শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ!
মৃণালকান্তি দাস
‘অত্র বাড়ির মালিক টারজান। টারজান পশু ও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় দক্ষ। টারজানের জিনিসপত্রের কোনো অনিষ্ট করবেন না। টারজানের নজর পলকহীন। ’ জংলি আফ্রিকার উপকূলে পরিত্যক্ত এক কেবিনের সামনে এই নোটিস দেখতে পান অধ্যাপক আর্কিমিডিস পোর্টার, পোর্টার-তনয়া জেন আর ওঁদের সফরসঙ্গীরা।
তাদের জাহাজ তলিয়ে গেছে জলের তলায়। কোনো মতে জীবন বাঁচিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলের একপ্রান্তে। আর সেখানেই খোঁজ মেলে মানব-গরিলার অস্তিত্ব। গল্প বুনেছিলেন টারজান কাহিনীর লেখক এডগার রাইস বারোস।
টারজান এই জাহাজডুবি শ্বেতাঙ্গদের জঙ্গলের ত্রাস থেকে বাঁচায়, বারবার।
ইংরেজ অভিজাত বংশের উইলিয়াম সিসিল ক্লেটনকে তো একবার সিংহের কব্জা থেকে ছিনিয়ে গাছগাছালির ফাঁকফোকরে নিজের কেবিনের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসে টারজানই। যে রকম স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে প্রকাশ্য দিবালোকে লন্ডনের রাজপথে হাঁটা যায়, জংলি রাতের কালিমাখা অন্ধকারে এই মানব-গরিলা ঠিক সেই রকমই স্বাচ্ছন্দ্য, সেই রকমই দৃপ্ত পা চালনা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ারই কথা। জঙ্গলের কিছুতেই ভয় নেই টারজানের। জঙ্গল যেন তার খাসতালুক। আতঙ্কগ্রস্ত এই জঙ্গলকে জয় করা মানুষেরই বিস্মৃত অতীত কিংবা জংলি ঔরসের ওপর শ্বেতাঙ্গ বংশগৌরবের প্রাধান্য, মার্কিন লেখক এডগার রাইস বারোস তাঁর লেখায় বারবার সেই কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
মার্কিন ঔপন্যাসিক চরম ডানপন্থী এডগার বারোস টারজানমালার একনম্বর গ্রন্থ লেখা শুরু করেন ১৯১১-এর ডিসেম্বর মাসে। লেখা শেষ হয় পরের বছর মে মাসে। লেখার উদ্দেশ্য ছিলো ‘যাকে বলে কল্পনা-প্রতিভা সেই মানস পরীক্ষাগারে কৌতূহলী নিরীক্ষা চালানো : জনৈক ইংরেজ লর্ডসন্তানের, নবজাত শিশুর নৈতিক, মানসিক ও দৈহিক বিকাশে বংশগতি, পরিবেশ, প্রতিপালনের তুলনামূলক মূল্য তলিয়ে দেখা। ’ কুড়িটিরও বেশি বই লেখা হয় এই গ্রন্থমালায়। সর্বশেষ গ্রন্থের রচনা ১৯৪৪সালে।
টার্জান কাহিনী উপনিবেশবাদের পুরাণ।
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের জমানায় শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশের সম্পর্কই এর আসল রসদ। এই গ্রন্থমালায় পাওয়া যায় আফ্রিকায় উপনিবেশ বিস্তারের আবেদনময় ধারাবর্ণনা। এই গ্রন্থমালার এক নম্বর গল্পটি লেখার সময়ও আফ্রিকার বিস্তর এলাকায় তখনো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পায়ের চিহ্ন পড়েনি। কঙ্গোয় বেলজিয়ামের সীমাহীন নির্যাতনের বিরুদ্ধে দুনিয়াজোড়া প্রতিবাদের ঘটনা বেশি পুরনো হয়নি।
কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে বেলজিয়ামের নোংরা রাজনীতির কথাও বারোস তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন। আবার গ্রন্থমালার শেষ গল্পের সময় যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, জার্মান ও জাপানিদের আক্রমণে উপনিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলি কোণঠাসা, তখন সুমাত্রায় জাপানি সেনার বিরুদ্ধে টারজানকে যুদ্ধে নামানো হয়েছে।
গল্পের শুরু জনৈক ব্রিটিশ অফিসার লর্ড গ্রেস্টোকের সূত্র ধরে। পশ্চিম আফ্রিকার কোন এক ব্রিটিশ উপনিবেশে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর জুলুমের অভিযোগ তদন্ত করতে তিনি আফ্রিকা সফর করছিলেন। সমুদ্রেই তাঁর জাহাজে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
তরুণী ভার্যাসহ গ্রেস্টোক আফ্রিকার উপকূলে জলবন্দী হয়ে পড়েন। মা বাবা দুজনেই প্রাণ হারালে ‘কালা’ নামের এক গরিলা মায়ের আদরে বড় হতে থাকে ওঁদের অনাথ শিশু। শিশুর টার্জান নাম গরিলাদেরই দেওয়া, যার অর্থ ‘সাদা চামড়া’। শিশু বড় হয় গরিলাদেরই আপন, কেরচাক গোত্রের শাবক হিসেবে। তাতে আর জঙ্গলের-জানোয়ারে কোন ভেদ নাই।
তবু বারোস তাঁর গল্পে জংলি লালনের ছাপ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকটা আদিম অথচ আচার-আচরণে ইংরেজ ভদ্রলোকের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করায় টার্জানকে। পরিবেশকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে টার্জান। কারণ, বারোসের মতে টার্জানের শিরায় বহমান রক্তে রয়েছে পূর্বপুরুষের ইংরেজ আভিজাত্যের ঐতিহ্য। আর তাই কৈশোরেই সে জঙ্গল এবং গরিলাদের অধিপতি হয়ে ওঠে।
প্রয়াত বাবার পরিত্যক্ত কেবিন খুঁজে পাবার পর ওখানে পড়ে থাকা বইয়ের পাতা উলটে পালটে নিজে নিজেই ইংরেজী পড়তে লিখতে শেখে টারজান।
অথচ তখনও গরিলাদের ভাষাই ওর মুখের বুলি। মনে হতে পারে এ এক কল্পকাহিনী। ১৯৮৬সালে, লন্ডনে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক রেস অ্যান্ড ক্লাস পত্রিকার ১৮বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় অধ্যাপক জন নিউসিঙ্গার লিখছেন, ‘অজ্ঞানের অন্ধকার রাতে পথ হাতড়ে জ্ঞানের আলোকবর্তিকার দিকে এগোনো আদিম মানবের রূপক। আসলে বারোস পাঠককে বারবার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, জংলি পরিবেশে বংশগতির বিজয়নিশান। তাই যখন টারজান গরিলাদের থেকে আলাদা হয়নি, যখন সে আদিম উদ্দাম, মাতাল নৃত্যে মশগুল, সেই সময়ই তার মজ্জার ভেতরের খাঁটি ইংরেজিয়ানা মাথাচাড়া দিতে শুরু করে।
বংশগতি ও পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ আর নিজের জাতির অধঃপতনের ভয়-পীড়া শুধু টারজান কাহিনীতেই নয়, বারোসের সকল লেখাতেই হাজির। ’
২
কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে টারজানের প্রথম দেখা কাহিনীর সিকিভাগ এগোনোর পর। নৃশংস বেলজিয়াম বাহিনীর শোষণের হাত থেকে বাঁচতে কোন একটি গোষ্ঠী টারজানের খাসমহালে ঠাঁই নিয়েছিলো। বারোস এদের মাপলেন টারজানের মাপে, কাঁটায় কাঁটায় :
