আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
গল্প: ইলিওনোরা
মূল: এডগার এলান পো
ভাষান্তর: হিমালয়
The soul is saved through preservation of a specific form….
----RAYMOND LULLY
(১)
আমার গোষ্ঠী সম্পর্কে একটা বিশেষ প্রবাদ প্রচলিত আছে- কল্পনা আর কাম, এই দুই ‘ক’ এর জন্য নাকি তারা সুবিখ্যাত। তো সেই গোষ্ঠীর লোকজন আমার নাম দিয়েছে ‘পাগলা’; এ নিয়ে অবশ্য আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। তবে একটা অমীমাংসিত কৌতূহল আছে, আর তা হল, পাগলামিই সবচেয়ে উচ্চস্তরের বুদ্ধিবৃত্তি কিনা। এরই সম্পূরক হিসেবে আরও কিছু প্রশ্ন জড়ো হতে থাকে : আমরা যা কিছু মহান আর অভিনব বলে জানি, তার সবই কি কম-বেশি ভাবনারোগের ফসল, কিংবা সেই ভাবনাগুলো কি সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির বেশ কিছুটা উপরের স্তর থেকে উৎসারিত হয়?
যারা দিবাস্বপ্ন দেখে তারা একদিক থেকে সেইসব গড়পড়তা মানুষ, যারা স্বপ্নটাকে শুধু রাতের ঘুমের জন্যই তুলে রাখে, তাদের থেকে জ্ঞানী; এই দিবাস্বাপ্নিকদের কাছে এমন অনেক কথা চলে আসে যার নাগাল ঐসব গড়পড়তা মানুষ কোনদিনই পায়না। দিবাস্বপ্নের রঙ ধূসর; এই ধূসর স্বপ্নের স্বাপ্নিকরা ক্ষণিক মহাকালের বৃত্তে ঢুকে পড়ে শিহরিত হয়, জেগে জেগেই এক অজানা অনুভূতির সাথে তারা পরিচিত হয়।
এই অনুভূতি কখনো-সখনো সবাক হয়ে উঠে বলে, ‘আমরা এক মহারহস্যের সিংহদ্বারে পৌছে গিয়েছি’। নীট হিসেব করলে তারা জ্ঞানের একটা ঝাজ অন্তত পায়- সেটা ভাল-মন্দ যেমনই হোক। সুজ্ঞান হলে এক অনির্বচনীয় আলোর বিশাল জ্ঞানসমুদ্রে তারা ঢুকে পড়ে; সে সমুদ্রে রাডার-কম্পাস কিছুই লাগেনা। আর জ্ঞানটা কুজ্ঞান হলে নুবিয়ান জিওগ্রাফারদের মত দুঃসাহসিকতায় তারা আঁধারের সমুদ্র সেঁচে আঁধার খুঁজতে বেরোয়।
তখন হয়ত ‘আমি পাগল’ কথাটা বলে আমাদের অনেকেই বেশ মজা পাবে।
আমারও খারাপ লাগেনা। কারণ, অন্তত এই ভেবে ভাল লাগে যে, পাগলামির সৌজন্যে হলেও আমার মধ্যে দুটো ভিন্ন মানসিক অবস্থানের অস্তিত্ব টের পাই। প্রথম অবস্থানে থাকে প্রচ্ছন্ন যুক্তিবোধ; সেই বোধের খুপড়িতে খুপড়িতে সাজানো আমার প্রথমজীবনের স্মৃতিবিম্ব।
দ্বিতীয় অবস্থানের নাম ছায়া ছায়া সংশয়। এই ছায়া আর সংশয়ের সমণ্বয় আমার বর্তমানকে বিনির্মাণ করেছে; বলা যায়, ছায়াচ্ছন্ন সংশয় অথবা সংশয়াচ্ছন্ন ছায়ার এপিটাফই আমার অস্তিত্বের ২য় আখ্যানভাগ।
তাই জীবনের শুরুর অংশকে আমি বলি বিশ্বাস, আর এর সাথে জীবনের পরবর্তী অংশকে মেলালে যে জীবন পাই, তাকে বলতে ইচ্ছা হয় বকেয়া জীবন। কিংবা নাহয় এর নাম দিলাম ঘোর লাগা সংশয়; আর যদি সংশয় না হয়, তবে পুরোটাই হোক এক হেয়ালিগাথা। জীবনের এই হেয়ালির মাঝে আরেকটি ঈদিপাস যদি অভিনীতই হয়- হলোই বা।
