পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি
আগের পোস্টে বলেছি ,
মেয়েদের উপর নেগেটিভ প্রেশার তৈরী করার চেয়ে তাদের আদর্শ হিসেবে বিকল্প পজিটিভ ইমেজ দেওয়াটা খুবই জরুরী । পারিবারিক লেভেলে আপনি আপনার মেয়েটিকে যত বেশি পারেন চিন্তা চেতনার স্বাধীনতা দেবেন, তাঁর নিজস্ব মতামত স্বাধীন ভাবে চর্চার সুযোগ দেবেন , তাঁকে ২ বছর বয়স থেকেই কোনটা ভালো কোনটা মন্দ শেখাবেন ( আমি বলেছি ভালো তাই ভালো ধরনের উদ্ভট সুবিধাবাদী কান্ড করলে হবে না , সময় নিয়ে বাচ্চাদের লেভেলে নেমে তাকে তার মত করে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন খারাপ , কেন ভাল, এইটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ), ২ বছর বয়স থেকেই তাকে মূল্যবোধ শিক্ষা দেবেন এবং সবচাইতে জরুরী যেইটা , তাকে খুউউব ভালো করে বুঝিয়ে দেবেন আপনি তাকে ঠিক কি কারনে ভালোবাসেন, সম্মান করেন।
হ্যা রে ভাই , আপনার সাড়ে তিন বছরের পিচকি পোলা কিংবা হাটতে গেলে উলটে পড়ে ন্যাদা কন্যাকেও একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে । এই জিনিস গুলো তার ভিতরে যে নিরাপত্তা , ভালোবাসা ও আত্মসম্মান বোধের জন্ম দেবে তা থেকেই সে বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে নিজেকে মূল্যবান , তথাকথিত “ সুপার স্টার” বানানোটা দরকারী মনে করবে না ।
সব সময় মনে রাখবেন , যেই মানুষের ভিতরে ইন্টার্নাল ভ্যালু তৈরী হয় না , সে-ই বাহ্যিক বা এক্সটার্নাল জিনিস পত্রের ভিতরে নিজের দাম খুঁজে বেড়ায়, অন্যের মত – অন্যের পথের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ।
এখন কথা হচ্ছে , বাপ মা হয়ে তাকে ঘিরে তো রাখলেন । সামান্য হলেও কি টিভি দেখবে না ? পেপার পড়বে না? বন্ধু বান্ধবের কাছে শুনবে না? কম্পুটার, সিনেমা , গান বাজনা , নাচ পার্টি – প্রভাব তো আসবেই । আগেও বলেছি কর্পোরেট জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো মিডিয়া । পেপার , অধুনা এফ এম রেডিও, কম্পিউটার – ইন্টারনেট , টিভি – সিনেমা; সব খানে সব জায়গায় কর্পোরেট মিডিয়া ভোগবাদিতাকেই উস্কে দিচ্ছে । এইটাকে বন্ধ করা খুবই কঠিন।
আবার এর বিপরীতে এইটাও সত্য যে মুনাফালোভী বেনিয়া পুঁজিবাদ কিন্তু খুব দরকার না পড়লে নতুন চাহিদা তৈরী করার মত খরচ করে না । বরং সমাজের খাঁজে খাঁজে ভাঁজে ভাঁজে লুকানো চাহিদাকে উস্কে দিয়ে কাজ সারে । সুতরাং, সমাজের ঘরে ঘরে পরিবারে পরিবারে আমরা যদি এক লাক্স সুপারস্টার ছাড়া আর কোন পজিটিভ ইমেজ তৈরী না করি , অবধারিত ভাবেই মেয়েরা ঐদিকেই ছুটবে ।
একটু চিন্তা করে দেখেন তো , মেয়েদের অন্য কোন পেশার কোন পজিটিভ ইমেজ কি আমরা রেখেছি ? চলুন দেখা যাক,
১। গৃহবধু – যারা বাইরে কাজ করে না তারা আসলে বোকা সোকা মেধাহীন তাই সারাদিন হাড়িই ঠেলে আর বাচ্চা সামলায় ।
ইন্টারনেট, চেইন মেইল, পত্রিকার ফান পাতা, ব্লগের পোস্ট পোস্টে কেবল বউ যে কত খারাপ আর ষণ্ডা আর গন্ডার আর রাক্ষসী – তারই কেচ্ছা কাহিনী । কার মন চাইবে বধু হইতে?
