আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হলিউডে আমেরিকার চরিত্র!



‘গুড শেফার্ড’ নগ্ন করেছে আমেরিকার চরিত্র! মৃণালকান্তি দাস ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত অসংখ্য কফিনে ঢাকা লাশ সেদিন টলিয়ে দিয়েছিল গোটা মার্কিন মুলুককে। পুত্রশোকের আবেগ তাড়িত করেছিল মার্কিনী মায়ের হৃদয়। ছিন্ন হাত, খণ্ডিত দেহ কিংবা নাপামে দগ্ধ শিশুর শরীর টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে আমেরিকানরা নিজেদের অজান্তেই শরিক হয়েছিলেন যুদ্ধবিরোধী মিছিলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনী বর্বরতার বিরুদ্ধেই দীর্ঘ মিছিল হেঁটেছিল বোস্টন থেকে ওয়াশিংটন। যুদ্ধবিরোধী শান্তি সমাবেশে তুমুল বিক্ষোভ কাঁপিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগানের গদি।

প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কোনো এক অচিন্ত্যনীয় পরিত্রাতার। এক প্রবল পরাক্রান্তার। ‘জাতীয় অপমানের আগুন’কে স্তিমিত করতে সেদিন এগিয়ে এসেছিল মার্কিনী চলচ্চিত্র শিল্প। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শ প্রচারের উদ্দেশে হলিউডে তৈরি হতে শুরু করেছিল হিংসাশ্রয়ী ছবি। সাম্রাজ্যবাদের জঠরে জন্ম নিয়েছিল এক কাল্পনিক যোদ্ধা।

ভিয়েতনামের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি থেকে সমগ্র দেশকে মুক্ত করতে, রাষ্ট্রপতি রেগানের গদি সামলাতে সেদিন মার্কিনী প্রতিশোধ-স্পৃহা জন্ম দিয়েছিল ‘রা‌ম্বো’র। আটের দশকে বিশ্বের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় হলিউডের সেই ভয়াবহ সন্ত্রাসের প্রাণশক্তি ছিল রাম্বো চরিত্রে অভিনেতা সিলভেস্টার স্ট্যালোন। হলিউডি শিল্পে এতো নগ্ন মিথ্যাচার, এতো তীব্র আক্রোশ আর প্রতিহিংসার বিকৃত কুৎসা, এতো স্নায়ুবিদারক কাল্পনিক অপরাধের প্রচারাভিযান এর আগে বিশ্ব কখনও দেখেনি। রাম্বোর ছবিগুলিতে প্রতি ঘণ্টায় ঘটেছে ১৬১টি হিংসাশ্রয়ী ঘটনা। এর মধ্যে ৫৪টি ঘটনায় রাম্বো সোভিয়েত এবং ভিয়েতনামের মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে।

আর বিশ্বভ্রমণে রাম্বো টিকিট বিক্রিতে বক্স অফিস রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আসলে মার্কিন-সংস্কৃতির তীব্র অস্থিরতা আর আগ্রামী রুচির অচরিতার্থতার জ্বালা যন্ত্রণা প্রতিফলিত হয়েছে রাম্বোর চরিত্রে। বিশ্বের তাবড় গণমাধ্যমের কলমবাজ আর ক্যামেরার মিথ্যা কথনের বিস্ময়কর শক্তিতে বলীয়ান হলিউড ‘জন রাম্বো’ কে তৈরি করার চেষ্টা করেছে এক কল্পিত অপরাজেয় মার্কিনী পৌরুষের প্রতীক হিসেবে! যা তাড়িয়ে উপভোগ করেছে গোটা বিশ্ব। আটের দশক জুড়ে হলিউড গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছে রাম্বোর দাপাদাপি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশল।

লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। একইসঙ্গে চলেছিল মার্কিন দেশাত্মবোধের প্রলেপ লাগানো সেই যুদ্ধভিত্তিক ছবিতে কাল্পনিক বিশ্বদখলের প্রক্রিয়া। ১৯৮২-তে রযাল ম্বো সিরিজের প্রথম ‘ফার্স্ট ব্লাডের’ মুক্তি। দর্শকদের ভাবনায় চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসা এক কাল্পনিক একক যোদ্ধার বিশ্বভ্রমণ শুরু। যদিও আজকের যুদ্ধের কৃৎকৌশল আর বুদ্ধিবৃত্তির অতলান্ত গভীরতা সম্পর্কে আশির দশকের রাম্বো ছিল অজ্ঞ।