সম্পর্কে সে ছিল আমার খালাত বোন, যার প্রেমে তারুণ্যে ডুবসাঁতার দিতাম, আর এখন যার স্মৃতিকে ছুঁয়ে থেকে নীরবে শুধু চিঠি লিখে যাই। বহুদিন আগেই ছবি হয়ে যাওয়া আমার মৃত মায়ের একমাত্র বোন, মানে আমার খালা, তার মা।
নাম তার ইলিওনোরা।
আমাদের সংসারে এই তিনজন মোটে মানুষই ছিলাম; কখনই আলাদা হইনি। রঙ-বেরঙের ঘাসের সমারোহে ঘেরা উপত্যকা, মাথার উপরে তপ্ত-ক্ষিপ্ত সূর্য, আর উপত্যকার মাঝে আমরা তিনটি প্রাণী। সেই উপত্যকায় কোন অচেনা পথিক আসতোনা, সেভাবে আসার সুযোগও ছিলনা; কারণ, জায়গাটা উঁচু উঁচু পাহাড়ে এমনভাবে ঢাকা ছিল যে, সেই পাহাড়ের পাঁচিল ভেদ করে সূর্যের আলোই আসত কদাচিৎ। সেখানে কোন পথ এসে মেশেনি, বা কোন পথ মাড়িয়েও যায়নি।
আমাদের শান্তকুটিরে পৌছতে হলে অনেকটা পথ পিছিয়ে যেতে হত। ইচ্ছা না হলেও পিছাতে পিছাতে একেবারে পথের শুরুতে গিয়ে নতুন পথ ধরতে হত। সেই পথ যদিওবা খুঁজে পাওয়া যেত, তবুও কুটিরের হদিস পেতে গহীন অরণ্য, অগুণতি পাতা আর সুগন্ধি ফুল মাড়িয়ে আসতে হত। তাই আমাদের পৃথিবীটা ছিল ক্ষুদ্রেরও ক্ষুদ্রতর। উপত্যকার বাইরে সেই পৃথিবীর কোন লেনদেন ছিলনা ; জনশূন্য সেই ছোট্ট পৃথিবীতে মানুষ বলতেও আমরা তিনজন - খালা, আমি, আর সে।
আমাদের কুটিরের ডানদিকের পাহাড়ের বাইরের ঝোপঝাড়ে ঘেরা অদেখা অঞ্চল থেকে একটা সরু-গভীর নদী এসেছিল; নদীটাকে মনে হত যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বইছে। সেই নদীর টলটলে পানিতেই ইলিওনোরার মুখটা সবচেয়ে ভালভাবে বোঝা যেত। চোর যেভাবে চুপিসারে পথ চলে, নদীটাও তেমন চাতুর্যে একেবেকে বইত। পাহাড় আর গিরিখাতের দুর্ভেদ্য পর্দার আড়াল থাকায়, পাহাড়ের অন্যপাশে নদীটা দেখতে কেমন তা জানবার কোনই উপায় ছিলনা। আমরা সেই নদীটাকে বলতাম ‘নৈঃশব্দ্যের নদী’।
ওর গতিপথে একটা অস্ফূট নৈস্তব্ধ্য ছিল- চট করে তাকালে দেখে মনে হত ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বইছে। তীর থেকে কোন শব্দ শোনা যেতনা, সাধারণত স্রোতের যে কলকল ধ্বনি থাকে, কান পাতলেও তা বোঝা যেতনা; সে নদী এতটাই ধীরে বইত যে তীরে মুক্তার মত ঝিলমিল করা নুড়িগুলো তীরেই নিথর পড়ে থাকত, একচুলও নড়তোনা। সেইসব নুড়ির দিকে আমরা দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতাম, তাকিয়ে মুগ্ধ হতাম। নুড়িগুলো ঝিকমিক করত, সেই ঝিকমিক যেন অনন্তকালব্যাপী।
