জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের বিপর্যয় নিয়ে সারা বিশ্ব যখন শংকিত, বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম সহ সকল ফোরামে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে তখন একদল হ্যাকারের কল্যানে যে তথ্য আমরা পেলাম তাতে যেমন আশান্বিত হচ্ছি তেমনই শংকিত ও হচ্ছি। পাশাপাশি দ্বিধায় ভূগছি আসল সত্যি কোনটা।
দৈনিক ইত্তেফাকের এই সংবাদটিতে চোখ আটকে গেল।
বাংলাদেশ ডুবছে না!
গত ৭ ডিসেম্বর ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রানত্ম আনত্মর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আনত্মঃপ্রশাসনিক প্যানেলের (আইপিসিসি) সভাপতি রাজেন্দ্র পাচুরি আবেগসঞ্চারি এই আহ্বান জানিয়েছিলেন বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি৷ এমন বিশাল সম্মেলনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গেলে দেখানোর দরকার ছিল ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে পারে কয়েকটি দেশ ও অঞ্চল৷ বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি৷ বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম 'ভিকটিম' হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বাংলাদেশকে৷ সাথে উচ্চারিত হয় শত কোটি ডলারের ৰতিপূরণের প্রশ্ন৷ অসহায়কে সহায়তা দিতে আগ্রহী হলে 'ভিকটিম' চাই৷ অস্বসত্মিকর সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশকে বানানো হয়েছিল সেই কাল্পনিক ভিকটিম৷ বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের মানুষ বিশ্বাস করেছিল যে, সত্যিই বাংলাদেশের বিরাট অংশ অদূর ভবিষ্যতে পানির নিচে ডুব মারছে৷
কিসের ভিত্তিতে কর্তাদের কপালে চিনত্মার রেখা ভেসে উঠেছিল যে, বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ বেশ কিছু দ্বীপরাষ্ট্র উষ্ণায়নের কারণে পানিতে ডুব-সাঁতার কাটবে? সেটি হলো আইপিসিসির (শব্দটির সঙ্গে আগেই পরিচয় করানো হয়েছে) একটি গবেষণা রিপোর্ট, যাতে বলা হয়েছিল, ২০৩৫ সালের মধ্যে হিমালয়ের সব হিমবাহ গলে পানি হয়ে যাবে যদি বর্তমান হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়৷ কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাঁড়ির খবর বের করে এনেছে একদল হ্যাকার৷ তারা যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার জলবায়ু গবেষণা ইউনিটের (সিআরইউ) রাশিয়া ভিত্তিক একটি ওয়েবমেইল সার্ভারে ঢুকে কয়েক হাজার ই-মেইল চুরি করেছে৷ সিআরইউ থেকে আইপিসিসি এবং আইপিসিসি থেকে সিআরইউতে যাওয়া-আসা এসব ই-মেইল থেকে ধরা পড়ে গেছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহ গলে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চল পানিময় হবে বলে যে ভয় দেখানো হয়েছিল, তা আসলেই ভুয়া! মানবসৃষ্ট কারণে তাপমাত্রা যে বাড়ছেই সেটা বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করানোর জন্য জলবায়ু গবেষণা রিপোর্ট অনেক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভয় দেখানোর মতো করে উপস্থাপন করার নির্দেশ ছিল বিজ্ঞানীদের প্রতি! যে রাজেন্দ্র পাচুরি বাংলাদেশকে বাঁচানোর আহ্বান জানিয়ে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির পিলে চমকানো তথ্য দিয়ে রীতিমতো হিরো হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি এখন নিজের চাকরি বাঁচাতে লড়ছেন৷ কারণ, জলজ্যানত্ম মিথ্যাকে এত বড় সত্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য দাবি উঠেছে তার পদত্যাগের৷ পাচুরি স্বীকার করেছেন, ভুল হয়ে গেছে! ২০৩৫ সালে হিমবাহ গলে জল হয়ে যাবার তথ্যটা সঠিক নয়৷ তবে তিনি পদত্যাগ করবেন না বলেজানিয়ে দিয়েছেন৷ কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনি আইপিসিসির প্রধান৷ ভুল হয়ে থাকলে তা করেছেন জাতিসংঘের হয়ে কাজ করা জলবায়ু বিজ্ঞানীরা৷ আইপিসিসির রিপোর্টের জন্য তাপমাত্রা সংক্রানত্ম তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব সিআরইউ-এর৷ কেলেংকারি ফাঁস হবার পর সিআরইউ-এর প্রধান ফিল জোনস্ সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন৷
কি ছিল সেই রিপোর্টে ঃ জাতিসংঘের আইপিসিসির ৯৯৮ পৃষ্ঠার চতুর্থ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টের দশম অধ্যায়টির মূল কথা ছিল এরকম : বিশ্বের যে কোনও অংশের তুলনায় হিমালয়ের হিমবাহ গলছে দ্রম্নত গতিতে৷ হিমবাহ গলার হার যদি একইরকম থাকে, তাহলে ২০৩৫ সালের মধ্যে সব হিমবাহ গলে যাবে৷ এমনকি তার আগেও গলে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়৷
এই রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার ভিত্তিতেই ভবিষ্যদ্বাণী করা শুরম্ন হয়েছিল বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ আরো কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র পানির নিচে তলিয়ে যাবে৷ মালদ্বীপ কথাটি বিশ্বাস করে কয়েকমাস আগে অক্সিজেন মাস্ক পরে সাগরের পানির নিচে মন্ত্রিসভার বৈঠক করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল৷ হুমকিটা যে অনত্মঃসারশূন্য ছিল সেটা আগে জানতে পারলে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার মন্ত্রীদের অত কষ্ট করে অতৰণ পানির নিচে ডুবে থাকতে হতো না৷
কথাটি উঠল কি করে ঃ কিন্তু ২০৩৫ সালের মধ্যে সব হিমবাহ গলে এই অঞ্চল ডুবে যাবার কথাটা আসলে উঠল কি করে৷ সেটি আরো মজাদার৷ আইপিসিসি নিজস্ব বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেনি৷ ১৯৯৯ সালে লন্ডনভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন 'নিউ সায়েন্টিস্ট' একটি রিপোর্ট ছেপেছিল৷ ওই রিপোর্টের মধ্যে টেলিফোনে নেয়া ভারতীয় হিমবাহ বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ ইকবাল হাসনাইনের কিছু বক্তব্য ছিল, যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল '২০৩৫ সালের মধ্যে হিমবাহ গলে যেতে পারে' এই কথাটি৷ এরপর ২০০৫ সালে ডবিস্নউডবিস্নউএফ নামের একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান তার একটি রিপোর্টে 'নিউ সায়েন্টিস্ট' ম্যাগাজিন থেকে ওই কথাটি উদ্ধৃত করে৷ আর ২০০৭ সালে জাতিসংঘের আইপিসিসি তার 'সাড়া জাগানো' জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রিপোর্টে নকলবাজ ছাত্রের মতো এই কথাটি ডবিস্নউডবিস্নউএফ-এর পাতা থেকে মেরে দেয়! তারপর থেকে আইপিসিসি রিপোর্টের এই অংশটিকে উদ্ধৃত করে ভয় দেখানো শুরম্ন করে৷ আর আমরাও ভীষণ ভয় পেতে শুরম্ন করি৷ নানা রং মিশিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নানা গুজব তৈরী হতে থাকে৷ ভবিষ্যত্ প্রজন্মের দুঃস্বপ্নের আশঙ্কা থেকেই অনেকে দম্পতিদের সনত্মান না নেয়ার পরামর্শও দেয়া শুরম্ন করেন!
