সত্যের চেয়ে অপ্রিয় আর কিছু নেই
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ,
অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং
প্রো-উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ]
---------------------------------------------------------------------------------
২২ জানুয়ারির প্রায় সব পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ, কবিরাজি হালুয়া খেয়ে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মোনতলা এলাকায় শুক্রবার ৪ যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। এক পর্যায়ে নিহতদের পরিবারের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে স্থানীয় থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘাতক কবিরাজ পালিয়ে গেছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের মোনতলা মৌজার কাঠকারচালা গ্রামের আবদুর রহমান (২২), চান মিয়া (২৩) ও পার্শ্ববর্তী মোনতলা গ্রামের আবদুল লতিফ (২৪), বাচ্চু মিয়া (২৫) ও রফিকুল ইসলাম-এই ৫ যুবক স্থানীয় অজ্ঞাতনামা এক কবিরাজের কাছ থেকে বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় যৌন উত্তেজনাকর হালুয়া খায়। রাত ২টার দিকে তাদের বমি শুরু হলে কবিরাজকে ফোন করা হয়। কিন্তু কবিরাজ কোন সাড়া না দেয়ায় পরিবারের লোকজন মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়। হাসপাতালে নেয়ার পথেই চান মিয়া মারা যায়। এ ছাড়া হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায় আরও ৩ জন।
বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে রফিকুল ইসলাম। কোন কবিরাজের হালুয়া খেয়ে ৪ যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে তাকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। তবে ঘাতক কবিরাজের মোবাইল নম্বর উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনার খবর পেয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
পেশাগত দিক থেকে আমি একজন ফার্মাসিষ্ট বলে ওষুধ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
দেশের নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ এবং অপচিকিৎসা সম্পর্কে অনেকগুলোর লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। সেই লিখাগুলোতে বাংলাদেশে অপচিকিৎসায় কী মারাত্মক নৈরাজ্য চলছে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লেখাগুলোতে বিদ্যমান সমস্যার প্রতিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনাও ছিল । কিন্তু লেখাগুলো আমাদের দেশের কোন কালের কোন কর্তাব্যক্তি বা নীতিনির্ধারকের দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়নি ।
স্মরণাতীতকাল থেকে এ দেশে অপচিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জীবন দিয়েছে অসংখ্য লোক ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে রাস্তাঘাট, পথে-প্রান্তরে, বাসে-ট্রেনে বিক্রিত ওষুধ নামের এসব ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার পরবর্তী ফলাফল ও নিরাপত্তা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, ওষুধ নামের এসব জিনিসের অপপ্রয়োগের ফলে বহু মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসকের নাম ভাঙ্গিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচেছ অসংখ্য অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, ভন্ড চিকিৎসক । এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ অসহায় নিরীহ মানুষ । শিক্ষিত মানুষ কোন কালেই এসব চিকিৎসা গ্রহণ করে না । কারণ তাদের বোধশক্তি আছে ।
কিন্তু এদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ-অসহায় মানুষের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত ভন্ড এবং অসৎ মানুষ লোক ঠকিয়ে, ক্ষতিসাধন ও হত্যা করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে ।
ওষুধ নামের আজগুবি সব বস্তু এবং চলমান অপচিকিৎসার হাত থেকে এ দেশের লক্ষ লক্ষ অসহায় নিরীহ মানুষকে রক্ষা করার জন্য কি কিছু করণীয় আছে ? না কী জীবন নিয়ে ফ্রি ষ্টাইলে এসব অপকর্ম চলতেই থাকবে, যদি মনে করেন সত্যি সত্যি কিছু করার আছে, তবে দেরি না করে এই চলমান অপচিকিৎসা নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন সম্পর্কে আমাদের অনেকের মনে একটি সহজ-সরল ধারণা প্রচলিত আছে। ধারণাটি এরকম, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন নিরাপদ এবং এসব ওষুধের কোন ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া নেই। অনেকে বলেন, ভেষজ ওষুধের বৈশিষ্ট্য হচেছ এর সহজলভ্যতা, দামে সস্তা এবং এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
তাই আজ বিশ্বব্যাপী শ্লোগান উঠেছে- ফিরে চলো প্রকৃতির কাছে।
ভেষজ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই- এ কথাটি আমার বোধগম্য নয়। আমি বহু বছর ধরে ভেষজ উদ্ভিদ এবং ওষুধের ওপর গবেষণা করে আসছি। বিভিন্ন ওষুধি গাছ থেকে প্রায় দুইশ নতুন রাসায়নিক যৌগ আইসোলেট করে অনেকগুলোর ওষুধি গুণাগুণের ওপর প্রচুর কাজ করেছি। সুতরাং ওষুধি গাছ এবং হার্বাল ওষুধের ওপর আমার যৎসামান্য অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান আছে বলে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
পৃথিবীতে এমন কোন ওষুধ নেই যার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রিয় পাঠক আসুন, ভেষজ ওষুধের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