নৈঃশব্দ্যের নদী, আর এতে উপগত উপনদীগুলো মিলমিশে একই নালীতে প্যাচানো পথে কেবল বয়েই চলত।
নদীর ধারঘেষে যে ফাকা জায়গার শুরু এবং উপত্যকায় গিয়ে শেষ, এই অঞ্চলটুকু সমগ্র পাগাড়ী এলাকার চেয়ে মোটেই কমকিছু ছিলনা। এই সুদীর্ঘ অঞ্চল জুড়ে নরম কচি ঘাসগুলো এক সবুজের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছিল যেন। ছোট ছোট ঘাস, সেগুলো দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান এবং শরীরে তাদের ভ্যানিলার সুগন্ধ । কিন্তু হলদে বাটারকাপ, সাদা ডেইজি, বেগুনী-পদ্মলাল পারিজাতের উপচে পড়া সৌন্দর্যের কাছে সেই সুগন্ধিও ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে পড়েছিল । মাথা খারাপ করে দেয়া মাত্রা ছাড়ানো সেই সৌন্দর্য উচ্চকণ্ঠে ভালবাসার আকর আমাদের হৃদয়ের প্রতিবিম্ব হয়ে হৃদয়ের সাথেই কথা বলত যেন।
সেই সৌন্দর্য ঈশ্বরের অপার ঐশ্বর্যময়তাও মূর্ত হতে চাইত।
স্বপ্নে মরুভুমিকে কেমন দেখায় জানা না থাকলেও ঐ ঘেসো অঞ্চলের যত্রতত্র অদ্ভুত সব গাছ-গাছালি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তাতে অঞ্চলটাকে ওরকমই লাগত। সেই সরু অথচ দীর্ঘ গাছগুলোর গড়ন একহারা নয়, বরং সূর্যের প্রতি ঔদার্য দেখিয়ে কিছুটা হেলে পড়েছিল, যাতে গাছের ফাকে উঁকি মেরে দিনের সূর্য উপত্যকার দুপুরের রূপ দেখতে পারে। গাছগুলোর বাকলের রঙ ছিল ভারী অদ্ভুত - কালো আর রূপালির সঙ্কাশে একটা তীব্র রঙ ধারণ করেছিল ; বাকলের ছোট ছোট ছোপগুলো ছিল এর অলংকারের মত : ছোপের কারণেই বাকলগুলোকে আকর্ষণীয় লাগত। ইলিওনোরার ত্বক, নাকি গাছগুলোর বাকল; কোনটি বেশি মসৃণ, আমি সেই ধন্ধেয় পড়ে যেতাম।
গাছের বড় বড় পাতাগুলো ছিল সবুজেরও সবুজ; সারে সারে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু গাছগুলোর পাতা এতটা উপরে থেকেও একটা বিশাল পাতার লাইন তৈরি করে নিয়েছিল; সেই লাইন পেরিয়ে পশ্চিমা বায়ুরাজ জেফিয়ারসের আর আসা হতনা উপত্যকায়। সারিবদ্ধ পাতাগুলোকে দেখে মনে হত কোন বিশাল দৈর্ঘ্যের সাপ, আর বাতাসে তাদের উঠানামা দেখে মনে হত সেই সাপটি বুঝি সূর্যকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
দীর্ঘ ১৫বছর ধরে হাতে হাত রেখে উপত্যকা চষে বেড়াতে বেড়াতে আপন অলক্ষ্যেই ইলিওনোরাকে চাইতে শুরু করেছিলাম। আমি নিশ্চিত, আমাদের হৃদয়প্রকোষ্ঠে তখনো পর্যন্তও প্রেম নামে কোন কুঠুরির সৃষ্টি হয়নি। সে তখন পঞ্চদশী, আর আমি কুড়ি ছুইছুই।
এক সন্ধ্যায় সর্পিল গাছগুলোর একটার নিচে দুজন দুজনাকে জড়িয়ে ধরে শরীর ঘেষে বসে ছিলাম; বসে বসে নৈঃশব্দের নদীর পানি দেখছিলাম, নদীর পানিতে দুজনের সম্মিলিত ছায়া পড়েছিল কিনা জানিনা।