‘জনাপঞ্চাশ কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা সামনে এগোচ্ছে, হাতে তাদের সরু সরু কাঠের বল্লম। কাঁধে লম্বা ধনুক, বিষমাখা তীর।
ডিম্বাকার ঢাল পিঠে, নাকে বিশাল বিশাল নোলক। মাথা অল্প আগুনে অনেকক্ষণ পোড়ানো, দেখেই মনে হয় নিরেট, শক্ত। মাথার দড়িপাকা পশম ফুঁড়ে বেরুচ্ছে রঙ বেরঙের পালকের গোছা। কপাল জুড়ে তিনটে করে সমান্তরাল রঙিন রেখা আর বুকের চারপাশে তিন তিনটা কেন্দ্রমুখী বৃত্তের উল্কি। দাঁতের পাটি হলদে, থরে থরে সাজানো, একেবারে আগায় সূঁচালো।
ওদের চেহারা এমনিতেই নিচু, পাশব ও জঘন্য। সামনে ঝুলে থাকা বড় বড় ঠোঁট সেই চেহারাকে আরো জঘন্য করে তুলেছে। ’ ওদের হাতে পড়ার দুর্ভাগ্য যাদের হয়, সেই বন্দীদের খেয়ে ফেলার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি হিসাবে আগাপাস্তলা পেটানো এদের রীতি। টারজানের মতে, এদের এই ধরনের বন্যতা বন্য পশুর বন্যতাকেও হার মানায়। এইসব মানবপশুর সাক্ষাতে টারজানকে দেখানো হয়েছে ‘মহাপ্রাণ আদিম মানুষ’-এর আদলে, শিকারি ও যোদ্ধার ভূমিকায়।
তাঁর দুখানি চওড়া কাঁধ, অভিজাত ঠাট আর সুশ্রী, স্বচ্ছ চোখে জীবন ও বুদ্ধির আগুন নিয়ে সে সহজেই যেকোন যুদ্ধবাজ জনগোষ্ঠীর ‘কুলদেবতা’ গণ্য হতে পারে। লিখছেন বারোস।
কাহিনীতে টার্জান দেবদ্বিজের মত পরিবেশের ঊর্ধে উঠেছে কখনও। অথচ এই একই পরিবেশের কাছে হার মেনেছে কৃষ্ণাঙ্গরা, আত্মসমর্পণ করেছে টারজানের কাছেই। টারজানের ভয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অন্তরাত্মাসুদ্ধ যেন কেঁপে ওঠে।
শিকারসন্ধানী এক কৃষ্ণাঙ্গ একদিন টারজানের গরিলা মা ‘কালা’কে হত্যা করে। প্রতিশোধ নিতে জঙ্গলে তার পিছু নেয় টারজান। প্রথমে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে, তারপর কলিজা বরাবর ছোরা ঢুকিয়ে হত্যাকারী কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করে। তীব্র ক্রোধে মৃত কৃষ্ণাঙ্গের রক্ত খেতে উদ্যত টারজান কি যেন ভেবে থমকে দাঁড়ায় :
বারোস লিখছেন, ‘এক ঝলকে বিবমিষা তাকে ছেয়ে ফেলে...। এই কালো আদমটির রক্ত খেতে মানা, টারজানের জানার মধ্যে পুঁজি এটুকুই।
বংশগতির সহজাত প্রবৃত্তি এভাবেই অদীক্ষিত মনের জায়গা নেয়। ওর অজানা এক জগৎজোড়া নীতি লঙ্ঘনের দায় থেকে তাকে রক্ষা করে। গ্রেস্টোক বংশের চোদ্দপুরুষের রক্তই টার্জানকে নরমাংস ভক্ষণের হাত থেকে বাঁচায়, রক্ষা করে কাফ্রি অন্ধকারের কাছে হার মানা থেকে, তার অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে। ’
জেন পোর্টারের কাজের মেয়ে এসমারেন্দা। বারোস তাঁর কাহিনীতে ওকে খাড়া করেছেন গথবাঁধা কৌতুক চরিত্র ‘কালি’ রূপে।
শ্বেতাঙ্গ সভ্যতার আশীর্বাদ কৃষ্ণাঙ্গদের খানিকটা যে আলোর পথ দেখিয়েছে তা তুলে ধরতেই এসমারেন্দার আবির্ভাব। দুনিয়ার তাবৎ বিষয়েই মনিবভরসা এই পরিচারিকা। টারজানের চোখে এসমারেন্দা ‘একজাতীয় গৃহপালিত পশু’, পোষা কৃষ্ণাঙ্গ ছাড়া আর কি!
