ভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর প্রথম দিনই রিমির সাথে আমার জনম জনমের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চারমাস পরেই ও চলে যায় দিনাজপুর মেডিকেলে, পরিবারের সবার ইচ্ছা মেয়ে ডাক্তার হবে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম তখন। মোবাইল ছিল না, যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল চিঠি। আমার প্রথম চিঠির উত্তরে ওর চিঠিটা আমার সংগ্রহের এক অমূল্য সম্পদ।
এই চিঠিটা আমাকে চিঠি লিখতে শিখিয়েছিল, চিঠি লেখাকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল। এরপর আমি কত যে চিঠি লিখেছি। রোজ রোজ প্রতিটি বন্ধুর হাতে একটা করে চিঠি ধরিয়ে দিতাম, তাদের উত্তরের জন্য ঘ্যানঘ্যান করতাম। কত রঙের কাগজ আর কত রঙের কলম যে ছিল আমার চিঠি লেখার জন্য! এখন অবশ্য আর চিঠি লেখা হয় না কাউকেই।
কালরাতে পুরনো চিঠিগুলো খুলে খুলে পড়ছিলাম।
কত কত স্মৃতি, কত কত ঘটনা! হাসি-আনন্দ, মন খারাপ, মান-অভিমান.......আর রিমির প্রথম চিঠিটা, সবগুলো চিঠির মধ্যে সবচেয়ে সেরা। বারবার বারবার ঘুরে ফিরে পড়লাম।
আমার আদরের T, ১৪/১১/০২
ভালবাসা আর শুভকামনা জানিস। তোর চিঠি পেয়ে যতটা আনন্দ হয়েছে, ঠিক ততটাই কষ্ট হয়েছে। ভাল লাগার কারণ-তোরা আমার জীবনের সবচেয়ে সবচেয়ে আনন্দের, গৌরব আর স্বপ্নময় সময়ের, স্বচ্ছ আর মুক্ত আকাশের বন্ধুপাখি।
তোদের চিঠিতে যেন তোদের অবারিত ডানার গন্ধ আর অপূর্ব ডানা ঝাপটানোর বাতাস লেগে থাকে। আর কষ্টের কারণ.........বুঝিসইতো, আমি আমার আকাশ হারিয়েছি।
আমার জীবনে, জানিস, নিরঙ্কুশ আনন্দের সময় কখনো আসেনি। চিরকালই আমি বিষন্নতায় মলিন। কৈশোর থেকে তো ‘মন খারাপ’ কথাটা আমার জীবনে সিল মারা হয়ে গিয়েছিল।
তখন আমি যখন কোন প্রিয় মানুষকে চিঠি লিখতাম, তা হতো আমার আজকের চিঠির ভাষাগুলোর মতো কবিতা-কবিতা।
যখন আমি নিজেকে পড়াশুনার চাপ, দৈনন্দিন যাতায়াত, পরিশ্রম, দু:খ, আঘাত-সবকিছুর উপস্থিতি সত্ত্বেও নিরঙ্কুশ সুখী মনে করলাম, সেই আই.ই.আর-এ, তখন আমার চিঠির ভাষা হয়েছিল তোর চিঠিটার মত, প্রাণবন্ত, জীবনের সাথে নির্ভয়ে জড়িত।
আজকের চিঠি পেয়ে কি তবে বুঝতে পারছিস, আমি কেমন আছি?---তবু কষ্ট পাস না। আমি ঠিক আমার মত করে ভাল নেই, তবে ভাল আছি। জীবনে নিশ্চিন্ত প্রতিষ্ঠা, প্রিয় আপনজনদের অনাবিল সন্তুষ্টি-যান্ত্রিক পৃথিবীতে বোধহয় এগুলোই বেশি কাঙ্খিত।
‘যান্ত্রিক’ না বোধহয়, বলা উচিত ‘সদা দৌড়ায়মান পৃথিবী’।
যখন তুই লিখলি, “আমি আর পিকুল ‘ঢাবিসাস’ এ আবৃত্তি ক্লাস করছি.....”
“পড়ালেখা বাদ দিলে আমাদের দিন আগের মতই চলছে। সেইতো ক্যান্টিনে কি মল-চত্বরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে গ্যাঁজানো.....”
“আপা বলেছিল না, আই.ই.আর.-এ একদল উন্মাদ ভর্তি হয়েছে। এমন কিছু ভুল বলেনি। ”
..................আমার এমন উন্মাদ হতেই যে ভাল লাগে T!