তাই তখন রাম্বোর মস্তিষ্কের অনেক ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে তার ইয়াঙ্কি পেশিশক্তির পাথুরে পরাক্রম। সাম্রাজ্যবাদী হলিউডি শিল্পের অমোঘ যুক্তিতে তা প্রদর্শন করেই রযাদ ম্বোর বিশ্বজোড়া আধিপত্য। ১৯৮৮ সালে ‘রাম্বো থ্রি’ মুক্তির পর সিরিজের ইতি টানেন স্ট্যালোন নিজেই। দু’দশক বাদে আবার রাম্বো হতে চাইছেন কেন স্ট্যালোন? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্ট্যালোন নিজেই বলেছেন, ‘রাম্বোর শেষপর্ব আফগানিস্তনের পটভূমিতে। যেখনে রাশিয়ান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল রাম্বো।

একই হারিয়ে দিয়েছিল রাশিয়ান সেনাদের। এতোদিনে সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের স্মৃতির ওপর সময়ের ধুলো জমেছে। আজ পরিস্থিতি অন্যরকম। এই সময়ে আফগানদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রযাত ম্বোর লড়ার দৃশ্য মার্কিনীরা ভালো চোখে দেখছে না। তাই নতুনভাবে রাম্বো প্রত্যাবর্তন।

’ ঠিক তাই। দুনিয়ার সন্ত্রাসবাদীদের জন্ম দেওয়ার আঁতুরঘর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আজ ভয়ার্ত মনোবিকলনের বিকারে সন্ত্রস্ত। উন্মত্ত অস্থিরতায় সমস্ত কিছুই সর্পভ্রমে ছোবল মারছে মারণবিষে। রাম্বো থ্রি মুক্তির আগে হোয়াইট হাউস ভাবতেই পারেনি, মার্কিন জাত্যাভিমানের প্রতীক টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ক্রমপর্যায়ের দ্রুত পতনশীল দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজেদের নিদারুণ অসহায়-বিপন্নতার কথা ভাবতে হবে।

৯/১১-র আতঙ্কের মানসিক বিকৃতি আজও তাড়া করে ফিরছে মার্কিনীদের। যে আফগানিস্তানে ইসলামের নামে মানবতার বিরুদ্ধেই মৌলবাদের জেহাদকে দীর্ঘদিন ধরে লালন-পালন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ৯/১১-র ঘটনার পর সেই আফগানিস্তান এখন মার্কিনীদের চরম শত্রু। প্রতিদিন আফগানিস্তানে হারছে ন্যাটো। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ইরাকে প্রতিরোধের মুখে ইয়াঙ্কি সেনা। ফলে রাম্বো থ্রি থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতে হবে।

ষাট বছর পেরিয়েও তাই পেশির আস্ফালনে সিলভেস্টার-স্ট্যালোন ফিরতে চাইছেন পুরানো ভাবমূর্তিতে। মুক্তি পেয়েছে ‘রাম্বো’-র চতুর্থ পর্ব। ছবির নামও ‘রাম্বো’। এবার পটভূমি এশিয়া ভূখণ্ডে বার্মা মুলুকে। পরিচালক স্ট্যালোন নিজেই।

‘সন্ত্রাসবাদের রক্তাক্ত’ বধ্যভূমিতে রাম্বোই পরিত্রাতা। মার্কিন মুলুকের ভয়াবহ সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র রাম্বো’। একই কথা বলে আসছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান থেকে জর্জ বুশ। রাম্বোর প্রত্যাবর্তন কোন্ সঙ্কটের মুক্তি আশায়? এর পেছনে কি ইরাক যুদ্ধে তৈরি হওয়া মার্কিন সমাজে গভীর ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে? নাকি এশিয়া ভূখণ্ডে থাবা বসানোর কাল্পনিক প্রচেষ্টা? আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হলিউডকে বরাবরই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে। হলিউডকে ব্যবহার করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ-র ষড়যন্ত্রের কাজে।