১৯১৬ ও ১৯১৭সালে টারজানের জঙ্গল জীবনের গল্প সংকলনে বারোস ফিরে যান টার্জানের জংলি শৈশবে। বন্যদশা থেকে অভ্যূদয় কাহিনীতে বারোস আরো বিশদ, আরো খুঁটিনাটি। টারজান মনুষ্যসন্তান এবং ওর মনুষ্যস্বভাব কৃষ্ণাঙ্গ মনুষ্যস্বভাবের মতো নয়, অন্যরকম।
এই কথাটুকু মালুম করানোর প্রধান উপায় টারজানের পিশাচসুলভ কৃষ্ণাঙ্গ পীড়ন! এই বইতে লেখক আরো খোলামেলা।
বারোসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বর্ণবাদের অভিযোগ খণ্ডনের বা লাঘবের চেষ্টা করে রিচার্ড লুপফ সাফাই গেয়েছেন, ‘তাঁর লেখায় বর্ণবাদী ভাষার দেখা সহজেই মেলে। এ কথা অসত্য নয়। আবার একই সাথে বর্ণবাদবিরোধী ভাষার দেখাও সমানেই মেলে। ’ পালটা যুক্তিতে অধ্যাপক জন নিউসিঙ্গার লিখছেন, এ দাবিতে কিছুটা সত্য আছে, তবে কোন্ ভাষার প্রাধান্য একচেটিয়া তাও সন্দেহাতীত স্পষ্ট।
বারোসের জমানায় গথবাঁধা চরিত্রচিত্রণই ছিল যুগের দাবি। শেষ পর্যন্ত এই যুক্তির আশ্রয় নিতে বাধ্য হন তিনি। মামলা নিছক বর্ণবাদী বাঁধাবুলির নয়, টারজানমালার অনেক গল্পের বহির্বয়ান ও উপর্যুপরি হত্যামূলক পুলকপ্রবাহের তলে তলে বহমান প্রচণ্ড, জবরদস্ত বর্ণবাদী ভাষারও।
টারজান গল্পগুচ্ছে টার্জান যাদের নেতা, সেই গোষ্ঠীর নাম ওয়াজিরি। এমন কিছু তারিফযোগ্য কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রও তৈরি করেছেন বারোস।
তাও এমনভাবে করা, যাতে বর্ণবাদী মূল ভাবধারাটি আরো পোক্ত হয়। ওয়াজিরিদের সঙ্গে টারজানের প্রথম সাক্ষাতের সময় তাদের দেহগঠনের ভারসাম্যে এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যের স্বাভাবিকতায় সে মুগ্ধ হয়। গড়পড়তা বন্যদের মত থ্যাবড়া নাক আর ভারী ঠোঁটের কোন আদলই নেই এদের। এমনকি ওদের মেয়েরাও আকর্ষণীয়।
টারজানের অন্যতম দুশমন এস্তেবান মিরান্দা।
তার চোখে ‘বিবর্তনের সিঁড়িতে গরিলাদের চাইতে পশ্চিম পাড়ের কৃষ্ণাঙ্গরা যতখানি উপরে’, ওয়াজিরি গোষ্ঠী ‘কৃষ্ণাঙ্গদের চাইতে ততখানি উপরে’। ওয়াজিরিরা বুদ্ধিদীপ্ত, বিশ্বাসযোগ্য এবং সাহসী। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এ কথাও স্পষ্ট, তবুও ওরা শ্বেতাঙ্গের অধীন। আসলে বারোসের কাছে তারা যেটুকু মর্যাদা পেয়েছে তার কারণ, ওরা স্বেচ্ছায় শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং শ্বেতাঙ্গদের শাসন মেনে নিয়েছে। টার্জানকে সম্রাট কিংবা দেবতা মান্য করা ওদের অভ্যাস।
টারজান গল্পগুচ্ছে বারোস কালো মানুষের ছবি যেভাবে এঁকেছেন তা থেকে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ সম্পর্কে যতোটা না জানা যায় তার ঢের বেশি জানা যায় খোদ বারোস সম্পর্কে। এবং যে সংস্কৃতির মধ্যে তিনি বসবাস করেন সেই সংস্কৃতি সম্পর্কে। অন্য অচেনা জাতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানানোর মত কোনো রসদই নেই উপনিবেশবাদী সাহিত্যের।