এখানে ক্লাস এ বসে আমি শুধুই বুক মুচড়ে মুচড়ে খুঁজি শ্যামলী ম্যাডাম, রাশিদা ম্যাডাম, তাহমিনা ম্যাডাম, সিদ্দিকী স্যার, পাভেল স্যারদের উজ্জ্বল, ভালবাসা, স্নেহ আর বন্ধুত্ব মাখানো, আমাদের অনুভূতি, জিজ্ঞাসা, মতামতের প্রতি অ™ভুত সহনশীল মুখগুলো।
জানিস, এখানে সহজে ছুটি দিচ্ছে না। - অথচ আমি যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় যাবার জন্য উদগ্রীব - শুধু ভার্সিটি খোলা থাকলে গিয়ে তোদের সবাইকে একবার দেখবো বলে। আর বাসা, চিরকালের নিজস্ব টেবিল, বিছানা - বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটাকে বারবার চেপে ধরে সব।
আমি আর পারি না আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এর ঐতিহাসিক সুবিস্তৃত ভবন, মাঠ, রাস্তা, ভাস্কর্য, টি.এস.সি., আই.ই.আর., বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য যমজ বাস, ক্যাফেটারিয়া, শহীদ মিনারের ঝকঝকে স্মৃতিগুলো নিয়ে। আমি আর পারি না ‘আমার বাংলা আমার বৈশাখ’ নামের দেয়ালিকা, পহেলা বৈশাখ, মঙ্গলবারের স্বরশীলন, ক্যান্টিনের প্রতীক্ষা কয়েকজনকে নিয়ে, প্রথম শীত, ‘ধীরে চলুন’ এর সামনে ধীরে চলার স্মৃতিগুলো নিয়ে।
কি করে ভুলি বল!
ব্যস্ততায় ‘সলিল সমাধি’ না হয়ে গেল, মাঝে মাঝে সবার উদ্দেশ্যে একটা গণচিঠি লিখবো। - তুই কিন্তু নিয়মিত লিখিস। লিখতে বলিস আমাদের বাকি ৭ কনড্রিকথিস, মিশু, দ্যুতি, হিমেল, মাসুম, জামিকে।
আচ্ছা ১১ই ডিসেম্বর তোদের আমার ঘরে পাবোতো? যদিও এখন সন্ধ্যা হয় তাড়াতাড়ি। তোদের হয়তো সমস্যা হবে।
তবু বাসায় একটু বুঝিয়ে, আসতে পারবি না একসাথে? সক্কালে? বিকালে নাহয় তাড়াতাড়িই ফিরে যাস!
নাকি এক কাজ করবি- তোরা ‘দুম’ করে হারিয়ে যা আমার জীবন থেকে। বাসায় গেলেও যেন আমার আই.ই.আর.-এর স্বপ্নের মত প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কোন প্রতীক্ষা না থাকে।
আমার কথা সত্যিই বলে সবাই? জানি, মানুষ হারিয়ে যাওয়া মানুষকে একসময় ভুলে যায়। কিন্তু তোরা তোদের এই বোকা, অথচ জটিলতর জীবনাবর্তে ঘুরপাক খাওয়া বন্ধুটাকে অন্তত মনে রাখিস! অনেকদিন পর পর হলেও ক’জন একসাথে আমার গল্প বলিস! আমি তোদের সত্যিই বড় ভালবাসি। আমি তোর অদ্ভুত সুন্দর চোখ দুটোকে ভালবাসি।
আমি তোর অসামান্য বন্ধুত্বকে ভালবাসি।
--------------হ্যাহ। । মনের ভারে আমার বিছানা, টেবিল দেখছি ভেঙে যাবার যোগাড় হয়েছে! ইয়াব্বড় চিঠি জুড়ে শুধু নিজের কথা লিখছি বলে নিজেকে একটুও স্বার্থপর মনে হচ্ছে না। যে চ্যাপ্টারগুলো ক্লোজড, সেগুলোর গল্প হবে দেখা হলে।
তবু তুই ভাল থাকিস বন্ধু। তোদের মাঝে আমি দেখতে চাই পৃথিবীর মত গভীরতা, বিশালতা।
তোদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে, তাই না? খুব ভাল করতে হবে কিন্তু! তোরা এতটাই ভাল করবি, এতটাই ভাল অবস্থানে যাবি, এতটাই স্বচ্ছ মনের অধিকারী হবি যেন আমি একদিন গর্ব করে বলতে পারি-এরা আমার আই.ই.আর.-এর বন্ধু, আমি আই.ই.আর.-এর ৮ম ব্যাচের একদল উন্মাদের মাঝে একজন হতে পেরেছিলাম।
বন্ধু
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।