আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যু হয়েছে কার ? ছেলেটার ! নাকি আমাদের মনুষ্যত্ব আর বিবেকের!



*বাবা আমার খুব কষ্ট হয় সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে,তুমি আম্মুকে বলবা আমাকে টিফিনের জন্য পাঁচটা টাকা দিতে। *বাবা, সামনে আমার এস.এস.সি পরীক্ষা,আমি স্কুল স্যারের বাংলা ব্যাচে যাব আগামী মাস থেকে তুমি আমাকে টাকা দিবা,তা না হলে আমি বাংলায় খারাপ করবানি। *রানা ভাই,তোমার পরীক্ষা হয়ে গেলে তোমার টেষ্ট পেপার আর নোটবই গুলো আমাকে দিও। *বাবা তুমি আমাকে গত বছর ঈদে ফাঁকি দেছো। এ বছর ঈদে আমাকে ভালো একটা শার্ট কিনে দিবে।

পাঠক,উপরের কথা গুলো খুলনার সেন্ট জোষেফ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র জুলহাস খলিফা রমজান(১৫) এর। বাবা ক্ষুদ্র আয়ের একজন পেশিজীবি। পেশিজীবি বলছি কারন পেশির উপর নির্ভর করে যাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তারা তো পেশিজীবিই। যদিও পেশিজীবি বলতে বাংলায় কোনো শব্দ নেই। পেশিতে যতদিন জোর আছে ততদিন পেট চলবে,পেশির জোর শেষ তো সব শেষ।

মুখে তালা,অন্তরে রোজা,চোখে ধোঁয়াটে ধূষর শূণ্যতা। আর জুলহাসের বাবা এই পেশির জোর খাটিয়েই শক্ত হাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানির লাইন মেরামত করে যা আয় করেন তা দিয়ে স্ত্রী,নিজের চব্বিশ,বাইশ আর পঁনের বছরের তিন ছেলে এবং পুত্র প্রত্যাশী এক নিকট আত্মীয়ের ফেলে দেওয়া তিন বছরের প্রতিবন্ধী কন্যা সন্তান সহ ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে শহরের বস্তিতে ভাড়া করা একটি মাত্র কক্ষ এবং এক চিলতে সরু বারান্দা বিশিষ্ট একটি খুপরি ঘরে বসত করেন। যা আয় হয় তা দিয়ে আগুন ধরানো দ্রব্য মূল্যের বাজারে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে টিকে থাকা। তারপর আবার তিন ছেলের লেখাপড়ার খরচ। যদিও তিন জনের খরচ যোগাতে পেরে ওঠেন না,তবুও তিনি ছেলেদের পড়াশুনা বন্ধ করেননি।

কারন তিনি নিজে পেশিজীবি,কোন সম্পদ ও তাঁর নেই। সম্পদ বলতে যা তা ঐ তিনটি ছেলেই। ওরা একদিন পড়াশুনা শিখে বড় মানুষ হবে,চাকুরী করবে,সংসারের অভাব ঘুচবে। ম্যানশন,ভিলা,কটেজ(যদিও শহরের কটেজ গুলো দেখে কটেজ বা কুঁড়ে ঘর মণে করার কোন উপায় কিংবা কারন নাই),আবাস,নিবাস,হাউজ,নীড় কিংবা মহল এর মত বড় কিছু না হোক,অন্তত কোনমতে মান-সন্মান এর সাথে সবাইকে নিয়ে মাথা গোজার একটু জায়গা হবে,আর তাও যদি না হয় তবে একটু ভালো পরিবেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা যাবে হয়তো। সে আশাতেই পথ চলা।