৩
বহুদিন আগে আফ্রিকার অন্ধকার পেটে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন সভ্যতাও ফিরে এসেছে বারোসের লেখায়। এর মধ্যে আছে বিলুপ্ত আটলান্টিস, ফেরায়ুনী মিশর, প্রাচীন রোম, প্রথম রিচার্ডের ক্রুসেড, ষোল শতকের পর্তুগীজ সাম্রাজ্য এবং আরো অনেক রোমহর্ষক সভ্যতার উপনিবেশ।
এসব গল্পের কোনো কোনোটিতে তিনি সফল। কোনো কোনো সভ্যতাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। কোনোটি আবার বেশ আবেগ আর চিন্তার জোরে লেখা। এর মধ্যে সেরা আটলান্টিসের শেষ উপনিবেশ, শোচনীয় ধ্বংসের শিকার ‘ওপার’ শহরের ছবি। টার্জানকে বারবার ঐ শহরে নিয়ে গেছেন বারোস।
কাহিনীতে এই শহরে টারজানকে আক্রান্ত হতে হয়েছে। জনাবিশেক গরিলাকৃতি শ্বেতাঙ্গ টারজানকে বন্দী করে সূর্যদেবের কাছে বলি দিতে উদ্যত হয়। অভিজাত পুরোহিত, সুন্দরী ‘লা’র হস্তক্ষেপেই তাঁর প্রাণ বাঁচে। এই লা-ই তাঁর কাছে পশু-মানুষের উদ্ভব আখ্যান ব্যাখ্যা করে। লা’র মতে, ‘গরিলাকৃতি শেতাঙ্গরা প্রাচীন আটলান্টিস জাতিরই পতিত বংশধর, পুরুষের পর পুরুষ ধরে বন্যদশায় গিয়ে কদাকার বন্যপশুর চেহারা পেয়েছে।
বহুযুগ আগে যে পশুর মধ্যে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্ভাব্য উৎপত্তি খোদ সেই পশুর পর্যায়ে গোটা জাতিটার ফিরে যাওয়া নেহাত সময়ের ব্যাপার। তবে এই পতনের গ্রাস থেকে রেহাই পেরেছে শুধু মেয়েরাই। এখনো সুন্দর ওরা, এখনো বুদ্ধিদীপ্ত। ওদের পতনও তবে একরকম নিশ্চিত। ’ বারোস বর্ণিত বিলুপ্ত সভ্যতার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য কাগি সভ্যতা।
৪
টারজান উপন্যাসের সমালোচনা করতে গিয়ে জন নিউসিঙ্গার তাঁর ‘লর্ড গ্রেস্টোক অ্যান্ড ডার্কেস্ট আফ্রিকা: দি পলিটিক্স অব টারজান স্টোরিজ’ প্রবন্ধে লিখছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় টারজান নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বাগ্রে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান চ্যালেঞ্জের সামনে, তারপর দুই যুদ্ধের মাঝখানে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আর সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানীদের মোকাবিলায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিকদের মতো নিজ মনগড়া ভাষ্য প্রচারের বাহনস্বরূপ টারজান কাহিনী গড়ার লোভ দমন করতে পারেননি বারোস। ভয়-পীড়াজনিত ঘৃণার সঘন প্রচার আর পশ্চিমী সভ্যতার সামনে উদ্ভূত বিপদবিরোধী চেতাবনী তাঁর এই কেচ্ছাকাহিনী। ১৯৪৯সালের ডিসেম্বর মাসে বারোসের মৃত্যু না ঘটলে আমাদের হয়তো দেখতে হতো টারজান কেমন জড়িয়ে পড়েছে ঠাণ্ডাযুদ্ধে, কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে লড়ছে কেনিয়ার অরণ্যে, ভিয়েতনামের ধানখেতে সংগ্রামী মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে কিংবা সান্দিনিস্তার মোকাবিলায় লড়ছে নিকারাগুয়ার বনে ও জঙ্গলে।
