আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
নিউইয়ক সান অফিস
১৩ই এপ্রিল, সকাল দশটা
...............................
অবিশ্বাস্য খবর!
--নরফোক এক্সপেস
...........................
তিনদিনে আটলান্টিক পাড়ি!
................................
মনঙ্ক মেসন সাহেবের উড্ডয়ন যন্ত্রের অবিস্মরণীয় বিজয়!
...................................................................
ভিক্টোরিয়া নামের বেলুনে চড়ে দীর্ঘ ৭৫ঘণ্টা দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে
বেড়িয়ে মনঙ্ক মেসন, রবার্ট হোল্যান্ড,হেনসন, এইনসোর্থ সহ মোট ৮ জনের দলের
চার্লসটনের নিকটবর্তী সুলিভান দ্বীপে পৌছানো
.............................................................
অভিযানের বিস্তারিত
...........................
[অবশেষে মহাসমস্যার সমাধান হল। আকাশ-বাতাস সমুদ্র বিজ্ঞানের বশীভূত হল। এ বিজয় মানবজাতির ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সামান্য একটা বেলুনে চড়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া; তাও কোন অঘটন নেই, মেশিনের উপরে পূর্ণনিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা, এবং সর্বোপরি ৭৫ঘণ্টার মত অল্প সময়ে এতগুলো তীর অতিক্রম করা! চার্লসটন থেকে আমাদের উদ্দমী তরুণ প্রতিনিধির চৌকষ পেশাদারীতায় ৬ ই এপ্রিল, শনিবার থেকে ৯ই এপ্রিল, মঙ্গলবার পর্যন্ত চলা এই অসাধারণ অভিযানের খুঁটিনাটি খবরাখবর নিয়ে আমরাই সর্বপ্রথম পাঠকের সামনে হাজির হয়েছি।
অভিযাত্রী দলে ছিলেন স্যার এভারের্ড ব্রিংহার্স্ট, জনাব ওসবোর্ন (ইনি লর্ড বেন্টিঙ্কের ভ্রাতস্পুত্র), মনঙ্ক মেসন, বিখ্যাত বৈমানিক রবার্ট হোল্যান্ড, জ্যাক শেফার্ড বইয়ের লেখক হ্যারিসন এইনসোর্থ, জনাব হেনসন (ইনি উড্ডয়ন বিষয়ক একটা অসফল পরীক্ষা চালিয়েছিলেন), এবং ওলউইচ থেকে আনা জাহাজের দুজন খালাসি- মোট আটজন।
এই প্রতিবেদনের প্রতিটি ঘটনাকে সত্য ধরে নেয়া যায় চোখ বন্ধ করেই। সামান্য ব্যতিক্রম বাদে মনঙ্ক মেসন আর হ্যারিসন এইনসোর্থের যৌথ খেরোখাতা থেকেই হুবুহু লেখা তুলে দেয়া হয়েছে। এ দুজনের সৌজন্য ও আন্তরিকতার জন্য আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন; তারা মৌখিকভাবেও বেলুনের গঠন এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলেছেন। এই খেরোখাতায় যে সামান্য রদবদল হয়েছে তার একমাত্র কারণ সময়ের স্বল্পতা, তবুও মূল থেকে তা একচুলও বিচ্যুত হয়নি]
বেলুন
হেনসন সাহ্বে আর স্যার জর্জ কেইলির দু’দুটি নিরঙ্কুশ ব্যর্থতার পর আকাশে উড়া সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহে অনেকটাই ভাটা পড়ে গিয়েছিল।
হেনসন সাহেবের তত্ত্বের (বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এটির বাস্তবায়ন খুবই সহজ) মূলভিত্তি ছিল ইনক্লাইন্ড প্লেন কনসেপ্ট।
বাহ্যিক বল প্রয়োগের ফলে এই প্লেন একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে উড়তে শুরু করবে এবং বায়ুকলের পাতের মত কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক পাতের ঘূর্ণনের ফলে প্লেনটি নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু এডিলেড গ্যালারিতে এই প্রকল্পের পরীক্ষা চালিয়ে আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায়নি ; প্লেনের যে মডেলগুলো দিয়ে তিনি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, দেখা গেল সেগুলোর পাখা প্রোপেলারের কাজ তো করছেই না, উপরন্তু উড্ডয়নেও বাধা দিচ্ছে। যে একমাত্র প্রোপেলিং বলটি এই যন্ত্রে দেখা গিয়েছিল, তাও মূলত প্লেন অবতরণের সময় সৃষ্ট স্বয়ংক্রয়ি বেগ। মজার ব্যাপার হল, এই আপাত মনে হওয়া প্রোপেলিং বল যন্ত্রটা চালু থাকার চেয়ে বন্ধ অবস্থায়ই প্লেনকে বেশিদূর টানতে পারছিল ; যন্ত্রের অনুপযোগিতা বোঝাতে এটুকুই যথেষ্ট ছিল, কারণ প্রোপেলিং বা চলনশক্তি না থাকলে সমগ্র যন্ত্রটা আপনাআপনিই ভুপতিত হবে। শেষের এই সমস্যাটি পরবর্তীতে স্যার জর্জ কেইলির কাজের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
তিনি প্রোপেলারে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে একে এমন একট যন্ত্রের সাথে জুড়ে দেয়ার কথা ভাবেন, যার নিজস্ব পাওয়ার সাপোর্ট থাকবে- এখান থেকেই বেলুন ধারণার উদ্ভব হয়েছিল।
