অন্যায়ভাবে সংঘটিত সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই । ।
ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতিতে গত ১২ জানুয়ারির আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে অন্তত ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আড়াই লাখ মানুষ আহত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকহারে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন ৩০ লাখের মতো মানুষ। রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট প্রাসাদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ধ্বংস হয়েছে বিমানবন্দর ও নৌ বন্দরের মতো বড় বড় স্থাপনা। স্মরণকালের এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য কেবল প্রকৃতির রুদ্ররোষকেই দায়ী করা চলে না। এর জন্য প্রধানত দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির গত একুশ’ বছরের সম্পর্ক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,১৯১৫ সালে মার্কিন নৌবাহিনী প্রথম এই দ্বীপদেশটি দখল করে নেয় এবং পরবর্তী ২০ বছর ধরে সেখানে নিজেদের আধা ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখে। এরপর পরবর্তী তিন দশক তারা সেখানে দুবেলীয়র একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন যুগিয়ে যায়।
আশি ও নব্বই দশকে ওয়াশিংটন দেশটিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপকহারে বেসরকারিকরণে উৎসাহ যোগায় এবং কৃষি খাতকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ভয়ানক দারিদ্র্য দেখা দেয়ায় গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্সে ভিড় জমাতে শুরু করে।
মার্কিন নৌসেনা উপস্থিতির পাশাপাশি ওয়াশিংটন হাইতিকে এ পর্যন্ত যে ঋণ দিয়েছে তার বড় একটা অংশই দেশটির দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠীর পকেটস্থ হয়েছে। ঋণের বাদবাকি অংশে মার্কিন তত্ত্ববধানে যেসব নিম্নমানের অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল তার অধিকাংশই গত ১২ জানুয়ারির ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে। হাইতিবাসীর দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এই দেশটিতে পুনর্গঠন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও তথাকথিত মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের নামে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আবার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বেশি বেশি নৌসেনার সমাবেশ ঘটাতে শুরু করেছে।
এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নিজের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন নতুন ব্যবসারই শুধু সুযোগ তৈরি করছে না, নিরাপত্তার নামে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ত্রাণ কার্যক্রমের পথেও বাধা সৃষ্টি করছে। এ অভিযোগ করেছে ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, ইরানসহ অনেক দেশ। মার্কিন নৌসেনারা পোর্ট অ প্রিন্স বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পুরোপুরি নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে বাণিজ্যিক গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল পিস অপারেশনস এসোসিয়েশন কালক্ষেপণ না করে ইতিমধ্যেই হাইতিতে তার পুনর্গঠন বাণিজ্য কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্রুত বাড়িঘর নির্মাণ, জরুরি ত্রাণ শিবির স্থাপন এবং পরিবহন কাজের ঠিকাদারি করে।
কোনোটি আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক ও আফগানিস্তানে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বও পালন করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্ল্যাক ওয়াটার। এটি ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হ্যারিকেন ক্যাটরিনা বিধ্বস্ত নিউ অরলিয়েন্সে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় এর প্রতিটি নিরাপত্তারক্ষীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে দৈনিক ৯৫০ ডলার করে ব্যয় করতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই অর্থের সবটাই মার্কিন জনগণের করের টাকা। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের হাইতিতে উপস্থিতি কতটা মানবিক বিপর্যয়ে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের জন্য আর কতটা ব্যবসায়িক লাভালাভের জন্য তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
হেরিটেজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে জিম রবার্টস্ বলেছেন, ভূমিকম্প বিধ্বস্ত হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য প্রদানের বাইরেও সেদেশের দীর্ঘদিনের সরকারি অব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করার কাজে যুক্ত হতে চায়। এসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সে ওই অঞ্চলে নিজের ভাবমূর্তিকেও উজ্জ্বল করতে চায়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ওই অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো কার্যকর রাজনৈতিক প্রভাব নেই।
এদিকে ভূমিকম্পের প্রায় দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও লাখ লাখ হাইতিবাসী এখনো চিকিৎসা , খাদ্য ও আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন সামরিক পরিবহন বিমানগুলো হাজার হাজার সৈন্য ও নৌসেনা দ্বীপটিতে নামানো অব্যাহত রেখেছে।
আর তাদের উপকূলীয় রক্ষীরা সমুদ্র উপকূলের সীমান্তে কড়া নজরদারি জারি রেখেছে, যাতে হাইতির কোনো নাগরিক পলিয়ে যেতে না পারে। আহত কিংবা দুর্গতদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাদ্য ও পানির যে অভাব রয়েছে ব্যাপারটা তা নয়। আসল সমস্যা হলো সঠিকভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো। এ ক্ষেত্রে মার্কিন সেনাদের অসহযোগিতাই প্রধান বাধা। ভাবতে অবাক লাগে যে, এই মার্কিন সেনাবাহিনীই হাজার হাজার মাইল দূরের ইরাকে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে আড়াই লাখের মতো সৈন্য পাঠিয়ে বাগদাদ দখল করে নিয়েছিল।