কাহিনীতে টারজান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল তখনই, যখন জার্মান সেনাবাহিনীর এক শাখা পূর্ব আফ্রিকায় ওর খামারবাড়ি ধ্বংস করে। খুন করে জেনকে। ১৯১৪সালের শরৎকাল। জার্মান সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল আলো যেভাবে বেলজিয়ামের ওপর পড়েছে... তেমনই ঘন অন্ধকার আফ্রিকাতেও সেই আলোর প্রতিফলন শুরু হয়েছে। অতএব, দুনিয়ার যত বস্তু জার্মান সবটার ওপর টারজানের ঘৃণা।
সেই ঘৃণার ইশ্তেহার লেখায় দক্ষতা দেখিয়েছেন বারোস :
টারজানের বিশাল দুঃখের যন্ত্রণা আরেক আবেগের জন্ম দেয়। সেই আবেগের নাম ঘৃণা! জার্মানি ও জার্মান, জীবিত কি মৃত, সব কিছুকেই ঘৃণা। সে আবেগ তাঁর মনে অনেকখানি স্বস্তি ও শান্তি নিয়ে এলো। কারণ এতে তার মন আরো উন্নত হলো।
পূর্ব আফ্রিকায় জার্মান সেনাদের উত্যক্ত করতে শুরু করে সে।
একবার একটি জার্মান সেনাকে ছুঁড়ে দেয় এক অনাহারী সিংহের সামনে। তাতে অবশ্য প্রতিশোধ পূর্ণ হয় না। লক্ষ লক্ষ জার্মান সেনা যে এখনো প্রাণে বেঁচে রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর জার্মান নৃশংসতার কথা ফলাও করে বলেছেন বারোস। এই নৃশংসতার বীজ, তাঁর মতে, জার্মান সমাজেই গেঁথে রয়েছে।
অবশ্য একবার টারজান যখন দেখে একদল কৃষ্ণাঙ্গ একটা শ্বেতাঙ্গ মেয়ে বন্দী করেছে, তখন কৃষ্ণাঙ্গ খুনের নেশা ফের চেপে বসে। কৃষ্ণাঙ্গ খুনে বিশেষ আনন্দ, খুন-খেলায় দিন দিন টারজান হয়ে উঠেছে বড় পারদর্শী। দলের সর্বশেষ কালো মানুষটিকেও সে হত্যা করে, তারপর পথের ওপর দেহহীন মাথা এক গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়।
টারজান জানতে পারে কৃষ্ণাঙ্গদের হাতে বন্দী শ্বেতাঙ্গ মেয়েটি জাতে জার্মান। টারজানের দোটানাটা মনও বেশ মজার।
যত ঘৃণার পাত্রীই হোক সে জার্মান নারী। টার্জান বুঝতে পারে ওকে ‘নিচু কৃষ্ণাঙ্গ জাতের হাতে বন্দী’ রেখে যেতে তো সে পারে না। অতএব, উদ্ধার অভিযান ছাড়া পথ নেই।
জার্মানির শেষ পরাজয়ের পর মাথাচাড়া দেয় নতুন আরেক বিপদ। আফ্রিকায় যুদ্ধ ও বিপ্লব ঘটাবার মতলবে কমিউনিস্টদের অভিযান শুরু হয়।
সেই অভিযান আটকাতেই হবে। বারোসের কাহিনীতে এবার টারজানই কমিউনিস্টদের পথের বড় কাঁটা। গল্প বোনেন বারোস। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে টার্গেট করে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানো শুরু করেন লেখক। একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা নয় বরং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে মদত যোগাতেই সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াকে নিয়ে নোংরা কাহিনী রচেছেন বারোস।