ড. হাসনাইন কি বলেন ঃ ২০৩৫ সালের ডেডলাইনের মিথ্যাচারিতা নিয়ে এত হৈচৈ হচ্ছে৷ এই ডেডলাইনের 'জন্মদাতা' ভারতীয় সেই বিজ্ঞানী ড. সৈয়দ ইকবাল হাসনাইন৷ হাসনাইন কি জানেন যে, তার 'ভবিষ্যদ্বাণী' নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিন থেকে ডবিস্নউডবিস্নউএফ হয়ে ঢুকে পড়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু রিপোর্টে? কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে৷ গত ১৯ জানুয়ারি ভারতসহ কয়েকটি দেশের নামকরা পত্রিকায় তার সাৰাত্কার ছাপা হয়৷ পত্রিকাগুলোর কাছে ড. হাসনাইন বেমালুম অস্বীকার করেছেন এমন ভবিষ্যদ্বাণীর কথা৷ তিনি বলেন, '১৯৯৯ সালে নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ফ্রেড পিয়ার্স একটি রিপোর্টের জন্য হিমালয়ের হিমবাহ সম্পর্কে আমার সাথে কথা বলেন৷ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি বলেছিলাম, আগামী ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় এবং মধ্য হিমালয় অঞ্চলের হিমবাহের 'পুরম্নত্ব কিছুটা কমে যেতে পারে'৷ আমার কথাকে ওই ম্যাগাজিনে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং সম্ভবত ৪০-৫০ বছর কথাটিকে জোরালো করতে পত্রিকাটি নিজেই ২০৩৫ সাল বসিয়ে দেয়৷' আপনার কথা ভুলভাবে ছাপা হয়েছে এটা জানতেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে ড. হাসনাইন বলেন, হঁ্যা জানতাম৷ প্রতিবাদ করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে বিব্রত হাসনাইন বলেন, 'ওটা কোন গুরম্নত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল না, যা পাঠক পড়লে মহাৰতি হয়ে যাবে৷ তাই প্রতিবাদ পাঠাইনি৷ সামান্য একটা কথাকে এত বড় এবং ভুলভাবে দেখানো হবে বুঝতে পারিনি'৷ তিনি বলেন, আমার কথার মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কিংবা সব হিমবাহ গলে যাবে এমন একটা কথাও ছিল না৷
তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়েও কারচুপি ঃ জলবায়ু পরিবর্তন কথাটির সাথে যে কথাটি ঘুরে ফিরে উচ্চারণ হচ্ছে সেটি হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি৷ শিল্প কারখানা বৃদ্ধির কারণে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে৷ একই সাথে বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা৷ তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করার জন্য আইপিসিসির এক ঝাঁক বিজ্ঞানী আছেন৷ তারা যে তথ্য দিচ্ছেন সেই তথ্যই বিশ্বাস করে ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছি আমরা৷ প্রতিবছর তাপমাত্রা বাড়ছে এই কথা শুনলে 'হিমবাহ গলে ডুবে যাবার' মতো 'তাহলে কি একদিন পুড়ে মরে যাব, কিংবা আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের চামড়া কি তাপরোধী ও ভীষণ পুরম্ন হয়ে যাবে' এই ভয় ঢুকে যেতে পারে! কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে গরম থেকে বাঁচতে চামড়া পুরম্ন হয়ে জন্ম নেয়ার দরকার পড়বে না! কারণ, আইপিসিসি তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়েও কারচুপি করেছে! কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিবছর পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে বলে যে দাবি করা হয়েছিল সেটাও আসলে সঠিক নয়৷ ফাঁস হয়ে যাওয়া ই-মেইল থেকে জানা গেছে শিল্প-কারখানার কার্বন দূষণের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির গল্প তারা ইচ্ছা করেই তৈরী করেছেন৷ পৃথিবীর ইতিহাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এবং কমে যাওয়ার নজির আছে৷ আধুনিক যুগ ও শিল্পায়ন শুরম্ন হবার পর থেকে একটানা তাপমাত্রা বেড়েছে বলে আইপিসিসি দেখানোর চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু এটি সর্বাংশে মিথ্যা৷