সেই প্রেমশ সন্ধ্যার বাকি সময়টুকুতে আমাদের মুখে কোন কথা ছিলনা, এমনকি পরদিনও কথা হচ্ছিল মেপেমেপে; কণ্ঠ কাপছিল কথা বলতে গেলে। কামদেবতা এরোস আমাদের দুজনের মাঝখানে চলে এসেছিল; বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমাদের পূর্বপুরুষদের রিপুতাড়িত আগ্নেয় আত্মাকে এরোস দাউদাউ করে কামের আগুনে পোড়াতে শুরু করেছে। শতকের পর শতক ধরে যে কাম আমাদের গোষ্ঠীর মজ্জাগত, তা –ই কল্পনার চৌকাঠে এসে ভীড় করছিল। কাম-কল্পনার যুগলবন্দী যেন রঙ-বেরঙের ঘাসের উপত্যকার উপরে পরমসুখে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল, যে সুখের নাম বৈকল্যজনিত সুখ।
হয়তবা সেই প্রভাবেই চারপাশের সবকিছু কেমন বদলে যাচ্ছিল। কোনদিন ফুল ফুটেনা এমন গাছেও ফুলে ফুলে ভরে উঠছিল, সবুজ ঘাসের গালিচার রঙ আরও গাঢ় হয়ে মহাসবুজে রূপ নিচ্ছিল, আর সাদা ডেইজিগুলো যখন একে একে একে মিইয়ে পড়ছিল, তখন ঠিক ঐ জায়গায়ই একটার বদলে দশটা করে পদ্মলাল পারিজাত ফুটছিল। জীবন তার সবগুলো দ্বার আমাদের সামনে অবারিত করে দিয়েছিল।
ততদিন পর্যন্ত উপত্যকা অঞ্চলে কোন ফ্লেমিঙ্গো পাখি দেখা যায়নি, অথচ হুট করেই লম্বা একটা ফ্লেমিঙ্গো পাখি আরও কিছু রকমারি পাখির দলের সাথে উড়তে উড়তে চলে এসেছিল; উড্ডীয়মান সেই ফ্লেমিঙ্গো পাখি আমাদের সামনে তার পীতবর্ণের পালক নেড়ে যাচ্ছিল। নৈঃশব্দ্যের নদীর পানিতে হুটোপুটি খাচ্ছিল সোনালী-রূপালি মাছ, এতদিন নীরব থাকা নদীর কলতানও শোনা যাচ্ছিল, জড়তা কাটিয়ে নদীও বইছিল জোরেশোরে।
নদীর ঐ কলতানের মাঝে এক বিবশ মূর্ছনা ছিল, যার সম্মোহনী ক্ষমতা দেবতা ইয়োলাসের বায়ুবীণাকেও ম্লান করে দিয়ে স্বর্গীয় হয়ে উঠেছিল। সেই মূর্ছনার সম্মোহনের সাথে আমি কেবল ইলিওনোরার মায়াবী কণ্ঠেরই তুলনা খুঁজে পাই। যে সমস্ত সোনালী-লাল ঘন মেঘরাজিকে এতদিন শুধু দেবতা হেসপারের এলাকায় ভেসে বেড়াতে দেখতাম, সেগুলোকেও মনে হচ্ছিল উঁচু দূরপাহাড়ের চূড়ায় আছড়ে পড়ছে। নিষ্প্রভতা- নির্জীবতা চমৎকারিত্বে বদলে যাচ্ছিল। চিরদিনকার মত আমরা যেন এক যাদুর গারদে আটকে পড়েছিলাম; সেই কাঙ্ক্ষিত গারদের অন্যনাম সাড়ম্বড়িতার ঘর।
লাবণ্যের কথা বললে ইলিওনোরাকে বলব দেবী সেরাফিম। তবুও সে ছিল নিরহঙ্কার-নিষ্কলুষ এক রমণী, যার স্বল্পায়ু জীবনটাই এক জীবন্ত ফুল হয়ে উঠেছিল। কোন ছলাকলা বা নখড়ার ছদ্মাবরণে প্রেমের আকুলতাকে সে গোপন করেনি; সেই প্রেমের শুদ্ধিযাচাইয়ে সে আমাকে প্র্রেমের অন্তরতম প্রদেশেও পাঠিয়ে দিত , যে সময়টাতে রঙ-বেরঙের ঘাসের উপত্যকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুজনে পাশাপাশি হাটতাম। আমাদের আলাপনে শুধু প্রেমই থাকতনা, স্থান পেত প্রকৃতিও; তাই প্রকৃতির অস্বাভাবিক পরিবর্তনগুলোও আমাদের নজর এড়ায়নি।