২। শিক্ষিকা – যার নাই কোন গতি, তার ঝোঁক শিক্ষকতার প্রতি । ইংলিশ মিডিয়াম না হইলে বেতনও খুবই কম।
৩।
ডাক্তার – মানেই কসাই
৪। কর্পোরেটে চাকুরীজীবী – বসের সাথে ঢলাঢলি করে বেড়ায়, সব কয়টা বেশ্যা
৫। জার্নালিস্ট – এই গুলা আবার মেয়ে নাকি , সব তো শি মেইল । দিন নাই , রাত নাই টই টই করে বেড়ায় ।
৬।
গার্মেন্টস কর্মী – গরীব এবং ধর্ষিতা , প্রায়ই হত্যার শিকার ।
মডেল কন্যাদের যে খুব ভালো ইমেজ তা না কিন্তু অন্তত প্রচুর টাকা , প্রচুর খ্যাতি আছে । বাকি পেশা গুলায় মেয়েরা কি এমন পায় যে দলে দলে ছুটবে ? ডাক্তার – ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া বাকিরা পাত্তাও পায় না । ভার্সিটির মেয়েরা নাকি সারাদিন প্রেম করে বেড়ায় । হলের মেয়েরা ভাড়া খাটে ।
মেয়েরা বোকা, মেয়েরা লোভী , মেয়েরা সুবিধাবাদী – কলঙ্কের শেষ নাই। বেয়াব্রু তো বটেই । এত এত নেগেটিভ ইমেজ সমাজ জুড়ে , মেয়েরা লাক্সে ছুটবে না কেন? তারপরেও কর্পোরেট যদি মেয়ে দেখিয়ে আমাদের আকৃষ্ট করতে চায় আমাদেরকেই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হবে , এক্সকিউজ মি , আমরা আকর্ষিত নই, বরং আটারলি ডিসগাস্টেড! ক্রিকেট এর মাঠে চিয়ার লিডারদের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপনের পরে আর কি তারা নেমেছিলো? আমি তো শুনিনি। ঠিক এই মনভাবটাই মিডিয়াতে পৌছানো দরকার।
এখন এই গ্ল্যামার জগতে মেয়েদের জন্য বিকল্প কোন পেশা কি আমরা দিতে পেরেছি? টেকনিকাল পেশা গুলাতে কাজ শেখার সুযোগ দিচ্ছি? আমরা কি পদে পদে বলছি, শরীর নয় মাথা খাটিয়ে এই যে ক্যামেরা, লাইট, এডিটিং, মিক্সিং এর কাজ করো ? সামান্যই!
তারপরেও কথা থাকে , আমরা আসলে কি চাই? মেয়ে মডেল থাকুক কিন্তু খোলামেলা পোশাক বন্ধ হোক? বিজ্ঞাপনে মেয়েরা ব্যবহার বন্ধ হোক? নাকি বিজ্ঞাপনই বন্ধ হোক? যদি উত্তর হয় মেয়েরা মডেল হওয়া বন্ধ হোক, তাহলে মেয়েদের অন্যান্য পেশা গুলোকে সম্মান দিন।
বিভিন্ন মিডিয়াতে সুপারস্টার মা, বউ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার , টিচার, দোকানদার , ব্যবসায়ী ইত্যাদি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করুন। সুপারস্টার বিজ্ঞানী, অংকবিদ, বানান প্রতিযোগিতা করুন। সুপারস্টার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা করুন। আমি নিশ্চিত , মেয়েরা আর মডেলিং এর পিছনে ছুটবে না ।
বিজ্ঞাপনের শক্তিকে , ক্ষমতাকে আমরা পরাভূত করতে নাই পারি, তাকে নিজেদের সুবিধামত নিয়ন্ত্রন , পরিবর্তন কিন্তু করতেই পারি।
আমাদেরই ভাই, বোন, পরিবার , পরিজনেরা মিডিয়াতে কাজ করে । আজকাল ই মেইলে, অনলাইনে , এস এম এসে , ফোনালাপে, রেডিওতে নানান জায়গায় দর্শক শ্রোতাদের মতামত নেয়। টিভিতে প্রচুর টক শো হয়। এই সব কয়টা জায়গায় আমাদের নিজস্ব মতামত, জীবন দর্শন, আদর্শ , ভালো লাগা মন্দ লাগাটা তুলে ধরাটা এখন জরুরী হয়ে গেছে । আমাদের অস্তিত্ত্ই বিপন্ন হয়ে গেছে ।
