আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাসঙ্গিক ভাবনা-মোঃ নুরুল আমিন



প্রধানমন্ত্রীর সরকার উৎখাততত্ত্ব বিডিআর বিদ্রোহ ও বাস্তবতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির একটি পুরাতন ঘা'য়ে আঘাত করেছেন বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন যে, তার সরকারকে উৎখাত করার জন্যই গত বছর বিডিআর বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল। তিনি আরো বলেছেন যে, এই বিদ্রোহে নিহত ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ৩০ জনই আওয়ামী লীগ করতো। অবশিষ্ট ২৭ জন অন্য কোনও লীগ করতো কিনা তা অবশ্য তিনি বলেননি। বিডিআর বিদ্রোহে বিরোধী দলীয় নেত্রীর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিতে গিয়ে বেগম জিয়ার বড় সন্তানের নাম না নিয়ে তিনি আরো বলেছেন যে, ওনার বড় সন্তান কিভাবে সকাল ৭টা ৮টার মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করে তার মাকে বলেছিল ক্যান্টনমেন্টের বাসায় না থাকার জন্য।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে এরপর বেগম জিয়া তিন দিন কি আকাঙ্ক্ষায় কোথায় বসে ছিলেন সে রহস্য উ ঘাটন করার উপরও জোর দেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের এখানে দু'টি দিক রয়েছে। এক, তার সরকারকে উৎখাত করার জন্য বিডিআর বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল। দুই, এই বিদ্রোহে যে সমস্ত সেনা কর্মকর্তা মারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৩০ জন আওয়ামী লীগ করতেন। প্রথম কথাটি তিনি শুরু থেকেই বলে আসছেন।

এতে নতুনত্ব কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে তা পরীক্ষা করা দরকার। দ্বিতীয় কথাটিকে আমি মারাত্মক বলে মনে করি। কেননা এতদিন তিনি দেশের সিভিলিয়ানদের স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিতে বিভক্ত করেছিলেন। এখন সেনা বাহিনীকেও বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন।

আমরা এতদিন জানতাম যে, সেনাবাহিনীর কোনও দল নেই, তারা জাতীয় সম্পদ। প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই ধারণা ভেঙ্গে দিচ্ছেন। দলীয় ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভক্তি মঙ্গলজনক নয়। এখন প্রধানমন্ত্রীর প্রথম অভিযোগের যথার্থতা নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। পাঠকদের হয়ত মনে আছে যে, বিডিআর হত্যাকান্ডের পর গত বছর ২ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার স্বর্ম (রাজ-২/গোপ্র-বিবিধ/ ৪-৫/২০০৯/২০৮ নং স্মারক মূলে বাংলাদেশ সরকারের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব জনাব আনিস-উজ-জামান খানকে সভাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে সদস্য সচিব করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন।

কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল, বিডিআরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইনুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব এহছানুল হক, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব জনাব মঈন উদ্দিন আব্দুল্লাহ, সশস্ত্র বাহিনীর তিনজন প্রতিনিধি যথাক্রমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির, পরিচালক আর্টিলারী, কমডোর এম নাসির, নৌ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, এয়ার কমডোর এম সানাউল হক, জিডি (পি) এয়ার অফিসার কমান্ডিং, ঘাঁটি বাসার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, অতিরিক্ত মহা-পুলিশ পরিদর্শক নব বিক্রম ত্রিপুরা, সেনা সদরের জাজ এডভোকেট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নূর মোহাম্মদ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব মো. গোলাম হোসেন। তদন্ত কমিটির কর্মপরিধির মধ্যে ছিল ঘটনার পটভূমি ও কারণ উদঘাটন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা। এই কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের সাথে তার কোন সামঞ্জস্য নেই। এই কমিটি কোথাও বলেনি যে, সরকার উৎখাতের জন্য পিলখানা হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে এবং এর সাথে বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দল, বেগম জিয়া অথবা তার পুত্র তারেক রহমান সম্পৃক্ত ছিলেন। বরং তদন্ত রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকার এবং দলীয় নেতৃবৃন্দের সম্পৃক্ততার আশংকাই বেশি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।

বিদ্রোহের পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে কমিটির মন্তব্য ছিল প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে যে, কমিটি তদন্তকালে প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেও বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাকারী কারা ছিল তা সনাক্ত করতে পারেনি। এজন্য তারা কমিটির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছে এবং আরো তদন্তের সুপারিশ করেছে। বলাবাহুল্য, কমিটি তার রিপোর্টে সীমাবদ্ধতা শিরোনামে যে মন্তব্য করেছে তা একটি সরকারের ন্যক্কারজনক কর্মকান্ডের প্রতিই ইঙ্গিত করে। বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ছিল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতি একটি চরম আঘাত।