সেই ধারণাটা গালগপ্পো অথবা সত্যি যেমনই হোক, স্যার জর্জ তখনো পর্যন্তও এর নির্মাণকলার চেয়ে প্রায়োগিক দিক নিয়েই বেশি ভাবছিলেন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তিনি আবিষ্কৃত মডেলটার একটা পরীক্ষা চালান । হেনসনের মত তিনিও যন্ত্রের বিঘ্নিত পৃষ্ঠে প্রোপেলিং নীতি প্রয়োগ করে পাতগুলোকে ঘুরাতে চাইছিলেন। এরকম পাত ছিল মোট ৪টি, কিন্তু ওগুলোর ঘূর্ণনে বেলুনের নড়াচড়ায় কোন প্রভাবই পড়ছিলনা; ঊর্ধ্বমূখী বলও বাড়ছিলনা।
তাই পুরো প্রকল্পটি ব্যর্থতার ইতিহাসই কেবল সমৃদ্ধ করেছে।
ঠিক এমনই এক সন্ধিক্ষণে মনঙ্ক মেসন (ইনি ১৮৩৭ সালে নাসাউ বেলুনে চড়ে ডোভার থেকে উইয়েলবার্গে ভ্রমণ করে হইচ্ই ফেলে দিয়েছিলেন) বাতাসে পরিচালনের ক্ষেত্রে আর্কিমিডিসের স্ক্রু-তত্ত্বটা ব্যবহারের চিন্তা করেন। তবে হেনসন আর স্যার জর্জের তত্ত্ব দুটিকেও তিনি এর সাথে যুক্ত করেন। অর্থাৎ হেনসনের ভুলগুলো শুধরে নেন এবং স্যার জর্জের বিঘ্নিত পৃষ্ঠের বদলে স্বতন্ত্র্য পাতে প্রোপেলিং নীতি প্রয়োগের পরিকল্পনা করেন। উইলিসিস রুমে তার মডেলের প্রথম মহড়া হয়, কিন্তু এরপরই সেখান থেকে সরিয়ে তিনি তার মডেলটাকে এডিলেড গ্যালারিতে নিয়ে যান।
স্যার জর্জের মডেলের মত তার বেলুনটিও পরাবুত্তাকার : দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৩ফুট. উচ্চতা ৬ফুট৮ ইঞ্চি । বেলুনের গ্যাস ধারণক্ষমতা ৩২০ঘনফুট, এবং গ্যাসটি বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন হলে, বেরিয়ে যাওয়ার বা নষ্ট হওয়ার আগে এর প্রথম স্ফূর্তিতেই অতিরিক্ত ২১পাউন্ড ওজন বহন করতে সক্ষম। মেশিন আর টুকিটাকি যন্ত্রপাতির সম্মিলিত ওজন ১৭ পাউন্ড; মানে ৪পাউন্ড অব্যবহৃত ওজন রয়ে যায়। বেলুনের কেন্দ্র বরাবর নিচে নয়ফুট দৈর্ঘ্যের একটা হালকা কাঠের কাঠামো ছিল ; এই কাঠামোটার সাথেই বেলুনকে আটকানো হয়েছিল। কাঠামোর অন্যপ্রান্তে ঝুলানো ছিল একটা রথগাড়ি।
স্ক্র’র এর দৈর্ঘ্য ১৮ইঞ্চি; এটা মূলত ছিদ্রওয়ালা পিতলের নল- এর একটা অক্ষও আছে। এই ছিদ্র দিয়ে অক্ষের সাথে ১৫ ডিগ্রি কোণে ২ফুট লম্বা বেশ কয়েকটি স্টিলের রড ঢুকানো যায়। এই ২ফুট ব্যাসার্ধের রড অক্ষবিন্দুতে সমবিভক্ত হয়ে অক্ষের ২পাশে ১ফুট করে থাকে। এই তারগুলো দুই প্যাচের মাধ্যমে সবচেয়ে বাইরের প্রান্তে যুক্ত হয়ে স্ক্রুর একটা সুশৃঙ্খল কাঠামো গঠন করে। স্ক্রকাঠামোকে তৈলাক্ত রেশমি কাপড় দিয়ে ঢেকে শক্ত করে বেধে দেয়া হয়েছিল, যাতে সহনীয় মাত্রার সুষম পৃষ্ঠ পাওয়া যায়।
এর অক্ষের দুইপ্রান্তই উপরের মাস্তুল থেকে নেমে আসা ছিদ্রযুক্ত নলের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দেয়া ছিল। এই নলের নিচের প্রান্তে খোলা, সেখানে অক্ষের ঘূর্ণনবিন্দুগুলো ঘুরে। রথের পাশের অক্ষপ্রান্ত থেকে একটা শ্যাফটের শুরু হয়েছে, যা রথের একটা স্প্রিংওয়ালা বেরিংয়ের সাথে মূল স্ক্রকে যুক্ত করেছে। এই স্প্রিঙ চালিয়ে স্ক্র অনেক জোরে ঘুরানো যায়, সেইসাথে একটা অগ্রগামী বেগ সমগ্র মেশিনে ছড়িয়ে দেয়া হয়। রাডার দিয়ে মেশিনের গতি যেকোন দিকেই করা যায়।
আকৃতির তুলনায় স্প্রিঙয়ের ক্ষমতা সন্তোষজনক : প্রথমবার ঘূর্ণনের পরই এটা চার ইঞ্চি ব্যাসের ব্যারেলের উপর ৪৫ পাউন্ড ওজন তুলতে পারে এবং ঘুরা শেষ হওয়ার আগে এই ক্ষমতা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এর মোট ওজন ৮পাউন্ড ৬ আউন্স। রাডারটা দেখতে বেতের ব্যাটের মত- রেশমি কাপড় দিয়ে এটা ঢাকা থাকে। এটা ৩ফুট লম্বা, ১ফুট চওড়া, ওজন প্রায় ২ আউন্স। ডানে-বামে, উপরে-নিচে এর দিক পরিবর্তন করা যায় বিধায় বেলুনচারীরা বাতাসের বাধাকে ইচ্ছামত দিকে ঠেলে দিতে পারবে, একইসঙ্গে বিপরীত দিক থেকে কোন বেলুন আসতে থাকলে রাডার তারও সংকেত দেবে।
এডিলেড গ্যালারিতে এই মডেলের (সময়াভাবে আমরা আপাতত মডেলটির বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারছিনা) একটা মহড়া দেয়া হয়েছিল, যেখানে এটি ঘণ্টায় ৫কিলোমিটার বেগ তুলতে পেরেছিল; তবে দুঃখজনক ব্যাপার হল, হেনসন সাহেবের ব্যর্থ হওয়া জটিল যন্ত্রটি মানুষের মধ্যে যেমন সাড়া ফেলেছিল, এক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও দেখা যায়নি, যদিও তার যন্ত্রটি একদমই সহজ-সরল ; আমরা বোধহয় সিম্পল জিনিসকে অবজ্ঞা করতিই মুখিয়ে থাকি ; আকাশে উড়া সে কি আর চাট্টিখানি কথা- তাতে বলবিদ্যার কঠিন কঠিন সব ব্যবহার থাকবে, জটিল জটিল যন্ত্র থাকবে; তবেই না তাকে সমীহ করব!
