অকাট মূর্খ যাকে বলে আমি তাই। সুতরাং জ্ঞানীরা বেশি জ্ঞান দিলে আমি চাইয়া চাইয়া দেখা ছাড়া কিচ্ছু করতে পারিনা। পোড়া কপাল!!
সত্যজিৎ রায়
স্টিভেন স্পিলবার্গ
সত্যজিৎ এর তুলিতে "দি এলিয়েন"।
সত্যজিৎ রায় একটি অমর নাম। তার কলাসিদ্ধিকে সবাই মূলত স্মরন করে একজন পরিচালক, চিত্রনাট্যকার,গল্পকার, সংগীতজ্ঞ, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক ডিজাইনার এবং চলচ্চিত্র সমালোচোক হিসেবে।
কিন্তু কজন জানে সত্যজিৎ এর সেই অনবদ্য একটি সৃষ্টির হলিউড মূল্যায়ন সম্পর্কে?
স্টিভেন স্পিলবার্গ (Steven Spielberg) এর ব্লকবাস্টার মুভি E.T. the extra-terrestrial নিয়ে রয়েছে বহু বিতর্ক। এখনো অভিযোগ রয়েছে যে ছবিটি আসলে সত্যজিৎ রায় এর "দি এলিয়েন" নামক স্ক্রিপ্ট এর ছায়া অবলম্বনে নির্মিত।
১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায় "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" নামক একটি বাংলা কল্পগল্প লেখেন যেটা রায়দের পারিবারিকভাবে প্রকাশিত শিশুতোষ "সন্দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মূলত গল্পের কাহিনী আবর্তিত হয় একটি মহাকাশযান নিয়ে যেটা গ্রাম বাংলার কোন এক পুকুরে অবতরন করে এবং গ্রামবাসীরা এটাকে মন্দির ভেবে এর পূজা শুরু করে দেয়। তাদের ধারনা ছিল মহাকাশযানটা ভূ-গর্ভ থেকে উঠে এসেছে।
যাই হোক, ভিনগ্রহবাসী বা "এলিয়েন" এরপর হাবা নামের এক গ্রাম্য কিশোরের সাথে স্বপ্নের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং এই গ্রহে তার স্বল্পকালীন অবস্থানের সময়ে গ্রাম্য সম্প্রদায়ের সাথে কিছু রসিকতা করে। কিন্তু "এলিয়েন" কারো কোনপ্রকার ক্ষতি করেনা ।
কয়েক বছর পরে লন্ডনে বিখ্যাত কল্পকাহিনী লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক (Arther C. Clarke)এর সাথে এক সাক্ষাতে সত্যজিৎ হঠাৎ তাঁর গল্পের কথা আলাপ করেন এবং নিজের ভাষায় একে বর্ণনা করেন এভাবে "ধারনার একটি অঙ্কুর যা আমার মধ্যে ছিল একটি কল্পকাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য"। চমকপ্রদ এই প্লটটি পেয়ে ক্লার্ক যোগাযোগ করেন তার বন্ধু এবং শ্রীলঙ্কা ভিত্তিক প্রযোজক মাইক উইলসন (Mike Wilson) এর সাথে। মাইক এই কথা শুনে এতে প্রচন্ড আগ্রহ দেখান এবং যথাসম্ভব দ্রুত কলকাতায় উড়ে যান এবং সত্যজিৎ এর সাথে যোগ দেন।
কিছুদিনের মধ্যে তারা দুজনে "দি এলিয়েন" নামে একটি হলিউড ব্লকবাস্টার এর সম্ভাবনাময় চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন।
রায় এন্ড কোং এরপর উড়াল দেয় হলিউডের উদ্দেশ্যে। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে তারা আলোচনার টেবিলে বসেন ছবিটির সহযোগী প্রযোজক সংস্থা "কলম্বিয়া পিকচার্স"(Columbia Pictures) এ। ছবিটির কুশীলব হিসেবে ঠিক করা হয় পিটার সেলারস (Peter Sellers) কে মূল চরিত্রে এবং মারলন ব্রান্ডো (Marlon Brando) কে দ্বিতীয় প্রধান চরিত্রে। উল্লেখ্য যে ঐ সময়ে "দি এলিয়েন" এর কপি হলিউডের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্টুডিওতেই ছিল।
কিন্তু কাজ শুরুর প্রাক্কালে কিছু জিনিস সত্যজিৎ কে সমস্যায় ফেলে দেয়। তিনি প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছিল এটা দেখে যে, মাইক উইলসন তাঁকে বাদ দিয়ে স্ক্রিপ্ট এর গ্রন্থস্বত্ত্ব নিবন্ধন করান, অথচ সত্যজিৎ স্ক্রিপ্টটি দুজনের নামেই লিখেছিলেন। শুধু তাই নয়, মাইক সত্যজিৎ এর স্ক্রিপ্ট ফি ও আত্মসাৎ করেন। আর এ সবই করেন সত্যজিৎ এর অগোচরে। পাশাপাশি কুটিল রাজনীতি এবং চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যবসাঃ আসলে হলিউড সত্যজিৎ এর প্রথম হলিউডি চলচ্চিত্র পরিচালনার আগ্রহের মাশুল নিতে শুরু করেছিল।
