ফটোগ্রাফি এক ধরনের নেশা। অনেক আগে থকেই এ নেশায় আমি আক্রান্ত। কিন্তু এ নেশা কখনোই পেশা হিসেবে নেইনি। যার কারনে ফটোগ্রাফিতে প্রচুর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আমার ভাল/দামী কোন ক্যামেরা নেই বা নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। যখনই কোন ক্যামেরা হাতে পেয়েছি (তা সেটা ফিল্ম ক্যামেরাই হোক আর মোবাইল ক্যামেরা কিংবা ডিজিটাল ক্যামেরাই হোক) ফটো তুলেছি।
যাহোক, ফটোগ্রাফিতে আমার আগ্রহের বিষয় হল নাইট ফটোগ্রাফি। কারন একজন ফটোগ্রাফার কতটা দক্ষ তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার নাইট ফটোগ্রাফিতে। নাইট ফটোগ্রাফিতে ফটোগ্রাফারকে তার দক্ষতার মুনশিয়ানা দেখাতে হয়। কেননা হালের পয়েন্ট এন্ড শ্যুট ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে দিনের বেলা অবজেক্টের দিকে তাক করে ধরে শাটার বাটন চেপেই যে কেউ সুন্দর সুন্দর ছবি তুলতে পারে এবং বন্ধু বান্ধবদের তাক লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু রাতের বেলা বা কম আলোতে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।
এক্ষেত্রে ক্যামেরা ম্যানুয়ালি ম্যানিপুলেট না করলে অনেক দামী (প্রফেশনাল বা ডিএসএলআর) ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেও ছবি ভাল আসে না। অথচ সামান্য অপশন পরিবর্তন করেই অনেক কম রেজুলুশন ক্ষমতা সম্পন্ন ক্যামেরা দিয়েও চমৎকার রাতের ছবি তোলা সম্ভব।
যাহোক এ লেখায় আমি আমার নাইট ফটোগ্রাফির ক্ষুদ্র জ্ঞান/অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করব। এবং এ লেখা অবশ্যই দক্ষ ফটোগ্রাফারদের জন্য নয়। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকে সুচিন্তিত মতামত আশা করছি।
নাইট ফটোগ্রাফির মূলমন্ত্র
ভাল ছবি তোলার জন্য রাতের বেলা/কম আলোতে যে অপশনগুলো আপনাকে পরিবর্তন করতে হবে তা হলঃ আইএসও, এক্সপোজার টাইম (শাটার স্পীড) এবং এপারচার ভ্যালু। এর পাশাপাশি ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন এবং ভাইব্রেশন রিডাকশন অপশন দুটোও কাজে লাগাতে পারেন (যা বর্তমানের অধিকাংশ ডিজিটাল ক্যামেরাতেই থাকে); তবে নাইট ফটোগ্রাফিতে এর ভুমিকা সামান্য।
১। আইএসও- (ISO)--এর অর্থ হল আপনার ক্যামেরা আলোতে কত সংবেদনশীল (সেনসেটিভ)। যত বেশি আইএসও সিলেক্ট করবেন (অর্থ্যাৎ ক্যামেরার সেন্সরকে বেশি আলোক সেনসেটিভ করবেন), একই ধরনের ছবি তুলতে তত কম এক্সপোজার টাইম লাগবে।