তার প্রমাণও মিলেছে একাধিকবার। সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ’র কর্মকর্তারা হলিউড কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেছিলেন। বৈঠকে সি আই এ’র দক্ষ অফিসার পল ব্যারিকে হলিউডের সাথে সি আই এ’র সমন্বয় গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছেন। খোদ মার্কিন সংবাদ সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ঐ বৈঠকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ হলিউডকে তার সবচেয়ে দক্ষ ও সাহসী কর্মীদের নামের তালিকা সরবরাহের অনুরোধ করেছে। যাতে এই কর্মীদেরকে নামের তালিকা সরবরাহের অনুরোধ করেছে।

যাতে এই কর্মীদেরকে সি আই এ’র লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করা যায়। সি আই এ’র মুখপাত্র পল কে লিয়ানো ঐ বৈঠকের একটি বিবৃতি পড়ে শোনান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ’র কর্মকর্তারা ঐ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছেন যে হলিউডসহ অন্যান্য মার্কিন গণমাধ্যমের কর্মতৎপরতার ওপর সি আই এ’র সরাসরি নজরদারির কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ কিংবা মিডিয়া সন্ত্রাসবাদের বিপদ সম্পর্কে গত কয়েক দশক ধরে অনেক আলোচনা হয়েছে। এখনও হচ্ছে।

যার মূল প্রতিপাদ্য সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রসারে মিডিয়ার পরিকল্পিত প্রয়োগ। খবরের কাগজ, টি ভি চ্যানেল থেকে অনলাইন মিডিয়া সংস্থাগুলি যখন ‘সম্মতি নির্মাণে’র ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকে। মিডিয়ার ফোর্থ এস্টেট ভূমিকা যখন পরিণত হয় আধিপত্যবাদী রাজনীতি রূপায়ণের নেতিবাচক সঙ্কীর্ণতায়। কিন্তু এই বিতর্ক বা প্রতর্কে প্রায়শ:ই আড়ালে থেকে যাগ মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের বা মিডিয়া সন্ত্রাসবাদের নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠান বা থিঙ্কট্যাঙ্কগুলি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বুলির আড়ালে এই প্রতিষ্ঠানগুলিই পন্থা বাতলে দেয় বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার।

যাদের আমরা বলতে পারি মিডিয়া। সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যদের বহুজাতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক। নিও লিবারেশন বিশ্বায়ন পর্বে সাম্রাজ্যবাদের নতুন এই কলাকৌশল বাড়তি উদ্যম পেয়েছে সন্দেহ নেই। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা তার অব্যবহিত পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক স্তরে এ ধরনের বহুজাতিক মঞ্চ খাড়া করার চেষ্টা করে এসেছে। বিশেষত লাতিন আমেরিকাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের উদ্যোগ আমরা আগেও দেখেছি।

ক্রমশ, শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্বজুড়েই কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। শুধু চেষ্টা নয়, বিপুল অর্থ ঢেলে তৈরিও করা হয়েছে। ১৯৭০-র দশকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভিতরে -বাইরে তথ্য সাম্রাজ্যবাদ বা মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিপদকে প্রতিহত করে নয়া বিশ্ব তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দাবি যখন বিশ্বজোড়া প্রভাব ফেলতে শুরু করে তখন থেকে তথাকথিত স্বাধীন ও বহুত্ববাদী মিডিয়ার স্বাধীন ভূমিকা এবং বিশ্বজুড়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহের তত্ত্বকে পরিকল্পিতভাবে হাজির করা শুরু হলো মিডিয়ার উন্নয়নকামী ও গণতান্ত্রিক ভূমিকার প্রস্তাবের পালটা হিসেবে। সাম্রাজ্যবাদ মিডিয়াকে ব্যবহার করতে চায় সঙ্কীর্ণ স্বার্থে, অথচ মুখোশ নিচ্ছে মিডিয়ার উদার গণতান্ত্রিক ভূমিকার। গত শতকে সাতের দশকের গোড়া থেকে আটের দশকের গোড়া পর্যন্ত তথ্য/মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের এই কৌশলের নানাবিধ রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