কোপেনহেগেন সম্মেলনে বলা হয়েছিল, গত ১৩০০ বছরের মধ্যে বর্তমানে বিশ্বের তাপমাত্রা সবচে' বেশি৷ এই পিলে চমকানো তথ্যটি শুনে 'তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে' এমনটি বিশ্বাস না করে কারো উপায় ছিল না৷ কিন্তু আসল কাহিনী হলো, জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের বিরাট একটি অংশ এমন দাবি না তোলার জন্য বলেছিলেন৷ এমনকি তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাদানুবাদও হয়েছিল৷ বিরম্নদ্ধবাদি বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, বিশ্বের কোটি কোটি কল-কারখানার কথা চিনত্মা করে লোকে হয়তো এই কথা বিশ্বাস করবে, কিন্তু কাজটি অবৈজ্ঞানিক হবে৷ মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার বিজ্ঞানী ডেভিড রিন্ড বলেন, পৃথিবীর বুকে তাপমাত্রা কখনো বেড়েছে কখনো কমেছে৷ ১০০০ সালের আশপাশের বছরগুলোতেও এখনকার মতো তাপমাত্রা ছিল৷ তাই ধারণা করা হয় প্রাকৃতিক নিয়মেই তাপমাত্রা ওঠানামা করে৷ সিআরইউ-এর সার্ভার থেকে চুরি হওয়া ইমেইল থেকে জানা যায়, আইপিসিসি'র বিজ্ঞানীদের 'সুচতুর' হবার পরামর্শ দিয়ে তাপমাত্রা 'কমে যাবার' রেকর্ডগুলো বাদ দিয়ে গ্র্যাফ তৈরী করতে বলা হয়েছিল যাতে তাপমাত্রার রেখাটি কেবলই ঊধর্্বমুখী হয়! সিআরইউ-এর পরিচালক ফিল জোনস আরো নির্দেশ দিয়েছিলেন তাপমাত্রা কমে যাবার তথ্যগুলো এমন সব সার্ভারে রাখতে যাতে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে সেগুলো না পাওয়া যায়৷ ১৯৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর ফিল জোনস তার সহকর্মীদের একটি ই-মেইল করেন যাতে 'তাপমাত্রা কমে যাবার রেকর্ডগুলো সুচতুরভাবে লুকাতে পারার' জন্য তিনি সনত্মোষ প্রকাশ করেন৷ অন্যান্য ইমেইলের সঙ্গে এটিও হ্যাকাররা বের করে এনেছে৷ তবে এই কেলেংকারি ফাঁস হবার পর ফিল জোনস পদত্যাগ করেছেন৷ কেলেংকারি ফাঁস হবার পর তিনি লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যার চিনত্মা করেছিলেন বলে নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন৷
আইপিসিসির জন্য সবচে' ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মধ্যযুগটা৷ কারণ ওই সময়ের কোন কোন বছর এখনকার চেয়েও উষ্ণ ছিল! যে সময় পৃথিবীতে গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী কোন যানবাহন কিংবা কল-কারখানা ছিল না, তখন কেন তাপমাত্রা বাড়ত এই ব্যাখ্যা দেয়ার ভয়ে সিআরইউ অনেক কিছু লুকানোর চেষ্টা করেছে৷ গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট ১৭২৪ সালে থার্মোমিটার আবিষ্কার করেন৷ বিজ্ঞানীরা তার আগেরকার তাপমাত্রা বের করে থাকেন 'প্রক্সি ডাটা' ব্যবহার করে অনেক জটিল হিসাব নিকাশের মাধ্যমে৷ বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা যায়, 'মধ্যযুগীয় উষ্ণ আমল' বলবত্ ছিল প্রায় ৩৫০ বছর যা শুরম্ন হয়েছিল ১০০০ সালের আশেপাশে৷ ওই সময়টা ১৯৯৮ সাল থেকেও উষ্ণ ছিল৷ অথচ আইপিসিসি ১৩০০ বছরের মধ্যে সবচে উষ্ণ বলেছিল ১৯৯৮ সালকে৷ আইপিসিসি উষ্ণতার যে গ্র্যাফ তৈরী করছিল তাতে ১৯৬০ সাল পর্যনত্ম তাপমাত্রা 'ক্রমাগত বৃদ্ধি' দেখাতে পেরেছিল৷ কিন্তু ১৯৬১ সালের পর থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরম্ন করে৷ তাপমাত্রা গ্র্যাফের রেখাটি তখন নিম্নমুখী হওয়া শুরম্ন করে৷ এই রেখাটি তখন সেখানেই থামিয়ে দিয়ে কৌশলে আরো কিছু রেখার আড়ালে ঢেকে ফেলা হয়! নতুন রেখা দিয়ে আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেখানো শুরম্ন হয়৷ এই গ্র্যাফটিও হ্যাকাররা চুরি করে এনেছে৷ ১৯৬১ সালের পর থেকে তাপমাত্রা কমে যাবার বিষয়টি আইপিসিসির তৃতীয় অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে গোপন করা হয়৷ ফাঁস হওয়া আরেকটি ইমেইল থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে ফিল জোনস অধঃসত্মন এক জলবায়ু বিজ্ঞানীকে ই-মেইলে লিখেছিলেন, 'তাপমাত্রার রেকর্ডগুলো সার্চযোগ্য ওয়েবসাইটে দিবেন না৷ কে কোথা থেকে কে সার্চ দিয়ে বের করে ফেলবে তার ঠিক আছে!'
