munirshamim@gmail.com
কথা ছিল ধর্ম সরে যাবে। আস্তে আস্তে। ক্রমান্বয়ে। রাষ্ট্র থেকে, রাজনীতি থেকে। অর্থনীতি, এমনকি সব আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান থেকে।
ধর্মের জায়গায় বসবে ইহজাগতিকতা। ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকবে, এর চর্চাটা হবে বড় জোর ব্যক্তিগত পর্যায়ে। যৌক্তিকতা আর বিজ্ঞানমনস্কতার স্তর অনুযায়ী কেউ চাইলে তা পালন করবে। যে চাইবে না সে করবে না।
রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাবে না। বিশেষ কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর হবে না। রাষ্ট্র হবে সবার। এ রকম আলোকিত জনআকাঙ্খার জায়গা থেকেই সংঘটিত হয় লক্ষ্য প্রাণের বলিদান, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু সে জনআকাঙ্খাটা বাস্তবে রূপ নিল না।
বরং ধর্মই এ রাষ্ট্রের ঘাড়ে ঝেকে বসলো। ভীষণভাবে। রাষ্ট্র, রাজনীতি এমনকি অর্থনীতিতে ধর্মের প্রাধান্যই বাড়লো। বাড়ানো হলো। এ ক্রমাগত বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় সরাসরি অবদান রাখলো সামরিক সরকার, বেসামরিক সরকার, ভোটে নির্বাচিত সরকার, ভোটে অনির্বাচিত সরকার।
বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ? আ’লীগ সরকারও। এ ধারাবাহিকতায় এখন ধর্ম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বহুল ব্যবহৃত হাতিয়ারে। যার সফল উদাহরণ হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নাম সরিয়ে হজরত শাহ জালাল এর নামে ঢাকা বিমানবন্দরের নামকরণ। প্রতিপক্ষ দলের কোন প্রভাবশালী জাতীয় রাজনৈতিক নেতার নাম সরিয়ে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নাম বসিয়ে দেয়ার সফল কাজটি করিয়ে দেখিয়েছিল বিএনপি এবং চারদলীয় জোট সরকার। শাহ আমানতের নামে চট্রগ্রাম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
সে সময় আ’লীগ যত নাখোশ হোক না কেন রাজনৈতিক ময়দানে এটি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করতে পারে নি। বিশেষ করে চট্রগ্রামে স্থানীয়ভাবে এটি নিয়ে কোন আন্দোলন দাঁড় করাতে পারেনি। কারণ শাহ আমানতের নাম পরিবর্তনের দাবি চট্রগ্রাম অঞ্চলে ভাল গ্রহণ যোগ্যতা পাবে না। এটি আ’লীগ জানতো। জানতো বলে আন্দোলনে নামেনি।
আর চারদলীয় জোট তো জেনেশুনে সচেতনভাবে এ ধর্মাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এবার আ’লীগ তার প্রতিশোধ নিল। একই কায়দায়, একই ধর্মীয় হাতিয়ার ব্যবহার করে। শাহ আমানতকে দিয়ে মুছে দেয়া হয়েছিল আ’লীগ নেতার নাম। এবার শাহজালাকে দিয়ে মুছে দেয়া হলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার নাম।
ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে থাকলো না। না ধর্মের সোল এজেন্ট বিএনপি, না ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার আ’লীগ। সাবেক সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমনাবন্দরের সামনে বাউল ভাস্কর্যগুলোকে টেনে হিচড়ে আক্ষরিক অর্থে রক্তাক্ত করেছিল মৌলবাদীরা। বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাদের দিনের পর দিন কারাগারের ভাত খাওয়ানোর কৃতিত্ব দেখালেও তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার এ সব মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে নি অথবা করে নি। তবু আশা ছিল ওখানে, বিমানবন্দরের সামনে আবার বাউলরা ফিরে আসবে।