সেদিন এক নাগাড়ে বলেই চলেছিল ইলিওনোরা।
তার চোখে জল ঝরছিল। জীবনের অনিবার্য আর মর্মান্তিক পরিবর্তনটার ব্যাপারেই সে বলছিল।
এরপর প্রায় প্রতিদিনই সেই বেদনাবহ পরিবর্তনের কথা শুনতে হত তার মুখে; দুটো আবেগী-ভাবের কথা বলবো, তখনো সে ঐ বেদনাকেই ডেকে আনত। শব্দবুনন আর কথামালায় আকর্ষণীয় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও Schiraz এর গানগুলোতে যেমন ঘুরেফিরে একই দৃশ্যচিত্রই চলে আসে, তেমনি তার কথাগুলো যেমনই হোক, পুনরাবৃত্তির ভারে তাও একইরকম হয়ে যাচ্ছিল।
আমি জানিনা, কিভাবে সে বুকের উপরে মৃত্যুর আঙ্গুলের পরশ পেয়েছিল।
মাত্র ১দিনের আয়ু পাওয়া পতঙ্গদের জীবনের কোন ভবিতব্য নেই বলে তাদের সদাকার-কদাকার একই কথা। তাই আমিও ভেবেছিলাম, ইলিওনোরার চোখ ধাধানো লাবণ্য বুঝি তার আসন্ন মৃত্যৃ উপলক্ষ্যেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কবরের ভয় তাকে গ্রাস করছিল ; এক গোধুলিবেলায় নৈঃশব্দ্যের নদীতীরে বসে সেই অন্তর্যাতনার কথা সে আমার কাছে প্রকাশই করে ফেলল। তাকে সমাহিত করে রঙ-বেরঙের ঘাসের এই সুখী উপত্যকা ছেড়ে আমি বহুদূরে চলে গিয়ে বাইরের পৃথিবীতে হারিয়ে যাব, আর আমার প্রবল প্রেম, যা শুধু তারই নৈবেদ্য, তা-ও অন্য কোন নারীকে নিবেদন করব- এই ভাবনায় সে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল, তার দুঃখের সীমা যদিওবা ছিল, পরিসীমা ছিলনা মোটেকালেও। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে স্বর্গ আর তার নামে কসম করে বলেছিলাম, পৃথিবীর কোন মেয়ের সাথেই বিয়ের বাধনে জড়াবোনা, যাতে করে তার অম্লান স্মৃতি আর অকৃত্রিম প্রীতি, যা পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, তার খেলাপ করা হয়।
মহাবিশ্বের সেই মহাশক্তিমানকেও আমাদের মাঝে ডাকছিলাম আমার কসমের দৃঢ়তা আর বিশুদ্ধতা প্রত্যক্ষ করতে। ইলিওনোরা তখন আমার কাছে নারী নয়, এক স্বর্গের তপস্বিনী হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বর আর তপস্বিনীরূপী ইলিওনোরাকে সাক্ষী রেখে করা শপথ ভাঙলে কেমন ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে, তাও উচ্চারণ করছিলাম যাতে করে মনের খেয়ালে শপথভঙ্গের ইচ্ছা জাগলেও, শাস্তির ভয়ে আবার ফিরে আসি।