ঠাণ্ডাযুদ্ধ পর্বে একদিকে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে টার্গেট করে সরাসরি মিডিয়ার নানা মাধ্যমকে ব্যবহার করে সরকারী উদ্যোগে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানো, অন্যদিকে পশ্চিমী-মার্কিনী তথাকথিত বেসরকারী বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার সমাজতন্ত্র-বিরোধী ও তৃতীয় বিশ্ব-বিরোধী আক্রমণাত্মক ভূমিকা। আর আজ সেই অভিন্ন লক্ষ্যে একইভাবে সরাসরি ব্যবহার করতে চাইছে হলিউডকে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ দীর্ঘ বহু বছর ধরে নিজের কর্মীকে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা শিল্পসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়োজিত করে এসব গণমাধ্যমকে দিয়ে পাশ্চাত্যের সম্প্রসারণকামী লক্ষ্যগুলো হাসিলের চেষ্টা করে আসছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ’র এই কৌশল ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। মার্কিন সরকার হলিউডকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রত্যাশামতো তৃতীয় দুনিয়ার অন্যান্য দেশের ওপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও পশ্চিমী সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শ শীর্ষক এক নিবন্ধে ফরাসী অর্থনীতিবিদ সামির আমিন ‘আমাদের মার্কিন বন্ধু জাতীয় শব্দের ব্যাপারে প্রতারিত না হতে’ তার পাঠকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন সরকার যে কোনো দেশের বন্ধু হতে পারে না তার যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে সামির আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইতিহাসের একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। প্রত্যেক দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সে দেশের রাজনীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে গড়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও নিউ ইংল্যান্ডের চরমপন্থী গ্রুপগুলোর মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।

তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো : আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদের ওপর গণহত্যা চালানো, ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অন্যদেরকে দাসে পরিণত করা, আমেরিকায় অভিবাসী বিভিন্ন জাতি বা সমাজকে আলাদা করা এবং জাতিগত ও গোত্রীয় পার্থক্যগুলোকে বড় করে তুলে ধরা। ’ সামির আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আরও লিখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের লোকেরা ফ্যাসিবাদীদের মতো নিজেকে সর্বোত্তম জাতি বলে মনে করে। তারা এও মনে করে যে স্রষ্টা নাকি তাদেরকে নিজ ধর্মের বিশ্বাসগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত বর্ণবাদী গোষ্ঠী ক্লু ক্লাঙ্ ক্লান ও ফ্রিম্যাশন গোষ্ঠীর মতো উগ্র গ্রুপগুলোর বিশ্বাস এবং চরমপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরাই শেষ পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ’র ছত্রচ্ছায়ায় একত্রিত হয়েছে। ’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ে গুপ্ত সংস্থাগুলো চলচ্চিত্রের জগতকেও তাদের চিন্তাধারা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে।

গত কয়েক বছর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ নিজ লক্ষ্যের বিরোধী কোনো কোনো চলচ্চিত্রের সমালোচনা করে সেগুলোকে অবাস্তব বলে আখ্যা দিয়েছে। হলিউড ও সি আই এ’র মধ্যে সমন্বয়ের উদ্দেশ্য হলো, মার্কিন সরকার ও সি আই এ’র লক্ষ্যের বিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণের সম্ভাবনা দূর করা। হলিউড ও সি আই এ’র বৈঠকে এটা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো কোনো চলচ্চিত্র ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সি আই এ’র চেহারা বিকৃত করে তুলে ধরেছে এবং এর ফলে দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে এই সংস্থা সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সমালোচক বলছেন, হলিউডে মাঝে মধ্যে এমন দু-একজন স্বাধীনচেতা ফিল্ম-নির্মাতা দেখা যায় যারা বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চান এবং তারা নিজ চলচ্চিত্রে বাস্তবতা তুলে ধরছেন। ‘গুড শেফার্ড’ এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত।

২০০৬ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বা সি আই এ গঠনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। গুড শেফার্ড শীর্ষক চলচ্চিত্রটি এডওয়ার্ড উইলসন নামে এক ব্যক্তির জীবন কাহিনীর চিত্ররূপ। এই উইলসন সি আই এ গঠনে এবং ষাটের দশকে মার্কিন এই গোয়েন্দা সংস্থার ধ্বংসাত্মক তৎপরতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ গঠনের পটভূমি ও এর বিকাশ এবং এই সংস্থার অতীতের ও বর্তমান লক্ষ্যগুলো এই ছবিতে মেলোড্রামার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবিতে কিউবার পিগ উপসাগরে মার্কিন অনুচরদের হামলা এবং এই হামলায় মার্কিনীদের লজ্জাজনক পরাজয়ের কাহিনীও স্থান পেয়েছে।

