আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগ্নেয়গিরির ছাইভস্মে থমকে গেল সভ্যতা



আগ্নেয়গিরির ছাইভস্মে থমকে গেল সভ্যতা আমাদের সংকট যখন পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস নিয়ে আমাদের সংকট যখন চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে, ইউরোপের সংকট তখন ছাইভস্ম নিয়ে। আইসল্যান্ডের ইজাফজয়েল আগ্নেয়গিরির ছাইমেঘ ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় ইউরোপের বিমান পরিবহনে দেখা দিয়েছে সংকট। এই ছাইমেঘের কারণে সারাবিশ্বে লাখ-লাখ বিমানযাত্রী আটকা পড়েছে। ইউরোপের বিমানপরিবহন কর্মকর্তারা বলেছেন, মহাদেশ সোমবার পর্যন্ত টানা পঞ্চম দিন প্রকৃতপক্ষে নো ফ্লাই জোনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবহনমন্ত্রীরা ছাইমেঘের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

আগ্নেয়গিরি থেকে উ গত ছাইয়ে কাঁচ, বালু ও পাথর রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই তিনটি উপাদান জেটবিমানের ইঞ্জিনও বিকল করে দিতে পারে। যাত্রীদের নিরাপত্তা-শংকায় প্রায় ৩০টি দেশ তাদের আকাশসীমায় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এই ছাইমেঘের কারণে বিশ্বব্যাপী ৬৮ লাখ বিমানযাত্রী আটকা পড়েছে। এই তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিষদ (এসিআই)।

এসিআই-এর ইউরোপীয় প্রধান ওলিভার জাংকোভ্যাক বলেন, বিধিনিষেধের কারণে ৩১৩টি বিমানবন্দর স্থবির হয়ে পড়েছে। আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির ছাইমেঘের কারণে ইউরোপজুড়ে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় বিমান সংস্থাগুলোর দৈনিক ২৭ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি নাইন-ইলেভেনের চেয়ে বেশি বলে ‘আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশন' (আইএটিএ) প্রধান গিওভান্নি বিসিগনানি জানান। তিনি আরো বলেন, আগ্নেয়গিরি বিমান খাতকে অচল করে দিয়েছে। প্রথমে এর প্রভাব ছিল ইউরোপে এখন এর প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়েছে।

আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশনের (আইএটিএ) প্রধান যে কথা বললেন, তাতে ভেবে দেখার মত অনেক বিষয় রয়েছে। তিনি বললেন, আগ্নেয়গিরির ছাইভস্ম বিমানখাতকে অচল করে দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম বিকাশের এই যুগেও মানুষ প্রকৃতির কাছে কত অসহায়। অখ্যাত এক দেশের অখ্যাত এক আগ্নেয়গিরি কিছু ছাইভস্ম উদ্গীরণ করলো, আর তাতেই স্থবির হয়ে পড়লো শতশত বিমান বন্দর। এতে আটকা পড়ে গেল লাখ লাখ মানুষ।

ক্ষতি হলো বিমান কোম্পানীগুলোর কোটি কোটি ডলার। আরো নানা সম্পর্ক সূত্রে আবদ্ধ লাখ লাখ বিমানযাত্রীর যে কত প্রকার ও কী পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পরিমাপ করার গরজ বা সামর্থ্য বর্তমান সভ্যতার নেই। আর লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই ক্ষতির প্রভাব প্রথমে ইউরোপে লক্ষ্য করা গেলেও এখন তা সারাবিশ্বেই অনুভূত হচ্ছে। আমাদের এই পৃথিবী যে খুবই ছোট্ট একটি গ্রহ, সেই কথাটি আবারো প্রমাণিত হলো। দূরের কোন একটি দেশের প্রাকৃতিক কোন একটি ঘটনা কত দ্রুত এবং কত সহজেই না পৃথিবীর অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করে ফেলে।

