ব্লগর ব্লগর হাজার বছর
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মরহুম আতাউল গণি ওসমানী। সিলেটের এই বীর সন্তান মুক্তিযুদ্ধে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তা গোটা জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। আমৃত্যু সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ওসমানী ছিলেন বঙ্গভঙ্গ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী। সামরিক কিংবা ব্যক্তিজীবনে তাঁর স্পষ্টবাদিতার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক সময় রাজনীতিতে জড়ালেও নীতিবোধ এবং স্পষ্টবাদিতার কারণে বেশিদূর এগোতে পারেননি।
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের অনেক জানা-অজানা ইতিহাসের নায়ক ছিলেন ওসমানী। তিনি জীবিত থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক প্রশ্নের উত্তরে নীরব থেকেছেন। বলতেন, তিনি বই লিখছেন যাতে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। জীবদ্দশায় সাংবাদিকদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক প্রশ্নের উত্তরই এড়িয়ে যেতেন। এসব প্রশ্নের ক্ষেত্রে প্রায়ই তাঁর জবাব ছিল, লিখিত পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ হলেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
ওসমানীর অন্তিম ইচ্ছে ছিল পাণ্ডুলিপিটি পাঁচ খণ্ডে বই আকারে প্রকাশ করবেন। এর মধ্যে দুটো খণ্ডে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের ঘটনাবলি। ওসমানীর ঘনিষ্ঠ সানি্নধ্যে ছিলেন এমন অনেকে বলেছেন, ওসমানী ঢাকায় এবং সিলেটে তাঁর বাড়িতে অবসর পেলেই পাণ্ডুলিপি লেখার কাজে বসে যেতেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হচ্ছে বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শাসন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতা দখলসহ অনেক ঘটনা সংবলিত লেখার পাণ্ডুলিপিটি তাঁর মৃত্যুর পরপরই রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যায়। বিগত আড়াই দশকে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই এই অমূল্য দলিলটি খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জেনারেল ওসমানীর সানি্নধ্যে দীর্ঘদিন ছিলেন সিলেটের আইনজীবী দেবতোষ চৌধুরী। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, ইংরেজি ভাষায় রচিত এ পাণ্ডুলিপিটি ওসমানী তিন-চার বছরে তৈরি করেছিলেন। তিনি জানান, ওসমানী ডিকটেশন দিতেন এবং গোলক বাবু ও সোহেল চৌধুরী নামে তাঁর দুজন সহকারী তা লিখতেন। পরে তা টাইপ করা হতো। ১৯৮৪ সালে ওসমানী চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান।
দেবতোষ চৌধুরী সে সময় ওসমানীর সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি জানান, মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে ওসমানী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করবেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পাননি। অ্যাডভোকেট দেবতোষ চৌধুরীর কাছ থেকে জানা যায়, ওসমানী যখন মারা যান তখন এই পাণ্ডুলিপিটি সিলেটের নাইওরপুলের ওসমানীর বাসভবন নূর মঞ্জিলে রক্ষিত ছিল। ওসমানীর বিশ্বস্ত কর্মচারী সিরাজ মিয়া তখন নূর মঞ্জিলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
ওসমানীর মৃত্যু সংবাদ সিলেটে পেঁৗছালে জালালাবাদ সেনানিবাসের তৎকালীন অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার গোলাম রব্বানী এবং অন্য সংস্থার কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে ওসমানীর বাসভবন নূর মঞ্জিল পুলিশ হেফাজতে রেখে তাঁর শয়নকক্ষ ও স্টোর কক্ষটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। পরে ওসমানীকে দাফনের পর 'ওসমানী ট্রাস্ট'-এর সদস্যরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নির্দেশে বিশেষ বিমানে সিলেট আসেন এবং নূর মঞ্জিলে এক বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে সিলেটের কর্নেল (অব) এ আর চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট এ টি এম দলিল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সম্মানিত ট্রাস্টিবৃন্দ ট্রাস্টের দলিল মোতাবেক সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দায়দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক ওসমানীর সব সম্পত্তি আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মচারী সিরাজ মিয়ার কাছ থেকে বুঝে নেন। পরে সব অস্থাবর সম্পত্তি নূর মঞ্জিলে বিশেষ ব্যবস্থায় রেখে কেবল ওসমানীর পাণ্ডুলিপি, এ সংক্রান্ত বই ও কাগজপত্র ৮টি ট্রাংকে বোঝাই করে ওইদিনই অপরাহ্নে বিশেষ বিমানে ঢাকা ফিরে যান।
এর পর থেকে এ পাণ্ডুলিপির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট দেবতোষ চৌধুরী ১৯৯১ সালের ৫ মে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের কাছে এক লিখিত আবেদনে পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধারের আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
মরহুম ওসমানীর এই পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করা গেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ঘটনা হয়তো জানা যেত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বিতর্কেরও হয়তো অবসান হতো।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার। কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থেই ইতিহাসের এই অমূল্য দলিলটি উদ্ধার করা দরকার। ওসমানীর সেই পাণ্ডুলিপিটি আদৌ উদ্ধার করা সম্ভব হবে কি না কে জানে।
সূত্র:আহমেদ নূর,কালের কন্ঠ,১৬-২-২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।