প্রতিরক্ষা বাহিনী হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ভূখন্ডের নিরাপত্তা রক্ষাকারী একমাত্র এজেন্সি যার অস্তিত্ব বিপন্ন হলে দেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। এই হত্যাযজ্ঞে বাংলাদেশ তার সেনাবাহিনীর ৫৯ জন চৌকস সিনিয়র ও মধ্য সোপান কর্মকর্তাকে হারিয়েছে। এই ক্ষতি জাতির জন্য অপূরণীয়। সরকার দেশের অস্তিত্ব বিনাশী এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং এর পরিকল্পনাকারী ও পেছনের শক্তিকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেন এবং কমিটিকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিলেন না তা শুনতেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু মনে হলেও তা সত্য।

কমিটির ভাষায় : ‘‘তদন্তের স্বার্থে এই কমিটি কয়েকটি সংস্থার প্রধান, কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নিকট হতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা আবশ্যক বলে মনে করেছে কিন্তু পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাবে এই কাজগুলো করা সম্ভবপর হয়নি। ফলশ্রুতিতে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণসহ এ বিদ্রোহ এবং হত্যাকান্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারীদের সনাক্ত করা এবং ঘটনার পেছনের মূল কারণ বা মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। ‘‘কমিটি সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ যেমন এনএসআই, ডিজিএফআই, র্যা ব, সিআইডি ও পুলিশের এসবিকে তাদের সংগৃহীত বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য ও প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে কমিটির নিকট সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বর্ণিত সংস্থাসমূহ হতে ইw≈ত সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ‘‘যেহেতু এই কমিটির কাছে সত্য উ ঘাটনের জন্য সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করার উপযুক্ত উপকরণ, প্রযুক্তি এবং কৌশল ছিল না তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কমিটির নিকট উপস্থাপিত বা আনীত প্রায় সবাই কোনও প্রকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা প্রমাণ দেয়নি।

ফলশ্রুতিতে কমিটির নিকট এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে বিডিআরের বিদ্রোহের ঘটনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ও পেছনের পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত না করা পর্যন্ত এই ঘটনার পেছনের কারণ উদ্দেশ্য বের করা একটি দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ কাজ। ’’ সেনাবাহিনীকে আমরা দেশরক্ষা বাহিনী বলে থাকি। এই বাহিনীর ওপর হামলা দেশের অস্তিত্বের ওপর হামলার শামিল। এ প্রেক্ষিতে যারা পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীর ৫৯ জন শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে তাদের স্ত্রী কন্যাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে তারা প্রকৃতপক্ষে দেশের অস্তিত্বের মূলে আঘাত করেছে। হত্যাযজ্ঞের দুই দিনে আমরা যত সেনা কর্মকর্তাকে হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসেও আমরা তত অফিসারকে হারায়নি।

এই অবস্থায় এই ঘটনার তদন্তের জন্য সরকার নিয়োজিত কমিটি সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারি সংস্থা ও এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাবার অভিযোগ ছোটখাট কোনও অভিযোগ নয়। সেনাবাহিনীর তরফ থেকেও এই হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে একটি তদন্ত দল তদন্ত কাজ পরিচালনা করেছে। তারাও মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে পারেনি এবং এজন্য সরকার প্রদত্ত Terms of Reference বা কর্ম পরিধির সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেছে। সিআইডির তদন্ত এক বছর ধরে চলছে। পাঠকরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে আইন বা সরকারের জারিকৃত পরিপত্রে বিধান না থাকলেও পিলখানার ঘটনা তদন্তে নিয়োজিত তিনটি কমিটির কাজ সমন্বয়ের জন্য সরকার হঠাৎ করে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে সমন্বয়কারী নিয়োগ করেছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে মন্ত্রীদের মধ্য থেকে একজন সমন্বয়কারী থাকা সত্ত্বেও সেনা তদন্ত দল এবং সরকার নিয়োজিত বেসামরিক তদন্ত দল সীমাবদ্ধতা ও অসহযোগিতার কারণ দেখিয়ে ষড়যন্ত্রের মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলো কেন? তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে তদন্তকাজ যাতে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতে না পারে তার জন্যই সমন্বয়কারী নিয়োগ করা হয়েছিল? সমন্বয়কারী হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অবঃ) ফারুক খান নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং দিয়েছেন, অনেকের ওপর দায় চাপিয়েছেন। কিন্তু তদন্ত রিপোর্টে তার কল্পকাহিনীর প্রতিফলন ঘটেনি। যেটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। যে দুটি কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে তার প্রত্যেকটিই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছে। এর অর্থ হচ্ছে সরকার চাননি বলেই কমিটিগুলোর কাজের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়নি কিংবা থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবার ভয়ে সরকারের তরফ থেকেই প্রতিবন্ধকতাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে প্রকৃত অপরাধী এবং ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করা না যায়।

