ফ্রম দ্যা হার্ট অফ ডার্কনেস
বৃদ্ধা বসে আছে মরা কড়ই গাছের নিচে। হাতে একটা পেতলের ঘটি। তাতে পানি। বিল থেকে ভরে এনেছে ঘটি।
কল্পনা তাকে যখন দেখতে পায়, বেলা ডোবা ডোবা।
কল্পনা অবাক হয়। গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে একাকী এই বিলের ধারে এই অসময়ে বসে আছে কেন বাংগালী বৃদ্ধা? নতুন নাকি এই এলাকায়?পরিস্থিতির কথা জানেনা? একাকী বাংগালী বৃদ্ধা যদি এখন শান্তিবাহিনীর কারো চোখে পড়ে যায়!কিংবা প্রতিশোধপরায়ন চাকমা যুবক যদি তাকে দেখতে পায়!তাহলে কি ঘটবে ভাবতে গিয়ে শিউরে ওঠে সে। দ্রুত ছুটে যায় বৃদ্ধার কাছে। ডাকে- বুড়ি মা! ও বুড়ি মা!
বৃদ্ধা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অস্তগামী সূর্যের দিকে। ধ্যানমগ্ন সন্যাসিনী যেন।
কল্পনার উপস্থিতি খেয়ালই করেনি। কল্পনার কন্ঠ তার কানে পৌঁছেছে বলে মনেই হয়না।
কল্পনা আরো এগিয়ে যায়। বৃদ্ধার একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত রাখে বৃদ্ধার কাঁধে।
বৃদ্ধা একটুও চমকায় না। আস্তে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। দৃষ্টিতে একরাশ শূন্যতা।
কল্পনার বুকটা আরো নরম হয়ে উঠে বৃদ্ধার শূন্যদৃষ্টি দেখে। মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে- একা একা এখানে বসে আছো কেন বুড়িমা? এই সময় এখানে থাকা ঠিক না।
বিপদ হতে পারে।
বৃদ্ধা কথাগুলো শুনেছে কিনা বোঝা যায় না। কেননা তার কোন ভাবান্তর ঘটে না। কল্পনার সন্দেহ হয়, বৃদ্ধা বোধহয় কানে খাটো। কিংবা হয়তো পাগল।
সে আবার বলে- তুমি কোথায় থাকো বুড়ি মা? এখানে একা বসে আছো কেন?
এতক্ষনে বৃ্দ্ধার চটক ভাংগে যেন। তার দৃষ্টিতে ভাষা ফিরে আসে। মৃদু কন্ঠে বলে- এমনি এমনি বসি আছি রে মা।
কল্পনা বোঝাতে চায়- কিন্তু বিপদ...
আর বিপদ!
বুড়ির কন্ঠস্বরে যে কোন পরিণতি মেনে নেবার নিস্পৃহতা।
তুমি কোথায় থাকো?
ঐ যে ছোট পাহাড়ডার ঐপারে- বুড়ি উত্তরের ছোট টিলা দেখায়- গুচ্ছিগ্রাম না কী জানি কয়।
তা এইখানে একা একা এসেছো কেন?
এই ছোট্ট এক ঘুপচি গিরামের মদ্যি থাকতি থাকতি পেরানডা হাঁপায় উঠিছিল রে মা। এইভাবে কি থাকা যায়! আত্মীয় নাই, পড়শি নাই, কুটুম নাই। মানুষি মানুষি চালাচালি নাই। আর কী একখ্যান দ্যাশ ইডা! আছে কী? না। খালি পাহাড় জংগল, মশা, মরণজ্বর।
দ্যাশ আছিল আমাগের।
উম্মা প্রকাশ পায় কল্পনার কন্ঠে- এসেছো কেন তাহলে আমাদের দেশে?
কল্পনার উম্মা বুড়িকে স্পর্শই করেনা। সে আবার চলে গেছে ঘোরের মধ্যে-দ্যাশ আছিল আমাগের! ঘরে ঘরে সব মানুষ সবায়ের কুটুম। দিনমান কাম করি মরদরা যায় হাটে-বাজারে আড্ডা দিতি আর মাগি মানুষিরা বসে উঠোন জুরে গপ্পো করতি, উকুন বাছতি, চুলে ত্যাল লাগাতি। কত শাস্তর-বিস্তর, হাসি-আহ্লাদ।
কী জীবনডা আছিল!
.......................................................................................................
আমি কি আসতে চাইছি? সোয়ামি মরিছে, ছাওয়াল আমাক খাওয়া-পড়ায়। সেই ছাওয়াল আসতি চাইলে আমি আর কোন ঠাঁয়ে যাবে?
কল্পনা একথার উত্তরে কী বলবে ভেবে পায়না। বুড়ি নিজের মনেই বকবক করে- ছাওয়াল কি আর এমনি এমনি আইছে। গবমেন্টের সেপাইরা বলিছিলি থাকার বাড়ি পাবা, দশ বিঘে জমি পাবা, হালের লাংগল-বলদ পাবা, দিনে বারো সের গম পাবা। তখনই না লোভে পড়লি ছাওয়াল আমার।
............... আমরা কারো জমি-ভিটে দখল করতে চাইনি। আমরা শুনিছি এই দ্যাশে জমি অঢেল। চাষ করার মানুষ নাই। নিজের দ্যাশে তো আমাদের আধপেটা খাওয়া। নিজেদের জমি নাই, কামলা-মজুর দিয়ি খাওয়া।
তখন এতো লোভ দেখালি কে আর না আসে তুই ক দিনি! কিন্তু এসে দেখি সব ফক্কা। গুচ্ছিগিরাম তো না, জেলখানা।
তাহলে ফিরে যাওনা কেন নিজেদের দেশে।
সিখানে ফিরার তো কোন উপায় নাইরে মা। ভিটে-মাটি সব বিক্রি করে চলি আইছি।
ছাওয়াল কয়, আর ফিরার উপায় নাই। মরতি হলিও এই জাগাত দাঁত কামড়ে পড়ি থাকতি হবি।
এই প্রথম অন্য এক বাস্তবতা উন্মোচিত হয় কল্পনার সামনে। এই মানুষগুলোও প্রতারিত। রাজার লোকেরা জঘন্য প্রতারণা করেছে এদের সাথেও।
এদের ফেরারও পথ নাই। তাই এখানে টিকে থাকার জন্য এতটা হিংস্র হয়ে উঠেছে সবাই।
.......................................................................................................
বুড়ি মাথা নাড়ে- পাহাড়ের মানুষ আমাগের সাথে কথা বলতি চায়না। ঘিন্না করে আমাগের। কিন্তুক আমাদের দোষডা কী কও দিনি।
আমাগের বললি যে ঘর পাওয়া যাবি, রোজ বারো সের গম, চষার জন্য অঢেল জমি পড়ি রইছে। ................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।