আমার কথা শুনে ইলিওনোরার সানলাইট চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল; বুকভরে সে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিল, যেন তার বুক থেকে একটা জগদ্দল পাথর নামিয়ে দিয়েছে কেউ। সে কাঁপছিল, শব্দ করে কাঁদছিলও, তবুও আমার কসম ( যার জন্য সে শিশুর মত অবুঝ হয়ে উঠেছিল) সে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছিল।
এক অনাবিল আনন্দ, আর অনিঃশেষ নির্ভারতায় সে মৃত্যৃশয্যায় শুয়েছিল।
এর কয়েকদিন বাদেই, এক সন্ধ্যায়, প্রান্তিক আয়ুসীমায় মুমূর্ষু অবস্থায়, সে আমায় বলেছিল আমার শপথে সে মরেও শান্তি পাচ্ছে, তাই প্রেমের মন্ত্রবলে মৃত্যুর পরও সে আমাকে চোখে চোখে রাখবে, এবং সম্ভব হলে রাতের নিকষ আঁধারে সে আমায় দেখা দেবে। আর যদি তার বিদেহী আত্মাকে সে ক্ষমতা না দেয়া হয়, তবুও অন্তত তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতির জানান দিতে সান্ধ্যবাতাসে সে আমার ওপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়বে, অথবা স্বর্গরাজ্যের কড়া বিধানের চাপে তার আত্মা এটাও করার অনুমতি না পেলে, দেবদূতদূতদের ধূপাধারে করে সে বাতাসে সুগন্ধি ছড়াবে, যাতে সেই সুগন্ধি বাতাস গ্রহণ করে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তাকে অনুভব করতে পারি...
দু’ঠোটের ফাক গলে ওটাই ছিল তার সর্বশেষ উচ্চারিত পঙক্তি; এরপরই তার সরল জীবনটাকে সে মৃত্যুর কাছে ইজারা দিয়েছিল, সেইসাথে আমার নিজের জীবনের প্রারম্ভিক আখ্যানেরও উপসংহার টেনেছিল।
এতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার বক্তব্যে সর্বোতভাবে সৎ থেকেছি। কিন্তু প্র্রেয়সীর মৃত্যুতে সৃষ্ট শোক আর সময়পথের বাধা অতিক্রম করে জীবনের ২য় পর্যায়ের দিকে যখন এগিয়ে চলি, আমার কেবলই মনে হতে থাকে আমার মস্তিষ্কের কোষে ছায়া জমে যাচ্ছে, যার প্রভাবে প্রথম জীবনের স্মুতিগুলোর স্বচ্ছতা আর শুদ্ধতাকে ক্রমেই অবিশ্বাস করতে শুরু করছিলাম।
তবে, এ ব্যাপারে আমার আরও কিছু বলবার আছে।
ইলিওনোরা-পরবর্তী বছরগুলো বিগত বছরের স্মৃতিভাণ্ডারকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছিল, আমিও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক রঙ-বেরঙের ঘাসের উপত্যকাতেই রয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আরও একবার প্রকৃতি তার বদলে যাওয়ার খেলা শুরু করে দিল।
তারার মত জ্বলজ্বল করা ফুলগুলো ছোট হতে হতে গাছের গুড়ির মধ্যে মিশে গিয়ে চিরতরে বিলীন হয়ে গেল, ঘাসের মহাসবুজ গালিচাও রঙ হারিয়ে শ্রীশূন্য হয়ে গেল, পদ্মলাল-পারিজাতগুলো একে একে শুকিয়ে গেল, তার জায়গা নিল চোখের চেয়েও কালো মিশকালো লতা; সেই লতাগুল্মগুলো বিশ্রীভাবে দোলে, আর প্রতিদিন শিশিরে ভিজে জবজবে হয়ে থাকে। এভাবে আমার পথ থেকে জীবন সরে যাচ্ছিল ক্রমশই।