হ্যাকিং হলো কিভাবে ঃ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহবাদীদের বিদ্রূপের হাসি হাসার সুযোগ করে দিয়েছে হ্যাকিং হওয়া হাজার হাজার ই-মেইল ও ডকুমেন্টগুলো৷ রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি (সাবেক কেজিবি) বলেছে, ই-মেইলগুলো সাইবেরিয়ার টমস্ক সিটির ওয়েবসার্ভারে ছিল এটা সঠিক৷ কিন্তু হ্যাকিংয়ে রম্নশ গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা সরকার কোনভাবে সহায়তা করেনি যেমনটি অনেকে অভিযোগ করেছে৷ অপরদিকে, কোপেনহেগেন সম্মেলন পন্ড করার জন্য রাশিয়ার সরকারি সহায়তায় ওই ওয়েবসার্ভার হ্যাকিং হয়েছে এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে মস্কো৷ দেশটির প্রধান জলবায়ু কর্মকর্তা আলেকজান্ডার বাদরিসকি বলেছেন, হ্যাকিংয়ের কাজে সরকারের সহায়তা করার প্রশ্নই ওঠে না৷ আইটি বিশেষজ্ঞরা তদনত্ম করে দেখেছেন, রাশিয়ার বাইরে বসে হ্যাকিংয়ের কাজ করা হয়েছে৷ গত বছর ১৭ নভেম্বর হ্যাকাররা সার্ভার থেকে ১ হাজারের বেশি ই-মেইল এবং ৩ হাজার অন্যান্য ডকুমেন্টস চুরি করে৷ আইটি এক্সপার্টরা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেন, তুরস্কে বসে হ্যাকিংয়ের কাজ করা হয়েছে৷ এ ব্যাপারে ফৌজদারি তদনত্মও শুরম্ন হয়েছে৷
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ঃ ঠান্ডার দিন শেষ৷ বছর যাবে পৃথিবী গরম থেকে গরমতর হবে, আইপিসিসির এই মতবাদ প্রচারে বাদ সেধেছে গত বছরের এবং নতুন বছরের হাঁড়কাপানো ঠান্ডা৷ কেবল গরমের সাথে ছিল যেসব দেশের বসবাস তেমন অনেক দেশ এবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ঠান্ডা কাকে বলে! চীনে এবার যে শীত পড়েছে এমন শীত খুঁজতে ১০০ বছরের আগের রেকর্ড ঘাঁটতে হবে৷ ইরাকের রাজধানী বাগদাদ তার ইতিহাসে এবার প্রথম তুষারপাত দেখেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের অনত্মত ৩০টি রাজ্যে এবার যে তুষারপাত হয়েছে তা কয়েকশ' বছরে দেখা যায়নি৷ ব্রিটেনও একই ঘটনার শিকার হয়েছে৷ এবার রেকর্ড সৃষ্টিকারী তুষারপাত দেখেছে মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, গ্রীস, দৰিণ আফ্রিকা, গ্রীনল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, চিলি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, স্কটল্যান্ডসহ অর্ধ শতাধিক দেশ৷ ভারতের রাজধানী দিলস্নীতেও হয়েছে প্রবল তুষারপাত৷ এমন অনেক দেশে এবার তুষারপাত হয়েছে যারা কেবল পত্রিকায় তুষারপাতের খবর পড়ে থাকেন৷ বিশ্বের ৪টি প্রধান আনত্মর্জাতিক তাপমাত্রা ট্র্যাকিং স্টেশন যথা হেডলি, নাসা, জিআইএসএস এবং আরএসএস গত ১২ মাসের যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে এই সময়ব্যাপী বিশ্বের তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে কমেছে৷ এবারের প্রচণ্ড তুষারপাত ও শীত তাই কেলেংকারির চাপে চুপসে যাওয়া উষ্ণায়নের মতবাদ প্রচারকারীদের কাছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে হাজির হয়েছে৷