মেসন সাহেব তার আবিষ্কারের চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে চূড়ান্তরকম আশাবাদী ছিলেন বলে অবিলম্বেই একটি বড়সড় বেলুন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং সেটিতে চড়ে ভ্রমণে বের হয়ে সকল সংশয়কে পাথরচাপা দিতে চান ; নাসাউ বেলুনের মত এবারও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বৃটিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া। তিনি তার প্রকল্পের কথা স্যার এভারার্ড ব্রিংহার্স্ট আর জনাব ওসবোর্নকে জানিয়ে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা চান, কারণ এই মানুষ দুজন যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষত আকাশে উড়াউড়ির পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন।
ওসবোর্ন সাহেবের ইচ্ছেনুযায়ী, প্রকল্পের সবকিছু জনসাধারণের থেকে কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়; যে গুটিকয়েক মানুষকে বিশ্বাস করে এসম্পর্কে জানানো হয় তারা সবাই আসলে বেলুন নির্মাণ কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এরা হলেন জনাব হোল্যান্ড, স্যার এভারার্ড ব্রিংহার্স্ট ; ওসবোর্ন আর জনাব মেসন তো বাইডিফল্ট ছিলেনই। ওয়েলসের পেনসট্রুথাল থেকে অল্পদূরে জনাব ওসবোর্নের আঙ্গিনায় নির্মাণ কাজ চলেছিল।
শনিবার একেবারে শেষমুহূর্তে জনাব হেনসন আর বন্ধু এইনসোর্থকে সাথে নিয়ে এই বেলুনে তাদের সাথে ব্যক্তিগত ভ্রমণের অনুমতি পান। তবে এই দলে জাহাজের দুজন খালাসিকে কেন নেয়া হয়েছিল, সে ব্যাপারে এখনো আমরা জানতে পারিনি। আশা করছি, দু-একদিনের মধ্যেই এই অসাধারণ অভিযানের প্রতিমিনিটের পৃঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা আমাদের পাঠকদের সামনে তুলে ধরব।
বেলুনের আস্তরণ তৈরি করা হয়েছিল রেশমি কাপড় দিয়ে; সেই কাপড়ে আবার রবারের আঠা দিয়ে বার্নিশ করা। বেলুনটাও দৈত্যাকৃতির- ৪০০০০ ঘনফুট গ্যাস জমা রাখতে পারে ; তবে বেলুনে দামী ও অসুবিধাজনক হাইড্রোজেন গ্যাসের পরিবর্তে কোল-গ্যাস ব্যবহার করায় যন্ত্রের উপরে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।
যেমন, বেলুন পূর্ণ স্ফীত হলে আর স্ফীতির অব্যবহিত পর এর সাপোর্টিং পাওয়ার ২৫০০ পাউন্ডের বেশি হতে পারবেনা; তাতে অবশ্য লাভই হয়েছে। কোলগ্যাস শুধু দামেই সস্তা নয়, এর যোগাড়যন্ত ও কাজে লাগানো দুই-ই বেশ সহজ।
উড্ডয়নকাজে কোলগ্যাস ব্যবহারের প্রচলন করেছিলেন জনাব চার্লস গ্রীন; তার প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা। তার আবিষ্কারের আগে স্ফীত প্রক্রিয়া মারাত্মক খরুচে ছিল, একাজে অনিশ্চতাও ছিল ব্যাপক । একটা বেলুনকে হাইড্রজেন দিয়ে ভর্তি করতে ২-৩দিন সময় নষ্ট করার পরও অনেকসময় দেখা যায় কিছুই হয়না।
তাছাড়া হাইড্রোজেন অতিরিক্ত সূক্ষ হওয়ায় বেলুন থেকে বেরিয়ে বায়ুমন্ডলের সাথে মেশারও প্রবণতা থাকে। আবার, কোলগ্যাস টানা ৬মাস গুণে-মানে অপরিবর্তিত অবস্থায় বেলুনের ভেতর থাকতে পারে, সেখানে সমপরিমাণ হাইড্রোজেন টেনেটুনে ৬সপ্তাহ বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে পারে।
বেলুনের সহ্যক্ষমতা ধরা হয়েছিল ২৫০০ পাউন্ড; অভিযাত্রীদের সম্মিলিত উচ্চতা ১২০০ পাউন্ডের আশেপাশে- অর্থাৎ প্রায় ১৩০০ পাউন্ডের মত ওজন অবশিষ্ট রয়ে যায়। এর মধ্যে ১২০০ পাউন্ড আবার নানাভাবে খরচা হয়েছে; যেমন বিভিন্ন আকারের পাথরকুচিভর্তি বেশকিছু ব্যাগ, টেলিস্কোপ, ১৪দিনের খাবার রাখা ব্যারেল, পানির ক্যান, চটের ব্যাগ; এর বাইরে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন কফি হিটার। এই উচ্চতায় স্ল্যাকলাইম দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কফি গরম করাটা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত প্রশ্ন রাখে বইকি।
পাথরকুচির ব্যাগ বাদে বাকি সবগুলোই মাথার উপরের মাস্তুল থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মডেলে দেখানো রথের চেয়ে মূল রথটি ছোট আর ওজনে হালকা। হালকা কাঠের তৈরি হলেও নড়বড়ে লাগা মেশিনের জন্য যথেষ্ট মজবুতই বলতে হবে। এর রিমের গভীরতা ৪ফুট। মডেলের রাডারের চেয়ে আসল রাডার বেশকিছুটা বড়; সে তুলনায় স্ক্রুটা ছোটখাটই।
