আওয়ামী লীগ বদলালে দেশ বদলাবে-আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজন আধুনিক রাজনীতিবিদ। জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে হিসেবে তিনি বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার উত্তরাধিকারী। কিন্তু আমরা দেখেছি, অনেক সময় এর ব্যত্যয়ও ঘটে, আলেমের ঘরে জালেমও জন্মায়; সৈয়দ আশরাফের ক্ষেত্রে এ রকমটি ঘটেনি। তিনি দীর্ঘদিন বিলেতে কাটিয়েছেন এবং লন্ডনে মূলধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্রিটেন যখন আফগান মুজাহিদ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন শীতলযুদ্ধে আহত মৌলবাদী নেতাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছে, তখন সৈয়দ আশরাফ এর বিরোধিতা করেছেন এবং তখনকার অনেক রাজনৈতিক নেতার বিরাগভাজন হয়েছেন।
ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা কাগজের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং বাংলাদেশের বাইরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছেন। ফলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নানা অভিজ্ঞতায় ভরপুর এবং বর্তমান বিশ্বের 'মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ' রাজনীতিও তিনি বেশ ভালোভাবেই বোঝেন বলে মনে হয়। সুতরাং তিনি যখন এ কথা বলেন যে 'আওয়ামী লীগ বদলালে, বাংলাদেশ বদলাবে' তখন কথাটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায় এবং এ নিয়ে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রও তৈরি হয়।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং বলা যেতে পারে সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম। এ দলটির সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা।
বিশ্বের অন্য অনেক দেশেই দেখা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় এবং তারপর সেখান থেকে নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট দলটি মূলধারায় থাকে বটে, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য থাকে না। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের মুসলিম লীগের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর একেবারে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাওয়ার মতো বিপদ কম আসেনি। একাত্তরে এসেছে, পঁচাত্তরে এসেছে, তারপর ধারাবাহিকভাবে ২০০১ থেকে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর অবধি এমন বিপদ এসেছে। কিন্তু কার্যত দেখা গেছে, এসব আঘাত দলটিকে ভাঙতে তো পারেইনি, বরং ক্রমাগত এর ভিত্তিকে শক্ত করেছে।
সেটা কেমন? বঙ্গবন্ধু যে আওয়ামী লীগকে রেখে গেছেন, তাঁকে হত্যা এবং জেলের ভেতর আওয়ামী লীগ তথা জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পর এই দলটি যে আবার দাঁড়াতে পারবে, সেটাই ছিল কল্পনার অতীত। পঁচাত্তর থেকে আশি, এই পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের অবস্থা কল্পনা করলে যে দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে আজকের আওয়ামী লীগকে মেলানো যায় কি? যায় না, কোনোভাবেই যায় না। শেখ হাসিনা যখন মা-বাবা ও পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হারিয়ে, নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন, তখন তিনি যে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তা মূলত আওয়ামী লীগের কঙ্কাল, তাতে মাংস ও মগজ ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তবুও সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাঁরা শেখ হাসিনা ফিরে আসা পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন তাঁদেরও প্রশংসা না করে উপায় নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা ফিরে এসেই যে একেবারে স্বর্গোদ্যান পেয়েছিলেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
বরং তিনি দলীয় কোন্দলে ঠাসা, আন্তর্জাতিকভাবে সম্পূর্ণ বন্ধুহীন একটি রাজনৈতিক দল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মেয়েকে সামনে রেখে রাজনীতি করার জন্য তখনকার আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অনেক নেতার খায়েশ ছিল প্রকাশ্যই; কিন্তু শেখ হাসিনা দলের ভেতরে ও বাইরের সেই বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছেন। মজার ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনা আওয়ামী রাজনীতির হাল ধরেছিলেন বলেই বিএনপি নামক সামরিক ছাউনিজাত প্ল্যাটফরমেও জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়াকে প্রয়োজন পড়েছিল, সে হিসেবে বেগম জিয়া 'বাই ডিফল্ট' নেতা, পরবর্তী সময়েও এর নানাবিধ প্রমাণ আমরা দেখতে পাই, আজকের নিবন্ধে সেসব আর আলোচনায় আনছি না।
শেখ হাসিনা একে নারী, তার ওপর বাংলাদেশের নারী_এ দুটোর কোনোটিই তাঁর জন্য আওয়ামী রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ইতিবাচক ছিল না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব, শোষিতের গণতন্ত্র এবং ভারত-সোভিয়েত বন্ধুত্ব বিশ্বের মোড়লদের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না।
ফলে শেখ হাসিনাকে শুরু করতে হয়েছে একেবারে শূন্য থেকে। আজকে তাই যে আওয়ামী লীগকে আমরা দেখছি, তা সম্পূর্ণই শেখ হাসিনার নির্মাণ। বিশেষ করে এবার ক্ষমতায় আসার পর যে আওয়ামী লীগকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে আর কারোরই বিন্দুমাত্র কোনো হাত নেই,