তবে নাইট ফটোগ্রাফির জন্য আইএসও-র সুত্র হল---প্রায় সকলক্ষেত্রে রাতের বেলা আপনাকে ভাল ছবির জন্য আইএসও বাড়াতে হবে। আর নাইট ফটোগ্রাফির জন্য সর্বজন স্বীকৃত আইএসও হল ৪০০। আপনি প্রয়োজনে এরচাইতেও বাড়াতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই এপারচার অথবা এক্সপোজার টাইম পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা ছবিতে গ্রেইন আসবে। আইএসও-র বেলায় কয়েকটি জিনিস মনে রাখবেনঃ-
ক।
কাছের স্থির অবজেক্ট (যেমন ফুলের ছবি বা কারো পোর্ট্রেইট) এর ক্ষেত্রে আইএসও খুব বেশি না বাড়ানোই ভাল।
খ। যদি অবজেক্ট কাছে এবং স্থির হয় এবং আপনি ট্রাইপড ব্যবহার করেন এবং যেখানে অবজেক্ট ফ্ল্যাশ রেন্জের মধ্যে সেখানে আইএসও না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
গ। যদি অবজেক্ট মুভিং হয় (যেমন ষ্টেজ শো, কনসার্ট, বার্থডে পার্টি, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি) এবং আপনি ট্রাইপড ব্যবহার না করে থাকেন তাহলে আইএসও যতদূর সম্ভব (প্রয়োজনমত) বাড়িয়ে দিন।
এবং এর সাথে সাথে এক্সপোজার টাইম কমাতে হবে (শাটার স্পীড বাড়াতে হবে)। নতুবা ছবির সাথে ভৌতিক ছায়ার আবির্ভাব ঘটতে পারে।
ঘ। সাধারণভাবে যেখানে আলো কম এবং অবজেক্ট ফ্ল্যাশ রেন্জের বাইরে সেখানে আইএসও বাড়াতেই হবে।
২।
এক্সপোজার টাইম (শাটার স্পীড)-- কতক্ষন আপনার ক্যামেরার শাটার খোলা থাকবে (শাটার স্পীড এর মাধ্যমে) এবং এর ফলে কতক্ষন আপনার ক্যামেরার সেন্সর আলোয় এক্সপোজ থাকবে (এক্সপোজার টাইম)। এক্সপোজার/শাটার স্পীড ক্যামেরা ভেদে ৬০ সেকেন্ড থেকে ১/৮০০০ সেকেন্ড পর্যন্ত হতে পারে। নাইট ফটোগ্রাফিতে প্রায় সকল ক্ষেত্রে আপনাকে এক্সপোজার বাড়াতে হবে। তবে মনে রাখবেন খালি হাতে (ট্রাইপড ব্যবহার না করা হলে) এক্সপোজার ১/১৫ সেকেন্ডের বেশি দিলে ছবি ব্লার আসবে। এরচে বেশি এক্সপোজারে ছবি তুলতে হলে অবশ্যই ট্রাইপড ব্যবহার করতে হবে।
যদি ট্রাইপড না থাকে তাহলে রিমোট কন্ট্রোলার ব্যবহার করতে পারেন। যদি ক্যামেরায় রিমোট কন্ট্রোল না থাকে (সাধারণত ডিএসএলআর বা কিছু সেমি ডিএসএলআর ক্যামেরায় রিমোট কন্ট্রোল থাকে) তাহলেও দুশ্চিন্তার কিছু নাই সেক্ষেত্রে ক্যামেরাকে কোন দেয়াল বা স্ট্যান্ড এর উপর রেখে ক্যামেরার “সেল্ফ টাইমার” অপশন ব্যবহার করতে পারেন; এতে কিছুটা হলেও কাজ হবে। আর এক্সপোজারের ক্ষেত্রে যে জিনিসটা মনে রাখবেন তা হচ্ছেঃ
ক। যদি আপনি বেশি এক্সপোজার ব্যবহার করেন তাহলে এপারচার ভ্যালু (f) বেশিতে সেট করার চেষ্টা করুন (নতুবা ছবি ওভারএক্সপোজড/সাদা আসবে)। আর যদি কম এক্সপোজার ব্যবহার করেন তাহলে এপারচার ভ্যালু (f) কমে সেট করার চেষ্টা করুন (নতুবা ছবি অন্ধকার/কালো আসবে)।
৩। এপারচার---এপারচার হল আপনার চোখের মনির মত। চোখের মণিতে আলো বেশি পড়লে মণি আপনা আপনি ছোট হয়ে যায় আবার অন্ধকারে/কম আলোতে মণি বড় হয়ে যায়। এপারচারও সেরকমই। পার্থক্য শুধু--ক্যামেরা আপনার চোখের মত নিজে নিজেই তার মনি (এপারচার) ছোট-বড় করতে পারে না।