ছোট্ট নোঙর আর সঞ্চালক-দড়ি- এ দুটোকেই বেলুনের অঙ্গসজ্জায় রাখতে হবে, কারণ পরবর্তীতে এদের ভূমিকা অপরিহার্য।
এবার আমাদের পাঠকদের কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করতে হবে, যাতে আকাশে উড়ার মেকানিজমগুলো তারা বুঝতে পারে, এবং এগুলো কোন ধাধার মধ্যে না ফেলে তাদের।
বেলুন মাটি ছাড়ামাত্র্ কিছু কিছু পরিস্থিতির কারণে ওজনের তারতম্য সৃষ্টি হয়; এতে এর উপরে উঠার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ধরা যাক, বেলুনের রেশমি কাপড়ে কয়েকশো পাউন্ড শিশির জমা হল- এক্ষেত্রে সমওজনের পাথরকুচি নিচে ফেলতে হবে; নইলে বেলুন নিচে নামতে থাকবে। পাথরকুচি ফেলার পর, কিংবা সূর্যের তাপে শিশির বাষ্পীভূত হলে, কিংবা গ্যাসের স্ফীতি ঘটলে মেশিনের গতি প্রচন্ড বেড়ে যাবে; ফলে বেলুন উপরে উঠতে শুরু করবে।
তখন অতিরিক্ত উপরে উঠা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হল বেলুন থেকে গ্যাস বের করে দেয়া (জনাব গ্রিনের সঞ্চালক-দড়ি পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে এটাই একমাত্র উপায় ছিল); কিন্তু গ্যাস হারানো কোন ভাল কথা নয়- এতে উপরে উঠার ক্ষেত্রেও একটা পর্যায়ে এসে বাধা পড়ে। ফলে বেলুনের সমস্ত রসদ ফুরিয়ে অচিরেই নিচে নামতে শুরু করে। এটা একটা বিরাটা প্রতিবন্ধক।
সঞ্চালক-দড়ি এ সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করতে পারে। দড়িটা অনেক লম্বা, এর একপ্রান্ত রথের সাথে বাধা এবং এর প্রধান কাজই হল বেলুনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে রাখা, অবস্থান বদল করতে না দেয়া।
যেমন, বেলুনে কুয়াশা জমলে সমউচ্চতা বজায় রাখতে পাথরকুচি ফেলবার কোন প্রয়োজন নেই; দড়ির খোলাপ্রান্তে সমওজনের পাথরবেধে মাটিতে ফেললেই হল। পক্ষান্তরে কোনকারণে বেলুনের ভেতরে ওজনহীনতা সৃষ্টি হলে নিচ থেকে ঐ পাথরটা উপরে তুলে ফেলতে হবে; ব্যস কাজ শেষ। পানির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তামা অথবা কাঠের পিপে পানিতে ফেলবার প্রয়োজন পড়ে, সেই পিপেতে পানির চেয়ে হালকা তরল থাকে ; দড়িতে বেধে পিপেগুলো ফেলা হয়, সেই পিপে পানিতে ভাসতে থাকে।
তবে সঞ্চালক-দড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বেলুনের দিক ঠিক রাখা। দড়িটা জলে-স্থলে বেলুনকে টেনে নিয়ে চলে, বেলুন মোটামুটি মুক্তই থাকে; সুতরাং, যা-ই ঘটুক বেলুন গতি ধরে রাখে ।
কম্পাসের সাহায্যে বেলুন আর দড়ির আপেক্ষিক অবস্থান থেকে বেলুনের গতিবেগ সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় : দড়ি মেশিনের উলম্ব অক্ষের সাথে যে কোণ তৈরি করে সেখান থেকেই গতিবেগ বোঝা যাবে। কোন কোণ তৈরি না হলে, মানে দড়ি আর যন্ত্র একই সরলরেখায় থাকলে, মেশিনের গতি সর্বনিম্ন হয়; কিন্তু কোণ যত বড় হয়, দড়িও বেলুনের প্রান্ত থেকে ততদূরে চলে যায়- বেগ বাড়তে থাকে। কোণ কমালে বিপরীত ঘটনা ঘটে।
বৃটিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্যারিসের যতটা কাছাকাছি সম্ভব অবতরণ করা মূল পরিকল্পনা ছিল বলে অভিযাত্রীরা সতর্কতা হিসেবে ইউরোপ মহাদেশের পাসপোর্ট করে রেখেছিলেন; পাসপোর্টে ভ্রমণের ধরনটাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়েছিল। নাসাউ বেলুনে ভ্রমণের সময়ও এই কাজগুলো করতে হয়েছিল; তারা অভিযানটার নাম দিয়েছিল ‘কর্মব্যস্ততাকে ছুটি’।
নানা অনভিপ্রেত ঘটনার প্রেক্ষিতে পরে অবশ্য সেই পাসপোর্ট কোন কাজেই আসেনি।
দিনের প্রথম প্রহর থেকেই বেলুন ফোলানো শুরু হয়েছিল; দিনটি ছিল ৬ই এপ্রিল, শনিবার, এবং স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল উত্তর ওয়েলসের পেনসট্রুথাস থেকে ১মাইল দূরত্বে হোয়েল-ভর হাউস প্রাঙ্গনে- জনাব ওসবোর্নের বসার জায়গায়। ১১টা ৭ মিনিটে সমস্ত আয়োজন সম্পণ্ন করে বেলুন ছাড়া হয়, এবং ধীরেধীরে সেটি উপরে উঠে দক্ষিণমুখী যাত্রা শুরু করে। প্রথম আধঘণ্টায় স্ক্রু-রাডারের কোন প্রয়োজনই পড়েনি।