আমি যখন কলামটি লিখছি, তার কিছুক্ষণ আগে আইসল্যান্ডের কাছের দেশ নরওয়ে থেকে আমার এক আপনজন ফোন করে জানতে চাইলেন, আমরা কেমন আছি। নিজেদের কথা জানাতে গিয়ে নরওয়ে প্রবাসী জানালেন, আমরা এখন ঘরে থাকারই চেষ্টা করি। আকাশে কৃষ্ণপ্রভাব। আইসল্যান্ডের দিক থেকে বাতাস প্রবাহমান থাকলে ক্ষতির আশংকায় আমরা বাড়ী থেকে বের হই না। আর বাতাস বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হলে আমরা বাড়ীর বাইরে যাই।

প্রকৃতি মানববান্ধব না হলে মানুষের জীবন-যাপন আসলেই দুঃসহ হয়ে ওঠে! আগ্নেয়গিরির ছাইভস্মের ঘটনায় প্রশ্ন জাগে, তুচ্ছ ঐ বস্তুতে এমন কি আছে যে, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও তার কাছে এতটা অসহায় হয়ে পড়লো? প্রচন্ড গতিসম্পন্ন জেট বিমানও এখন আকাশে উড়তে ভয় পায়! বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আগ্নেয়গিরির ঐ ছাই-ভষ্মে রয়েছে কাচ, বালু ও পাথর কণা এবং এই তিনটি উপাদান জেট বিমানের ইঞ্জিনকেও বিকল করে দিতে পারে। ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়, একটি আগ্নেয়গিরির কাছে কত সহজেই না হার মেনে গেল মানুষের সভ্যতা। মানুষের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দাপট এবং সভ্যতার অহঙ্কার কি এতটাই ঠুনকো ব্যাপার? প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের নানা বর্ণনা মুদ্রিত হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা, ভূমিকম্পে অতীতে অনেক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে, পতন হয়েছে অনেক অহঙ্কারী বাদশার। পবিত্র কুরআনের সূরা ফীল-এ তেমন এক ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।

পবিত্র কাবাঘর ধ্বংস করতে এসেছিল অহঙ্কারী বাদশাহ আব্রাহা। কিন্তু কাবা ধ্বংসতো দূরের কথা, হাতির পালসহ নিজেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বাদশাহ আব্রাহা। আর তাদের ধ্বংসের কারণ ছিল আকাশ থেকে ছোট পাখির নিক্ষিপ্ত ছোট্ট ছোট্ট পাথর কণা। আইসল্যান্ডেও এবার পাথর কণা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, নিক্ষিপ্ত হয়েছে কাচ ও বালু কণাও। তবে তা আকাশ থেকে নয়, আগ্নেয়গিরি থেকে।

আকাশ-বাতাস, সাগর, পাহাড়, আগ্নেয়গিরি, বন-জঙ্গল, পশুপাখি সবই প্রকৃতির অংশ। মানুষও প্রকৃতির অংশ, তবে শ্রেষ্ঠ অংশ। শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জন্য প্রকৃতি জগতকে কল্যাণকর করে সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ। বলা যায়, প্রকৃতিকে মানববান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা। আবার এই প্রকৃতি যখন বিরূপ হয়ে ওঠে, ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে- তখন আমরা বলি, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়েছে।

আমরা এ কথাও বলি যে, প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় নির্মম! কিন্তু প্রশ্ন জাগে, প্রকৃতি কি স্বয়ং সব কিছু করে ফেলে, নাকি স্রষ্টার অনুমোদন লাগে? এখানে যে রহস্যটি সুপ্ত আছে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করলে যে কোনো মানুষই একথা স্বীকার করবে যে, প্রকৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশ্যই স্রষ্টার অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে। প্রকৃতি কখনো পালন করে সৃজনের ভূমিকা, কখনো বা ধ্বংসের। কিন্তু কেন এই দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় প্রকৃতি? প্রকৃতির এই ভূমিকা উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন গভীর জ্ঞান ও গবেষণার। তবে শত জ্ঞান-গবেষণার পরও প্রকৃতির সব রহস্য উদঘাটন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ অসীম জ্ঞানের খুব অল্পই মানুষ ধারণ করতে পারে।

