তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা ১৯২০ সাল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। সৈনিকদের পল্টন ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। করাচী থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছেন এক তরুণ। বিশ-একুশের ভরা তারুণ্যে তার বয়স।
নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
কলকাতার ব্যস্ত নগরীতে এসে কাজী নজরুল যেন তার সব চঞ্চলতা ফিরে পেলেন। গল্প কবিতায় ততদিনে খানিক পরিচিতি জুটেছে তার ভাগ্যে। এ নিয়ে উচ্ছাসের শেষ নেই তরুণ নজরুলের। শহর ঘুরে বেড়ানো আপাতত তার প্রথম কাজ।
কতদিন পর একটু অবসর মিলেছে তার।
টগবগে এ তরুণ নজরুল তখনও সৈনিক জীবনের মায়া ছাড়তে পারেন নি। তিনি যতদিন করাচীতে ক্যাম্পে ছিলেন, সেখানেও তিনি সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন হাসি আনন্দে। এ সৈনিক জীবনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এক মৌলভীর কাছে ফার্সী ভাষাটা আরও ভালভাবে শিখে কবি হাফিজের বেশ কিছু কাব্য অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়। এ ছাড়া তিনি কিছু গল্প কবিতা লেখালেখি করতেন সেখানে বসে।
এবং সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন কলকাতার ‘মোসলেম ভারত’ ও অন্যান্য পত্রিকায়।
কলকাতায় এসেও তিনি নামের আগে ‘কাজী’ আর ‘হাবিলদার’ খেতাব ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, খেয়ালী এ তরুণ কবি কারো কথা তোয়াক্কা না করে কালো বুট পায়ে দিয়ে সৈনিকের পোষাক গায়ে জড়িয়ে বিভিন্ন সভায় হাজির হতেন। সৈনিকবেশী নজরুল আর তার আচার আচরণ দেখে অন্যরা ভাবত, কে এই আগন্তুক। তার হো হো অট্টহাসি শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো, প্রাণখোলা হাস্যরসে গড়িয়ে পড়ছে এ তরুণ।
একুশের তারুণ্যে সেই নজরুলকে কেমন লাগতো দেখতে তখন? নজরুলকে নিয়ে তার তৎকালের বন্ধু এবং অন্যরা প্রায় একই ভাষায় তার অবয়ব বর্ণনা করেছেন, এসব থেকে কয়েকজনের বর্ণতা তুলে ধরার চেষ্টায় আজকের এ লেখা।
কলকাতার ঐ সময়ের সাহিত্য পত্রিকা সওগাতের জনাব নাসিরুদ্দীনের লেখা দিয়েই শুরু হোক। তার স্মৃতিকথায়, পল্টন থেকে ফিরে নজরুল কলকাতায় এসে স্টেশন থেকে ফিরে সোজা আমাদের সওগাত অফিসে উঠল। সওগাত অফিস তখন লালবাজারের নিকটবর্তী বউবাজার স্ট্রীটে ছিল। নজরুলের পরনে তখন সামরিক কাপড়-চোপড় পরা ছিল।
আমি আকস্মিক ওকে দেখে চমকে গেলাম। আমাদের অফিসে মিলিটারির লোক কেন? কী কান্ড! ও আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে বলল, আমি নজরুল ইসলাম। বলে হা হা হাসি। আমি তখন আশ্বস্ত হলাম। বসতে বললাম ওকে।
ও জানাল, আগে চা পান জরদা আনান। তারপর বলা যাবে। এটা ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকের কথা। ’
‘সবল শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো যেন পেয়ালা, আর সে পেয়ালা দুটো যেন কখনো খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদা ভরপুর, তার গলা সারসের মতো পাতলা নয়, বরং পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সরল বীর্য-ব্যঞ্জক, গলার স্বর ছিল ভারী, তার সেই মোটা গলার সুরে ছিল যাদু, ঢেউয়ের আঘাতের মতো তার গান আছড়ে পড়তো ঝড়ের ঝাপটা হয়ে শ্রোতার বুকে। প্রবল হতে সে ভয় পেতো না, নিজেকে মিঠে দেখানোর জন্য সে চেষ্টা করতো না।
’ এ বর্ণনা দিয়েছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবির বন্ধু বুদ্ধদেব বসুর ভাষ্য আরও আকর্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘নজরুল ছিল একাই একশো। চওড়া মজবুত জোরালো তার শরীর, লাল-ছিটে লাগা বড়ো বড়ো মদির তার চেজাখ, মনোহর মুখশ্রী, লম্বা ঝাঁকড়া চুল তার প্রাণের ফূর্তির মতোই অবাধ্য, গায়ে হলদে কিংবা কমলা রঙের পাঞ্জাবী এবং তার উপর কমলা কিংবা হলদে রঙের চাদর, দুটোই খদ্দরের। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি রঙীন জামা পরেন কেন? ‘সভায় অনেক লোকের মধ্যে চট করে চোখে পড়ে তাই’, বলে ভাঙা ভাঙা গলায় হো হো করে হেসে উঠেতেন তিনি।