সাম্প্রতিককালে পরিচালিত বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে -হার্বাল ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিষক্রিয়াজনিত রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কিডনী ও লিভার ধ্বংস ছাড়াও বিভিন্ন কারণে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হচ্ছে। হার্বাল ওষুধের অন্যতম ভয়াবহ সীমাবদ্ধতা হলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত ধাতু, রাসায়নিক পদার্থ, কীটনাশক জাতীয় পদার্থ দ্বারা কন্টামিনেশন বা দুষিত হয়ে পড়া। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করে অসংখ্য হার্বাল ওষুধে এসব ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
বলা হয়ে থাকে, হার্বাল ওষুধের নিজস্ব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চেয়ে এসব ভয়ঙ্কর পদার্থের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেকগুণ বেশি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, হার্বাল ওষুধের প্রস্তুতকারকগণ এবং তাঁদের প্রমোটারগণ এসব তথ্য কোন সময়ই উল্লেখ করেন না।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষ বিভিন্ন রোগের প্রতিকারে প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে আসছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতিতেও মানুষ এখনো সনাতনী চিকিৎসা পদ্ধতি এবং চিকিৎসা উপকরণের উপর আস্থা হারায়নি, বরং যতই দিন যাচেছ মানুষ ও মানব সভ্যতা ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মোতাবেক পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার আশি শতাংশ মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের উপর নির্ভর করে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ৩০তম এসেম্বলিতে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চত করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত আল্মা আটা সম্মেলনে পৃথিবীর সব দেশের সরকারকে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের বিজ্ঞানসম্মত উন্নয়ন, উৎপাদন, কার্যকর ও নিরাপদ প্রয়োগ নিশ্চতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা না হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধকে স্বীকৃতি প্রদান করার কারণে বিশ্বজুড়েই ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের উন্নয়নে ও আধুনিকীকরণের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফলশ্রুতিতে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন, আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের উৎপাদন ষ্টান্ডার্ডাইজেশন, গুণগত মান নির্ণয় কার্যকর ও নিরাপদ ব্যবহারের উপর প্রকৃত অগ্রগতি সাধিত হয়।
পৃথিবীতে ওষুধি গাছগাছড়ার প্রকৃত সংখ্যা কত ? এ প্রশ্নের উওর দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। কয়েক বছর আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ১১টি দেশের বই-পুস্তক ও প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক একুশ হাজার ওষুধি গাছগাছড়ার একটি তালিকা প্রস্তুুত করা হয়।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাপ্রালেট ডাটাবেস তেত্রিশ হাজার গাছগাছড়ার মধ্যে নয় হাজার দুইশ গাছগাছড়ার ওষুধি গুণাগুণের কথা লিপিবদ্ধ করে। এক হিসেব মতে-চীনে পাঁচ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার গাছগাছড়ার ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত অসংখ্য ওষুধের উৎস সরাসরি মেডিসিনাল প্লান্ট অথবা মেডিসিনাল প্লান্ট থেকে প্রাপ্ত উপাদানের রাসায়নিক রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যবহার। । এই চমৎকার তথ্যটি আমরা অনেকেই জানি না।
আ্যলোপ্যাথিতে ব্যবহৃত মরফিন কোডেইন, এট্রপিন ডিজক্সিন, কুইনিন, নস্কাপিন, থিউফাইলিন, ভিনব্লাস্টিন, ভিনক্রিস্টিন-এর মত অসংখ্য আধুনিক ওষুধ বিভিন্ন গাছগাছড়া থেকে পাওয়া যায়।
১৯৯৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন Contemporary Medicine, New Approaches to Good Practices শীর্ষক এক রিপোর্টে হার্বাল মেডিসিনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরে এবং চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে হার্বাল মেডিসিনের ব্যবহার থেকে যথেষ্ট সুফল পাওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করে। ব্রিটিশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত দু’জন ডারমাটোলজিষ্ট এবং চীনের ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন চিকিৎসকদের যৌথ উদ্যোগে চীনের হার্বাল মেডিসিন হিসেবে ডারমাটাইটিসে ব্যবহৃত জেমোফাইট (Zemophyte) নামক একটি ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে দেখতে পান যে, হার্বাল ওষুধটি ডারমাটাইটিসে অ্যালোপ্যাথি ওষুধের মত সম বা ক্ষেত্রবিশেষে বেশি কার্যকারিতা প্রদর্শন করে। ইতিমধ্যে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের মাধ্যমে বহু আধুনিক ওষুধ আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। এ প্রসংগে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণটি হচেছ সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনহাউজু (Quinhausu)| এই ওষুধটি Artemesia annua থেকে আবিষ্কৃত হয় এবং এই গাছ দুই হাজার বছর ধরে চীনে ম্যালেরিয়া রোগের ক্ষেত্রে সাফল্যজনকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ওষুধটি বর্তমানে Paluther নামে বহুজাতিক কোম্পানি রোনপোলেঙ্ক কর্তৃক প্রস্তুত ও বাজারজাত হচ্ছে।
