হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “গীবত কী তা কি তোমরা জান?” লোকেরা উত্তরে বলল, “আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। ” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “গীবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। ” জিজ্ঞাসা করা হলো, “আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তবে এটাও কি গীবত হবে?” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলেই সেটা হবে গীবত, আর তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে সেটা হবে বুহতান বা মিথ্যা অপবাদ। ” (মিশকাত ঃ পৃ-৪১২)
প্রিয় ভাইয়েরা আমার! গীবত মানুষের জন্য অত্যন- ক্ষতিকর একটি অভ্যাস। যে হাদীসটির উল্লেখ করা হলো তাতে নবীয়ে পাক (সাঃ) অত্যন- সংক্ষিপ্তভাবে অথচ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন গীবত কাকে বলে আর গীবত করা কতখানি নোংরা একটা ব্যাপার।
গীবত হচ্ছে একজন ব্যক্তির অনুপসি'তিতে তার দোষ অন্যের নিকট বলা- যদিও সকলেই জানে যে সেই ব্যক্তি সত্যিই দোষী। মোটকথা, কোনো দোষী ব্যক্তির প্রমাণিত দোষ সম্পর্কে বলাবলি করাই গীবত। একটা লোক দোষ করেছে যেটা সকলেই জানে তারপরও বিনা কারণে শুধুই কিছুটা মজা বা আনন্দ করার জন্য ঐ ব্যক্তির অসাক্ষাতে তার তার দোষ সম্পর্কে বলাবলি করাই গীবত। ভাইয়েরা! চিন-া করে দেখুন, নবী (সাঃ) বলেছেন যে, ঐ ব্যক্তি যদি প্রমাণিতভাবে দোষী হয়ে থাকে তবেই কেবল তার দোষ সম্পর্কে বলা হবে গীবত আর যদি তার দোষ ইতিমধ্যে প্রমাণিত না হয়ে থাকে অথবা সত্যিকার অর্থে সে যদি দোষী না হয়ে থাকে তবে তার দোষ সম্পর্কে বলাবলি করলে তা হবে “বুহতান” বা মিথ্যা অপবাদ যা গীবতের চাইতেও ঘৃণ্য অপরাধ এবং গীবতের চাইতেও কঠিন গুনাহের কাজ। বিবেক বিবেচনা সম্পন্ন একজন ভদ্রলোক সাধারণতঃ এরূপ মিথ্যা অপবাদ দেয়ার কাজটি করেন না।
কিন' গীবত আমাদের দ্বারা প্রায়ই হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার। গীবত থেকে বেঁচে থাকতে হলে প্রথমে আমাদেরকে গীবতের সংজ্ঞাটি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে। দেখুন! নবীয়ে পাক (সাঃ) কত সুন্দরভাবে, সংক্ষিপ্ত ভাষায়, স্পষ্ট বর্ণনায় গীবতের সংজ্ঞা দিয়েছেন অথচ আমাদের তা বুঝতে যেন কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ আমরা আসলে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে চাই না।
অথচ সৃষ্টজগতের সেরা প্রাণী হিসেবে আমাদের এ বোধটি থাকা উচিত যে, একজন মানুষ তার মানবিক দূর্বলতা থেকে এক মুহুর্তের প্ররোচনায় কোনো দোষ বা অপরাধ করে থাকতেই পারে এবং সেই অপরাধের জন্য সে ইতিমধ্যে শাস্তি পেয়ে থাকতে পারে অথবা অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে থাকতে পারে। তাছাড়া আমার নিজের মধ্যে যে এরকম মানবিক দূর্বলতা নেই তা নয়। হতে পারে আমি নিজেও ঐরকম দোষ করে থাকতে পারি। তাই আমি যখন অন্যের নিকট কোনো দোষী ব্যক্তির দোষ অকারণে বর্ণনা করতে থাকি বা শুনতে থাকি তখন আমার লজ্জা পাওয়া উচিত। গীবত বলা বা শোনার ব্যাপারে এই প্রকারের লজ্জাবোধ যার মধ্যে আছে কেবল তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত মুসলামন এবং সত্যিকারের ভদ্রলোক।
আর গীবত করা যাদের কাছে “ঘী-ভাত” এর মনে হয় তাদের পোষাক আশাক আর চেহারাসুরত যেমনই হোক না কেন তারা অসভ্য ও নির্লজ্জ।
বিসমিল্লহির রাহমনির রাহীম।
“আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের অসাক্ষাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? প্রকৃতপক্ষে তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।
আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী পরম দয়ালু। ” (সুরা হুজুরাত- ৪৯ : ১২)
গীবত কতখানি ন্যাক্কারজনক ব্যাপার তা বুঝতে আমরা এই আয়াতে কারীমার দিকে মনোযোগ দেই। দেখুন ! আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বলছেন, গীবত করা হচ্ছে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য। এখানে তুলনাটা কত পরিস্কার! প্রথমতঃ আদম সন-ান ভাই-ভাই। রক্তের সম্পর্কে না হোক, স্বভাবের সম্পর্কে ভাই-ভাই।