কিন্তু তথাপিও আনিস-উজ-জামান কমিটি তার রিপোর্টে বিদ্রোহের পরিকল্পনা অনুচ্ছেদে (অনু. ৬.১) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে। এতে সংযোজনী ৭-এর তথ্য প্রমাণ দিয়ে বলা হয়েছে যে, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের হত্যাকান্ড, লুটতরাজ ও অন্যান্য অপরাধের পরিকল্পনার সাথে বিডিআরের অনেক সদস্যসহ অনেক বেসামরিক ব্যক্তি জড়িত ছিল এবং প্রায় ২ মাস যাবত এই পরিকল্পনা চলে। পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে তারা বেশ কিছু বৈঠকও করেছে বলে এতে বলা হয়েছে। বৈঠকের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে নির্বাচনের পূর্বে ব্যারিস্টার তাপস (বর্তমানে সংসদ সদস্য) এর অফিসে হাবিলদার মনির, সিপাহী তারেক, সিপাহী আইয়ুব, ল্যাঃ নাঃ সহকারী সাইদুরসহ ২৫/২৬ জন জওয়ান ও জনৈক জাকিরকে নিয়ে জনাব তাপসের সাথে বৈঠকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচনের ৩/৪ দিন পরও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিডিআর সদস্য এমপি তাপসের বাসভবন স্কাই স্টারে মিটিং করার কথা রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে।

আবার এতে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সংসদ সদস্য শেখ সেলিমের বাসায় ২ জন ডিএডি এবং বেসামরিক জাকিরের নেতৃত্বে ১০/১২ জন বিডিআর সদস্যের তার সাথে বৈঠকেরও উল্লেখ রয়েছে। রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী পরবর্তীতে এই গ্রুপটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও দেখা করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। তদন্ত রিপোর্টে এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মীর্জা আজমের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে তারা ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধি দলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের জন্য তার বাসভবন যমুনায় গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ১৪ জনের নামের কোনও তালিকা তদন্ত কমিশনকে দেয়া হয়নি।

জানা গেছে যে, এদের কোনও তালিকা সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ একজন সরকারি কর্মকর্তার সাথেও যারা দেখা করেন তাদের নাম ঠিকানা সংরক্ষণ করা হয়। বৈঠক করলে রেজিস্টারে তাদের স্বাক্ষর দিতে হয়। বিডিআর সদর দফতরে বিদ্রোহ হলো, হত্যাযজ্ঞ ঘটলো, বিদ্রোহী একটা গ্রুপ বা প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করলেন, তাদের নাম ধাম সংরক্ষণ করা হলো না এবং তাদের আসা যাওয়া ও বৈঠককালে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলোও বন্ধ রাখা হলো, তাদের ছবি রাখা হলো না এর কারণ কি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি এর কারণ এখনো খতিয়ে দেখতে পারেননি? তিনি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট কি বলেছে তা তলিয়ে দেখেননি।

এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এ ব্যাপারে আরো কিছু তথ্য সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। এগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ : ১. তদন্তকারীদের সূত্র উল্লেখ করে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারির মধ্যে ২৫ জন বিদেশী কমান্ডো বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ঢাকায় তাদেরকে যারা অভ্যর্থনা জানায় এবং আশ্রয় দেয় তারা কূটনীতিকের কাভারে কাজ করেছেন। ২. একইসাথে স্থানীয় বিডিআর হতে ১০-১২ জনের একটি ছোট গ্রুপকে রিক্রুট করা হয়, এদের মধ্যে ছিলেন ২ জন ডিএডি। এই ১০/১২ জনের দায়িত্ব ছিল ঐ বিদেশী কমান্ডোদের গুপ্তচরের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করা।

