'আমা পানে চাও, ফিরিয়া দাঁড়াও, নয়ন ভরিয়া দেখি'
১.
আমাদের দেশে অনেক মানুষের শুভবুদ্ধির অভাব রয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই নেই বুদ্ধিজীবীর অভাব। তাই ভেবেছিলাম কোথাও না কোথাও এরই মধ্যে কোন একদিন কোন এক বুদ্ধিজীবী বিষয়টি লিখে ফেলবেন। অথবা আজকালকার টকশোতে বসে বলে ফেলবেন। আমি মনে করেছিলাম এই বিষয়টা তাঁদের চোখে পড়বে।
কিন্তু পড়লো না! তাঁরা লিখলেন না, বললেনও না। বিষয়টা তেমন কিছুই নয়, আমাদের দেশের সাংবাদিকদের পরিস্থিতি নিয়ে আর কী।
আমাদের দেশের সাংবাদিকরা এখন সুস্পষ্ট দুই দলে বিভক্ত। দলের ভেতর নানা উপ-দল, প্রতিদল, পাল্টা দল রয়ে গেছে। তবে মূল ধারা দু'টি এবং আবশ্যিকভাবে আগামী দিনে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের গন্তব্য নির্ধারণ করার জন্য আমাদের দেশের জনগণের বর্তমান সময়টাকে বুঝে ফেলা ভীষণ জরুরি।
আমার চোখে, এখন থেকেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একটি বড় ধরনের লড়াই শুরু হলো। বসুন্ধরার সাংবাদিক ভার্সাস বাইরের সাংবাদিক।
বসুন্ধরা বাংলাদেশের একটি বড় শিল্পগ্রুপ। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান পর্যবেক্ষণ আমাদের ধারনা দেয় এদের অগাধ টাকা রয়েছে। কতো টাকা- এ বিষয়ে ধারনা করতে দিলে আমাদের দেশের ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষ সম্ভবতঃ ধারনা করতেও ভয় পাবেন! উভয়ের টক্করবাজির কালে আমরা দেখেছি, যমুনা গ্রুপের যুগান্তরে বসুন্ধরার বুড়ো, আন্ডা-বাচ্চাদের নিয়ে যা ছাপা হয়েছে, তাতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকার কথা নয়।
বসুন্ধরা মানেই তাই এক ধরনের গডফাদার বা মাফিয়া পরিবারের বাংলা সংস্করণ বলেই মনে হয়।
সেই বসুন্ধরার টাকায় একটি খবরের কাগজ বেরিয়েছে। তার নাম কালের কণ্ঠ। বাংলাদেশে `টাকা হলেই সংবাদপত্র বের করা'র মিছিলে কনিষ্ঠ সংযোজন কালের কণ্ঠ ইতিমধ্যে দেশের এক নম্বর প্রচারসংখ্যার কাগজটিকে পেরিয়ে যেতে প্রাণপাত করছে। কালের কণ্ঠের আগে আমাদের দেশে গুণবান সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খানের দুই টাকার কাগজ আমাদের সময়, বিএনপি নেতা ফালুর আমার দেশ, হামীম গ্রুপের সমকাল, জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের নয়া দিগন্ত, যমুনা গ্রুপ ও বাবুল-সালমা দম্পতির যুগান্তর বেরিয়েছে।
তারও আগে বেরিয়ে গেছে ভোরের কাগজ ভেঙে 'বড় বাজেট' নিয়ে করতে যাওয়া একদা একতার নেতা মতিউর রহমানের প্রথম আলো, যার টাকা ঢাললেন লতিফুর রহমান আর মধ্যস্থতা করলেন মাহফুজ আনাম। এসবই পুরনো কথা। প্রথম আলো যখন বাজারে আসে তারপর থেকে সবার আগে যে কাজটি তারা করে, সেটি হলো ফিচারের নামে পাক্ষিক, সাপ্তাহিকের সমস্ত স্বাদ দৈনিকের ভেতরে ঢুকিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরশীল প্যাকেজে পরিণত করা। এর একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিলো একক বাজার প্রতিষ্ঠা। একক বাজারের সবচে বড় সুবিধা হলো, একবার বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, তখন খবরের কাগজ আর শুধু খবরের কাগজ থাকে না! সে রীতিমতো বাইবেল হয়ে ওঠে! অনায়াসেই অতি দক্ষতার সঙ্গে সে মানুষের সম্মতি উৎপাদন করে।
মানুষকে সুশীল হতে শেখায়, জরীপের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে শেখায়। প্রথম আলোর পর অন্য যে কাগজগুলো বের হয়, সেগুলো কেবলমাত্র ওই বড় কাগজটিরই কাট-কপি-পেস্ট। অনুসরণে অতিমাত্রায় দক্ষ জনপ্রিয় সম্পাদক গোলাম সারওয়ার যুগান্তর বা সমকালকে বড় কাগজটির পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতেই যেন পছন্দ করলেন। কিন্তু বাজারের ক্ষেত্র আগ্রাসন এই দুই কাগজের কম থাকা, সম্মতি উৎপাদনে সুচতুর ও কুশলী না হওয়া এবং গোলাম সারওয়ারের টানাহেঁচরার কারণে বিদ্যমান অস্থিরতা এই দুই কাগজকে তথাকথিত মানসম্পন্ন হতে দেয় নি। ফলটা হচ্ছে, সারা জীবনেও দেড় লাখের ওপরে দুই কাগজের সার্কুলেশন উঠতে পারে নি।
প্রথম আলো সাড়ে ৪ লাখ ছুঁয়ে গেছে। আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাজার সেই প্রথম আলোরই দখলে। অতএব তারাই রাজা!
