আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গীবত বা পরনিন্দা

চলার পথ অনেক, সত্য পথ একটাই

গীবত-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- অপবাদ, অসাক্ষাতে নিন্দা, কুৎসা রটনা, কলঙ্ক রটনা, কারো চরিত্র হননের জন্য বিবৃতি দেয়া ইত্যাদি। ইসলামী পরিষাভায় গীবত হচ্ছে কারো সম্বন্ধে তার অনুপস্থিতিতে এমন কোনো কথা বলা, যা শুনলে অপ্রিয় মনে হবে। অপরের দোষের দিকে দৃষ্টি রেখে যে কথা বলা হয়, তাই গীবত। গীবত সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর যেসব হাদীস রয়েছে এগুলোর মর্ম হচ্ছে ‘যা সম্মুখে বললে মনে বিরক্তি ও কষ্ট আসে, অগোচরে তা বলাই গীবত। ’ সব ধরনের অশস্নীলতা ও অশালীন উক্তি ইসলামে নিষিদ্ধ।

যে কথা শুনে মানুষ কষ্ট পায়, তাই অশালীন। কারো সম্পর্কে অপ্রীতিকর বাক্য না বলাই হচ্ছে শালীনতা। ইসলামের আগমন হয়েছে মানুষকে শালীনতা ও সৌহার্দ্য শিক্ষা দেয়ার জন্য। তাই শালীনতাকে ইসলাম মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হিসাবেও নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ যে যতো বেশি শালীন সে ততো বেশি মর্যাদাবান।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ তা’য়ালার নিকট ঐ ব্যক্তি বেশি মর্যাদাবান যে বেশি শালীন ও পরহেযগার। ’ আমাদের অনেকের মধ্যে যেন একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, পাপীর পাপ সম্পর্কে উল্লেখ করলে কিংবা যার যে দোষ আছে তা অন্যকে বললে গীবত হয় না। বরং এ ধরনের গর্হিত কাজের নিন্দা করা পুণ্যের কাজ। এই ধারণা ঠিক নয়, বিভ্রান্তিমূলক। যার মধ্যে যে দোষ নেই, তা যদি বলা হয়, তাহলে তা হবে মিথ্যা অপবাদ।

আর যদি সত্যি হয়, তখন তা হবে গীবত। এই প্রসঙ্গে নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘কারো সম্বন্ধে তার অগোচরে এমন কোনো কথা যদি বলা হয়, যা শুনলে তার নিকট অপ্রীতিকর বোধহয়, তবে সে কথা সত্য হলেও গীবত। ’ ইমাম গাযযালী (রা) তার ‘কিমিয়ায়ে সাআদাত’ গ্রন্থে গীবতের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, অন্যের দেহ, বংশ, বসনভূষণ, ভাবভঙ্গি, ক্রিয়াকলাপ, কথোপকথন ও গৃহের কোনো দোষ বের করে কিছু বললেই তাকে গীবত বলে। দীর্ঘ দেহবিশিষ্ট লোককে লম্বু, খর্ব লোককে বামুন, কালো লোককে নিগ্রো, উজ্জ্বল লোককে সাদা, কাটা চক্ষু বা টেরা ইত্যাদি বললে দেহ সম্পর্কে গীবত হয়ে যায়। কোনো ব্যক্তিকে কোনো হীন পেশাদারের সন্তান বললে তার বংশ সম্বন্ধে গীবত হয়ে যায়।

কাউকে নিন্দুক, মিথ্যাবাদী, গর্বিত, কাপুরুষ, অলস ইত্যাদি বললে তার প্রকৃতি সম্পর্কে গীবত করা হয়। কাউকে বিশ্বাসঘাতক, আমানত খেয়ানতকারী, অসংযমী, অতিরিক্ত আহার করে, হারাম খায়, অধিক নিদ্রা যায়, পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার রাখে না, আয় অনুযায়ী ব্যয় করে না ইত্যাদি তার ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে গীবত। কারো সম্পর্কে যদি বলা হয়, তার পোশাক বেসামাল, আস্তিন ঢিলা, আচল দীর্ঘ তা হলে তার বসন-ভূষণ সম্পর্কে গীবত করা হলো। গীবত কেবল মুখ দ্বারাই হয় না। চক্ষু, হাত এবং ইঙ্গিত দ্বারাও গীবত হয়ে থাকে।

সব ধরনের গীবতই হারাম। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, ‘আমি একদিন হযরতের নিকট ইশারায় প্রকাশ করেছিলাম যে, অমুক মহিলা বেটে। নবী করিম (সা) বললেন, হে আয়েশা তুমি গীবত করলে। ’ গীবত করা যেমন নিষেধ তেমনি গীবত শোনাও নিষেধ। যে গীবত শুনে, সেও গীবতের পাপের অংশীদার হয়ে যায়।