তবে একথা ঠিক যে, প্রকৃতি সৃজন কিংবা ধ্বংস- যে রূপই ধারণ করুক না কেন, তাতে রয়েছে মানুষের জন্য শিক্ষা। বর্তমান পৃথিবী যারা শাসন করছে তাদের প্রধান হাতিয়ার হলো বিজ্ঞান-প্রযুক্তি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বদৌলতে তারা শুধু নিজেদের পরিবেশকেই নয়, গোটা পৃথিবীকেই আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা ভয়ানক সব অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলেছে, বিস্ময়কর প্রচারযন্ত্র নির্মাণ করেছে, গড়ে তুলেছে বিশাল তথ্যভান্ডার এবং অর্থভান্ডার। এসবের মাধ্যমে তারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে চায় একক নেতৃত্ব।

এ লক্ষ্যে তারা কথামালাও সাজিয়ে নিয়েছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী- এসব কথামালা যে নিছক প্রতারণার নামান্তর, তা ইতোমধ্যেই মানবজাতির উপলব্ধিতে এসে গেছে। কিন্তু তারপরও শাসকদের দাপট থামেনি। তাদের অভিযান তারা অব্যাহত রেখেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির দানবীয় আগ্রাসনে তারা মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত ও পদানত করতে চায়।

তাই পরাশক্তির মুখেও আজ যেমন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জয়গান, তেমনি দরিদ্র দেশের ফ্যাসিবাদী শাসকেরাও আজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জয়গানে পঞ্চমুখ। এমনি এক পাপেট-সভ্যতায় মানুষের সুস্থ জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই সভ্যতায় শুধু মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্যও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যও। এমন অবস্থায় যদি প্রকৃতি প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে তাহলে অবাক হওয়ার কোন কারণ থাকবে কী? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহার ছাড়াও দেশে-দেশে জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-প্রতারণা, হত্যা-লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অজাচার-অনাচারের যে তান্ডব চলছে তাতে এই পৃথিবী এখন আর মানুষের কাছে তেমন উপাদেয় কোন বিষয় নয়।

এমন অবস্থায় প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রবণতা যদি স্রষ্টার অনুমোদন পেয়ে যায়, তাহলে ধ্বংসের প্রলয়কে রুখবে কে? আইসল্যান্ডের এক আগ্নেয়গিরি বদলে যদি পৃথিবীর দিকে-দিকে শতশত আগ্নেয়গিরি প্রতিশোধের লাভা কিংবা ছাইভস্ম উদ্গীরণ করতে থাকে তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিপূজারী অহংকারী শাসকরা কোথায় উড়ে পালাবেন? তাদের বিমানবহরতো তখন আর আকাশে ওঠার সাহসও পাবে না। প্রকৃতি বিরূপ হয়ে উঠলে ধরিত্রীতে বসবাসও হয়ে উঠবে অসম্ভব। এমন অবস্থাকেই বলা হয় গজব। এই গজব থেকে বাঁচতে হলে সর্ব-সমাজের সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে- অনুতপ্ত হৃদয়ে জুলুম-নির্যাতন, অনাচার-পাপাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে- বেছে নিতে হবে আত্মসংশোধন ও প্রত্যাবর্তনের পথ। গজব থেকে বাঁচতে হলে তওবার এ পথই এখন মানবজাতির বাঁচার পথ।

এমন উপলব্ধি এখন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সব দেশের মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় বাংলাদেশের জন্যও। কারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দানবীয় আগ্রাসনে এই পৃথিবীতে মানুষ এখন সন্ত্রাস, জুলুম, অশ্লীলতা ও অনাচারাপূর্ণ এক জাহেলিয়াতের মধ্যে বসবাস করছে। এমন জীবন-যাপন কিংবা এমন পৃথিবীতো কখনও মানুষের কাম্য হতে পারে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।