তাদের রাজত্ব দূর করার স্বপ্ন নিয়েই বাজারে কালের কণ্ঠকে নামিয়েছে বসুন্ধরা। আমরা যারা প্রথম আলোর 'অত্যাচারে' ত্যক্ত বিরক্ত, যুগান্তরের রক্তের হোলিখেলা পৃষ্ঠাসজ্জায় অসহায় কিংবা সমকালের অতি সরকার ঘনিষ্ঠ হবার প্রচেষ্টায় ক্ষুব্ধ, তাদের জন্য কালের কণ্ঠ সাদা চোখে আশীর্বাদই বটে! বসুন্ধরা কাগজটি বাজারে আনার আগেই বুঝে নেয়, পুরনো দিনের স্টাইলে বাজারে খবরদারি করার দিন শেষ। পৃষ্ঠা বেশি, ফিচার বেশি, নিজের পরিবহন, এজেন্টদের ঘুষ, হকারদের উপহার, অতিরিক্ত কমিশন ইত্যাদির পেছনে বেসুমার খরচ করেও শেষ বেলায় মিডিয়া কিং হতে গেলে শুধু কালের কণ্ঠ থাকলে চলবে না।
একদিন প্রথম আলো যেমন অন্য সব দৈনিককে, এমনকি সাপ্তাহিক পাক্ষিকেরও বাজার দখল করে নিয়েছিলো, তেমনি আজ বসুন্ধরাও চাইছে সেভাবেই মিডিয়ায় একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে।
বসুন্ধরার এই তৎপরতার পেছনের কারণ খুঁজতে হলে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সরকারগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তার পরিস্থিতি কী ছিলো সেদিকে একটু নজর দিতে হবে। নিশ্চিতভাবেই নিজের মিডিয়া থাকলে বসুন্ধরা অনায়াসেই এইসব সংকট পারি দিতে পারতো! এখানে বলে রাখি, বসুন্ধরার টাকা ঢাকার অনেক বড় বড় সংবাদপত্রচাঁইদের পেটে রয়েছে বলে বসুন্ধরার কর্ণধাররা ঘনিষ্ঠ মহলে প্রায়ই বলেন। এনজিওআলা সম্পাদক বলে পরিচিত একজন তো ঠেকা বেঠেকায় বসুন্ধরার কাছে নাকি হাত পেতেই থাকেন। আবার দীর্ঘদিন ধরে বেয়ায়েত সাহেবের ভোরের ডাকও চালাচ্ছে বসুন্ধরা।
নতুন প্রেস কেনা হয়ছে তাদেরই টাকায়। ঢাকা শহরে ভোরের ডাকের যত বিলবোর্ড দেখা যায়, সব ওই বসুন্ধরার টাকায়। কিন্তু এতোকিছুর পরেও মিডিয়ায় একক বাজার তাদের পাওয়া হয় নি। তাই এবার তারা হাঁটছে সে পথেই।
শুধু কালের কণ্ঠেই ক্ষান্ত নয়।
বসুন্ধরা ইংরেজি কাগজ বের করবে। হাসান শাহরিয়ার সেটার সম্পাদক। ডিআরইউ'র সাবেক সভাপতি বিডি নিউজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আলমগীর হোসেন বসুন্ধরার টাকায় করবেন অনলাইন দৈনিক। বসুন্ধরা তাকে সেই অনলাইন দৈনিকের সম্পাদক করেছে। একটি ডিপ্লোম্যাটিক জার্নাল বের করছে।
অচিরে টেলিভিশন চালুরও চিন্তা চলছে। আর ভোরের ডাকটাকে পুরোপুরি কিনে নিয়ে সাজাহান সরদারকে সেটার দায়িত্ব দিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। ৮ টাকার কাগজ বললে কালের কণ্ঠ, কম টাকার কাগজ বললে ভোরের ডাক, অনলাইনে খবর পড়লে তারাই- এভাবে সবখানে যেন বসুন্ধরাই থাকে তার প্রস্তুতি ভালোই নিয়েছে তারা।
সবগুলো মিডিয়া প্রকল্পে বেসুমার টাকা ঢালছে বসুন্ধরা। সাংবাদিকদের জনে জনে গাড়ি দিয়েছে।
আরও দেবে। বেতন হয়েছে দ্বিগুণ, তিনগুণ। আবেদ খান, ইমদাদুল হক মিলন, অমিত হাবিব, মোস্তফা কামাল, তৌহিদুর রহমান, মোস্তফা মামুন, মুনীর রানা, মুস্তাফিজ শফি, প্রবীর সিকদারের মতো সাংবাদিকেরা এখন বসুন্ধরায়।
আমাদের সংবাদপত্রেও কালের কণ্ঠের হাত ধরেই সর্বকালের সবচে বেশি অর্থ লগ্ন হলো। কিন্তু এর মাধ্যমে নতুন সংকটও শুরু হলো।
