ওইদিন ফেসবুকে এক বান্ধবীর স্টেটাস দেখলাম এই লাইনটা। মনে পড়ে গেল লাল বাসের সাথে জড়ানো আমার ছয় বছরের কত না মধুর স্মৃতি!
ভার্সিটিতে যেদিন ভর্তি হতে গেলাম, আব্বু বলল তোদের তো আলাদা গাড়ি আছে, জানিস? আমি জানতাম না। আব্বুর সাথে ডিপোতে গেলাম সিডিউল জানার জন্য। গিয়ে তো অবাক। একেকটা বাসের দেখি একেক রকম নাম।
আর নামগুলোও কি সুন্দর! বৈশাখী, চৈতালি, শ্রাবণ, হেমন্ত, ফাল্গুন, মৈত্রী, উল্লাস, ক্ষণিকা......আর যখন জানলাম আমার বাসের নাম ক্ষণিকা, তখনতো এত ভাল লাগছিল! নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছিল শুনেই। প্রথম ক্লাসের দিন আব্বুর সাথেই গেলাম আমাদের স্টপেজে। শুরু হল যাত্রা। আর প্রেমে পড়ে গেলাম লাল বাসটার!
কখনো কোন কারণে যাওয়া বা আসার পথে আমরা চাইতাম না ভার্সিটির বাস মিস করতে। কোন সকালে বাস মিস হলে মেজাজ এত খিচড়ে যেতো, মনে হতো যে পুরো দিনটাই মাটি।
কারণ প্রচন্ড ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হলেও ভার্সিটির বাসের হাজারটা সুবিধা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা ছিল নিরাপত্তা যেটা পাবলিক বাসে পাওয়া যেতো না আর সময়ও অনেক কম লাগতো। আর একসাথে সবাই মিলে হইচই করতে করতে যাওয়া.....এটা অন্য কোথাও পাওয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না।
প্রথমদিন ফেরার পথে দশ মিনিট আগে যেয়ে দেখি কোন সিট খালি নাই, সবাই ব্যাগ বা আইডি কার্ড দিয়ে জায়গা রেখেছে। মাঝামাঝি এক সিটে এক ছেলে বসেছিল একা।
গিয়ে খুব ভাল মানুষের মত জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাইয়া এখানে বসা যাবে?' সে সব দাঁত বের করে বলল, 'এটা তো ছেলেদের সিট!' শিখলাম দুইটা জিনিস, সিট পেতে হলে আগেই জায়গা রাখতে হবে আর বাসের অর্ধেক ছেলেদের অর্ধেক মেয়েদের। এরপর আর ভুল হয়নি কখনো।
বাসে ঘুমানোর অভ্যাস ভার্সিটির বাসে চড়েই হয়েছে। সিট পেলেই দিতাম ঘুম। এক ঘুমে কখনো কখনো আমার স্টপেজও পার হয়ে যেতো।
ভাগ্যিস কোনদিন গাজীপুর পর্যন্তই চলে যাইনি।
বাসে বেশিরভাগ সময়ই প্রচন্ড ভিড় হতো। কখনো এমন হতো বসার জায়গা পাওয়া দূরে থাক দাঁড়ানোর জায়গাই পাওয়া যাচ্ছে না। এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে এসেছি পুরো পথ। একদিন এক আপু ভিড়ের মধ্যে ওড়না রেখে নেমে গিয়েছিল, আরেকদিন বাসায় ফিরে দেখি আমার চুলে কাল ক্লিপ-অথচ স্পষ্ট মনে আছে ওই দিন আমি কোন ক্লিপ লাগাইনি চুলে, এইরকম আরো কত কাহিনী যে হতো! মাঝে মাঝে ডাবল ডেকারে জায়গা হতো না, মেয়েরা সব দরজার কাছেই ভিড় করে থাকতো, সামনের দিকে খালি থাকলেও অনেকে উঠতে পারতো না।