লম্বা ফ্লেমিঙ্গো পাখিটা ওর পীতবর্ণের পালক আমার সামনে আর নাড়াতনা, বরং বিষণ্ন চেহারায় ওর সহচর পাখিগুলোকে নিয়ে উপত্যকা থেকে পাহাড়ের দিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল, সোনালী-রূপালি মাছগুলোও নদী থেকে নির্বাসন নিয়ে গিরিখাতের সংকীর্ণ অঞ্চলে এলেমেলো সাঁতরে বেড়াত; ওদেরও মন ভাল ছিলনা। নদীর কলতানের যে মূর্ছনা ইয়োলাসের বায়ুবীণাকেও ম্লান করে দিত, তাতেও ছন্দপতনের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল, এবং শেষমেষ তাও পুরনো নৈঃশব্দ্যের গাম্ভীর্যেই পরিণতি পেল। সেই সোনালী-লাল ঘনমেঘরাজিও পাহাড়ের চূড়া থেকে সরে সরে যাচ্ছিল, আবারো তাদের অস্পষ্টতা বৃদ্ধি চ্ছিল; সেই গুমোটতা নিয়েই তারা হাসপারের এলাকায় ফেরত গেল; রঙ-বেরঙের উপত্যকার সব রঙ ধীরেধীরে ঝাপসা হয়ে আসছিল।
এতকিছুর পরও ইলিওনোরাকে করা শপথ ভুলে যাইনি। কারণ দেবদূতের ধূপাধারের দোলনের শব্দ আমি শুনতে পেতাম; এক পবিত্র সুগন্ধি উপত্যকার বাতাসে ভেসে বেড়াত, এবং রাতের যে নিঃসঙ্গ প্রহরগুলোতে আমার হৃদস্পন্দন জোরালো হত, সেসময় আমার ভ্রু ভিজিয়ে দেয়া সুগন্ধি বাতাস দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে ভারাক্রান্ত হয়ে আমার কাছে আসত।
অব্যক্ত মর্মর ধ্বনি রাতের বাতাসকে ভরিয়ে তুলত, কিন্তু তা একবার, মাত্র একবারের জন্যই! ঠোটে অশরীরী ঠোটের ছোয়ায় আমি জেগে উঠতাম; আমার মনে হত এ যেন চিরনিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠা।
কিন্তু এই ছেলেভুলানো খেলায় আমার হৃদয়ের শূন্যতাগুলো পূর্ণ হতে চাইছিলনা। রক্ত-মাংসের প্রেমের জন্য আমি উতলা হয়ে উঠেছিলাম, যে প্রেম কানায় কানায় হৃদয়কে ভরিয়ে দিয়ে, উপচে পড়ার ইন্তেজাম করবে। একপর্যায়ে উপত্যকাটা আমার কাছে দুর্বিষহ লাগতে শুরু করল; এর প্রতিটি দৃশ্য ইলিওনোরার স্মুতি মনে করিয়ে দিয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল; সেই পীড়ন সইতে না পেরে উপত্যকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম নতুন পৃথিবীর পথে - জগতের অন্তঃসারশূন্যতা আর ডাকসাইটে বিজয়গুলোকে কাছ থেকে দেখবার আশায়। সেই ছিল আমার রঙ-বেরঙের উপত্যকা থেকে চিরপ্রস্থান।
(২)