মিডিয়া হইলো সমদ্রের মত। তাকে সম্পূর্ণ বাঁধতে গেলে সব ভেঙে ঘরে ঢুকবে । বরং তাকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে স্লুইস গেট দিয়ে ( নীতিমালা) ঢুকাতে পারি, নিজেদের পছন্দ মত জলাশয়ে ধরতে পারি ( আমাদের একান্ত নিজস্ব কালচার, প্রাচ্যের জীবন দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অনুষ্ঠান) এবং সেই জলাশয়ে চিংড়ির চাষ ও করতে পারি ( আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার)। যত্র তর নারীদেহ ব্যবহার করে পণ্যের প্রচার করা যাবে না, সেক্স ও সেক্সুয়ালিটিকে উস্কানো যাবে না , বাচ্চাদের জন্য অনৈতিক আচরণ দেখানো যাবে না – এই ধরনের আইন করা জরুরী ।
আর পুঁজিবাদী , মুনাফালোভী, ন্যায় নীতির বালাইহীন কর্পোরেট আগ্রাসনকে যদি ঠেকাতেই হয় তাহলে নির্লোভ- ত্যাগী- সংযমী ও পরিমিত যাপিত জীবনকে আমাদের মিডিয়াতে স্টার স্ট্যাটাস দিতে হবে।
ক্লিশে শোনালেও , আটপৌরে নিয়ন্ত্রিত জীবনের রুপকেই সত্যিকারের আকর্ষনীয় , সেক্সি বলে প্রচার করতে হবে।
আমরা সুপার স্টার সুন্দরী মেয়ে দেখতে চাই না , আমরা সুপার ডুপার “ সাধারণ মানুশ দেখতে চাই”। সুপারস্টার চাষী, জেলে, কামার, কুমোর, শিক্ষক, দেখতে চাই। সুপার স্টার গ্রাম দেখতে চাই। ঘুরে ফিরে সেই একই মুখ ১০ টা টিভি আর ২০টা পত্রিকায় দেখতে চাই না ।
প্রত্যেক ঈদে একই টাড়কা কিভাবে রাধেন, কিভাবে হাগু করেন , পড়তে চাই না ।
টাকার জোরে ভেসে যাওয়া ভারতীয় ও পশ্চিমা মিডিয়ার অনুষ্ঠান মানেই হইলো সেক্স, ভায়োলেন্স, আর নাইলে পরকীয়া আর ভোগবাদিতার ছড়াছড়ি। প্রতিদিন নতুন মেয়ে ( নতুন মাংস) , কড়া মেক আপ, খোলা মেলা পোশাক, অবাধ সেক্স, লাক্সারী লাইফ। এরা এখন আমাদের মিডিয়াকেও বুঝাতে চায় যে পাবলিক আসলে এই সবই খায়। এক জিতেন্দ্রর মেয়ে প্রতি মাসে একটা করে সোপ নামায়।
সোপ কি? পানি পাইলে বুদ উঠে আর ফেনা শুকায় গেলে বুদ বুদ হারায় যায় , পড়ে থাকে ময়লা। হিন্দী সোপ গুলা দেখে মানুষ নতুন কিছুই শেখে না , ন্যায় নীতি বোধ বিবেক হীন কেবল ভোগ ছাড়া। টিভি অফ করার পরে মাথার ভিতরে পড়ে থাকে এই সব ময়লা। আমাদেরকে বাংলাদেশের মিডিয়াকে জোর গলায় জানায় দিতে হবে , আমরা এই সব ময়লা ফেনা খাইতে চাই না। আমরা আমাদের বাউল, সুফী, অল্পে সন্তুষ্ট জীবনের দর্শন দেখতে চাই, খাইতে চাই।
আমাদের বিপরীত মুখি দর্শনকে ঠেলা , ধাক্কা দিয়ে আড়ালে আসসলে নেওয়া যাবে না । বরং এর চাপে আড়াল হয়ে যাওয়া আমাদের নিজস্ব জীবন দর্শনটাও যে সুন্দর সেইটাকে লাইম লাইটে , মেইন স্ট্রিমে আনতে পারি। আমাদের আত্মকেন্দ্রিক ভোগ বিলাসিতা বিরোধী আত্মা ( স্প্রিচুয়াল ) নির্ভর জীবন দর্শনটাকে প্রতিদিন, প্রতিটা মিডিয়াতে বার বার প্রচার করে বলতে পারি এইটাই আসল সুপারস্টার এর লাইফ!