গীবত শোনাও যে পাপ তার সমর্থনে হাদীস হচ্ছে- ‘একদিন হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) একসাথে সফর করছিলেন, এমন সময় একজন অপরজনকে বললেন, ‘অমুক ব্যক্তি অতিরিক্ত নিদ্রা যায়। ’ তারপর তারা রুটি খাবার জন্য তরকারি চাইলে, নবী করিম (সা) বললেন, ‘তোমরা উভয়েই তো তরকারি খেয়েছো। ’ তারা বললেন, কি খেয়েছি আমরা জানি না। নবী করীম (সা) বললেন, ‘তোমরা নিজের ভাইয়ের মাংস খেয়েছো’। এ হাদীস থেকে জানা যায়, ‘অমুক ব্যক্তি অতিরিক্ত নিদ্রা যায়’ কথাটি একজন বলেছেন অন্যজন শুনেছেন।

অথচ নবী করীম (সা) উভয়কে গীবতের অপরাধী করলেন। নিশ্চিত না হয়ে কারো সম্পর্কে মন্দ কিছু ধারণা করাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের মন্দ ধারণাকে ইমাম গাযযালী আন্তরিক গীবত বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে বর্ণিত হয়েছে, ‘যদি তোমাদের নিকট কোনো ফাসিক কোনো খবর নিয়ে আসে, তা ভালমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধান করে নেবে। ’ নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ মুসলিমের রক্ত, ধনসম্পদ ও তার প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করাকে হারাম করেছেন।

’ গীবত বা পরনিন্দাকে নবী করীম (সা) অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং এর পরিণাম সম্পর্কে তার উম্মাহকে অবহিত করেছেন। হযরত আবু হুরাইয়া (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে তিনি বলেন, ‘ইসা ইবনে মালিকিনা আসলামী নবী করীম (সা)-এর নিকট এসে চতুর্থবারের মতো ব্যাভিচারের স্বীকারোক্তি দেয়ায়, তিনি তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যার আদেশ দেন। অতঃপর নবী করীম (সা) ও কতিপয় সাহাবা (রাঃ) তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, এই বিশ্বাসঘাতকটা কয়েকবারই নবী করীম (সা)-এর নিকট আসে এবং প্রত্যেকবারই রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ফিরে যেতে বলেন, অতঃপর যেভাবে কুকুর হত্যা করা হয়, তেমনি তাকে হত্যা করা হয়। নবী করীম (সা) এ কথা শুনে মৌনতা অবলম্বন করেন।

এরপর তারা যখন একটি মৃত গাধার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন এবং গাধাটি ফুলে যাওয়ায় এর পাগুলো উপরের দিকে উঠেছিলো, তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমরা দু’জনে এটা খাও। তারা বললেন, গাধার মৃত দেহ খেতে বলেছেন হে রাসূল! তিনি বললেন, কেন তোমাদের ভাইয়ের সম্মানহানীর মাধ্যমে ইতিপূর্বে তোমরা যা অর্জন করেছো, তা এর তুলনায় অধিক বেশি গর্হিত। মুহাম্মদ (সা)-এর প্রাণ যার হাতে সে পবিত্র সত্তার শপথ সে এখন জান্নাতের ঝর্ণাসমূহের মধ্যে একটি ঝর্ণাতে সাঁতার কাটছে। ’ (আল আদাবুল মুফরাদ)। গীবতের পরিণাম সম্পর্কে নবী করীম (সা) আরো বলেছেন, ‘আগুন যেমন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে, গীবতও তদ্রূপ মানুষের সওয়াবসমূহ ধ্বংস করে ফেলে।

’ গীবত পরিহার করে চলা কঠিন কোনো কাজ নয়। নবী করীম (সা) এটাকে কোনো কঠিন কাজ বলে মনে করেননি। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে ছিলাম। তিনি এমন দু’টি কবরের পাশে উপনীত হলেন যেগুলোর অধিবাসীদ্বয় আজাবে লিপ্ত ছিল। তিনি বললেন, এরা কোনো কঠিন বা গুরুতর ব্যাপারে শাস্তি পাচ্ছে না।

তাদের মধ্যে একজন লোকের গীবত করে বেড়াতো, আর অপরজন পেশাব হতে সতর্ক থাকতো না। অতঃপর তিনি একটি কিংবা দু’টি তাজা খেজুরে ডাল এনে তা ভেঙে কবরের উপর গেড়ে দিতে নির্দেশ দিয়ে বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এ ডাল দু’টি তাজা থাকবে কিংবা বললেন শুকিয়ে যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাস্তি হালকা করে দেয়া হবে। ’ ইমাম গাযযালী (রা) তার রচিত কিমিয়ায়ে সাআদাত নামক গ্রন্থে গীবত থেকে বাঁচার কিছু উপায় ও প্রতিষেধক বর্ণনা করেছেন। তিনি গীবতকে একটি রোগ বা অসুখ বলে আখ্যায়িত করে এ রোগের জ্ঞানমূলক ও অনুষ্ঠানমূলক দু’টি ওষুধের কথা বলেছেন- জ্ঞানমূলক ওষুধ হচ্ছে- প্রথমত পবিত্র কুরআন ও হাদীসে গীবতের ক্ষতি ও অনিষ্ট সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার মর্ম উপলব্ধি করে তার ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা। দ্বিতীয়ত নিজের দোষ অনুসন্ধান করা।