একমাত্র শেখ হাসিনাই এর মা-বাবা বা স্রষ্টা_যা-ই বলি না কেন। যে কারোরই জন্য এ রকম একটি মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দলকে সামলে-সুমলে রাখা ভয়ঙ্কর কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস, এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলেও একাধিকবার ভাঙন এসেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে আছে ঋজু ভঙ্গিতে, মাঝখানে খানিকটা 'হাঙ্কিপাঙ্কি' হলেও এই দাঁড়িয়ে থাকার পেছনে রহস্য কী, সেটা রাজনৈতিক গবেষকদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি আকর্ষণীয় বিষয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন, তখন বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের প্রথম পর্ব চলছে, বাঙালি-বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশি-তত্ত্ব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়েছে, টাকা কোনো সমস্যা নয়_তত্ত্বে তখন উজ্জীবিত দেশ এবং হিজবুল বাহার প্রজন্ম অস্ত্র ও অর্থ হাতে দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার পক্ষে কোন পথটি খোলা ছিল এগোনোর? একেবারে সেক্যুলার, সাত্তি্বক, মুক্তবাজার অর্থনীতিকে অস্বীকার করা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটানো একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলা নাকি স্বৈরাচারের কু-রাজনীতির ছাইগাদার ওপর দাঁড়িয়ে সব পক্ষকে একটি জায়গায় স্থির রাখা এবং মোটামুটি একটি মিশ্র রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া? আমরা এখন এ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক করতে পারি, কিন্তু আশির দশকে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে তা নির্ণয় করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমাদের এ বিষয়টি মাথায় রাখলে আজকের শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষণ করা সহজ হবে বলে আমি মনে করি।
এটি একটি দীর্ঘ আলোচনার বিষয়, সম্পাদকের বেঁধে দেওয়া শব্দ সংখ্যায় এ নিয়ে আলোচনা পোষাবে না, এমনিতেই মনে হচ্ছে, আরো দুই সপ্তাহ এ বিষয় নিয়ে লিখতে হবে। তাই আগে থেকেই সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে রাখছি।
এ বিশাল বিষয়কে অল্প কথায় বলতে গেলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রকে আমরা যদি ধরতে পারি. তাহলে সৈয়দ আশরাফ কথিত এর বদল এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশের বদলের বিষয়টি একত্র করে আমাদের একটি উপসংহারে পেঁৗছাতে পারা সম্ভব হবে। নচেৎ আমরা শুধু কথার পর কথাই বলে যাব, শেষ হবে না কিছুই। যে কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কথা তোলা হলো তা হলো, বঙ্গবন্ধু যে সময়ে রাজনীতি করেছেন সে সময়ের প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আজকে মানুষের জীবন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার যে বিশ্বায়ন ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের গুরুত্ব আর আগের অবস্থানে নেই, বরং এত বেশি স্ট্র্যাটেজিক হয়েছে যে এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গুরুত্ব নোবেল পুরস্কারকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে। একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সঙ্গে এ রাজনৈতিক বিবেচনায় নোবেল প্রদানের বিষয়টিও মিলিয়ে দেখা যেতে পারে, যদিও এর প্রেক্ষাপট বিচারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে খানিকটা।
সুতরাং আজকের বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে অনেক ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর চেয়েও অধিক কৌশলী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষিপ্র ও কঠোর এবং আপসকামী হতে হয়েছে। আর জীবনের ঝুঁকি? বিশ্বের আর কোনো নেতা শেখ হাসিনার মতো এত বড় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি করেন কি না, তা আমার জানা নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান আওয়ামী লীগ আসলে মধ্য-বাম, মধ্য-ডান বা রাজনীতির কোন ধারায় একে ফেলে আমরা এই দলটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেব? বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সময় বা মেধা খরচ কোনোটাই করতে হয় না। কারণ, তারা নিজেরাই নিজেদের বলে ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শুরু করার পর আর তো আমাদের কোনো সন্দেহই নেই যে বিএনপি-জামায়াত আসলে একই বৃন্তের একটি ফল, শুধু যিনি যে নামে ডেকে সুখ পান, তিনি সেই নামেই এই দল দুটিকে ডাকেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগও নিজেদের সম্পর্কে কী বলে সেটা মুখ্য নয়, বরং জনগণ এ দলটির রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে, তা এখন জানাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, এরপর আমরা জাতীয়ভাবে যেদিকে এগোবো তা অনেক বেশি আমাদের ভবিষ্যৎ জাতি-চরিত্র নির্ধারণী। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ এখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যারা বিরোধিতার নামে অকাতরে হত্যা, নির্যাতন, অগি্নসংযোগে অংশ নিয়েছে ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে গণহত্যায়, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার আয়োজন করেছে। ফলে এ দলটি তাদের জাতীয় কর্তব্যের একটি বিশাল অংশ পালন করার কাজে হাত দিয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু এটাই তো সব নয়, দেশ এখন মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম থেকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে, মুক্তিযুদ্ধ নতুন প্রজন্মের সেন্টিমেন্টে একটি বিশাল জায়গাজুড়ে আছে বটে; কিন্তু সেখানে দেশের ভবিষ্যতের 'ভিন্ন চিন্তা'ও রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ সেই জায়গাটি ধরতে পেরেছে কি না? আজকে যে বদলের কথা সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, সেখানে নতুন প্রজন্মের বাঙালি-চেতনার কোনো উপকরণ আছে কি নেই, বর্তমান আওয়ামী লীগকে তা স্পষ্ট করেই একই সঙ্গে রাষ্ট্র, দল ও গণমানুষকে আগামী দিনের দিকে নিতে হবে_কিন্তু লক্ষণ কী বলে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।