আশা পূরণ হোক অথবা না হোক শত বাস্তবতার মাঝেও মানুষতো আশা নিয়েই পথ চলে,ভবিষ্যত স্বপ্নের জাল বোনে নিরবে নিভৃতে। হোকনা সে আশা অধিকাংশ মানুষেরই জীবনে শুধুই মরীচিকা! বাবা আনিসুর রহমানও তাই করতেন। পেটের দানবীয় আর রাক্ষসী ক্ষুধাকে অনেক সময় পেটে পুষে রাখলেও ছেলেদের পড়াশুনা চালিয়ে যাবার জন্য তিনি তার সাধ্যের বাইরেও অনেক কিছু করেছেন। ছোট ছেলে জুলহাসের আগামী বছর এস.এস.সি পরীক্ষা। তাই শিক্ষক নাম মাথায় রেখে বিদ্যালয়ে চাকুরী করতে এসে শ্রেণী কক্ষে একটা অক্ষর ও না শেখানো স্কুল শিক্ষকদের বাসার স্পেশাল ব্যাচ, নব্য নয়াল ভাইয়াদের রমারমা ব্যাবসা সফল কোচিং সেন্টার,গণিত বিষয়ের স্পেশাল একক প্রায়ভেট ব্যাচ সবই তিনি ছেলেকে দিয়েছেন।

কারন হাজার কষ্ট আর অভাবের কামড় সয়ে হলেও তিনি ছেলেকে দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করাতে চান। ছেলে বড় হবে,প্রতিষ্ঠিত হবে,চাকুরি করবে,ছেলের সাফল্যই একদিন নদীর জোয়ারের ঢেঁউ এর মত সব কষ্ট ভাষিয়ে নিয়ে যাবে। হ্যাঁ নদীর জোয়ার এসে সব কিছুই ভাষিয়ে নিয়ে গেছে,তবে তা কষ্ট নয়,নিয়ে গেছে স্বপ্ন, নিয়ে গেছে আশা। যা আর কখনোই দেখা দেবেনা দুপুরের তীব্র রোদে পোড়া কালো পিচের রাস্তা কিংবা মরুভূমির কোন জলশূন্য স্থানের মরীচিকা হয়েও। আর স্বপ্ন,আশা এসবের বদলে যা দিয়ে গেছে তা এক বুক হতাসা,দু-চোখ ভরা কান্না,ধোঁয়াটে ধূসর দৃষ্টি আর আমরণ দীর্ঘশ্বাস।

গত পাঁচ মার্চ ২০১০(2010) “ই.হক কোচিং” নামের একটা কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আয়োজিত শিক্ষা সফর বনাম পিকনিকের একটি আয়োজনে গিয়ে জুলহাস আর ফিরে আসেনি,আসতে পারেনি। এসেছে তিনদিন পর তার অর্ধ গলিত লাশ.........!!!!!!! সর্বনাশী,রাক্ষসী রূপসা তাকে সাপের মত গিলে খেয়ে ফেলেছে,শকুনের মত ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে ছিড়ে খেয়ে ফেলেছে,মাংশাসী বাঘ সিংহের মত কামড়িয়ে খামছিয়ে খেয়ে ফেলেছে। ভন্ড রাজনীতিবিদ,ক্যাডার পোষা ক্ষমতাবান বড় বড় নেতা,নষ্ট ভ্রষ্ট দেশ রক্ষক,দূর্নীতিবাজ আমলা,কর্মকর্তা,কর্মচারীরা যেমন ক্ষুধার্থ কুকুরের মত আমাদের এ দেশটাকে মজাদার লোভনীয় খাবারের মত চেঁটে পুটে খেয়ে ফেলছে, অজগারের মত শান্ত হয়ে পড়ে থাকা রাক্ষসী রূপসা ও তেমনি করে জুলহাসের বাবা-মার সব আশা ভরষা আর স্বপ্ন গুলোকে চেঁটে পুটে খেয়ে ফেলেছে। জুলহাস নদীর পানিতে শরীর এবং পায়ে লাগা কাঁদা ধুঁয়ে পরিস্কার করতে গিয়ে রূপসার জলে ডুবে মারাগেছে গত পাঁচ মার্চ ২০১০ শুক্রবার দুপুর সোয়া বারোটায়! (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.