অথচ মূল মার্কিন ভূখন্ডের মাত্র ৭শ’ মাইল দূরে আহত ও দূর্গত লাখ লাখ হাইতিবাসী খাদ্য এবং চিকিৎসার অভাবে কাতরাচ্ছে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শত শত। এখনো পর্যন্ত পোর্ট অ প্রিন্সের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি থেকে জীবন্ত মানুষ উদ্ধার করা যাচ্ছে দেখেও মার্কিন ও জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছেন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার আর দরকার নেই।
এ থেকে পরিস্কার হয়ে যায়, হাইতিতে মার্কিন উপস্থিতির উদ্দেশ্য মানুষের জীবন বাঁচানো নয়। তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে সেখানে আরো বেশি মাত্রায় মার্কিন সামরিক দখলদারিত্ব কায়েম করে ত্রাণ ও পুনর্গঠনের নামে বাণিজ্য করা। তা না হলে সৈন্যসহ অন্যান্য রসদ সামগ্রী নামিয়ে দিয়ে মার্কিন পরিবহন বিমানগুলো খালি অবস্থায় ফেরত যেতো না।
তারা সে সব বিমানে করে চিকিৎসার জন্য বহু আহত হাইতিবাসীকে নিয়ে যেতে পারত। পোর্ট অ প্রিন্সে নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তি রক্ষীবাহিনীর ব্রাজিলীয় কর্মকর্তা এবং ফ্রান্স সরকার মার্কিন সেনাদের আচরণে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছেন ওয়াশিংটনের কাছে। ফরাসি সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী আ্যলেইন জাঁদি জাতিসংঘের কাছে ওয়াশিংটনের আচরণের ব্যাখ্যা দাবি করে বলেছেন, হাইতিতে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেখানকার দুর্গত মানুষকে সাহায্য করা, হাইতি দখল করে নেয়া নয়। ত্রাণ কাজে অংশ নেয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কর্মকর্তারাও ত্রাণ পরিচালনার ক্ষেত্রে মার্কিন সেনাবাহিনীর ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছেন প্রকাশ্যে।
ডকটর্স উইদাইট বর্ডার্স নামের আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা জানিয়েছে যে, ১২ টন চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্র বহনকারী তাদের একটি বিমানকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণধীন পোর্ট অ প্রিন্স বিমানবন্দরে অবতরণে তিন দফা বাধা প্রদান করা হয়েছে। ১৪ জানুয়ারির পর তাদের অন্তত পাঁচটি বিমানকে পোর্ট অ প্রিন্স বিমানবন্দরে নামতে না দিয়ে ডোমিনিকান রিপারলিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফল হলো শত শত আহত হাইতিবাসীর চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ। পোর্ট অ প্রিন্সে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী স্পেনের একটি সংস্থা মাদ্রিদ বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলন করে ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছে, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে তার সামরিকীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
এ ফলে সেখানকার ত্রাণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শ্রীলংকা থেকে শুরু করে তুরস্ক পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ কাজ চালাতে গিয়ে এমন বাঁধার মুখে তারা কখনো পড়েনি বলেও সংস্থাটি সাংবাদিকদের জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যে বিভিন্ন দেশের দুর্গত অঞ্চলে উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ তৎপরতার নামে কী করে তার বড় প্রমাণ মেলে হাইতিতে ত্রাণ কাজে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বারাক ওবামার তার দু’জন পূর্বসূরি বিল ক্লিনটর ও জর্জ ডব্লিউ বুশকে মনোনীত করার মধ্যে। সাবেক এই দুই প্রেসিডেন্টের হাতই হাইতবাসীর রক্তে রঞ্জিত। ২০০৪ সালে বুশ প্রশাসন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে হাইতির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ বার্টেন্ড এরিসটিডকে ক্ষমতাচ্যুত ও অপহরণ করে।
সে ঘটনায় সিআইএ’র ঘাতক বাহিনীর হাতে হাজার হাজার হাইতবাসী নিহত হয়েছিল। আর ১৯৯৪ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও হাইতিতে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। মানবিক বিপর্যয়ের কথা ভুলে গিয়ে বিল ক্লিনটন পোর্ট অ প্রিন্স-এ সাংবাদিকদের কাছে হাইতির প্রেসিডেন্ট রো পাভেলের ত্রাণ কার্যক্রমের প্রশংসাই শুধু করলেন না, তিনি হাইতির পুনর্গঠনে যক্তরাষ্ট্রের বেশি পরিমাণ বিনিয়োগের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। আসলে এই ব্যবসার বিষয়ই যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাইতির এই করুণ দশা ও মানবিক বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে দেশটিকে নিজের নয়া উপনিবেশে পরিণত করতে চায় যেখানে তথাকথিত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক লাভ অর্জন করবে।
তাছাড়া ওই অঞ্চলে ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ এবং চীন যে তার প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারেও সচেতন। হাইতিতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে ওয়াশিংটন আসলে ওই পুরো অঞ্চলটিতেই নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদিকে কর্পোরেট মিডিয়াগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্য হাসিলে শামিল হয়েছে। তারা হাইতিবাসীর অবর্ণনীয় কষ্টের জন্য মায়াকান্নার পাশাপাশি হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ত্রাণ ও উদ্ধার প্রচেষ্টার ভূমিকাকে ফলাও করে প্রচার করলেও, তাদের কারণে যে সেখানকার ত্রাণ কাযক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সে ব্যাপারটি বেমালুম চেপে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র হাইতির অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত গরিব মানুষগুলোর বিরুদ্ধে যে অপরাধ করে চলেছে তা দুনিয়ার অন্যান্য জায়গার গরিব মানুষদের প্রতি তার করা আচরণ থেকে আলাদা কিছু নয়।
এই আচরণ ও অপরাধ প্রবণতা আসলে পুঁজিবাদের ভয়াবহ সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ। গত একশ’ বছরে হাইতির শৃমিক কৃষক মেহনতি মানুষদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদ যে অবিচার করেছে তার থেকে বের হয়ে আসার উপায় হচ্ছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ক্ষোভ ও সংগ্রামকে এক সূতায় গাঁথা।
লেখক: নেয়ামুল হক
সূত্র/সংগ্রহ: সাপ্তাহিক বুধবার(সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ)-২০তম সংখ্যা;২৭জানুয়ারী ২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।