তিনজন রাজনৈতিক নেতার মাধ্যমে এই ছোট গ্রুপটি কাজ করে এবং হত্যাকান্ডের পূর্ব পর্যন্ত যাবতীয় খবরাখবর সংগ্রহ করে। এই রাজনৈতিক নেতারা সরকারি দলের। ৩. অপারেশন চালানোর দিনক্ষণও নির্বাচন করা হয় অনেক ভেবে চিন্তে। তাদের টার্গেট ছিল বিডিআরের সমস্ত সিনিয়র অফিসারদের একসাথে পাওয়া; এসব অফিসার বার্ষিক বিডিআর দিবস উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন। ৪. ষড়যন্ত্রকারীরা প্রথমে অপারেশনের তারিখ ঠিক করে ২৪ ফেব্রুয়ারি।

সেদিন বিডিআর দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার Salute নেয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেদিন অপারেশন করতে গেলে সামরিক অফিসারদের মাঝে বেসামরিক অফিসারদের মারা যাওয়া বা Collateral damage এর চিন্তা করে তার ঝুঁকি নেয়া হয়নি। ৫. ২৪ তারিখে আনুমানিক রাত ১০.৩০টায় ঢাকার উপকণ্ঠে একটি বাসভবনে বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে বিদেশ থেকে আসা কিলার গ্রুপ, বিডিআরের ঐ ১০-১২ জন এবং দেশের তিনজন তরুণ রাজনীতিবিদ যোগ দেন। ঐ বৈঠকেই পরের দিনের অপারেশনের দিনক্ষণ ঠিক হয় এবং তাদের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করা হয়। কখন কোন গ্রুপ কোথায় কিভাবে অপারেশন করবে তাও ঠিক করে দেয়া হয়।

৬. ঐ সিদ্ধান্ত মোতাবেক অন্যতম ডিএডি ৪নং গেটে কোন্ কোন্ সেন্ট্রি সকাল থেকে ডিউটিতে থাকবে সেই দায়িত্ব বণ্টন করে। বলা বাহুল্য, ঐসব সেন্ট্রিকেই ডিউটিতে বসানো হয় যারা তাদের খাস লোক। ৭. পূর্ব পরিকল্পনা মত সকাল ৮.১০ মিনিটে বিডিআরের একটি বেডফোর্ড ট্রাকে ৪নং গেট দিয়ে বিদেশী কমান্ডোরা পিলখানা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে। তাদেরকে বহন করার জন্য এক ঘণ্টা আগে বেডফোর্ড গাড়ি পাঠানো হয়। ঐ সব গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল ডিএডিরা।

কমান্ডোর পরনে ছিল Sports gear। এর কারণ ছিল যাতে অপারেশন শেষ করে যাবার সময় যেন তারা মুহূর্তের মধ্যেই পোশাক পরিবর্তন করতে পারে। ৮. বেডফোর্ড গাড়ির পেছনে ছিল ছাই রঙের একটি পিকআপ ভ্যান, ভ্যানে ছিল বাইরে থেকে আনা অস্ত্র ও গোলাবারুদ। অপারেশন শুরু করার জন্য একজন বাংলাদেশী কমান্ডোকে দরবার হলে প্রবেশের নির্দেশ দেয়া হয়। তার ওপর দায়িত্ব ছিল অপ্রয়োজনে অপ্রাসঙ্গিকভাবে দরবারের সভাপতি ও ডিজি জেনারেল শাকিলের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া।

উদ্দেশ্য ছিল বেয়াদবী করে ডিজিকে উত্তেজিত করা। ৯. পরিকল্পনা মত ডিজিকে গুলী করার পর উপস্থিত অন্যান্য অফিসার এই ঘাতককে জাপটে ধরেন। মুহূর্তের মধ্যেই কিলারের একশান গ্রুপ দরবার হলে ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে গুলী করতে থাকে। ঘাতকদের যে গ্রুপটি কাভার করছিল তারা মুহূর্তের মধ্যেই সমগ্র দরবার হল ঘিরে ফেলে। ১০. এর পর শুরু হয় কিলিং মিশনের দ্বিতীয় পর্বের বাস্তবায়ন।

এই পর্বে উদ্যত সঙ্গীনের মুখে অন্যান্য ট্রুপকে ঘাতকের সাথে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। একটি গ্রুপ অস্ত্রের মুখে মালখানা লুট করে। এরপর তারা অফিসারদের বাসভবন, তাদের পরিবারবর্গের অবস্থান এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত দলিলপত্র কোথায় আছে তার খোঁজ-খবর নেয়। এসব দলিলপত্রের মধ্যে ছিল সীমান্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং সীমান্তে বিডিআর জওয়ানদের মোতায়েনের মানচিত্র। ওরা এসব দলিল লুট করে নিয়ে যায়।