শেষ পর্যনত্ম দুঃখ প্রকাশ ঃ হিমালয়ের হিমবাহ ২০৩৫ সালের মধ্যে গলে শেষ হয়ে যাবে এমন দাবি থেকে পিছু হঠেছে জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থা৷ গোটা বিশ্বের চাপের মুখে সংস্থাটি অবমাননাকরভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে৷ আইপিসিসির চেয়ারম্যান ড. রাজেন্দ্র পাচুরি এক কৌশলী বিবৃতিতে বলেছেন, যে প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে ওই প্রসঙ্গ আমাদের রিপোর্টে অনত্মভর্ুক্ত করার সময় আমরা সাবধানতার পরিচয় দিতে পারিনি৷ মান বজায় রাখতে সৰম হইনি৷ আইপিসিসি'র তথ্য প্রণয়নে এই বিব্রতকর ত্রম্নটির জন্য সংগঠনের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং কো-চেয়ারম্যানরা দুঃখ প্রকাশ করছেন৷
তবে দুঃখ প্রকাশ মানতে রাজি নয় সমালোচকরা৷ তাদের দাবি, এমন মিথ্যাচারিতার শাসত্মি হওয়া উচিত সংশিস্নষ্ট সবার পদত্যাগ৷ অন্যথায় ভবিষ্যতে সুন্দর পরিবেশ গড়ার আন্দোলনটিই হুমকির মুখে পড়তে পারে৷ জলবায়ু পরিবর্তন শব্দযুগল কেবল ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকেই উচ্চারিত হতে পারে৷
ছোট নয় বাংলাদেশ বড় হচ্ছে ঃ বাংলাদেশের আয়তন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে (দৰিণাঞ্চল ধীরে ধীরে পানির নিচে যাবার কারণে) এমন দাবি করেছিল আইপিসিসি৷ কিন্তু আসল ঘটনা হলো বাংলাদেশের জমি দিন দিন বাড়ছে৷ ২০০৮ সালের ২৯ জুলাই বার্তা সংস্থা এএফপি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল যাতে ঢাকা ভিত্তিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-এর গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ৩২ বছর ধরে স্যাটেলাইট চিত্র নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে বাংলাদেশের আয়তন প্রতি বছর অনত্মত ২০ বর্গকিলোমিটার করে বাড়ছে৷ সীমানা পরিবর্তন নজরদারি সংক্রানত্ম সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির তত্কালীন ডিপার্টমেন্ট প্রধান মাইনুল হক সরকার এএফপিকে বলেছিলেন, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদীর দ্বারা বয়ে আসা পলি জমে জমে বরং বাংলাদেশের জমির পরিমাণ বেড়ে জলেছে৷ এসব নদী দিয়ে আনুমানিক একশ' কোটি টনের বেশি পলি প্রবাহিত হয়ে আসে যার বেশিরভাগ বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দৰিণাঞ্চলে জমা হয়ে নতুন নতুন জমি সৃষ্টি করছে৷
অথচ ওই সময় আইপিসিসি বলতে শুরম্ন করেছিল অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ অংশ ডুবে যাবে৷ বাংলাদেশের মোট আয়তন ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৭ শতাংশ পানির নিচে যাওয়া মানে ২৪ হাজার ৪৮০ বর্গকিলোমিটার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া৷ দৰিণাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর কপালে চিনত্মার রেখা জাগিয়ে দেয়ার জন্য এই তথ্য যথেষ্ট ছিল৷ কারণ খুলনা জেলার আয়তন মাত্র ৪ হাজার ৩৯৪ বর্গকিলোমিটার এবং গোটা খুলনা বিভাগের আয়তন ২২ হাজার ২৭৪ বর্গকিলোমিটার৷ অর্থাত্ গোটা খুলনা বিভাগের চেয়ে বেশি অংশ হারিয়ে যাবার ভয় দেখানো হয়েছিল৷ আইপিসিসির ওই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে নাসার আরেক বিজ্ঞানী প্রফেসর জেমস হ্যানসেন বলেছিলেন শতাব্দির শেষ নাগাদ পুরো বাংলাদেশই ডুবে যাবে!