বাউল ভাস্কর্যগুলোকে আবার প্রতিস্থাপন করা হবে। কিন্তু এখন ওখানে বাউল ভাস্কর্য পুনস্থাপন তো দুরে থাক, ঐ জায়গাটার স্থায়ীভাবে মুসলমানীকরণের একটি রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া শুরুর কথা শোনা যাচ্ছে। ধর্মের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার ও মতলবী ব্যবহারের কাছে পরাজিত হচ্ছে বাউল দর্শন ও বাউল ঐতিহ্য উপস্থাপনের যৌক্তিকতা ও আকাঙ্খা।
ধর্মের এ মতলবী ব্যবহার, ধর্মের কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় গ্রহণের মিছিলে আপাতত প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত আমাদের কোন কোন কবি-কথাসাহিত্যিকও পিছিয়ে নেই। মনে পড়ে তসলিমা নাসরিনের 'ক' প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের একজন পাঠক নন্দিত লেখক আদলতে গিয়েছিলেন।
বইটি নিষিদ্ধের দাবিতে। বইটিতে তার নামও ছিল। বেশি কিছু না, স্রেফ প্রণয় প্রত্যাশী হিসেবে। যৌননিপীড়নের চেষ্টাকারী হিসেবে। কিন্তু এ প্রগতিশীল? লেখক সেদিন আর্জিতে বইটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলেছিলেন।
নিজের বিচ্যুতিকে ঢাকতে চেয়েছেন ধর্মের মোড়কে। এ মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে অনেক বছর আগে টানাবাজার 'যৌনপল্লী' উচ্ছেদের কথা। কোন এক শুক্রবারে জুমার নামাজ শেষে দলবল নিয়ে হামলা করা হয়েছিল ওখানে। সেদিনও সামনের সারিতে ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তারা নারায়নগঞ্জকে পাপমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
যে উৎপাদন ব্যবস্থা আর সামাজিক কাঠামোর উপজাত হিসেবে বাজারে শরীরের বিকিকিনি ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তাকে জিইয়ে রেখে তারা সেদিন 'যৌনপল্লী' উচ্ছেদের মহাযজ্ঞে মেতে ছিল। তাও স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু সামনে টেনে এনেছিল ধর্মকে। শুনেছি ঐ পল্লীর আয়ের বড় অংশ যেত উচ্ছেদে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঘরে। ফলে যারা নিজেরাও হয়তো ওখানে কখনও সখনও 'পতিত' হয়েছিলেন সেদিন তারাও উচ্ছেদে অংশ নিয়েছিলেন।
হাজির হয়েছিলেন জুমার নামাজে। স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের 'ইনকাম পকেট'টাকে নষ্ট করে দেয়ার ইচ্ছায়। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যাদের উজ্জ্বল ব্যাবসায়িক স্বার্থ ছিল এ উচ্ছেদের মধ্যে। কিন্তু সব কিছু চাপা পড়ে গিয়ে তথাকথিত ধর্মীয় পবিত্রতাই সেদিন প্রধান হয়ে উঠেছিল।
স¤প্রতি ৭২ এর সংবিধান-এ ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। বিতর্ক হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যখন সরকারের নীতিনির্ধারকরা ব্যাখ্যা করে বলেন, ৭২ এর সংবিধানে ফিরে গেলেও সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকবে। তখন নাগরিক হিসেবে আমরা আবারও নিশ্চিত হই, ইহজাগতিকতা নয়, ধর্মই এ রাষ্ট্রে প্রবল, এখন পর্যন্ত।
একই সাথে চারদলীয় জোট নেতারা যখন বলেন ৭২ এর সংবিধানে ফিরে গেলে দেশে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে, তখনও আমাদের একই কথাই মনে পড়ে। রাষ্ট্র ও রাজনীতি আজ ধর্ম আশ্রিত। চলমান ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল না ঘটলে, শাসকশ্রেণীর পরিবর্তন না ঘটলে, এ ভাবেই ধর্ম রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রভাবক হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকবে। ধর্মের মতলবী ব্যবহার আরও বাড়বে। সে সুবাদে মৌলবাদের চাষ হবে।
মৌলবাদ চাষাবাসের উপযোগী শর্তগুলোর বিকাশ হবে। আর আমরা হাটবো ইতিহাসের পেছনের দিকে। আলোর বদলে অন্ধকার ই শাসন করবে আমাদের। যেমনটা করে এসেছে বিগত দিনগুলোতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।