১১. অফিসারদের হত্যা করার প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার পূর্বেই তারা বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা শাখা RSU -এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে RSU'র যোগাযোগ যন্ত্রগুলো দখল করে নেয় এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। উপরোক্ত তথ্যগুলোর ভিত্তিতে বিডিআর হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারীদের চিনতে কষ্ট হবার কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সরকার যদি নিজেই তাদের লালন করেন তাহলে তদন্ত টীম তাদের চিনবেন কি করে? প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহের সাথে বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা প্রমাণের জন্য বেগম জিয়ার তিন দিন ক্যান্টনমেন্টের বাসায় না থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি এও প্রশ্ন তুলেছেন যে, কিভাবে তার বড় ছেলে সকাল ৭টা-৮টার মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করে তার মাকে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় না থাকার জন্য বলেছিল। তার এই প্রশ্ন শুনে আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী কাঁচের ঘরে বসবাস করে অন্যের প্রতি ঢিল ছুঁড়ছেন।

অথচ তিনি বুঝতে পারছেন না যে, অন্যেরাও যদি তার প্রতি ঢিল ছুঁড়তে শুরু করেন তাহলে তার ঘর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এখানে কতগুলো স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠে আসে। বিডিআর বিদ্রোহের আগে সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার SSF নিরাপত্তা তুলে নিয়েছিলেন। বেগম জিয়া তার বাড়িতে নিরাপদ ছিলেন না। বিদ্রোহের দিন সকাল থেকেই দেশ-বিদেশে বিদ্রোহের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই অবস্থায় তার বড় ছেলে যদি তাকে নিরাপদ কোনও স্থানে গিয়ে থাকতে বলে থাকেন তাহলে এর মধ্যে বিদ্রোহের সাথে সম্পক্তির সম্পর্ক কোথায়? দ্বিতীয়ত প্রধানমন্ত্রী এই টেলিফোনের খবর জানলেন কি করে? তিনি কি বেগম জিয়ার টেলিফোনে আড়ি পাতেন? না গোয়েন্দা কোনও সংস্থা আড়ি পেতে তা তাকে জানিয়েছেন? এই দু'টোর যে কোন একটি যদি সত্য হয় তাহলে আমি বলবো এ দেশের কোনও ব্যক্তিই সরকারের হাতে নিরাপদ নয়। বিডিআর হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে বিডিআর, সিআইডি, ডিবি প্রভৃতি সংস্থা কিছুই জানলো না, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা সেনাপ্রধান কেউই কোনও পূর্বাভাস পেলেন না আর বেগম জিয়াকে কে টেলিফোন করে কি বললো প্রধানমন্ত্রী তা জেনে গেলেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এখানে দুর্মুখরা আরো কিছু প্রশ্ন করতে পারে। বিডিআর হত্যাযজ্ঞের আগে আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনায় স্থানান্তর করে তার সামনে ট্যাংক কামানসহ সৈন্য মোতায়েন করা হলো কিন্তু পিলখানায় আক্রান্ত সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া হলো না কেন? শুরুতেই খুনীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এবং সব দাবি মেনে নিয়ে তাদের অধিকতর খুনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হলো অথচ যাদেরকে হত্যা করে তাদের পরিবার পরিজনকে জিম্মি করা হলো তাদের খোঁজ-খবর নেয়া হলো না কেন? বিদ্রোহের আগের দিন হঠাৎ করে ২৫ তারিখের ডিনারে প্রধানমন্ত্রীর যোগদান কর্মসূচি বাতিল করা হলো কেন? বিদ্রোহের পর প্রথম রাতে পিলখানা ও তার আশেপাশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে অপরাধীদের লুটপাট, ধর্ষণ, নির্যাতন, লাশগুম ও পালানোর সুযোগ করে দেয়া হলো কেন? তাপসের নির্দেশে পিলখানা ও তার আশপাশে তিন কিলোমিটার এলাকা জনশূন্য করার জন্য মাইকিং করা হলো এবং এলাকা খালি করে অন্যান্য সকল অপরাধীকে পালানোর সুযোগ করে দেয়া হলো কেন? এই কেন'র উত্তরগুলোই বলে দেবে আসলে সরকার উৎখাতের জন্য না তাঁবেদার সরকারের অবস্থা নিরাপদ করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে উৎখাত করার জন্য বিডিআর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যৎই এর সঠিক উত্তর দিবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.