ঐ দোষী ব্যক্তি যে রক্ত-মাংসের তাড়ানায় দোষ করেছে ঐ রক্ত-মাংসের তৈরী আমি নিজেও। তাই সেই ব্যক্তি যে দূর্বল মুহুর্তে, যে পরিসি'তিতে পড়ে দোষ বা অপরাধ ঘটিয়েছে ঐরকম দূর্বল মুহুর্ত আমার জীবনে আসলে আমিও যে ঐ প্রকার অপরাধ করতাম না তার গ্যারান্টি কে দেবে? তাই আচরণগত দিক থেকে আদম সন-ানরা একই মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাই তারা পরস্পর ভাই-ভাই। একজন ব্যক্তি যখন অন্য একজন অনুপসি'ত দোষী ভাইয়ের নামে গীবত করে তখন সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খায় বটে। এখানে “মৃত” বলতে “অনুপসি'ত” বুঝাচ্ছে। একজন মৃত ব্যাক্তির শরীর থেকে গোশত খুলে নিলেও মৃত ব্যক্তি যেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না তেমনি কোনো অনুপসি'ত ব্যক্তির নামে হাজারটা সত্যমিথ্যা দোষের কথা বর্ণনা করে গেলেও অনুপসি'ত থাকার কারণে সে ঐসব কথার কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না।
অথচ ঐ একই কথা তার সাক্ষাতে বলা হলে সে নিশ্চয়ই আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু না কিছু বলতে চাইত। এমনকি আমরা জানি, আদলতে দোষী ব্যক্তির বিচার চলকালেও কেবলমাত্র আসামীর উপসি'তিতেই মামলার শুনানী বা আসামীর দোষ পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। যদি আসামী উপসি'ত না থাকে তবে পত্রিকার মাধ্যমে তাকে উপসি'ত হওয়ার নোটিশ দেয়া হয় এবং তারপরই কেবল দোষী ব্যক্তির বিচার শুরু হয়। এভাবে দেখা যায় আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিধান মানুষের আইন-আদালতে প্রয়োগ করা হয়। কারণ এটাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান।
তারপরও মানুষের তৈরী বিধানের সাথে আল্লাহর দেয়া বিধানের কোনো তুলনাই চলে না। আল্লাহর বিধান মানুষের বিধানের চাইতেও সর্বদিক দিয়ে উত্তম, কল্যাণকর আর মানবতাবাদী। আর তাই তো আল্লাহ তায়ালা গীবত করার অভ্যাসকে নিরুৎসাহিত করেছেন। শুধু আইন-আদালতে নয়, এমনকি দৈনন্দিন সামাজিক আচার আচরণেও অনুপসি'ত ব্যক্তির দোষচর্চা বা গীবত করাকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন তিনি। কারণ এরই মধ্যে রয়েছে উত্তম ফলাফল, চিরকালীন কল্যাণ আর মানবতার বিজয়।
অনুপসি'ত আসামীর নামে শুনানী না করাটা সার্বজনীন নিয়ম, সকল দেশের আইন-আদালতের নিয়ম। আর সর্বোত্তম আইন হচ্ছে আল্লাহর আইন। তাই আল্লাহ তায়ালা অনুপসি'ত ব্যক্তির দোষচর্চাকে নিষেধ করেছেন কেবল আইন-আদালতের পরিসরেই নয়, এমনকি সামাজিক মেলামেশার পরিসরেও যাতে করে মানুষ অকল্যাণ থেকে বাঁচতে পারে ও মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ লাভ হয়।
আল-কুরআনে ও হাদীসে গীবত বলা ও শোনাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে কারণ সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ থাকে না। হতে পারে সে দোষী কিন' তারও নিজের পক্ষে কিছু বলার থেকে থাকতে পারে।
তাই তার অনুপসি'তিতে তার দোষ চর্চা করা আর মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে গোশত খুলে নেয়া একইরুপ ব্যাপার। দেখুন! আল্লাহ তায়ালার দেয়া উপমাটি কত স্পষ্ট আর অর্থময়। এখানেই শেষ নয়। আল্লাহ তায়ালা আর বলেছেন, গীবত করার অর্থ কেবল মৃত ভাইয়ের শরীরের গোশত খুলে নেয়ার ব্যাপার নয়, বরং মৃত ভাইয়ের গোশত খুলে নিয়ে তা খাওয়ার মত ঘৃণ্য ব্যাপার। এ তুলনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, একজন মুমিন মুসলমান ও একজন ভদ্রলোক হিসেবে তোমাদের পক্ষে গীবত বলা বা শোনার মত অভিরুচি থাকাটাই উচিত নয়।
মানুষ হয়ে নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মত রুচি কেবল অসভ্যদেরই থাকে। শোনা যায়, জংলী মানুষেরা মানুষের গোশত খেয়ে থাকে। তাই গীবত করাটা হচ্ছে অসভ্য, বর্বর, জংলী একটা অভ্যাস। কাজেই সাবধান। তোমরা যারা সভ্যতার দাবীদার তাদের পক্ষে গীবত করা বা শোনার অভ্যাস বড়ই অশোভন।
মোটের উপর গীবত হলো সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এক ফেতনা। অতএব, প্রিয় ভাইয়েরা আমার! আমরা সকলেই গীবত বলা থেকে তো বটেই এমনকি গীবত শোনা থেকেও বিরত থাকব ইনশাআল্লাহ। কোনো গীবতকারীকে আমরা প্রশ্রয় দেবনা। একথা নিশ্চিত জেনে রাখবেন, যেই ব্যক্তি আপনার সামনে অন্যের দোষ সম্পর্কে বলে থাকে কোনো সন্দেহ নেই যে সেই ব্যক্তি আপনার অনুপসি'তিতে অন্যের সামনে আপনার দোষও বলে থাকে। অতএব সাবধান।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে গীবত বলা ও শোনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন। আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।