যতটা সম্ভব কালিমালিপ্ত করার চেষ্টায় খামতি রাখেননি। কাহিনীতে দেখা যায়, ওপার শহরের সোনাদানা লুটের বাসনায় অভিযান পরিকল্পনা করে কমিউনিস্টরা। এই লুটের সোনা দিয়েই ওরা অভিযানের অস্ত্র ও অর্থ যোগান দেবে। অভিযানের উদ্দেশ্য নাকি ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে যুদ্ধ উসকে দেওয়া। ইউরোপীয় শক্তিজোট একবার পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক।
তখন উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি বিদেশি শাসনের উপড়ে ফেলে দেবে আর গোটা তল্লাটে স্বশাসিত সোভিয়েত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভ্যুত্থান ঘটাবে। কমিউনিস্ট নেতা পিটার জুয়েরি অবশ্য কমিউনিস্ট আদর্শ এক ফোঁটাও বিশ্বাস করে না। ওর আসল মতলব ওপারের সোনাদানা হাত করা, আফ্রিকার সম্রাট হওয়া, ক্ষমতা দখল করা। এখানে টার্জানই আফ্রিকার পরিত্রাতা!
বারোসের কমিউনিস্ট বিরোধী কাহিনী এমনই সফল যে এই কেচ্ছার আরেক খণ্ড ছাপতে বেশিদিন দেরি কার হয়নি। এই খণ্ডে দেখা যায় লিয়ন স্টাবুচ নামে এক গোয়েন্দাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন খোদ স্তালিন।
আফ্রিকা ঘুরে খুঁজে বার করে টারজান হত্যাই নাকি ওর চাকরি। কাহিনীতে বিপদ প্রসঙ্গে স্টাবুচকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন স্তালিন :
‘তোমার পথের কাঁটার ক্ষমতা কখনো ছোট করে দেখো না। তোমার কথা মতো হতে পারে, কিন্তু মনে রেখো এক সুসংগঠিত লাল অভিযান সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে সে-ই। তা না ঘটলে সে অভিযান আবিসিনিয়ায় আর মিসরে অনেক উদ্দেশ্য পূরণে সমর্থ হত...। আমরা আর এক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি, কমরেড, এ কথা বলতে বাধা নাই।
কিন্তু পথের কাঁটাটি সরানো হয়েছে, তোমার কাছে এই মর্মে রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ থাকবে। ’
কমিউনিস্টদের নিকৃষ্টতম অপরাধীরূপে আঁকা হলো আরো একবার। স্টাবুচ জোট বাঁধে ডোমিনিক কাপিয়েত্রো নামের জনৈক ইতালি কমিউনিস্টের সঙ্গে। গল্পের গরু গাছে ওঠে! তাই এই ডোমিনিক আবার একই সঙ্গে আবিসিনিয়ায় তৎপর একদল দাস-ব্যবসায়ীর সর্দার। ওদের হাতে বন্দী একটি শ্বেতাঙ্গ মহিলার দখল নিয়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয়।
কাপিয়েত্রো প্রস্তাব করে ফয়সালা হোক তাসে। বাজিতে কাপ্রিয়েত্রোর জিত হয়। কিন্তু স্টাবুচ তাকে খুন করে।
এমন কাপুরুষোচিত অপরাধীর কাছে টারজান হেরে যাবে! হতেই পারে না। স্টাবুচ শেষমেষ কোণঠাসা হয়।
আর টারজান তীরের ওপর তীর ছুঁড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় স্টাবুচের বুক। ইচ্ছা করেই যন্ত্রণা এমন দীর্ঘ করা। ‘আফ্রিকায় বিপ্লব ঘটানোর স্তালিনি চিন্তাভাবনার আপাতত এখানেই খতম’, এই ভাষাতেই লিখেছেন শ্বেতাঙ্গ মার্কিনী সরকারী সাংবাদিক এডগার বারোস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।