প্রথম আলোর বাইরে যে সাংবাদিকরা সবচে বেশি প্রতিভাবান এবং কর্মক্ষম তাদের জড়ো করার জন্য তাদের প্রত্যককে বসুন্ধরা যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা দিয়েছে, পরিস্কারভাবেই আগামী এক যুগেও এতো বড় বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কম। কারণ কালের কণ্ঠ যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, তাতে এভাবে চললে তাদের ব্রেক ইভেনে (না লাভ না ক্ষতি) পৌঁছতে কমপক্ষে ১৪ বছর লাগবে এবং ওই সময় শেষে তাদের মোট বিনিয়োগ ৭০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে! এই পুরোটা সময়ই কালের কণ্ঠকে নির্ভর করতে হবে সরাসরি বসুন্ধরার ওপর। প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিডিয়া দাঁড়াতে না পারলে সবচে বড় সংকটে পড়ে এর সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান। (যদিও প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়ানোর পরেও সম্পাদকের স্বৈরাচারি হয়ে ওঠার নজির এদেশেই রয়েছে। তবে সেখানে কাজের পরিবেশ কম ক্ষুণ্ন হয়।
) তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে, তা হলো, এই দীর্ঘ সময়ে এতো বড় বিনিয়োগে কেউ সাহস যদি না দেখায়, তাহলে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের মেরুদন্ড থাক আর যাক, এতো সুযোগ সুবিধা নিয়ে এই প্রতিভাবান সাংবাদিকেরা অন্যত্র গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বিপদে পড়বেন।
প্রিয় পাঠক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার পথে যে ধাপগুলো ছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলো একলাফে কয়েকশ গুণ বেশি বিনিয়োগ। ১৮৫১ সালে নিউ ইয়র্কে একটা নতুন কাগজ বের করতে ৬৯ হাজার ডলার (ব্রেক ইভেন পর্যন্ত) লাগতো। ১৯২০ সালে এই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৬ থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশেও কিন্তু ঠিক এমনটিই ঘটেছে।
গরীবদের কাছে সুদের বিনিময়ে ঋণ পৌছে দেয়া নোবেল জয়ী মোহাম্মদ ইউনুসকে দিয়ে প্রথম পাতায় যতোই সামাজিক ব্যবসার কথা লিখে নেয়া যাক, বসুন্ধরা যে 'সামাজিক ব্যবসা' করতে এতো টাকা ঢালছে না, তা নিশ্চিত। আবার যে টাকা ঢালা হচ্ছে তা কতোদিনে উঠে আসবে কেউ জানে না। তাহলে এখানে ব্যবসাটা কোথায়? মিডিয়া ব্যবসার মাধ্যমে কেবল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কি? প্রথম আলো যা ভদ্রোচিতভাবে বা কৌশলে করেছিলো, কালের কণ্ঠ দিয়ে বসুন্ধরা কি তা উগ্রভাবেই করবে? এছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য তো বোঝা যাচ্ছে না। কষ্ট শুধু এটুকুই, দেশের সবচে প্রতিভাবান ও কর্মক্ষম সাংবাদিকেরা এভাবে বিপরীতে দাঁড় বাওয়া ভুলে পুঁজির করিকাঠে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তারা বলি হবার জন্য নিজেদের অজান্তেই কি অপেক্ষা করছেন?
বলির অপেক্ষার বাইরে 'অপেক্ষাকৃত কম প্রতিভাবান' যে সাংবাদিকেরা থেকে গেছেন, তারা কি মিডিয়ার এই সর্বনাশ থামাতে কিছু একটা করবেন?
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।