সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
নীতিমালা নেই, যেখানে সেখানে বিলবোর্ড
"মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে"-নাগরিক কবির এই আশংকা আজ সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে। পণ্য প্রচারের জন্য গোটা পৃথিবীটাই আজ বিজ্ঞাপনময় বা বিজ্ঞাপন কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। কোথায় নেই বিজ্ঞাপন? এই বিজ্ঞাপন বিপ্লবের যুগে বিশ্বের যে কোন পণ্য সম্পর্কে মানুষ চট করেই জেনে যাচ্ছে বিস্তারিত তথ্য। ক্রেতা-বিক্রেতা এবং পণ্য উৎপাদনকারীদের প্রধান মাধ্যম এই বিজ্ঞাপন শিল্প। গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও।
টিভি, রেডিও, পত্রিকা, পথের পাশে বিলবোর্ড, দেয়াল, বাসের বডি, বাড়ীর ছাদ, সুউচ্চ ভবনের ছাদ, ওভার ব্রিজের পিলার, গাছপালা, লাইট পোস্ট, সবখানে ছেয়ে গেছে বিজ্ঞাপন। পণ্যটি খারাপ কিংবা ভালো যাই হোক না কেন তাকে ক্রেতার সামনে তুলে ধরতে চলে আকর্ষণীয় কলা-কৌশলের প্রতিযোগিতা। সারাক্ষণ চেষ্টা থাকে কত ভালো স্থানে পণ্যের বিজ্ঞাপনটি দেয়া যায়। কত বেশি সংখ্যক ক্রেতার নজর কাড়া যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিলবোর্ড স্থাপন করা যায়।
গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরে রাস্তার দু'পাশে, ভবনের দেয়ালে, বিভিন্ন আবাসিক বাণিজ্যিক ভবনের ছাদেও দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড।
দেশী-বিদেশী নানা ব্র্যান্ডের পণ্যের আকর্ষণীয় রং বেরংয়ের চটকদার বিলবোর্ডগুলো নগরীর প্রতিটি এলাকায় শোভা পাচ্ছে।
মাত্র কয়েক দিন পুর্বে পত্রিকায় দেখলাম-সামান্য ঝড়ের কারনে তেজগাঁও এলাকায় একটি বিল বোর্ড ভেঙ্গে ২ জন নিহত এবং ৫ জন আহত। ঝড়ের সময় অনেকজন পথচারী ঐ বিল বোর্ডের নীচে আশ্রয় নিয়েছিল হঠাত বৃস্টি থেকে রক্ষা পাবার আশায়। ঐ মর্মান্তিক খবরটা পড়ার পর আমি বিল বোর্ড নিয়ে কিছু লেখার জন্য সংশ্লিষ্ঠ বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করি। বিস্তারিত পাঠকদের কাছে তুলে ধরলাম।
চড়া দামে ভাড়া দেয়া হয় ছাদঃ
ঢাকার বনানী, গুলশান ও ধানমন্ডি বিলবোর্ড ব্যবসায়ে সবচেয়ে দামী এলাকা হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকার প্রধান সড়কের ওপর যেসব ভবন রয়েছে তার মালিকরা ভবনের ছাদ ভাড়া দিচ্ছেন চড়া দামে। বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক ভবন যাই হোক না কেন এগুলোর একেকটির ছাদে বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপনের জন্য ভবন মালিকপক্ষ বছরে ৪-৭ লাখ টাকা ভাড়া নিচ্ছের। প্রধান সড়ক ছাড়াও ভেতরের সড়কের সুউচ্চ ভবনের ছাদ-যা দূর থেকেও নজরে পড়ে, এমন ছাদের ভাড়াও মাসে ২-৩ লাখ টাকা হয়। অন্যদিকে বাণিজ্যিক এলাকা তেজগাঁও, মহাখালী, কারওয়ানবাজার, মতিঝিলসহ বাংলামোটর, ইস্কাটন, মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন এলাকায় ভবনের ছাদের ভাড়া নির্ধারিত রয়েছে ২-৪ লাখ টাকা পর্যন্ত।
নগরীর পুরানো এলাকাও এই ছাদ ব্যবসায় পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন রাস্তার পাশে কিংবা কর্ণার প্লটের ভবন সমূহের ছাদ ভাড়া খাটছে ৩০ হাজার-১ লাখ টাকায় । সিটি কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন ও সৌন্দর্যায়ন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরে বর্তমানে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী মোট ১৮০০টি ভবনের ছাদ ভাড়া খাটছে। যা ডিসিসির তালিকাভুক্ত রয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও বহু ভবনের ছাদ রয়েছে যা ডিসিসির অনুমোদন ছাড়াই ভাড়া দেয়া হচ্ছে।
নীতিমালা নেইঃ
আবাসিক/অনাবাসিক যে কোন ভবনের ছাদে বিজ্ঞাপনী ফলক বা ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপনের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখনো পর্যন্ত কোন নীতিমালা প্রণয়ন করেনি। ঢাকায় ভবনের ছাদে বিজ্ঞাপন বোর্ডের প্রচলন শুরু হয়েছে দু'দশকেরও বেশি সময় আগে। অথচ এতদিন পর্যন্ত রাজউক এ বিষয়ে নজর দেয়নি। সৌন্দর্যহানি কিংবা ভবনটি বিলবোর্ডের চাপে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে কিনা এ নিয়েও রাজউকের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এ প্রসঙ্গে আমি কথা বলেছিলা রাজউক-এর নগর উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী শেখ আবদুল মান্নান এর সাথে।