আমরা এখন জর্নালের মাধ্যমে পুরো ভ্রমণের চালচিত্র বয়ানের চেষ্টা করবো।
জনাব মনঙ্ক মেসন এবং জনাব এইনসোর্থের যৌথ খেরোখাতা থেকে এটি সংকলন করা হয়েছে। সংকলন করেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জনাব ফোরসিথ। খেরোখাতায় জনাব মেসন নিজহাতে বিভিন্ন ঘটনবলী লিখেছেন, আর প্র্রতিটি লেখার নিচেই জনাব এইনসোর্থ পাদটীকা লিখেছেন। এই জর্নালটাই এক অবিসংবাদিত রোমাঞ্চকর ভ্রমণের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বর্ণনায় আমাদের আগ্রহী পাঠকদের মোহাবিষ্ট রাখবে।
জর্নাল
৬ই এপ্রিল, শনিবার
[মেসন সাহেবের খেরোখাতা]
সম্ভাব্য সব ঝামেলাই রাতারাতি মিটে গেল বলে আমাদের আর অপ্রস্তুত হতে হলনা।
আজ সকালের প্রথম প্রহর থেকেই বেলুন ফুলানো আরম্ভ করেছিলাম, কিন্তু বেলুনের কাপড়ের ভাজে ভাজে ঘনকুয়াশা ঢুকে পড়ে এমন বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা করেছিল যে, সকাল ১১টার আগে আমাদের রওয়ানা করা সম্ভব ছিলনা। কিছুটা অধৈর্য হলেও মনের জোর বজায় ছিল; সেই জোর আর উত্তরা বায়ুর প্রভাবে আমরা বেশ জোরেশোরে উপরে উঠতে লাগলাম; উত্তরা বায়ু আমাদের বৃটিশ চ্যানেলের দিকে বয়ে নিয়ে চলল। বলতে দ্বিধা নেই- এতটা ঊর্ধ্বমুখী বল আমরাও প্রত্যাশা করিনি; পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে আমরা ক্রমশ সূর্যরশ্মির দিকে ধাবমান হলাম।
অভিযানের শুরুতেই এত গ্যাস খরচের কোনরকম ইচ্ছা ছিলনা আমার; তাই অহেতুক বেশি উপরে না উঠে বর্তমান উচ্চতাটাই বজায় রাখতে চাইছিলাম। তবুও সঞ্চালক-দড়িটা মাটি থেকে তুলে আনার পর আপনাআপনিই আরও বেশ কিছুটা উপরে উঠলাম।
এই উচ্চতায় বেলুনটা স্থিতু হল, আরও বাড়তি উচ্চতায় না উঠে; বেলুনটা দেখতেও লাগছে বলিহারি। উড়ার ১০মিনিটের মধ্যে একবার ব্যারোমিটার দেখলাম : ব্যারো সাহেবের মিটারের(!) ভাষ্যমতে আমরা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২৫০০০ ফুট উপরে অবস্থান করছিলাম। ঝরঝরে আবহাওয়া, এরই মধ্যে আমরা কয়েকজন। নিচের দৃশ্য দেখতে দেখতে রোমান্টিক হয়ে পড়ছিলাম : এন্তার পাহাড়-পর্বত-গিরিখাত আর এদের মধ্যবর্তী স্থানে বয়ে চলা হ্রদের ঘনপানি মিলে এক প্রহেলিকিার সৃষ্টি করছিল; মনে হচ্ছিল প্রাচ্যের রূপকথার মহাশহর দেখছি। আমরা ঝড়োগতিতে দক্ষিণের পাহাড়রাজ্যের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমরা যে উচ্চতায় উঠেছি তাতে পাহাড় ডিঙানো কোন সমস্যা হয়ে উঠতে পারেনি।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই আয়েশি ভঙ্গিতে আমরা পাহাড়গুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে উঠে গেলাম। এইনসোর্থ সাহেব রথ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলেন; খালাসী দুজনের অবস্থাও তথৈবচ । তার মনে হচ্ছিল বেলুন আর পাহাড়ের চূড়ার মধ্যে হাত ধরাধরি দূরত্বের ব্যবধান। তখনো পর্যন্ত আমরা দক্ষিণমুখী যাত্রাই অব্যাহত রেখেছিলাম।
সাড়ে এগারোটার দিকে প্রথমবারের মত বুটিশ চ্যানেলের দর্শন পেলাম ; এর মিনিট পনেরো পরে তীরের ভাঙনরেখাগুলো স্পষ্ট হতে লাগল।
নির্বিঘ্নেই সমুদ্রে এসে পড়লাম। সঞ্চালক-দড়ির সাথে কয়েকটা বয়া বেধে নিচে ফেললাম; পাশাপাশি বেলুন থেকে কিছু গ্যাসও ছেড়ে দিলাম। সবকিছু বেশ পাততাড়ি হয়ে গেল, আমরাও একটু একটু করে নিচে নামতে শুরু করলাম। ২০মিনিটের মধ্যে প্রথম বয়াটি, এত উপর থেকে পড়ার দরুণ প্রথমে ডুবে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই ভেসে উঠল; একটুপর দ্বিতীয়টাও ভেসে উঠল। ফলে, কিছুক্ষণের জন্য আমরা একটা উচ্চতায় স্থির হয়ে রইলাম।
ভেবে দেখলাম এই অবসরে রাডার আর স্ক্রুর কার্যকারীতাটা ঝালাই করে নেয়া যাক; এরই অংশ হিসেবে বেলুনকে পূর্বদিকে ঘুরিয়ে প্যারিসমুখী করলাম। আমাদের গতিপথও বাতাসের সাথে সমকোণে চলে এল। স্ক্রু আর স্প্রিংকে জোরে জোরে ঘুরানোর ফলে গতিসঞ্চার হল এবং তড়িৎগতিতে এটা আমাদের প্রত্যাশামাফিক প্রোপেলারের মত কাজ করতে শুরু করল। খুশিতে আমরা নয়বার চিয়ার্স করলাম, তবুও আশ মিটছিলনা। তাই আবিষ্কারের মূলনীতিটা একটা মেষের চামড়ার কাগজে লিখে সেটা দিয়ে একটা বোতলকে মুড়িয়ে বোতলটা নিচে সমুদ্রে বিসর্জন দিলাম।
