো ও মেসি, অথবা কাকা ও শেভচেঙ্কো একসঙ্গে খেলেন, তখন তাঁদের সম্মিলিত ‘আউটপুট’ (এখানে গোলের সংখ্যা), যদি তাঁরা আলাদা আলাদা ক্লাবে অনেক কম দক্ষ খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলতেন, তার তুলনায় স্বভাবতই অনেক বেশি হয়ে যায়।

কিন্তু আবার এও ঠিক, রোনাল্ডিনহো, মেসি, অথবা কাকা, শেভচেঙ্কোর মতো গুণমানকে কিনতে পারছে একমাত্র ধনী ক্লাবগুলি। হচ্ছে তাই সাফল্য ও গুণমানের কেন্দ্রীভবন। ইউরোপের জাতীয় লিগগুলির কথাই ধরুন। ১৯৯২সালে যেদিন থেকে ব্রিটিশ প্রিমিয়ার লিগ চালু হয়েছে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত শুধু একবার ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স ছাড়া বরাবরই লিগ জিতে এসেছে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল অথবা চেলসির মধ্যে কেউ না কেউ। এর মধ্যে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড একাই ১১-বার।

ইতালির সিরি এ’ চ্যাম্পিয়ান লিগে ১৯৯২থেকে দু’বার বাদে সব সময়ই জিতে এসেছে হয় এসি মিলান, ইন্টার মিলান অথবা জুভেন্টাস। এর মধ্যে এসি মিলান একাই ছ’বার। একই সময়ে স্পেনে শুধুই বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের দাপট। একসময় জিতলেও, রোমানিয়ার স্টেওয়া, সার্বিয়ার রেড স্টার, নটিংহ্যাম ফরেস্টের (এখন ইংলিশ লিগের তিন নম্বরে তলিয়ে যাওয়া) মতো গরিব ক্লাব, কিংবা ছোট দেশগুলির কাছে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়াশিপ জেতার স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার। ব্লাটারের ভাষায়, যা ‘বন্য পশ্চিমী-ধাঁচের পুঁজিবাদ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.