অনেকের ধারণা, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন নিরাপদ এবং এসব ওষুধের কোন ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া নেই। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধারণা পাল্টাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার ক্রমোন্নতির বদৌলতে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন হিসেবে ব্যবহৃত বহু গাছগাছড়া এবং উপকরণের ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা প্রকাশিত হচ্ছে। সাইটাস স্কোপেরিয়াস (Cytus scoparius) গাছ থেকে প্রাপ্ত পার্টাইন (Sparteine) নামক এক ওষুধ ডাইইউরেটিক (Diuretic) এবং প্রসবব্যথা উদ্রেককারী হিসেবে যুক্তরাজ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৮৯-১৯৯১ সাল পর্যন্ত হংকং-এ অ্যাকোনাইটিন (Aconitine) বিষক্রিয়ার ২০টি কেস্ রিপোর্ট করা হয়েছে। চীনা ওষুধিগাছ অ্যাকোনাইটিয়াম-এর শেকড় ব্যথা ও প্রদাহ উপশমে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কায় ক্ষতিকর অ্যালকালয়েড (Alkaloid) এর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ৭৫টি ওষুধি গাছগাছড়ার উপর এক পরীক্ষা চালানো হয়। এর মধ্যে অনেক গাছের নির্যাস বা পাউডার লিভার এবং কিডনির ক্ষত সৃষ্টি করতে সক্ষম বলে পরীক্ষা করে দেখা গেছে।
আমাদের আশপাশেও বহু গাছগাছড়া রয়েছে যেগুলোর ব্যবহার আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর বলে মনে না হলেও দীর্ঘদিন ব্যবহারে এসব গাছগাছড়া সুস্পষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। টক্সিকোলজিক্যাল (Toxicological) পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ইউনানী এবং আয়ুর্বেদিতে অসংখ্য গাছগাছড়ার ব্যবহার যুক্তিসঙ্গত কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অ্যালোপ্যাথিতে নিরাপত্তা সার্টিফিকেট প্রদান করার পূর্বে প্রত্যেকটি ওষুধ বা উপাদানের টক্সিকোলজিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। আধুনিক ওষুধের প্রত্যেকটি উপাদান এবং আনুষংগিক উপকরণের গুণগতমান নির্ণয় করে ওষুধ উৎপাদনের জন্য পাঠানো হয়। উৎপাদনকালীন সময়ে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও উৎপাদন শেষে ওষুধের গুণগতমান নির্ণয় অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া।
এর পরেও ড্রাগ টেষ্টিং ল্যাবরেটরীতে সরকারি পর্যায়ে প্রত্যেকটি ওষুধের গুণগতমান পরীক্ষা করা হয়। ইউনানী ও আয়ুর্বেদীকে ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এসব ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের উপর প্রকৃত অর্থে নিয়ন্ত্রণের কোন বিধান রাখা হয়নি। ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধে ব্যবহৃত সব গাছগাছড়া বা অন্যান্য উপকরণের নাম ও পরিমাণ সব সময় উল্লেখ থাকে না। এসব কারণে এই ওষুধের গুণগত মান নির্ণয়ও সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহের কারণেই হয়তো প্রায়শঃই আমার মনে কতগুলো প্রশ্ন ভেসে আসে।
প্রথমত, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনে অসংখ্য গাছগাছড়া ও অন্যান্য উপকরণের ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি? দ্বিতীয়ত, কার্যকারিতার জন্য সব গাছগাছড়া বা উপকরণের উপস্থিতি অপরিহার্য কিনা? তৃতীয়ত, একই ওষুধে অসংখ্য গাছগাছড়া এবং বিভিন্ন উপকরণের উপস্থিতি অপরিহার্য হলেও ব্যবহার কতটুক নিরাপদ? চতুর্থত, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনে ব্যবহৃত গাছগাছড়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা কেমন বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো কি কি? এসব গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের উত্তর এবং সমস্যা সমাধানের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের প্রস্তুুত স্টান্ডার্ডাইজেশন ও গুণগত মান নির্ণয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুবাদে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের উপাদান ও বিভিন্ন উপকরণের গুণগত মান নির্ণয় করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ ও প্রয়োগ কোন জটিল ব্যাপার নয়। ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের উৎপাদন স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, গুণগত মান নির্ণয় ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এসব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রযুক্তিসহ অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে প্রস্তুুত। ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের গুণগত মান নির্ণয় ভিন্ন একটি কারণেও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের এ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। আমাদের দেশে ওষুধি গাছগাছড়ার কোন অভাব নেই। অভাব রয়েছে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও আগ্রহের। আল্লাহ মানুষকে রোগ দিয়েছেন, তার প্রতিকারও তিনি প্রকৃতিতে লুকায়িত রেখেছেন। সেই অফুরন্ত প্রাকৃতিক ভান্ডার থেকে রোগের প্রতিকার খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের।
এই বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার আধুনিক, বিজ্ঞানসমত ও যুক্তিসঙ্গত না হলে তার খেসারত দিতে হবে দেশের নিরীহ কোটি কোটি মানুষকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনকে আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এসব ওষুধের কার্যকর ও নিরাপদ ব্যবহার যে শুধু নিশ্চিত হবে তা নয়, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের প্রতি দেশের কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
==================================
প্রকাশ: ইত্তেফাক, ২৬/০২/২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।