আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিঠিটা... (পরিচ্ছেদ ৪)

হিজিবিজি

আগের পর্ব: চিঠিটা... (পরিচ্ছেদ - ১) চিঠিটা... (পরিচ্ছেদ - ২) চিঠিটা... (পরিচ্ছেদ - ৩) ছয়মাস কি করে যে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। নতুন জায়গা, নতুন পড়া, অচেনা পরিবেশ আর ভয়াবহ চাপ - সংক্ষেপে এই ছিল সেই ছয়মাসের বর্ণনা। ঝঞ্ঝাতাড়িত রাতে জাহাজ যেমন দূরের লাইটহাউসের আলোর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে চলে; তেমনি আমিও সেই ডিসেম্বর মাসের প্রতিক্ষায় এই চাপ বহন করে চলছিলাম। সমাবর্তনের আগেরদিন রাতে বাড়ি এসে পৌঁছলাম। মা আমার এতদিন পর ছেলেকে দেখতে পেয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না।

সে একেবারে "মাটিতে থুলে পিঁপড়ায় খায়, মাথায় থুলে উকুনে খায়" অবস্থা। অস্বস্তি হচ্ছিল। মায়ের কাছে আমার আদর আর আব্দারের রাজত্বে এই কদিনের দুরত্ব কি করে যেন আপ্যায়নের বোঝা নিয়ে এসেছিল! অনেক রাত অবধি গল্প করলাম মাকে শান্ত করতে। "হ্যাঁরে, ওরা তোকে ঠিক মত খেতে দেয় তো?" "তোর যে মুরগির ঠ্যাং ভী্যণ প্রিয় সেটা ওদের বলেছিস তো?" "এই শীতে চানের জন্য গরমজল দিচ্ছে তো?" "কারো সাথে মারামারি করিসনি তো?" কি করে বোঝাই মাগো, হস্টেলে মায়ের প্রবেশ নিষেধ। শেষে রাশভারি বাবা এসে বাঁচালেন, "এতটা পথের ধকলে ও ক্লান্ত, ওকে ঘুমাতে দেবে না নাকি?" ইচ্ছা করছিল মায়ের পাশেই ঘুমাই; কিন্তু বড় হয়ে ওঠার লজ্জায় তা আর বলতে পারলাম না।

*** সকালে উঠতে দেরিই হয়ে গেল। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। প্রথমটা স্বপ্নের মত লাগছিল। চেনা পরিবেশ অনেকদিনের অনভ্যাসে কেমন অচেনা লাগছিল। উঠে বিছানার ওপর লেপ জড়িয়ে থম মেরে বসেছিলাম।

মা এসে বলল,"নাঃ হস্টেলে থেকেও তোর এই ঘুম থেকে উঠে গুম মেরে বসে থাকাটা গেল না। নে নে ওঠ। কত বেলা হয়ে গেল দেখেছিস? ফিরে যাবার আগে তোর পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে যাবি কিন্তু! যা যা আর লাগবেনা আলাদা করে দিয়ে যাবি। ও গুলো রদ্দিওয়ালার কাছে বেচে দেব। কি অবস্থা হয়ে রয়েছে দেখ।

আমি কিন্তু কিচ্ছুটি সরাইনি। যেমনটি রেখে গেছিলি দেখ, ঠিক তেমনটি আছে। " এগিয়ে গেলাম ঘরের কোণে জানালার ধারে আমার টেবিলটার দিকে। এটাই আমার ছাত্রজীবনের যুদ্ধক্ষেত্র - আরও ভালভাবে বললে অনুশীলনক্ষেত্র। যুদ্ধক্ষেত্রতো পরীক্ষার হল।

এই টেবিল আর সামনের বইয়ের তাকে আমার গোটা ছাত্রজীবনটা ছড়িয়ে আছে। আমার প্রথম ঝরণা কলম (ক্লাস ফাইভে বাবা কিনে দিয়েছিল), আমার কমিকসের ব্ই গুলো আছে দুনম্বর তাকে Resnik Haliday-এর ইংরাজি ব্যাকরণের বইটার পিছনে। আর অভিধান গুলোর পিছনে আছে কিছু নিষিদ্ধ ছবির বই। টেবিলের এক কোণায় পড়ে আছে আমার পাঁচ ক্লাস অবধি নিত্য নিয়ে যাওয়া টিনের বাক্স। দাদু কিনে দিয়েছিল।

আর তার উপরে অবহেলায় পড়ে আছে আমার কলেজ জীবনের নিত্যসঙ্গী কালো রঙের শতছিন্ন ব্যাগটা। ওতে পড়ার বই-খাতাও যেমন গেছে, ফিল্ডে পাথরও বয়েছি ওতে, আবার ফুর্তির প্রয়োজনে মদও ওতে করেই লুকিয়ে নিয়ে গেছি কলেজ হোস্টেলে। টুকরো স্মৃতি দিয়ে গড়া আমার মায়ার টেবিল। তাড়া ছিল, দ্রুত স্নানে যাই। *** বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরোতেই কেমন একটা ব্রাত্য অনুভূতি হল।

অবাক লাগল। যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্তর আমার জীবনের তিন বছরের সাম্রাজ্য ছিল সেটা কেমন যেন অচেনা লাগল। ভবন গুলিতে অচেনা রং, অচেনা মুখ জানান দিচ্ছে রাজা বদলে গেছে। গাছগুলো আর সুজিতের গুমটিই আমার সময়ের ধংসাবশেষের মত আজও অকৃত্রিম। "এই যে নদের নিমাই!" - বাবলুদা।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান জীবাশ্ম। কবে যে উনি কি পড়তে ঢুকেছিলেন আর এখন যে উনি কি করেন বা পড়েন তা আমাদের ছাত্রাবস্থায় আমরা জানতে পারিনি। মনে হয় না সে রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়েছ। ওনাকে পাওয়া যায় খেলার মাঠের আড্ডায়, ধাপিতে ও অন্যান্য সুপরিচিত ঠেকে। আর ঐ 'নদের নিমাই' টা ওনার যে কোনো ছেলেকে আদরের ডাক।

মেয়েদের ডাকটা আরও উচ্চাঙ্গের - 'সখিটা'। ওনার কাছেই জানলাম আমাদের দলবল নাথুদার ক্যান্টিনের সামনে ঠেক মারছে। গিয়ে দেখি সুমন, বিকাশ, ইয়াসিন, রক্তিমা ও অনুজ গোল হয়ে ঘাসে বসে গুলতানি মারছে। দৃশ্যমান হতেই সবাই হই হই করে উঠল। রক্তিমা ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠল, "বাব্বা! এই কদিনেই বেশ ভারিক্কি চেহারা বানিয়ে ফেলেছিস তোরে!?" বিকাশ ফোড়ন কাটলো, "হবে না? manager হতে চলল।

" সুমন গম্ভীরভাবে বলল, "এই বেশি হাসিস না। আজ আমাদের শোকের দিন। আজ থেকে আমরা confirmed bachelor। ডিগ্রির দ্বারা প্রত্যয়িত হতে চলেছি। " সবাই একসাথে হেসে উঠলাম।

আর মুহুর্তের মধ্যে আমার কিছুক্ষণ আগের বাধো বাধো ভাবটা কেটে গেল। সামগ্রিক বন্ধুত্বের শক্তিতে রাজা তার সাম্রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত - হোক না তা একটা দিনের। (চলবে...) পরের পর্ব: চিঠিটা... (শেষ পরিচ্ছেদ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.