আপনি আমি এখন থেকে , এই মুহুর্তে কি করতে পারি?
শচেয়ে প্রথমে আমরা মিডিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারি। দর্শক শ্রোতা ভোক্তা হিসেবে আমরা আসলেই কি চাই সেইটা তাদের সক্রিয় হয়ে জানাতে পারি।
লেখার মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে, মিডিয়ার লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে পিটিশন পাঠাতে পারি- তোমরা এই রকম প্রচার করিও না বলেই ক্ষান্ত দিলে হবে না, কি রকম প্রচার করলে আমরা গ্রহন করবো সেইটাও জানাতে পারি।
কোন ধরনের মানুষ আমাদের কাছে সত্যিকারের স্টার সেইটা জানিয়ে ঐ ধরনের মানুষকে লাইম্লাইটে আনতে বলতে পারি।
পুঁজিবাদের প্রাণ হইলো চাহিদা আর তার যোগান। বাজারে আমরা আমাদের চাওয়া দিয়ে যেই চাহিদা তৈরী করবো, মিডিয়া সেইটাই যোগান দেবে। আমরা যাদি ভোগ নির্ভর মুনাফার মানসিকতা প্রচারকারী অনুষ্ঠান গুলোর বিরুদ্ধে ৩৮ হাজার ব্লগার নিয়মিত মেইল, এস এম এস, ফোন করি, আজ হোক কাল হোক মিডিয়াকে আমাদের কথা শুনতেই হবে।
এই মিডিয়া বা কর্পোরেট পুঁজিবাদের ফ্যাক্টর গুলো আসলে বিষের মত।
স্বল্প ব্যবহারে ওষুধের কাজ করতে পারে , অনিয়ন্ত্রিত হলেই মরণ। অনেকেই প্রশ্ন রেখেছেন , আমরা কি কর্পোরেট পুঁজিবাদকে গ্রহন করবো না বর্জন ?
আমি বলবো , আমরা এর আগ্রাসন বন্ধ করতে পারবো না , কিন্তু নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রন করতে পারবো, বদলে নিতে পারবো। এর নিজস্ব হাতিয়ার মিডিয়াকে নিজেদের সংস্কৃতি ও জীবনদর্শনের প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো।
কর্পোরেট পুঁজিবাদের যে মূল স্ট্র্যাটেজি – গ্রোথ বা বৃদ্ধির মাধ্যমে বেঁচে থাকা- সেই বৃদ্ধিই এর পতন ঘটাবে । ৬ বিলিওনের পরে তো আর বাজার/ক্রেতা নেই।
তাই একে এক সময় থামতেই হবে। বেচা বিক্রির গ্রোথ বন্ধ হলে তখন শুরু হবে ভাঙন আর পতন। আজকে যারা মাল্টিন্যাশনালের গর্বিত কর্মী তারাই হয়ত খাবার আর পানির জন্য লড়বে।
সুতরাং,
যারা সুন্দরী প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে চান তারা নিজেদের বাচ্চাদের এখন থেকেই শিক্ষা দিন আর মিডিয়াতে বিপরীতধর্মী অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন, ব্যবসার চাহিদা তৈরী করুন।
আর যারা শেষ বিচারে সবার শেষে মরতে চান, তারা আর যাই করেন, আমার কাছে আপনার গরুটাকে বিক্রি কইরেন না, কোন অবস্থাতেই না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।