আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিমুর হাতে একটি নীল ব্ল্যাকবেরী

Let the wind blow out the candles

মহাকাশযানের শীতল ঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে হীমশীতল কালো ক্যাপসুলটির দিকে কাপা কাপা হাত বাড়িয়ে দিলো ক্রিনা। দীর্ঘ বারো বছর সে এই নি:সঙ্গ নি:শব্দ মহাকাশে কাটিয়ে দিয়েছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে প্রাণের একটু অস্তিত্বের খোজে ছুটে গিয়েছে, পেছনে ফেলে গিয়েছে তার জীবন, যৌবন সবকিছু। টাইটেনিয়ামের ঝকঝকে ক্যাপসুলে নিজের দেহাবয়বের প্রতিফলন দেখে ক্রিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কখনো জীবনসঙ্গী খুজে নেওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। মহাকাশচারীদের জীবন বড় নি:সঙ্গ, তাদের প্রিয়জন থাকতে হয়না।

ক্রিনা বেছে নিয়েছে মহাকাশচারীর জীবনের চ্যালেঞ্জ, সেটাযে কতবড় গাধামী হয়েছে সেটা চিন্তা করে ক্রীনা মাঝে মাঝেই নিজের বুদ্ধিমত্তাকে অভিশম্পাত করে। নাহ আর নয় এই নি:সঙ্গ জীবনে একটি মুহূর্ত, পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় যে মানবসন্তানটির রেপ্লিকা নিয়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়ানোর দায়িত্ব ক্রিনার, সেই মানবসন্তানটিকে আজ সে জাগ্রত করবে। মহাকাশ নীতিমালার চৌদ্দশ বিয়াল্লিশ নং ধারার এক দশমিক দুই তিন পাচ সাত নং নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে ক্রিনা কাপা কাপা হাতে ক্যাপসুলের পাশের নীল বাতিটি টিপে দিল। আস্তে আস্তে করে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলতে থাকে। এরই মাঝে জীবনরক্ষাকারী মডিউল হৃৎপিণ্ডকে চালু করে ক্রমশ: অন্যান্য অঙ্গগুলোকে জাগ্রত করা শুরু করেছে।

ক্যাপসুলের পাশে বায়ো মনিটরে মানব সন্তানটির হৃৎপিণ্ডের বিট দেখা যায় আর ক্রিনার হার্টবিট সেটির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে। যাক জীবন অতটা খারাপভাবে শেষ হচ্ছে না, পৃথিবীর অন্যতম সেরা মানবসন্তানের সঙ্গ কয়জনের ভাগ্যে ঘটে? ক্যাপসুলের ঢাকনাটি সম্পূর্ণ খুলে যাওয়া পর্যন্ত ক্রিনা অপেক্ষা করে, ধোয়া গুলো সরে যাওয়ার পর বুক ভরা আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় ক্রিনা, ক্যাপসুলটির দিকে ঝুকে পড়ে অত:পর........... হিমু?????! WTF! কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটায় গা এলিয়ে উত্তেজক পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে ক্রীনা চাঙ্গা হয়ে উঠছিলো। মহাজাগতিক নীতিমালা লঙ্গন করে সে যে জীবনরক্ষাকারী ক্যাপসুল থেকে সেরা মানব কে জাগ্রত করেছে সেটি নিয়ে তার এখন বিন্দুমাত্র ভয় নেই, কারণ ছয় মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড আগে সে মানুষটিকে মহাকাশে ছুড়ে ফেলেছে! ২ হিমু! হিমু!! ফিশফিশ করে কে যেন ডাকছে আমাকে? তাহলে কি আবারো স্বপ্নে বাবা হাজির হয়েছে? ধ্যাৎ, এই লোকটা আমাকে আর ছাড়বে না, পোলাপাইন সব স্বপ্ন দেখে মাল্টিকালার আর আমার স্বপ্নে এই মহাপুরুষ বাবাকেই আসতে হবে, কপাল বেশি ভালো থাকলে সর্বোচ্চ- রূপা। তাও রূপা স্বপ্নে দেখা দিলেই তার আতলামী শুরু হয়, মেঘের ডাক শুনে বৃষ্টি হবে কি হবে না এইসব গাজাখুড়ি থিওরী কপচাতে হবে। আরে আমি বলি, এই যুগে ওয়েদার ডটকম থাকতে কেউ ডাইনোসর আমলের সিস্টেমে বৃষ্টি মাপে? হিমু, হিমু! আবারো ফিসফিস করে লোকটা ডাকছে।

