আমি শুধু ঐ পথের পথিক ছিলাম
নারী স্বাধীনতা,নারী অধিকার নিয়ে যখন কোন সেমিনার বা আলোচনা সভায় অংশগ্রহন করি ক্ষনিকের জন্য মনে হতে পারে ‘এই তো,আমরা অনেকখানি এগিয়ে এসেছি। তথাকথিত নারী মুক্তি হয়ত খব বেশী দূরে নয়’। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো শুধু সেমিনার বা আলোচনা সভা ততক্ষন কোন ফলই বয়ে আনতে পারবে না যতক্ষন না একজন নারী নিজেকে প্রথমে মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে শিখবে। নারী অধিকার নিয়ে কেন আমাদের সভা করতে হবে? নারী স্বাধীনতার জন্য কেন আমাদের রাস্তায় মিছিলে নামতে হবে? একজন মানুষের যতটুকু অধিকার আছে সে ঠিক ততটুকুই নির্বিঘ্নে ভোগ করবে তাই আমরা চাই। নারীর বেলায় তবে কেন আলাদা এত আইন, নীতিমালা? ধুমধামের সাথে পালন করা হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ কিন্তু ‘পুরুষ দিবস’নামে তো কোন দিবস পালিত হয় না! তবে নারী দিবস কেন? একটু খারাপ হলেও এর উত্তরটা আসলে এরকম দাঁড়ায় যে, নারীদের এখনো আমরা মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে শিখি নি।
এই অবহেলার পিছনে আমরা দায়ি করি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে, চোখ রাঙাই কর্তৃত্বাধীন পুরুষজাতিকে। কিন্তু আমি বলি, কর্তৃত্ব সাধারনত দূর্বলের উপর সবলেরই হয়ে থকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা দূর্বলচিত্ত নারীদের উপর কর্তৃত্ব খাটাবে এটাই স্বাভাবিক। চোখ রাঙিয়ে, নীতি বাক্য শুনিয়ে বা আইন প্রনয়ণ করে কখনো তা বন্ধ করা সম্ভব না।
এই কর্তৃত্ব বন্ধ করতে হলে নারীকে প্রকৃতপক্ষেই সবল হতে হবে। তবে হ্যাঁ, এই দূর্বল নারীজাতি যাতে কখনোই সবল হতে না পারে তার পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একের পর এক সফল পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে স্বাচ্ছন্দে।
আমাদের দেশে নারীদের আমরা দেখতে পাই প্রধানত তিন রকম অবস্থানে। একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু আশ্চ্যর্যের ব্যপার হচ্ছে নারী স্বাধীনতা বা অধিকার নিয়ে এদের মধ্যে উদাসীনতাও সবচেয়ে বেশী।
একজন দাস যেমন কখনো চিন্তাই করে না তার অধিকার ও চাহিদা নিয়ে, সে রকম এ শ্রেণীর মেয়েরা কখনো বুঝতেই পারে না যে তারা কি পরিমানে নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের সব পাওয়া না পাওয়া ঘুরে ফিরে গিয়ে ঠেকে নিয়তির দ্বারে এবং জীবনযাত্রার মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় সহ্য করে যাওয়া। এদের নিয়ে নারী জাগরণের কাজ করা খুব সহজ। এদের যখন বোঝানো হয় যে এরা নির্যাতিত,অর্থনৈতিক মুক্তি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে তদের স্বাধীনতের পেছনে, তখন এ শ্রেণীর মেয়েরা যোগ দেয় কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টোরিতে অথবা সেলাই মেশিন কিনে পরিরারের অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে খুঁজে ফিরে নিজের মুক্তি। কিন্তু মানসিকভবে আটকে থাকে সেই একই জায়গায়-‘সে একজন নারী’।
অবস্থাদৃষ্টে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে মেয়েদের এর চেয়ে একটু বেশী স্বাধীন বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। মানুষ হিসেবে চিন্তা করলে এই স্বাধীনতার পরিমান অতি নগন্য। এক্ষেত্রে মেয়েরা স্কুল-কলেজে পরার সুযোগ পায়,অনেকে কর্মক্ষেত্রেও প্রবেশ করে। কিন্তু স্কুল-কলেজ,বই-পুস্তক এ সকল কিছুর আগেই সে পরিবার থেকে যে জ্ঞানার্জন করে তা হল-‘সে একজন নারী’। এ শিক্ষাদানের পেছনে পুরুষ নয়, প্রধান ভূমিকা রাখেন পরিবারের বয়জ্যাষ্ঠ নারীরা।