কিন্তু এই আনন্দোৎসব করার ক্ষণে একটা উটকো ঝামেলায় আমাদের মন খারাপ হল বেশ। প্রোপেলারকে স্প্রিং এর সাথে আটকে রাখা স্টিলের রডটি হঠাৎ ঝাকি খেয়ে সরে রথের প্রান্তে চলে গেল ( সম্ভবত দুই খালাসির কেউ একজন রথটাকে দুলিয়েছিল) ; মুহূর্তের রডটা মধ্যে স্ক্রুর ঘূর্ণনবিন্দু থেকে সরে অগম্য উচ্চতায় ঝুলে রইল। আমাদের সকল মনোযোগ ও প্রচেষ্টা যখন রডটা পুনরুদ্ধারের, ঠিক তখনই এক প্রলয়ংকরী উত্তরা বায়ু, এটা এতক্ষণ আমাদের বয়ে আনলেও, আমাদের আটলান্টিকের দিকে টেনে নিয়ে চলল। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা দেখলাম ঘন্টায় ৫০-৬০ মাইল ছুটতে ছুটতে কেপক্লিয়ারে এসে পড়েছি।
এইনসোর্থ সাহেব এক দুর্দান্ত (প্রকারান্তরে, আমার মতে কোনভাবেই অযৌক্তিক বা উদ্ভট নয় এমন) প্রস্তাব দিলেন; সাথে সাথে হল্যান্ড সাহেব তাকে সমর্থন করলেন।
তার প্রস্তাব হল, আমাদের ঝড়ের সুবিধাটা নেয়া উচিৎ ; অনেক দূরেই যেহেতু চলে এসেছি, তাই প্যারিসে ফেরার চিন্তা বাদ দিয়ে উত্তর আমেরিকার কোন উপকূলে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমিও এর পক্ষেই মত দিলাম ; বিপক্ষ বলতে কেবল খালাসি দুজন। তবে আমরা সংখ্যায় ভারি হওয়ায় তাদের ভয়কে বাতিল করে খুব সহজেই নতুন গন্তব্যে চলতে শুরু করলাম। আমরা পশ্চিমেই এগুচ্ছিলাম; কিন্তু, নিচের বয়াগুলো বেলুনের গতিকে বাধা দিচ্ছিল। উপরে উঠা- নিচে নামা উভয়ক্ষেত্রেই বেলুনের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
তাই শুরুতেই বেলুন থেকে ৫০ পাউন্ডের মত পাথরকুচি অপসারণ করলাম,িআর বয়ার বাধা দূর করতে চরকিকলের সাহায্যে পানি থেকে সঞ্চালক-দড়িটা উপরে তুলে আনলাম। আমাদের কাজের সুফল পেলাম হাতেনাতে : বেলুনের গতি বেড়ে গেল।
ঝড় কেটে যাবার পরও আমরা যে বেগে উড়ছিলাম, তা ছিল আমার ধারণারও বাইরে। এই বেগের কারণে রথে বাধা সঞ্চালক দড়িটাও উড়ছিল; জাহাজে পতাকা যেভাবে পতপত করে উড়ে- সেভাবে। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সময় পরেই আমরা উপকূল ছেড়ে বহুদূর চলে এলাম।
চলতিপথে বিবিধ সামুদ্রিক যান অতিক্রম করতে হয়েছিল ; কোন কোনটা আমাদের পেরিয়ে যেত চাইলেও অধিকাংশেরই ভিন্নচিন্তা ছিল। পুরো ভ্রমণের সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্তটা আমরা পার করছিলাম। এত আনন্দ নিজেদেরকেও এলেমেলো করে দিচ্ছিল ; বিশেষত আমাদের খালাসি দুজন। জেনেভিয়ান হুইস্কির সামান্য একটু পেটে পড়তেই তাদের মনের সকল ভয়-সংশয় বাতাসে মিশে গেল।
অনেক জাহাজ থেকেই ফাকা গুলি ছুড়ে আমাদের সম্মান জানাচ্ছিল, কেউ কেউ আবার খুশিমনে স্যালুটও দিচ্ছিল (মানুষের গলার স্বরের তীব্রতা সবার একরকম ছিলনা)।
কখনো ক্যাপ খুলে, রুমাল নেড়ে- অভিবাদনপর্ব চলছিলই। এভাবে কোন বড়সড় অঘটন ছাড়াই একটা পুরোদিন পার করে দিলাম। এরপর বেলুনের ভাজে রাত্রি নেমে এলে আমরা হিসেব কষতে বসলাম কতটা পথ পেরিয়ে এসেছি। কমসে কম ৫০০ মাইল তো হবেই, বেশিও হতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রোপেলারটা ঠিকঠাকমত কাজ করছিল বলেই চলার গতি এমন সুষমভাবে এগুচ্ছিল।
সূর্য ডুবে গেলে ঝড়মুক্ত আকাশটা হারিকেনের আলো ছড়াচ্ছিল যেন ; সেই আলোয় নিচের সমুদ্রটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সমস্ত রাত পূর্বদিক থেকে বাতাস বইল; এর মাধ্যমেই আমাদের সফলতার সবচেয়ে উজ্জল পূর্বলক্ষণটা দেখা গেল। ঠান্ডা বেশ ভোগাচ্ছে, স্যাতসেতে আবহাওয়াটাও বিরক্তিকর। কিন্তু রথের ভেতরে পর্যাপ্ত জায়গা আছে বলে কম্বল গায়ে শুয়ে থেকে উতরে গেলাম।
পাদটীকা [ এইনসোর্থ সাহেবের সংযোজন]
আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সময় নির্বাচন করতে বললে, আমি নির্দ্বিধায় বিগত ৯ঘণ্টাকে বেছে নেব।