মাইনুল হক সরকার তখন আইপিসিসির ভবিষ্যদ্বাণীতে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ডুবে যাবার তথ্যটি জোরেসোরে প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশে যে নতুন নতুন ভূমি জাগছে সেটা কেন জলবায়ু পন্ডিতরা বিবেচনায় নিচ্ছেন না সেটা বোধগম্য হচ্ছে না৷ তিনি সেদিন আরো বলেছিলেন, ১৯৭৩ সালের আগেরকার স্যাটেলাইট চিত্র এবং বাংলাদেশের পুরাতন মানচিত্র থেকে হিসাব পাওয়া যায়, এই কয় বছরে বাংলাদেশ ১ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি নতুন ভূমি পেয়েছে৷ তিনি সেদিন বার্তা সংস্থাটির কাছে উল্টো দাবি করেছিলেন আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের মানচিত্রে আরো ১ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি যোগ হতে পারে৷ কিন্তু জাতিসংঘের আইপিসিসির মতো বাঘা প্রতিষ্ঠানের 'বাংলাদেশ ডুবে যাবে' এমন দাবির বিপরীতে একজন বাংলাদেশী গবেষকের 'বাংলাদেশ আরো বড় হবে' দাবি তেমন প্রচারণা পায়নি সেদিন৷
জলবায়ু পরিবর্তন কি মিথ্যা ঃ সবকিছুই পরিবর্তনশীল৷ নাসার একদল বিজ্ঞানী বলছেন, পৃথিবী সৃষ্টির সময় কিংবা তারপর থেকে সারা জীবন ধরে জলবায়ু এখনকার মতো ছিল এমনটি একমাত্র বোকারা বিশ্বাস করবেন৷ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হতে হতে জলবায়ু আজকের পর্যায়ে এসেছে৷ তাতে প্রাণের প্রবাহ কিংবা সভ্যতার বিকাশ থেমে থাকেনি৷ সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায়নি৷ ভবিষ্যতেও পরিবর্তন হবে৷ হাজার বছর কিংবা পাঁচশ বছর আগের আমাদের পূর্বপুরম্নষরা জলবায়ু তখনকার অবস্থায় টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করেননি! গেল গেল রব তোলা তাই বোকামির পরিচয়৷ জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে প্রকৃতির নিজের নিয়মে৷ বিশ্বের বেশিরভাগ তাপমাত্রা পরিমাপ করার যন্ত্রগুলো নগরাঞ্চলে বসানো৷ সব দেশের পলস্নী অঞ্চলের চেয়ে নগরাঞ্চল বেশি উষ্ণ থাকে৷ জনসংখ্যার চাপে এবং ক্রমাগত উন্নয়ন হবার ফলে নগরের তাপমাত্রা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক৷ তাই এসব তাপমাত্রা গড় করে 'বিশ্বের তাপমাত্রা' ক্রমাগত বাড়ছে এমন দাবি অযৌক্তিক৷ সিআরইউ এর পদত্যাগকারী পরিচালক ফিল জোনস চলতি সপ্তাহে বিবিসি'র কাছে একটি সাৰাত্কার দিয়েছেন৷ সেখানে তিনি তার কট্টোরপন্থি অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বলেছেন ১৯৯৫ সাল থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত কমে চলেছে!
নতুন শব্দ ক্লাইমেটগেট ঃ কোনো কেলেংকারি ফাঁস হবার পর তার সাথে 'গেট' জুড়ে দেয়া বর্তমানে যেন চল হয়ে গেছে৷ জাতিসংঘের জলবায়ু কেলেংকারিকে এই প্রজন্মের সেরা বৈজ্ঞানিক স্ক্যান্ডাল দাবি করে সমালোচকরা এর নাম দিয়েছে 'ক্লাইমেটগেট'৷ শব্দটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ দিলে দেখা যাবে দেড় কোটির বেশি ওয়েবসাইটে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে! আইপিসিসির জলবায়ু পরিবর্তনের তত্ত্বে এর চেয়ে বড় চপেটাঘাত আর কি বা হতে পারে!
সংবাদের লিংক
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।