আর উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে মেয়েদেরই আজ আমরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীন বলছি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এরা স্বাধীনভাবে কিছু করার অধিকার রাখে এবং তথকথিত ‘নারী স্বাধীনতা’ ভোগ করে। কিভাবে? তারা চাকরিক্ষেত্রে অংশগ্রহন করছে, বিজ্ঞাপণে অংশগ্রহন করছে, বিভিন্ন সভা সেমিনারে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে ঠিক কি কি করলে একজন নারীকে স্বাধীন বলা যায় তা নির্ধারন করে দিচ্ছে আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, এবং পুরুষতান্ত্রিক মন মানসিকতার দাস হয়ে থাকা নারীবাদী নেতৃরা। নারীরা আজ এতটুকু স্বাধীন-কারন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একদল প্রগতিশীল পুরুষ নারীদের এই রকম স্বাধীন দেখতে পছন্দ করেন।
তারা যদি এইভাবে পছন্দ না করে নারীদের অন্য পথ দেখাতেন তবে নারীরা সেইভবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেন। তাই কথিত স্বাধীন নারীরা আসলে ঠিক কতটুকু স্বাধীন তা পূনর্বিবেচনার দাবী রাখে।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব কতটা নেতিবাচক এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই অবগত। কিন্তু এ পুঁজিবাদী ব্যাবস্থা এবং এ ব্যাবস্থার অন্তর্গত নানাবিধ প্রপাগান্ডা নারীদের ওপর কতখানি কর্তৃত্ব আরোপ করেছে সে বিষয়ে আলোচনা অনেকটাই অবহেলিত। নারী জাগরণের প্রতিবন্ধক হিসাবে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় নি।
কিন্তু এ বিষয়ে আলোচনা বর্তমান সময়ে অপরিহার্য।
এ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারী স্বাধীনতার নামে আমাদের সামনে স্বাধীন নারীর যে ছবি তুলে ধরেছে তা আসলে নারীদের পরাধীনতার শেকলে বেধে রাখার একটি ব্যবস্থা মাত্র। নারী স্বাধীনতার নামে পরিচালিত হচ্ছে নারীকে পন্য করার প্রক্রিয়া। বিভিন্ন সৌন্দর্য সামগ্রী, মোবাইল ফোন এমনকি গাড়ির বিজ্ঞাপনেও নারীর উপস্থিতি পণ্যের আকারে। আয়োজন করা হচ্ছে একের পর এক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা।
যেন সৌন্দর্য চর্চাই নারীর প্রধান কর্ম আর সৌন্দর্য প্রদর্শনই তার চুড়ান্ত স্বাধীনতা। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেই নয় কর্মক্ষেত্রেও নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়তি আকর্ষন হিসাবে। এভাবে প্রতিনিয়ত নারী স্বাধীনতার নামে একজন নারী নিজের অজান্তেই পরিণত হচ্ছেন নিছক পণ্যে।
নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা নারীবাদের অন্ধ অনুকরণও এক ধরণের বোকামি। পশ্চিমা নারীবাদ ও এ অঞ্চলের নারীবাদের মধ্যে লক্ষ্য আর বৈশিষ্টের দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকা প্রয়োজন।