কথার চেয়ে বেশী তার হাসি, হাসির চেয়ে বেশী তার গান। একটি হারমোনিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণ চা এবং অনেকগুলো পান দিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে সব ভুলে পাঁচ-ছয়-সাত ঘন্টা একনাগাড়ে গান করতে থাকতেন। নজরুল যে ঘরে আড্ডা জমাতেন, সে ঘরে আর কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতো না। ’
আবুল মনসুর আহমদও তার ‘আত্মকথা’য় কবিকে ১৯২২ সালে প্রথম দেখার কথা বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, ‘সভায় গিয়ে অন্যান্য সবার সাথে নজরুল ইসলামের সাথেও পরিচয় হলো। মিলিটারী ইউনিফর্ম পরা কাঠখোট্টা লোক, কবি বলে পছন্দ হলোনা, কিন্তু চোখ দুটো তার ভাসা ভাসা হরিণের মতো, দেখে আকৃষ্ট হলাম।
আমার এক কথায় সভার সমবেত সবার হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে যে ছাদ ফাটানো গলা শুনতে পেলাম, সেটি নজরুলের আওয়াজ। সভা শেষে তিনি আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি তার গায়ের অসাধারণ শক্তিতে বিস্মিত হলাম। ’
আরেকজন সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন কবি নজরুলকে প্রথম দেখার সুখস্মৃতি তুলে ধরেছেন, ‘অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হল, নজরুল এলেন। সৈনিক বেশ, কাঠখোট্টা চেহারা, দাঁিড় গোফ নেই, খনখনে অট্টহাসিতে ঘর মুখরিত করে আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন। ’
প্রবোধ কুমার লিখেছেন, ‘নজরুল যখন তার অনুরাগরঞ্জিত কবি জীবন নিয়ে এসে দাঁড়ালেন কলকাতার রাজপথে, তখন তার একদল লক্ষীছাড়া বন্ধুভিন্ন অপর সহায় সম্বল বিশেষ কিছু ছিল না।
কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এমন একটি প্রবল উজ্জ্বল প্রাণ, এমন একটি সরল উজ্জ্বল ও হাস্যোদ্দীপ্ত জীবন, যেটি সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত করে রাখতো তার বন্ধু সমাজকে। তার স্বভাবের দীপ্তি, তার প্রাণবন্যা এবং তার হাস্যমুখরতা- এদের আকর্ষণে একদা কলকাতার রাজপথে ভীড় জমে যেত। ’
আব্দুল হালিম লিখেছেন, ‘কবির সুডৌল বলিষ্ঠ দেহ, বড় বড় বিস্ফরিত উজ্জ্বল চোখ, মাথায় রুক্ষ দোলায়মান লম্বা চুল, সহাস্য মুখ, দীর্ঘ পিরান, পীত শিরস্ত্রাণ, গৈরিক বেশ হাতে বেণূ কবিকে মহিমান্বিত করে তুলতো। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাচ্ছে গান ও কবিতায়। শেষ হচ্ছে কাপের পর কাপ চা।
নজরুলের মুখে হাসির ফোয়ারা ছুটছে, কলহাস্যে মজলিস মুখরিত, আহার নেই, নিদ্রা নেই, কবি তার ছন্দ দোলায় গান ও কবিতা রচনা করে চলেছেন, শত কোলাহলের মধ্যেও তার লেখনী স্রোতের মতো বেগবান। ’
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন এবং তার সান্নিধ্যের ছোঁয়া পেয়েছেন- তারা সবাই স্বীকার করেছেন, মৃত্যু অবধি কাজী নজরুলের দু চোখে যে অপূর্ব দীপ্তি ও তেজোদ্দীপ্ত চাহনী ছিল, তাতে সরাসরি কেউ তার চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতো না।
জীবনভর তার শরীর ছিল নাদুস নুদুস, কাঁধ পর্যন্ত ঝোলানো বাবরী চুলে অপূর্ব দেখাতো তাকে। যে অসুখে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন, এর আগে পুরো যৌবন ও তারুণ্যে কখনো তিনি কোন মারাত্মক অসুখে পড়েন নি।
সূত্র- বিশ্বনাথ দে কর্তৃক সংকলিত ‘নজরুল স্মৃতি’ গ্রন্থ।
সাহিত্যম, কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংশোধিত সংস্করণ- ১৯৭১।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।