বাবা হিমু, তোর কি হয়েছে? তোর পকেটে মোবাইল কেন? তাতে দেখলাম ইন্টারনেটও আছে? আমার মহাপুরুষ বানানোর স্কুলে তোকে প্রথম যে বিদ্যা দিয়েছিলাম, সেটা ভুলে গেছিস? "মানব সম্প্রদায় হইতে যোগাযোগ যথাসম্ভব বিছিন্ন রাখিবে। সবাই যাহা করে, তুমি তাহা করিতে পারিবে না, কারণ তাহা হইলে সবাই তোমার প্রতি আগ্রহ হারাইবে আর তোমার বই কিনিয়া পড়িবে না। সবাই জুতা পরিধান করে বলিয়াই তুমি উহা পড়িতে পারিবে না, মানবকূল যদি খালি পায়ে হাটিতো তাহা হইলে তোমাকে লোহার আচ্ছাদন পড়িয়া হাটিতে হইতো। সবার চাহিতে আলাদা হওয়াটাই মূল মণ্ত্র, আর অবশ্যই যুগ হইতে কয়কশত বছর পিছিয়ে থাকিবে। সবাই টেলিফোন ব্যবহার করে বলিয়া তুমি উহা ব্যবহার করিবে না, তোমার যোগাযোগের মাধ্যম হবে টেলিপ্যাথি।

" মুখস্তবিদ্যার মত একনাগাড়ে বকরবকর করে বাবা হতাশ গলায় বললো, আজ তোর পকেটে ইন্টারনেট সহ মোবাইল, হিমু তুই আমাকে হতাশ করলি! আমি বিরক্তি চেপে বললাম, বাবা তুমি অনেক পেইন দাও। এইটা দুইহাজার একশো খ্রিস্টাব্দ, এইখানে সবাই স্যাটেলাইট মডিউল ইউজ করে। আর আমি তোমার থিওরি ফলো করতে গিয়ে এখন পড়েছি বিপদে! হাসপাতালের বেডে আধাশোয়া হয়ে অসহায় ভাবে মোবাইলটার দিকে তাকালাম। মহাকাশে যাবার আগে বাদলকে মোবাইলটা দিয়ে বলেছিলাম যত্ন করে রাখিস, পৃথিবীতে ফেরত আসলে কাজে লাগবে। বাদল ছাগলের মত মুখ করে বলছিল হিমু দাদা, একশোবছর পরে কি তুমি এটা দিয়ে কি করবে? হা হা করে হেসে বলেছিলাম, তুই সারাজীবন আমাকে ছাগলের মত ফলো করে গেছস দেইখাই তোর বুদ্ধিবৃত্তি এত নিম্ন পর্যায়ের।

রূপার মেয়ের মোবাইল নাম্বার সেইভ করা আছে। কথায় বলে ছাগলের কথা বাসি হলে ফলে, এখন দেখি তাই হয়েছে, পৃথিবীর একমাত্র মোবাইল অপারেটর "শহুরে ফোন" এর সিমকার্ড ভরে ডায়াল করলাম রুপার মেয়ের নাম্বারে, টুট টুট করে রিং বাজতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ইউরিন, ইউরিন বলে চেচাতে চেচাতে অর্ধনগ্ন একটি যুবক ঢাকা মেগাসিটির পুনর্বাসন হাসপাতালটি থেকে ছুটে যেতে দেখা গেল। হাসপাতল কর্তৃপক্ষ নাকি তার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে তিনদিন ব্যাপী অনলাইন মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। ৩ মাজেদা খালার দরজার সামনে দাড়িয়ে কলবেল টেপার আগে আরেকবার ভেবে নিলাম, আকাশছোয়া এই এপার্টমেন্টে আমি আগের মতই স্বাগত কিনা সেটা একটু ভাবা দরকার।

ছাগলের মত কিছু একটা করে মানুষকে কনফিউজ্ড করো, কনফিউজ্ড অবস্থায় ওরা যখন আমার মস্তিষ্কের সুস্থতার সমীকরণের সমতা বিধান করতে গিয়ে নিজেরাই মানসিক রোগী হয়ে পড়বে তখন সুন্দর করে সটকে পড় - এইটা আমার লজিক যদিও, এই যুগে সেটা খাটবে কিনা বুঝতে পারছিনা। "শহুরে ফোন" এর বিল দিতে গিয়ে আন্ত:গ্যালাকটিক মানসিক বিকারগ্রস্থ পুনর্বাসন তহবিল থেকে পাওয়া সব ইউনিট নষ্ট হয়েছে। এখন মাজেদা খালার উত্তরসূরীই আমার শেষ ভরসা। দরজা খুলেই আমি চমকে উঠলাম, "মা - মা - মা..."। ঠোট টিপে হাসি দিয়ে মাজেদা খালা ধমকে উঠলো, কি ম্যা ম্যা করছিস? আমি তোর মা না, খালাও না।