আমিতো ভাবতেই পারিনা এমন অদ্ভুত ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের চেয়েও আকর্ষণীয় কিছু থাকতে পারে জীবনে; এমনকি গল্প-উপন্যাসেও নয়। ঈশ্বর আমাদের সহায় হউক! আমার তুচ্ছ জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি সহায়তা চাইছিনা; মানবজ্ঞান আর বিজয়ের ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য হলেও আমাদের সফল হওয়া প্রয়োজন। এই দুঃসাহসটা বাস্তবায়ন এতটা সহজ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ কেন এর আগে পিছু হটেছে, ভেবে পাইনা। একটা ঝড়ই আমাদের বন্ধুর কাজ করেছে, হয়তবা অন্যদের ক্ষেত্রেও করবে ; ধরে নিলাম, এই ঝড় এক প্রবল ঘূর্ণিবায়ু সৃষ্টি করল, যা একটা বেলুনকে একটানা ৪-৫ দিন সমানে টেনে নিয়ে চলল (ঝড়ের স্থায়িত্ব বেশিও হতে পারে). তখন বেলুনের অভিযাত্রীরাও তীর থেকে তীরে বাহিত হতে পারবে। আরে, এই ঝড়ের জন্যই তো এতবড় আটলান্টিক মহাসাগরটা ছোট্ট একটা হ্রদের মত লাগছে।
এইমাত্র আরও একটা ব্যাপারে অভিভূত হলাম, তা হল মহাসমুদ্রের মহানীরবতা। সমুদ্রের সাথে উত্তাল গর্জনই বেশি মানানসই হলেও মহানৈঃশব্দ্যই আমাকে আকর্ষণ করল। সমুদ্রের নোনা পানি স্বর্গের কথা ভেবেও কোন শব্দ সৃষ্টি করছিলনা। আলোয় আলোয় ঝলমল করা সমুদ্র হয়ত মনে মনেই কষ্ট চেপে রাখে, নিরাভিযোগে অনাচার সয়ে যায়।
এই আকস্মিক অনুভূতিটা আমায় এক অস্বাভাবিক ভাবনায় ঠেলে দিল ; আমার মনে হচ্ছিল অগণন নৈঃশব্দ নপুংসকসুলভ গোঙানিসহকারে কাতরাচ্ছে।
আজকের এই রাতটা আমার কাছে ১০০বছর ধরে বয়ে বেড়ানো গৎবাধা জীবনের মতই, কিন্তু তবুও শতায়ু পাওয়া অতিসাধারণ জীবনের মোহেও এই তীব্র আনন্দকে আমি বিসর্জন দিতে পারবোনা।
৭ই এপ্রিল, রবিবার
[মেসন সাহেবের খেরোখাতা]
আজ সকালে ঝড়ো বাতাসের বেগ বোধহয় ৮-৯মাইল কমে গেছে ; ধারণা করছি এখন বেগ ৩০ মাইলের আশপাশে। বাতাস দিক পরিবর্তন করে উত্তরে মোড় নিয়েছে।
এখন সূর্যের তেজ কম; আমরা পশ্চিমে রওয়ানা হচ্ছি। প্রোপেলার আর স্ক্রুর কারণেই সবকিছু এত ভালোয়-ভালোয় হয় যাচ্ছে।
এখনো পর্যন্ত ভ্রমণটাকে সর্বোতভাবে সফলই বলবো ; বাতাসের গতি যেমন আর বেলুনের দিক যেদিকেই হোক- কোনটাই কোন আহামরি সমস্যা নয়। গতকালকের ঝড়ো বাতাসের বিরুদ্ধে আমরা হয়ত কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু প্রয়োজন হলেই আরেকটু উপরে উঠে বাতাসের নাগালের বাইরে যেতে পারতাম। আমি মোটামুটি এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি যে, বেয়াড়া বাতাসের মধ্যেও প্রোপেলার দিয়ে আমরা নিজেদের পথ করে নিতে পারব।
আজ দুপুরে আরও বেশকিছু পাথরকুচি ফেলে ২৫০০০ ফুট উচ্চতায় উঠে গেলাম। সরাসরি বায়ুপ্রবাহ পেতেই এটা করেছিলাম, কিন্তু এখন যে অবস্থায় আছি এর চেয়ে অনুকূল অবস্থা আর কখনোই ছিলনা।
আমাদের কাছে যে পরিমাণ গ্যাস আছে, তাতে এই মহাসমুদ্র পাড়ি দেয়া তুড়ি বাজানোর মত ব্যাপার; এমনকি এই বেলুনভ্রমণ তিনসপ্তাহও চালানো যাবে। আমি পরিণতির ভয়ে সামন্যতমও ভীত নই । অহেতুকই ঝামেলাগুলোকে বাড়ানো হয়েছে, কিংবা ভুলভাল অনুমান করে কিছুটা বাড়তি খাটুনি গেছে- এই আরকি। আমি আমার নিজের স্রোতকে বেছে নিতে জানি, এবং এই স্রোত যদি বিপরীতেও যায়, প্রোপেলার দিয়ে আমি ঠিকই একটা পথ খুঁজে নিতে পারব। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন ঘটনাকেই আলাদাভাবে মনে রাখার মত পাচ্ছিনা, বরং রাত্রির মাঝে আমি এক অনিঃশেষ প্রতিশ্রুতি দেখতে পাচ্ছি।
পাদটীকা [এইনসোর্থ সাহেব]
আমারও বিশেষ কিছু মনে রাখবার নেই, একটা ব্যাপার বাদে (এই ব্যাপারটাকে আমি আজগুবি হিসেবেই ভাববো); তা হল, কটোপ্যাক্সির সমান উচ্চতায় উঠেও আমার ঠাণ্ডা লাগছেনা, মাথা ব্যথা করছেনা। এমনকি হল্যান্ড সাহেব, মেসন সাহ্বে, বা স্যার এভেরার্ডদের অবস্থাও আমার মত। ওসবোর্ন সাহেব ‘বুকে ব্যথা করছে’ বলেছিলেন একবার, কিন্তু খানিকবাদে তাও সেরে গেছে।
দিনে আমরা অনেক জোরে ছুটেছি, আটলান্টিকের অর্ধেক পথ পাড়ি দেয়া শেষ। এসময়ে আমরা ২০-৩০টি জাহাজ ডিঙিয়েছি; সবগুলো জাহাজ থেকেই মানুষজন আমাদের দেখে বিস্মিত হয়েছে।
তবে আমি এখনো মনে করি বেলুনে চড়ে মহাসাগর পাড়ি দেয়া কোন কঠিন ব্যাপার নয়, কারণ Everything unknown is (taken as) grand.