পশ্চিমের একজন নারী কখনোই এমন কিছু আগ্রাসন বা নির্যাতনের শিকার হন না, উপনিবেশ এবং নয়া উপনিবশের আগ্রাসনের ফলাফল হিসাবে যেসব আগ্রাসন বা নির্যাতনের শিকার হন তৃতীয় বিশ্বের একজন নারী। বাঙালি রেঁনেসার সময় থেকেই এদেশের লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নারীবাদের যে বোধের জন্ম দিয়েছেন তা পশ্চিমের অনুকরণে সৃষ্ট। পশ্চিমের নারীকে আদর্শ ধরে তৈরি করা সৌন্দর্য তত্ত্বের মাধ্যমে আমাদের মতো উপনিবেশের শিকার হওয়া একটা দেশের নারীদের বাধ্য করা হচ্ছে পশ্চিমের অনুকরণে নিজেদের সাজাতে। একদিকে বিজ্ঞাপন, টিভি আর রেডিওর মাধ্যমে ইউনিলিভারের মতো বর্ণবাদী প্রতিষ্ঠান সৌন্দর্য সম্পর্কিত হীনমন্যতা এবং মনোজগতে উপনিবেশ স্থাপন করে যাচ্ছে স্থুলভাবে আর অন্যদিকে সুশিল লেখক, কবি বুদ্ধিজীবী সমাজের পশ্চিমা সৌন্দর্যবোধের লেখনিতে তা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাচ্ছে। এ বিষয়ে একটু সহজ সরল আলোচনা করা যাক।
আর্যদের আগমনের পূর্বে এদেশে যেসব জাতি গোষ্ঠী বসবাস করতো তাদের মধ্যে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতির বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিদ্যমান, ফলে বৈশিষ্ট্যগত ভাবেই এ অঞ্চলের মানুষের গায়ের রঙ কালো বা শ্যাম বর্ণের, স্থুলকায় সাস্থ্য, কালো চুল ইত্যাদি। এদেশের সবচেয়ে সাদা মানুষটাও পশ্চিমাদেরর তুলনায় একজন নেহায়েত বাদামী মানুষ। কিন্তু আমাদের দেশে এ সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়া একটি মেয়ে শিশুকে সমাজ পশ্চিমা সৌন্দর্যের ধারণা নিয়ে যেই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করে এবং ঐ মেয়ে শিশুটিও তার সৌন্দর্য সম্পর্কে যে হীনমন্যতা নিয়ে বেড়ে ওঠে তা একধরণের বর্ণবাদী অসুস্থ্যতা। শুধুমাত্র সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণাই নয়, পশ্চিমে অনুকরণে আধুনিকতার যে চেষ্টা চালানো হয়েছে তারও প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের নারীদের ওপর। তথাকথিত আধুনিক হতে গিয়ে আমাদের নারীদের চলনে বলনে স্মার্টনেসে থাকতে হয় পশ্চিমের ছায়া।
নারী মাত্রই দূর্বল, এ আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। কিন্তু এই দূর্বল নারীকেও আসলে সৃষ্টি করা হয়েছে একেবারেই সাম্প্রতিক কালে। অতীতে এ অঞ্চলের নারীদের এভাবে চিন্তা করা হতো না। এদেশের নারীরা ছিলো যথেষ্ট সাবলম্বি, কঠোর পরিশ্রমী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। বিভিন্ন লোকজ সাহিত্য থেকে এর যথেষ্ট প্রমাণ মেলে।
ময়মনসিংহ গিতিকাতেই আছে অজস্র প্রমাণ। মহুয়ার পালার মূল চরিত্র নায়িকা মহুয়া, এখানে মহুয়াকে কোন দুর্বল নারী হিসাবে দেখানো হয় নি, বরং নায়কের চেয়েও বেশি শক্তিশালী করে উপস্থাপন করা হয়েছে নায়িকা মহুয়াকে। একই কথা প্রযোজ্য মলুয়ার পালা, বেহুলা সুন্দরীর পালা এমন আর বহু শত কাহিনির ক্ষেত্রে। কিন্তু পরবর্তীতে উপনিবেশী মন মানসিকতা এবং ভিক্টোরিয়ান রীতিতে এই অঞ্চলের লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এক ধরণের মেকি মধ্যবিত্ত্ব নারী সৃষ্টি করেছেন, যারা এদেশের সাধারণ ঐতিহ্যবাহী মাঠের নারীদের তুলনায় দূর্বল, সর্বংসহা ও পরনির্ভরশীল।
এ অঞ্চলের নারীদের জাগরনের জন্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে আমাদের নিজস্ব নারীবাদ।
যে নারীবাদের মূলমন্ত্র হবে আত্মবিশ্বাস। কারণ নিজেকে হীন মনে করে কখনো কোন জাতির জাগরন সম্ভব নয়। নিজস্ব ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে জাগ্রত হলেই সম্ভব প্রকৃত নারী মুক্তি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।