তিনি জানালেন, সম্প্রতি এই বিষয় নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলেই রাজউক এ ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করবে।
সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম মোতাবেক, বিজ্ঞাপনী ফলক স্থাপনের জন্য অবশ্যই ডিসিসির অনুমতি লাগবে। সেক্ষেত্রে ভবন মালিক কিংবা বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান বছরে একটি নির্দিষ্ট হারে মডেল ট্যাক্স বা ডিসপ্লে ট্যাক্স ডিসিসিকে দেবে। এই ট্যাক্স বা কর নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা হারে।
আর ডিসপ্লে বোর্ডের সাইজ হবে ৬০০-৮০০ বর্গফুট পর্যন্ত। নগরের ভবনগুলোর ছাদে বিলবোর্ড স্থাপনের জন্য যদিও ভবনটির এবং নগরেরও সৌন্দর্য কিছুটা হলেও নষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও ডিসিসি-র অনুমোদন পাচ্ছে ভালো অংকের কর আদায়ের জন্য। কাজেই সৌন্দর্যহানি নিয়ে ডিসিসির সমস্যা নেই।
কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকিঃ
ডিসিসি সূত্রে জানা যায়, এই বিজ্ঞাপন ফলক বাবদ যে কর ধার্য করা হয়েছে তা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বছরে প্রায় ৩-৪ কোটি টাকার রাজস্ব আয় পাচ্ছে না সরকার।
ভবন মালিক কিংবা ফলক স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনী সংস্থা কেউই সহজে কর দিতে চায় না। বিলবোর্ডগুলো স্থাপন করার শুরুর দিকে কোন পক্ষই করের আওতায় ছিল না। পরবর্তীতে আয়ের ওপর কর ধার্য করলে ২০০৭ সালে ভবন মালিকরা কর না দেয়ার জন্য একটি রীট করেন আদালতে । এই অবস্থায় কর আদায় বন্ধ ছিল বহুদিন। পরবর্তীতে কর আদায়ের অনুমতি পায় ডিসিসি।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন রকম সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যেই দৈনিক পত্রিকায় কর দেয়ার নোটিশ জারি করেছে ডিসিসি। তাতে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে যেন সেই সময়ের মধ্যে কর জমা দেয়া হয় । না দিলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এমন নোটিশেও কাজ হয়নি।
কর দিতে তেমন আগ্রহী নয় ভবন মালিকপক্ষ বা বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানসমূহ।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা যা বলেঃ
বিলবোর্ডের ট্যাক্স আদায় সম্পর্কে ডিসিসির অভিযোগ প্রসঙ্গে এ্যাড এসোসিয়েশন-এর সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ রাশেদ জানান, ডিসিসির বক্তব্য ভুল, আমরা করের টাকা নিয়ে বসে আছি তারাই বরং কর নিচ্ছে না। তিনি আরো জানালেন, গত কয়েক বছর ধরেই এই বিলবোর্ড সংক্রান্ত একটা সুন্দর নীতিমালা প্রণয়নে দাবি আমরা জানাচ্ছি, সিটি কর্পোরেশন এবং রাজউক-এর কাছে। এদের সঙ্গে নানা সময়ে আলোচনায় বসেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন পক্ষই বিজ্ঞাপনী ফলকের জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি।
বিজ্ঞাপন ফলকের জন্য ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা কোন রকম দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় পড়লে সে বাবদ ক্ষতিপূরণ দেয় এ্যাড এসোসিয়েশন। নগর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, একটা বিলবোর্ড কতটা উচ্চতায় স্থাপিত হবে, তার পরিধি কতটুকু হবে সেটার জন্য যখন ডিসিসি ও রাজউক নিয়ম তৈরি করবে তখনই সৌন্দর্যহানি ঘটছে কিনা দেখা যাবে।
ছাদে বেড়ানোর স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে বিলবোর্ডঃ
হাজারো পণ্যের বিলবোর্ডগুলো ভবনের ছাদে স্থাপন করায় একদিকে যেমন ভবনটির স্থাপত্য সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে তেমনি ভবন ব্যবহারকারীদের জন্যও সংকুচিত হয়ে গেছে ছাদ। বিশেষ করে আবাসিক ভবনের যারা বাসিন্দা তারা খোলা ছাদে বিকেল-সন্ধ্যায় মুক্ত বাতাসে অবগাহন করতে পারেন না। ধানমন্ডির এক বাসিন্দা ও ভবন মালিক নিজেই আক্ষেপ করলেন বিলবোর্ড ভাড়া দেয়ায়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি জানালেন, আগে বুঝিনি যে এত বড় বিলবোর্ডটি আমার ছাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেবে। বাচ্চারা খোলা ছাদে ছুটোছুটি করতে পারে না এটা দেখে মানসিক কষ্ট পাই। তিনি জানান, বিজ্ঞাপনদাতারা শুরুতে বলেনি যে কতটা স্থান বরাদ্দ হবে বিলবোর্ডের জন্য। শুধুমাত্র তিনি একা নন, অনেকেই এখন ছাদে বিলবোর্ড ভাড়া দিয়ে সমস্যায় ভুগছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।