রাতের বেলা এই কাজটাই আপনাকে ম্যানুয়ালি করতে হবে (এপারচার ছোট-বড় করার কাজ)। ক্যামেরার এপারচারকে সাধারণত এফ (f) দিয়ে প্রকাশ করা হয়; যেমন—f2, f8....f32 ইত্যাদি। মনে রাখবেন এপারচার ভ্যালু যত বাড়বে ক্যামেরার চোখের মনি তত ছোট হতে থাকবে (অর্থ্যাৎ ক্যামেরায় আলো কম প্রবেশ করবে), পক্ষান্তরে এপারচার ভ্যালু যত কমবে ক্যামেরার চোখের মনি তত বড় হতে থাকবে (অর্থ্যাৎ ক্যামেরায় আলো বেশি প্রবেশ করবে)। আর নাইট ফটোগ্রাফির সুত্র হল---প্রায় সকলক্ষেত্রে এপারচার ভ্যালু কমাতে হবে। পাশাপাশি নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখবেনঃ-
ক।
যদি আপনার ছবিতে পুরো ফ্রেমের সবকিছুকে (ফোরগ্রাউন্ড এবং ব্যাকগ্রাউন্ড এর) হাইলাইট করতে চান তাহলে এক্সপোজার অনেক বাড়িয়ে দিয়ে (মোটামুটি ১ সেকেন্ড বা এরকম) এবং এপারচার ভ্যালু বাড়িয়ে দিয়ে (f16 বা f22) ছবি তুলুন। এতে ছবিতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের আবহ বিরাজ করবে (যেমন—সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্তের দৃশ্য বা গোধুলীর সময় কোন ছবি তোলার সময়)
খ। আপনি যদি শুধু ফোরগ্রাউন্ডের কিছু হাইলাইট করতে চান তাহলে উপরের পদ্ধতির উল্টোটা করুন। অর্থ্যাৎ এক্সপোজার কমিয়ে দিন (মোটামুটি ১/২৫০ সেকেন্ড বা এর আশেপাশে) এবং এপারচার ভ্যালু কমিয়ে দিন (f8 বা আরো কম)।
ক।
যদি দিনের বেলা পোর্ট্রেইট ছবি নিতে চান তাহলে এপারচার ভ্যালু বাড়াতে হবে এবং এক্সপোজার সামান্য বাড়াতে হবে; এতে ব্যাকগ্রাউন্ড ঝাপসা হয়ে যাবে কিন্তু ফোরগ্রাউন্ডে থাকা ব্যক্তির ছবি স্পষ্ট উঠবে। (আপনার প্রেয়সীকে সমুদ্র বা দূরবর্তী কোন পাহাড়/দৃশ্যের সামনে রেখে এ পদ্ধতিতে ছবি তুলুন আর তাকে দেখান…সে আপনার ফটোগ্রাফির ভক্ত হয়ে যাবে )
খ। রাতের বেলা যতদূর সম্ভব ফ্ল্যাশ এড়িয়ে চলুন।
একটা জিনিস মনে রাখবেন—রাতের বেলা প্রায় উপরের তিনটি জিনিসই একসাথে পরিবর্তন করতে হবে। শুধু একটি (শুধু আইএসও বা এপারচার) পরিবর্তন করলে চলবে না।
আপনি কি ধরনের ছবি চাচ্ছেন (পোর্ট্রেইট/ল্যান্ডস্কেপ/ফোরগ্রাউন্ড/ব্যাকগ্রাউন্ড) এবং পরিবেশের আলোর অবস্থার উপর নির্ভর করে উপরের তিনটি জিনিস ঠিকমত পরিবর্তন করে রাতের রহস্যময় মুহূর্তগুলো আপনার ফ্রেমে বন্দী করতে পারবেন। আর নাইট ফটোগ্রাফির বিষয়গুলো ভালভাবে আয়ত্ব করতে পারলে আমি বাজি ধরে বলতে পারি দিনের বেলা ফটো তোলা আপনার কাছে জলবৎ তরলং মনে হবে। কাজেই হ্যাপ্পি ফটোগ্রাফিং...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।