নিজের দোষ বের হওয়ার পর মনে করতে হবে, আমার ন্যায় অন্যেরও দোষ থাকা অসম্ভব নয়। নিজে যেহেতু দোষ থেকে বাঁচতে পারিনি, সেহেতু অন্যের দোষ দেখে এতো বিস্মিত হওয়ার কি আছে? অনুষ্ঠানমূলক ওষুধ হচ্ছে- মানুষ যেসব কারণে গীবত করে তার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মানুষ যেসব কারণে গীবত করে ইমাম গাযযালী (রা) এর সংখ্যা আটটি উল্লেখ করেছেনঃ (১) ক্রোধ, কেউ কারো প্রতি ক্রোধাম্বিত হলে সে তার গীবতে লিপ্ত হয়। সুতরাং ক্রোধ দমন করলেই এসব গীবত থেকে বাঁচা যায়। (২) কারো সন্তুষ্টি লাভের জন্য ঐ ব্যক্তির শত্রম্নদের গীবত করা হয়।

এ অবস্থায় মনে করতে হবে কোনো মানুষের সন্তুষ্টি লাভের জন্য আল্লাহতা’আলার অসন্তুষ্টি অর্জন করা নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। (৩) নিজের দোষ হতে অব্যাহতি লাভের জন্য অপরের দোষ উদঘাটন, নিজের দোষ ঢাকার জন্য অপরের দোষ প্রকাশ করে আল্লাহতা’আলার অসন্তুষ্টি অর্জন করা কখনো সঙ্গত হতে পারে না। এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। (৪) আত্মপ্রশংসা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য অন্যের নিন্দা করা।

অনেকে নিজেকে জ্ঞানী হিসাবে উপস্থাপনের জন্য বলে থাকে, অমুকে এ ব্যাপারে কিছুই বোঝে না। এসব উক্তিতে মূর্খ ও দুর্বলেরা তার ভক্ত হলেও জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা তার ভক্ত হয় না। মূর্খ ও দুর্বলদের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্য পরম পরাক্রমশালী আল্লাহতা’আলার বিরাগভাজন হওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। (৫) ঈর্ষা। নিজের যোগ্যতা দিয়ে যারা মান-সম্মান অর্জন করেছে, ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তির কাছে তা সহ্য হয় না।

কারণে-অকারণে সে ঐ সম্মানিত ব্যক্তির দোষ অম্বেষণ করতে থাকে এবং ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। এসব ব্যক্তি দুনিয়াতে ঈর্ষার অনলে দগ্ধ হয়, আর আখিরাতে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হয়। হিংসুকের হিংসায় সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান এতোটুকুও লাঘব হয় না। ক্ষতি হিংসুকেরই হয়। (৬) উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ।

অনেক সময় মানুষ মজা করা কিংবা অন্যকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাসে মত্ত হয়। উপহাসকারী যদি বুঝত যে তার এই উপহাস তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা হলে সে উপহাসকারী না হয়ে উপহাস্যাস্পদ হওয়ার প্রত্যাশা করতো, কেননা হাশরের দিন উপহাস্যাস্পদের পাপের বোঝা উপহাসকারীর কাঁধে চড়িয়ে দেয়া হবে। (৭) অসতর্কতা। অনেক সময় পরহেজগার ব্যক্তিরাও পাপের আলোচনা করতে গিয়ে পাপীর নামও উল্লেখ করে ফেলেন। লক্ষ্য করেন না যে, এটা গীবতের মধ্যে গণ্য হয়ে যায়।

সুতরাং পাপাচার নিয়ে আলোচনা করার সময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কখনো কারো নাম উচ্চারিত না হয় এবং কারো প্রতি ইঙ্গিত করা না হয়। (৮) মূর্খতা। মূর্খতা মানুষের জন্য বড় অভিশাপ। অনেকে জানেই না যে, কোন্ কথা গীবতের মধ্যে পড়ে, আর কোন্ কথা গীবতের মধ্যে পড়ে না কিংবা পাপ নিয়ে আলোচনার সময় পাপীর নাম নিলে গীবত হয়ে যায়। তবে অনিষ্টকর ব্যক্তির ক্ষতি হতে জনসাধারণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে অনিষ্টকারীর নাম নেয়া বৈধ।

এটা গীবতের মধ্যে পড়ে না। অনুরূপভাবে বিচারকের সামনে সাক্ষী হিসাবে পাপীর নাম নেয়া গীবত নয়। যারা প্রকাশ্যভাবে পাপ করে এবং পাপকে দোষের মনে করে না তাদের নাম নেয়া গীবত নয়। ************************** এ ম আ ব দু র র ব দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ জুলাই ২০০৮

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.