১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ "দি এলিয়েন" প্রকল্প ছেড়ে দেন এবং কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর নিজস্ব চিরচেনা পরিসরে পরিচালনার উৎসাহ নিবৃত্তির দিকে মনোনিবেশ করেন। তবে সত্যজিৎ হলিউডে তাঁর এই ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগটা নিয়ে কখনোই হতাশায় ভোগেননি।
কিন্তু ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় স্পিলবার্গ এর E.T. the extra-terrestrial এবং এটা সত্যজিৎ কে আবার সেই "দি এলিয়েন" প্রচেষ্টার কথা এর মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই মনে করানোটা ছিল হলিউডের প্রতি হতাশায় ভরা এবং দুঃখজনকভাবে সত্যজিৎ কে হলিউডের কাছ থেকে দ্বিতীয়বারের মত কষ্ট পেতে হল।
যখন E.T. মুক্তি পায়, "দি এলিয়েন" এর সাথে এর মিল নিছক কো ইন্সিডেন্স বলে সত্যজিৎ এর কাছে কখনোই মনে হয়নি।
অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধাও একই কথা বলেছেন। আর্থার সি. ক্লার্ক এই মিলগুলো দেখে মন্তব্য করেন "দি এলিয়েন" এবং "E.T." 'Striking Parallels' এবং ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে সত্যজিৎকে ফোন করে স্পিলবার্গের সাথে যোগাযোগ করে মিলগুলো ধরিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সত্যজিৎ এই ব্যাপারটি নিয়ে উৎসাহ দেখ্ননি যদিও তিনি ভালোভাবেই বুঝেছিলেন যে তাঁর প্রিয় প্রকল্প "দি এলিয়েন" কুম্ভিলতার শিকার। তিনি নিজের মুখেই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন যে স্পিলবার্গ এর E.T. "হয়তো সম্ভব হতোনা আমার "দি এলিয়েন" যদি পুরো আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকত"। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, E.T. এর সহযোগী প্রযোজক সংস্থা ছিল সেই একই "কলম্বিয়া পিকচার্স", যেটা ১৯৬৭ তে সত্যজিৎ এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল।
এত কিছুর পরেও সত্যজিৎ বিষয়টি নিয়ে কিছু করেননি এবং কেন করেননি তার ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন এভাবে "শিল্পীদের অধিকতর ভালো কাজে সময় ব্যয় করার সুযোগ রয়েছে"। পাশাপাশি তিনি এই বিষয়ে স্পিলবার্গ এর নির্লজ্জ এবং উঁচু গলায় প্রত্যাখ্যান সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। ১৯৮২ সালে যখন চারপাশে কথা উঠল তখন সংবাদ মাধ্যমকে স্পিলবার্গ বলেছিলেন "যখন রায় এর স্ক্রিপ্ট হলিউডে ঘোরাঘুরি করছিল তখন আমি ছিলাম হাইস্কুলের ছাত্র"। আচ্ছা আসুন তার এই দাবীটির যথার্থতা প্রতিপন্ন করা যাকঃ
স্পিলবার্গ Saratoga High School, California থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতক করেন যার অর্থ যখন সত্যজিৎ এর স্ক্রিপ্ট হলিউড জুড়ে ছড়িয়ে ছিল তখন স্পিলবার্গ স্নাতক শেষ করেছিলেন এবং ১৯৬৯ সালের দিকে স্পিলবার্গ ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে তরুন পরিচালক যে কিনা একটি অন্যতম প্রধান হলিউড স্টুডিও "UNIVERSAL"এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ঐ সময় থেকেই তিনি একজন পেশাদার পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং এর আগে অর্থাৎ তার শুরুটা ছিল ঐ একই স্টুডিওতে ১৯৬৮ সালে একজন বিনাবেতনভুক্ত, সপ্তাহে ৭ দিন কাজের চুক্তিবদ্ধ একজন শিক্ষানবিস এবং সম্পাদনা বিভাগের একজন অতিথি হিসেবে।