ফ্লাশ ব্যাক বা স্মৃতি রোমন্থন হিসেবে এডওয়ার্ড উইলসনের শৈশব এবং একটি গোপন সংস্থায় তার অন্তর্ভুক্তি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ’র গোড়া পত্তনের দৃশ্যগুলো এই চলচ্চিত্রের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক। নিরাপত্তার বিষয়ে দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তাহীনতা গুড শেফার্ড শীর্ষক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়। রবার্ট ডোনিরো এই ছবির নির্মাতা। আসলে চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে যে, সি আই এ’র পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচিত সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন সমাজে তথাকথিত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার নামে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোর জন্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। নির্মাতা এমন একটি সংস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন যা ভয়ানক গোপন সংস্থাগুলোর সমতুল্য এবং এসব সংস্থার রয়েছে নিজস্ব রীতি ও পদ্ধতি।

আর এই গোপন সংস্থাই পরবর্তীকালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বা সি আই এ’র রূপ নিয়েছে। তবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গণমাধ্যমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশল নতুন কিছু নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ চালাতে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের প্রায় প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ১৯৫১সালে চালু করা হয়েছিল বেতার কেন্দ্র, রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি। যেমন, ভয়েস অব আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী অর্থে পরিচালিত চ্যানেল।

১৯৪৮সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চালু হয়। যুদ্ধশেষ হবার পর মার্কিন সরকারের বিদেশ নীতি অনুযায়ী আধিপত্যবাদী রাজনীতি প্রচারের কাজে। বৃহৎ পরিচালিত মার্কিন পশ্চিমী বহুজাতিক মিডিয়াও আগ্রামী সাম্রাজ্যবাদী নীতি মেনে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র বিরোধী প্রচার যুদ্ধে শামিল হয়েছে বারবার। নয়া বিশ্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে তীব্র বিতর্কের সময় আটের দশকের গোড়ায় আমরা দেখেছি মার্কিনী পশ্চিমী সরকারী নীতি মেনে এইসব বেসরকারী বৃহৎ মিডিয়াও যথেষ্ট আগ্রাসী ভূমিকায় সংগঠিত হয়েছে। অর্থাৎ দ্বিমুখী আক্রমণ একদিকে প্রত্যক্ষ সরকারী অর্থে পরিচালিত মিডিয়ার সাহায্য, অন্যদিকে বেসরকারী মালিকানায় থাকা মিডিয়াকে ব্যবহার করে।

দুটোরই লক্ষ্য অভিন্ন। আটের দশকের গোড়া থেকে একদিকে সমাজতান্ত্রিক প্রতিচাপ ক্রমশ যখন দুর্বল হচ্ছিল এবং দশক শেষ হবার আগেই সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের দরুন একদিকে আমরা দেখলাম জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে দুর্বল হলো এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ/ইউনেস্কোর মঞ্চে তথ্য/মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিপ্রতীপে নয়া বিশ্ব তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ধাক্কা খেল। এরকম একটা পশ্চাদপটে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ তার প্রোপাগান্ডার প্রধান বিষয় হিসেবে বিজ্ঞপ্তি করতে শুরু করলো মিডিয়ার স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ ও সরকারী-নিয়ন্ত্রণহীনতার মতো বিষয়গুলিকে। আমরা লক্ষ্য করলাম, বিশ্বায়ন-পর্বে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রচার বিষয় গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদে। যা আপাতভাবে উদারবাদী গণতন্ত্র দেখালেও প্রকৃত অর্থে বিপরীত-আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক।

তাছাড়া শুধু প্রচার নয়, সাম্রাজ্যবাদ প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপেরও উদ্যোগ নিয়েছে। নানারূপে ও নানা বেশে বিশ্বজোড়া সক্রিয় বেশ কয়েকটি সংস্থা বা মঞ্চ যা মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে তার নীতি ও পরিচালনা নিয়ে ক্রমাগত প্রভাবিত করতে চাইছে বিশ্বজনমত, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের প্রভাবশালী নীতি-নির্ধারক মহলকে। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ায় নানাভাবে এইসব প্রতিষ্ঠান হস্তক্ষেপ করছে। লক্ষ্য একটাই, দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.