আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাজীপুরে গার্মেন্টে আগুন : ২১ লাশ



গাজীপুরের ভোগড়া এলাকায় গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডে ২১ গার্মেন্টকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গার্মেন্টের সব গেট বন্ধ থাকায় শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মারা গেছেন অধিকাংশ শ্রমিক। মারা যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ১৪ জন নারী এবং ৭ জন পুরুষ। এছাড়া আহত হয়েছেন ২০ জন। আহতদের গাজীপুর ও টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রায় তিন ঘণ্টা প্রাণান্ত চেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা রাত সাড়ে ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। গত বছরের জুলাইয়ে একই ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে চার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে ফায়ারকর্মীরা জানিয়েছেন। গাজীপুর সদর উপজেলার ভোগড়া এলাকার গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরির সাততলা ভবনের দ্বিতীয়তলায় রাত ৯টার দিকে লিংকিং শাখায় আগুন লাগে। এরপরই সাততলা থেকে দ্বিতীয়তলা পর্যন্ত থাকা শ্রমিকরা আটকে পড়েন। বিশেষ করে সাততলায় ২৬ শ্রমিক কাজ করছিলেন।

এছাড়া অন্য ফ্লোরগুলোতে তিন-চারজন করে নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করছিলেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষ দ্রুত ভবনের সব বাতি নিভিয়ে ফেলে। ফলে আটকে যাওয়া শ্রমিকরা আর বের হতে পারেননি। অন্ধকারের মধ্যে ছুটে বেরিয়েছেন এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে। আগুন লাগার পরপরই স্থানীয় লোকজন তিনতলার গ্রিল কেটে আটকেপড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।

দু'-এক শ্রমিককে সেখান থেকে উদ্ধার করা গেলেও অধিকাংশই আটকে যান। ফায়ারকর্মীরা অচেতন অবস্থায় ২৫ জনকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান। এর মধ্যে ২১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। জানা গেছে, শ্রমিকরা শ্বাসরুদ্ধ এবং পদদলিত হয়ে মারা গেছেন। গাজীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আলী হায়দার খান সমকালকে বলেন, অধিকাংশ শ্রমিক ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মারা গেছেন।

তিনটি হাসপাতালে ২১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন তিনি। রাত ৩টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও উদ্ধারকর্মীরা লাশের সন্ধানে ভেতরে অভিযান চালাচ্ছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে মৃতদের সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হাসপাতাল ও আত্মীয়-পরিজন সূত্রে সাতজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন রওশন আরা বেগম (৪৫), সাহারা খাতুন (৩২), সাহেদা বেগম (৩০), জরিনা বেগম (৪৫), শাহিনুর বেগম (৩৫), ফরিদা বেগম (৪০) ও মজিদা খাতুন (৩৫)।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার নুরুজ্জামান ঘটনাস্থলে সমকালকে জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে কর্তৃপক্ষের কিছু গাফিলতি রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। তিনি ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। অগি্নকাণ্ডের পরপরই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।

ঘটনার সময় রাতের শিফটে কাজ চলছিল। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সূত্র জানায়, রাত ৯টার দিকে সাততলা ভবনের দ্বিতীয়তলায় লিংকিং শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত। খবর পেয়ে গাজীপুর, টঙ্গী ও কুর্মিটোলা ফায়ার সার্ভিস থেকে ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পেঁৗছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। তবে ঘটনাস্থলে পানি স্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের বেগ পেতে হয়। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) ভরত চন্দ্র বিশ্বাস সমকালকে বলেন, রাত ৯টা ৮ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়।

সঙ্গে সঙ্গে তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে পেঁৗছে তিনি দেখেন স্থানীয় লোকজন গার্মেন্টের গ্রিল কেটে আটকে থাকা লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে। ভবনে মূল সিঁড়ির বাইরে আরও দুটি অতিরিক্ত সিঁড়ি রয়েছে। দোতলায় আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন ছোটাছুটি শুরু করেন। কিন্তু সিঁড়ি দুটি বন্ধ থাকায় তারা বের হতে পারেননি।

প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে লোকজন আটকে যান। তিনি বলেন, ভবনে ইমার্জেন্সি লাইট থাকলেও তা জ্বালানো হয়নি। এই লাইট জ্বালানো হলে প্রাণহানি কম হতো। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেননি তিনি। গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরির সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম শিকদার ঘটনাস্থলে জানান, বিকেল ৫টার দিকে গার্মেন্টের অধিকাংশ শ্রমিককে ছুটি দেওয়া হয়।

একমাত্র সাততলায় (টিনশেড) কাজ চলছিল। সব মিলিয়ে ভবনে অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছিলেন। ভবনের দোতলায় আগুন লাগে। এখানে গার্মেন্টের সোয়েটারের লট ও মেশিন ছিল। কয়েক শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন।

তিনি আরও জানান, এর আগে গত বছর ১০ জুলাই এই একই গার্মেন্টে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে ভবনের তিনতলায় আগুন লেগেছিল। সে সময় চার শ্রমিক মারা যান। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এরপরই ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা তল্লাশি চালিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান। তাদের সবাইকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

তিনি বলেন, আগুন ভবনের দোতলায় সীমাবদ্ধ ছিল। অগি্নকাণ্ডে নিহত গার্মেন্টকর্মী ফরিদা বেগমের ভাই সাইদুল ইসলাম জানান, ভবনের সাততলায় কাজ হচ্ছিল। সাততলার সুপারভাইজার ছিলের মোতালেব হোসেন। দোতলায় আগুন লাগার পর নিচ থেকে মোতালেবকে আগুন লাগার কথা জানানো হয়। কিন্তু মোতালেব ফ্লোরের কাউকে কিছু না জানিয়ে নিচে চলে আসেন।

এরপরই বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দেন। অন্ধকারে ঢেকে যায় পুরো ভবন। ফলে কেউ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে পারেননি। নিহত গার্মেন্টকর্মী সান্ত্বনা বেগমের স্বামী মাহবুব হোসেন জানান, তার শাশুড়িও অগি্নকাণ্ডে মারা গেছেন। সাততলায় তার স্ত্রী ও শাশুড়ি একসঙ্গে কাজ করছিলেন।

রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত তাদের কাজ ছিল। গার্মেন্টের অদূরেই তাদের বাসা। গরীব অ্যান্ড গরীব গার্মেন্টের শ্রমিক সোহেল জানান, এই কারখানার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। প্রতি তলাতেই একশ' থেকে দেড়শ' শ্রমিক কাজ করেন। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নায়েম মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এ প্রতিবেদককে জানান, বারবার কেন এই গার্মেন্টে আগুন লাগে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কমিটির সদস্যদের নাম জানা যায়নি। বারবার আগুন লাগে এই গার্মেন্টে গত বছরের ১০ জুলাই এই ভবনেরই তৃতীয়তলায় আগুন লেগে চার শ্রমিক মারা যান। ওই ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই সময় কমিটি জানিয়েছিল, নিম্নমানের কেবল ব্যবহারের কারণে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে।

পুরো ভবনের কেবল বদলানোর পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ গা করেনি। এর ফলে আবারও আগুন লেগেছে বলে ধারণা করছেন ফায়ারকর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) ভরত চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এবারও শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে বলে তারা ধারণা করছেন।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.