নিজেকে আমি এক অদ্ভুত শহরে আবিষ্কার করলাম, যে শহরের সবকিছুই বোধহয় আমার রঙ-বেরঙের উপত্যকা জীবনে দীর্ঘদিন স্বপ্নে দেখা স্মৃতিগুলোকে মুছে ফেলার ব্যবস্থা করছিল। জমকালো রাজ-দরবারের আড়ম্বড়-ধুমধাম, অস্ত্রের উন্মত্ত ঝনঝনানি, আর নারীর প্রভা ছড়ানো যৌবন আমার মাথাকে আউলা-ঝাউলা করে দিচ্ছিল, আমি মাতাল হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু তবুও আমার আত্মা থেকে শপথ হারিয়ে যায়নি, বরং তখনো রাতের নীরব প্রহরগুলোতে ইলিওনোরার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। এরপরই একদিন দুম করে অশরীরী ইলিওনোরা হারিয়ে গেল; জগতটা চোখের সামনে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এল, এবং এক মহাগুরুত্বপূর্ণ চিন্তার সম্ভাবনায় অভিভূত হয়ে আমি নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেই চিন্তায় এক প্রবল প্রলোভন ছিল, আমি তাকে উপেক্ষা করতে পারছিলামনা।
যে বিলাসী রাজদরবারে আমি চাকরি নিয়েছিলাম, সেখানেই এক নারীর দেখা পাই আমি। অনেক দূরদেশ থেকে এসেছিল সে, এতদূর যে কেউই সে সম্বন্ধে জানতনা; আমারও এতসব জানবার প্রয়োজন ছিলনা, আমি শুধু তার রূপের খবরই রাখতে চেয়েছিলাম। সেই রূপ দেখে আমার হৃদয় মুহূর্তের মধ্যে শপথ ভুলে গেল, নিঃসঙ্কোচে তার পা-রাখার চৌকিতে মাথা নত করলাম। একে নির্লজ্জ প্রেমপূজা মনে হলেও আমার ভিন্নচিন্তার অবকাশ ছিলনা। তার নাম ছিল ইমেনগার্দ।
আমি ভাবি, উপত্যকায় ফেলে আসা আমার কিশোরী প্রেমিকার প্রতি মোহ-নেশা, হঠাৎ দেখা ইমেনগার্দের প্রতি ব্যাকুলতা, বিলাপ, কিংবা জীবনবাজি রাখা আরাধনার তুলানায় এমন কি-ই বা ছিল? এ তো সেই নারী যার পায়ের কাছে চোখের জলে নিজের সমগ্র আত্মাকে ঢেলে দেয়া যায়! আহ কি দীপ্তিময়, লাবণ্যময় ঐ ইমেনগার্দ!
সেই ভাবনার ক্ষণে আমার সময় কোথায় অন্যদের নিয়ে ভাববার! ইমেনগার্দ যেন নারী নয়. কোন দেবকন্যা! তার স্মুতি খেলা করা চোখের গভীরে তাকিয়ে আমি শুধু দুটো সত্তাকেই ভাবলাম- সে আর আমি।
অভিশাপকে থোড়াই কেয়ার করে আমি তাকে বিয়ে করলাম, অভিশাপের তীব্রতাও আমাকে ভাবাল না; এতটাই বেপরোয়া আমি! এরপরই একদিন নীরব রাতে আমার জানালা দিয়ে সেই নিঃশ্বাসটা এল যা আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাসগুলো জড়ো হয়ে আমার সেই অতিচেনা সুমধুর কণ্ঠে পরিণত হয়ে বলে গেল:
‘শান্তিতে ঘুমাও! তুমি এখন ইমেনগ্রাদের প্রেমে বুঁদ হয়ে আছো, কামনায়ও ইমেনগ্রাদ; মনের সবখানেই ইমেনগ্রাদের অনুশাসন, তারই বিধান। তাই ইলিওনোরাকে করা কসমের দায় থেকে তোমাকে মুক্তি দিলাম। তবুও এই কসমই তোমাদের স্বর্গে আবারো পরিচিত করবে’!
..................
বিঃদ্রঃ এটা খসড়া অনুবাদ।
। । চূড়ান্ত অনুবাদে আরও সংশোধন ও পরিমার্জন হবে। । ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।