২৫০০০ফুট উপরে আকাশকে প্রায় কালো দেখায়, তারাও দেখা যায় স্পষ্ট ; সেখান থেকে সমুদ্রকে উত্তল লাগেনা, বরং নির্ভুলভাবে অবতল লাগে।
৮ই এপ্রিল, সোমবার
[মেসন সাহেবের খেরোখাতা]
আজ সকালে প্রোপেলারের রডটা নিয়ে আবারো ছোটখাট ঝামেলায় পড়েছি। বড়ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রোপেলারটাকে রিমডেলড করতে হবে- মানে রডটাকে ঠিকঠাক করতে হবে। বায়ুকলের পাতের ব্যাপারে কিছু বলছিনা, কারণ এগুলো বদলানো সম্ভব নয়।
আজ সারদিনই উত্তর-পূর্বদিক থেকে দমকা বাতাস বইছে; এখনো পর্যন্ত ভাগ্য আমাদের দিকেই হেলে আছে।
দিনের শুরুতে খানিকটা বিচলিত হয়েছিলাম বেলুনের ভেতরে ধাক্কাজনিত কারণে শব্দ হওয়ায়; শব্দের সাথে সাথে বেলুনের ভেতরকার মেশিনটাও স্থির হয়ে আসছিল- এটাই যত ভয়ের কারণ।
সম্ভবত ঘটনাটা গভীর রাতের দিকে ঘটেছিল। আসলে হয়েছিল কী, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গ্যাস প্রসারিত হয়েছিল, সেইসাথে বরফের ছোট ছোট কণাগুলো ভেঙ্গে মেশিনের নেটওয়ার্ক ঢেকে দিয়েছিল - সেখান থেকেই এর সূত্রপাত। অনেকগুলো বোতল ফেলতে হয়েছিল পরিস্থিতি সামাল দিতে; একটা জাহাজ থেকে সেই বোতলগুলো কুড়িয়ে নিতেও দেখতে পাই। জাহাজটা সম্ভবত নিউইয়র্কের।
আমি জাহাজের নাম দেখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছিলনা। ওসবোর্ন সাহ্বে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখে জানালেন নামটা আটলান্টা জাতীয় কিছু একটা হবে।
এখন রাত ১২টা, এবং আমরা এখনো পশ্চিমপানে ছুটছি, ধীরে-সুস্থে নয়, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। মহাসমুদ্রকে বিচ্ছিরি রকম দেদীপ্যমান লাগছে।
পাদটীকা [এইনসোর্থ সাহেব]
এখন রাত ২টা; চারপাশে শুনশান নীরবতা।
বাতাসে ভর করে চলছি বলে ঠিক আন্দাজ করতে পারছিনা আমরা এখন কোথায় আছি। হোয়েল-ভর ছেড়ে আসার পর একটুও ঘুমাইনি এ কয়দিন, দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু চোখ বুঁজতে হবে।
৯ই এপ্রিল, মঙ্গলবার
[এইনসোর্থ সাহেব]
রাত ১টা। আমরা দক্ষিণ ক্যারোলিনার নিম্ন উপকূল দেখতে পাচ্ছি।
যাক বাবা, মহাসমস্যা তাহলে মহাসমারোহেই মিটে গেল! আমরা হেসেখেলে আটলান্টিক পাড়ি দিলাম, স্রেফ একটা বেলুনে চড়ে! ঈশ্বরের অশেষ কৃপা। এরপরও কে বলবে- অসম্ভব বলে কিছু আছে?
.........................................................................................
জর্নালটা এখানেই শেষ। আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব ফোরসিথ, এইনসোরথ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে অবতরণের আরও কিছু তথ্য জেনেছেন।
সকালের দিকে প্রথমবারের মত অভিযাত্রীদের উপকূলে দেখা যায়; উপকূলটা দেখেই তাদের সঙ্গেকার খালাসি দুজন আর ওসবোর্ন সাহেব চিনতে পারেন। শেষোক্তজনের মোলট্রি দুর্গ পরিচিত হওয়ায় তড়িঘড়ি করে এখানেই অবতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এই উপকূলের পক্ষে আরও যে বিষয়গুলো কাজ করেছে তা হল, স্রোত ছিলনা তখন, বালিও বেশ শক্ত- সবমিলিয়ে অবতরণের জন্য উপযুক্ত। এরপর নোঙর ফেলা হয়; ফেলামাত্র সেটি মাটিতে গেঁথে যায়। দ্বীপ আর দুর্গবাসীরা বেলুনটাকে একনজর দেখতে ভীড় করতে শুরু করে; কিন্তু অভিযাত্রীদের যে মূল দুঃসাহসিকতা , মানে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া, এ ব্যাপারে কেউই কোন কথা বলেনি! নোঙর ধরতে দুপুর দুটো বেজে গিয়েছিল। এভাবে পুরো অভিযান শেষ হতে ৭৫ ঘন্টা সময় লেগেছে; তীর থেকে তীর গুণলে সময় কিছুটা কমও হতে পারে। বেলুনটি প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এলেও নিরাপদেই অবতরণ করেছে, এবং এই সংবাদটা যে খেরোখাতার উপর ভিত্তি করে দাঁড় করানো হয়েছে, সেই খাতাটি যখন তাড়াহুড়ো করে চার্লসটন থেকে পাঠানো হয়, তখনো অভিযাত্রী দল মোলট্রি দুর্গেই অবস্থান করছিলেন।
তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা এভনো জানা যায়নি; তবে পাঠকদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- সোমবার অথবা, খুব বেশি হলে, মঙ্গলবারের মধ্যেই এ ব্যাপারে আরোও তথ্য আপনারা পেয়ে যাবেন। সংশয়াতীতভাবে এটিই এখনো পর্যন্ত মানুষ পরিচালিত সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিযান। অদূর ভবিষ্যতে আরও অদ্ভুত-আকর্ষণীয় কী ঘটনা ঘটতে পারে, এখনই সেই হিসেব কষতে বসা সময়হত্যার শামিল।
.............................................................................................
দ্রষ্টব্য : এইনসোর্থ সাহেব একটা ঘটনার কোন ব্যাখ্যা দেননি, কিন্তু ব্যাখ্যাটা দরকার। ২৫০০০ফুট উচ্চতা থেকে সমুদ্র বা পৃথিবীপৃষ্ঠে কোন লাইন কল্পনা করলে বা টানা হলে সেটা একটা সমকোণী ত্রিভুজের লম্ব হবে।
সেই ত্রিভুজের ভুমি হবে ভূপৃষ্ঠ বরাবর, আর এর শেষপ্রান্তের সাথে বেলুনের সংযোগে অতিভূজ গঠন করবে। কিন্তু প্রত্যাশিত মাত্রার তুলনায় ২৫০০০ ফুট খুবই নগণ্য উচ্চতা। অন্যভাবে বলা যায়, প্রম্তাবিত ত্রিভুজের ভ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।