সুতরাং এগুলো প্রমান করে যে, যখন সত্যজিৎ এর স্ক্রিপ্ট হলিউডে সহজপ্রাপ্য ছিল তখন স্পিলবার্গ হাইস্কুলের ছাত্র না বরং স্নাতক শেষ করা এবং হলিউডে নিয়মিত যাতায়াতকারী একজন ছিলেন। এক্ষেত্রে তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি E.T. স্পিলবার্গ এর মৌ্লিক সৃষ্টিই হয়ে থাকে তবে এ ব্যাপারে অভিযোগের ব্যাপারে নিজের অবস্থান ভুলভাবে তিনি কেন উপস্থাপন করলেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে সত্যজিৎ এর "দি এলিয়েন" এবং স্পিলবার্গ এর "E.T." এর মিলগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভিনগ্রহবাসী বা এলিয়েনদের চরিত্রায়ন। সত্যজিৎ তাঁর এলিয়েনদের সম্পর্কে বলেছেন," এদের শান্ত স্বভাব,এবং ব্যাপারটা হচ্ছে এরা ছোট এবং শিশুদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং কিছু অতিমানবীয় গুনাবলীসম্পন্ন- যেটা শারিরীক শক্তি নয় বরং অন্য কোন ক্ষমতা,বিশেষ ধরনের দৃষ্টি এবং পৃথিবীর সব জিনিসের উপর উৎসাহ"। সত্যজিৎ এর এলিয়েনদের সম্পর্কে এই স্বতন্ত্র ভাবনা অত্যন্তভাবে E.T. এর সাথে মিলে গিয়েছিল যেখানে স্পিলবার্গ এর এলিয়েন ছোট বাচ্চাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং ছিল আমুদে ও দুষ্টামিতে পাকা, এছাড়া তারা পৃথিবীতে অবস্থানকালীন সময়ে মানবজাতির কোন অনিষ্টসাধন করেনি।
এলিয়েন আসলে হলিউডে কোন নতুন বিষয় নয়, কখনো ছিলওনা।
কিন্তু হলিউডে সবসময়েই এলিয়েনদের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে একটা নৃশংস প্রজাতি হিসেবে যারা পৃথিবীতে আসে কোন না কোন শয়তানি ইচ্ছা নিয়ে এবং ফলাফল হচ্ছে মানব প্রজাতি এবং এলিয়েনদের মধ্যকার অনিবার্য্য সংঘর্ষ। এভাবেই হলিউডি কাহিনী চলে আসছিল এবং এখনো আসছে। এর কারন হিসেবে বলা হয় চলচ্চিত্রের এই ধরনটির জমকালো অলীকতা, ঐন্দ্রজালিকতা এবং মায়াবী আহবান যা নিশ্চিতভাবেই অর্থনৈ্তিক সফলতার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোন কারনটি স্পিলবার্গকে প্রথাগত ধারার বাইরে আসতে উৎসাহী করেছে যেখানে তার বন্ধুস্থানীয় সমকক্ষরা প্রথাগত ধারায় থেকেই ব্যাপক সফল চলচ্চিত্র তৈ্রি করছিলেন। যেমন George Lucas এর Star Wars।
এটা কি আসলে স্পিলবার্গ এর প্রখর সৃজনশীলতা নাকি একটি স্ক্রিপ্ট এর প্রভাব যেটা সত্যজিৎ রায় "দি এলিয়েন" নামে লিখেছিলেন এবং যেখানে সত্যজিৎ এলিয়েন এবং মানব প্রজাতির যোগাযোগ, সম্পর্ক এবং পারষ্পরিক আচরনের রূপরেখা এমনভাবে এঁকেছিলেন যা হলিউড এর আগে কখনো দেখেইনি?এটা ভেবেও অনেকে আশ্চর্য বোধ করেন যে E.T. এর কেন সিক্যুয়াল হলোনা?যেখানে স্পিলবার্গ এর অন্যান্য সফল প্রকল্পগুলোর (যেমন Back to the Future, Jurasic Park) সিক্যুয়াল হয়েছিল। এখানে এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে স্পিলবার্গ এবং তার স্টুডিও DreamWorks অনেক ব্যাপারে নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত। এসবের মধ্যে, Amistad, Chicken Run, Twister, What Lies Beneath এবং আরো কয়েকটি চলচ্চিত্র উল্লেখযোগ্য।
E.T. কে বলা হয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটা এবং এই E.T. এর কারনেই স্পিলবার্গ আজকের এই স্পিলবার্গ হতে পেরেছেন। যদি আসলেই E.T. সত্যজিৎ এর "দি এলিয়েন" এর ছায়া হয়ে থাকে (যদিও যুক্তি প্রমাণ তাই বলে) তাহলে এই সত্যটা পৃথিবীর জানা দরকার এবং যদিও অনেক দেরী হয়ে গেছে তবুও সত্যজিৎ কে সন্মান জানানো উচিত হলিউড সম্প্রদায় এর পক্ষ থেকে এবং বিশেষ করে অবশ্যই স্টিভেন স্পিলবার্গের তরফ থেকে।
কৃতজ্ঞতাঃ লেখাটি পুরোটাই ২২ মে ২০০৯ এর স্টার উইক এন্ড ম্যাগাজিনে ওবায়দুর রহমান কর্তৃক "Satyajit Ray and The Alien" অবলম্বনে লেখা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।