তোর জিলাপীর প্যাচে পড়ে ক্যামনে যে তোর খালা হয়ে গেলাম কে জানে। যা-ই হোক, সবসময় তুই চমকে দিস, এবার আমি তোকে চমকে দিলাম, বিংগো! আমি ভেতরে ঢুকে বললাম, বাদল নেই? মাজেদা খালা যদি একশো বছর আগে আমার দেখা সেই থলথলে জলহস্তীর মতই অবিকল থাকতে পারে, কোন কিছুই অসম্ভব নয়। কে জানে বাদলের ছেলেমেয়ে গুলো হয়তো বাদলের মতই বোকার পাঠা হয়েছে। ওদের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে নাহয় পৃথিবীতে আরো কয়েক বছর কাটিয়ে দেয়া যাবে। বাদল নেই, তবে ওর গলায় যে ***** টাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিস সেটা দিব্যি দিনেদুপূরে ফস্টিনস্টি করে বেড়াচ্ছে।

মাজেদা খালা সবসময় বস্তিসমাজে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু অশালীন গালি ব্যবহার করে। নিন্দুকের মতে, এটা আমার বইএর কাটতি বাড়াতে বিশেষভাবে সাহায্যকারী। আমি অলসভাবে আরামদায়ক চেয়ারটায় গা এলিয়ে বসে মোবাইল থেকে ফেসবুকে ঢোকার চেষ্টা করলাম। যখন পৃথিবীতে ছিলাম তখন দৈনিক প্রথম আলোর ফেসবুক টিউটোরিয়াল গুলো কাটিং করে মানিব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম, তাহলে বরং সেই মানিব্যাগটাকে খোজা যেতে পারে। সাতপাচ ভাবতে ভাবতে ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম, চতুর্মাতৃক জগতের প্রাণীরা ফেসবুকের সার্ভার হ্যাক করেছে।

মনে মনে বাবাকে কয়টা বিশ্রি গালি দিয়ে ফেসবুক থেকে বেড়িয়ে গেলাম, টুইটারই শেষ ভরসা। মাজেদা খালা অবশ্য তার ট্যিপিকাল গজগজ চালিয়ে যাচ্ছে। "মহাজাগতিক রশ্মিতে পুড়ে দিন দিন যে কালো থেকে ক্লা হচ্ছিস সেটা খেয়াল করিস? একশোবার বলেছি ভালো কিছু খেতে, আমার কথা তো আমার বিড়ালটাও শুনে না তুই আর কি শুনবি" মন খারাপ করে গৃহস্থালী বিড়াল রবোট টার দিকে তাকিয়ে মাজেদা খালা গলা চড়িয়ে বললো, ক্রীনা মা, হিমুকে এখনই কড়া বিটুমিন দিয়ে শরবৎ বানিয়ে দে, ওর বিটুমিন খুবই দরকার। ক্রীনা? চমকে উঠে আমি হাত থেকে মোবাইলটা ফেলে দিলাম, রবোট টা কৎ করে ওটা গিলে ফেললো। ধুর রূপার মেয়ের নাম্বারটাও গেল।

মাজেদা খালা কোলাব্যাঙের মত বলে যেতে লাগলো, হ্যা, বাদলের মেয়ে ক্রীনা। তুই জানিশ না, ও তো মহাকাশচারী হয়ে গেছে। ও-ই তো আমাকে শীতল ঘরে ঘুম পাড়িয়ে এক শতাব্দী ঘুরিয়ে আনলো। কালকেই বাড়ি ফিরেছে, তবে কি নিয়ে অনেক মন খারাপ করেছে বেচারী, রেগে উন্মাদ হয়ে আছে। আমাকে গালিগালাজ করছে, আর ওর বাবা আর হিমু চাচা মিলে ওকে মহাকাশ অভিযানে পাঠিয়েছিল বলে ওদের ওপর চরম খেপে আছে, তোকে দেখলেই খুন করবে।

ভুলেও নিজের পরিচয় দিসনা ওর কাছে। হ্যা অবশ্যই , ভুলেও না। কোনমতে কথাগুলো শেষ করে মাজেদা খালার এপার্টমেন্ট থেকে কেটে পড়লাম। মহাকাশে নভোচারী মেয়েটি কেন আমাকে গালিগালাজ করে মহাকাশে ছুড়ে ফেলেছিল সেই অমীমাংশিত রহস্যের সমাধান হয়েছে। আমিই হিমু আলী দ্রষ্টব্য: কারো সাথে কোন চরিত্রের মিল পাওয়া গেলে আপনার উর্বর মস্তিষ্ক দায়ী থাকবে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।