মামা করতো কি একটুখানি টান দিয়েই একটা হার্ড ব্রেক করতো। মুড়ির টিনে যেমন ঝাকানি দিয়ে আরেকটু মুড়ির জন্য জায়গা করা হয় ঠিক ওইরকম মেয়েরা সামনে চলে আসতো আর একটুখানি জায়গা হয়ে যেতো। আরো কয়েকজন উঠতে পারতো। পরে অবশ্য আপুরা মামাকে ঝাড়ি দিয়েছিল এইরকম করার জন্য। একদিন প্রচন্ড ভিড়ে কোনরকমে ঝুলে আছি ডাবল ডেকারে...সামনে সিটে দেখি এক মেয়ে বই পড়ছে, জাফর ইকবালের 'আধ ডজন স্কুল', আমিও গলা বাড়িয়ে দিয়ে পড়া শুরু করেছি, সে যখন আর পড়বে না ঠিক করে রেখে দিল বইটা আমি তার কাছ থেকে নিয়ে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই নামার আগ পর্যন্ত পড়ে গেলাম...মজাই লাগছিল।
আরেকদিন ফেরার পথে বনানীতে আমাদের বাসের পাশে পাশে একটা টেম্পু ভর্তি কলা নিয়ে যাচ্ছিল। এক টেক্সি ক্যাবওয়ালা এক আঁটি কলা মেরে দেয়ার ফন্দিতে টেনে বের করতেই বাস থেকে ছেলেরা সব চিতকার শুরু করল। বেচারা আর কি করে, ফেরত দিল কলা। কিন্তু টেম্পুওয়ালা মজা পেয়ে কলার আঁটি হেল্পার মামার কাছে দিয়ে দিল। যখনই সামনে দিয়ে মেয়েরা নামছিল মামা সবাইকে একটা একটা করে কলা দিচ্ছিল।
কিন্তু আফসোস উত্তরা আসতে আসতে কলা শেষ...আমি আর পেলাম না একদিন ক্ষণিকার ডাবল ডেকারটা নষ্ট, রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, বাস আর আসে না। চৈতালির ডাবল ডেকারটা ক্ষণিকার হয়ে প্রক্সি ট্রিপ দিতে আসল রোকেয়া হলের উল্টোদিকে। সবাই হই হই করে গিয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি বুঝি নাই। বাস যখন চলে গেল তখন বুঝতে পারছি এটা উত্তরায় যাচ্ছে।
মন খারাপ করে শাহবাগের দিকে রিক্সা নিলাম। রিক্সাওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, 'আপা একটা কথা বলি? এই যে বাসগুলা যায় এইগুলাতে ভাড়া লাগে না?' আমি বললাম, 'না, লাগে না'। রিক্সাওয়ালা তখন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, 'অ, এরজন্যই'। এরজন্যই এই যুদ্ধ। উফফ, কি বুঝদার
যেমন ক্লাসমেট, ব্যাচমেট বা রুমমেট থাকে তেমনি আমার ছিল অনেক বাসমেট।
চারুকলার হ্যাপী আপু, অনেক মিষ্টি আর ভাল একটা মানুষ, যার হাসি শুনলেই দরজা থেকে বোঝা যেতো যে সে আছে; রুমি; কোন এক বিচিত্র কারনে যে আমাকে ভীষণ পছন্দ করতো; রোজি আপু, টুকটুকে ফর্সা আপুটা আর আঁকাবাকা দাঁতের হাসিটা যে কি মিষ্টি; মুক্তা আপু, কঙ্কালসার কিন্তু খুবই মায়াবতী একটা আপু; লাইজু আপু, ল’তে পড়তেন, এত ধারাল চেহারা আর অসম্ভব ব্যক্তিত্ব আমি খুব কম মানুষেরই দেখেছি; আর আমার ব্যাচের কয়েকজন-আমি, কেয়া, মর্জিনা, মারুফা, মিনু, মুন্নি...আমরা একসাথে হলে তো মনে হতো বাসের ছাদই উড়ে যাবে। কে কোথায় কি করল না করল তাই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা আর পচানি আর হা হা হি হি।
বাসের মামারাও ছিল একেকজন একেকরকম। মহসিন মামা, সকালে গাজীপুর থেকে আসতো। উনি ছিল ভয়াবহ মুডি একটা লোক।
প্রায়ই দেখা যেতো কোন কারণে রেগে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। এবং উনার বাস আর কারো ধরারও পারমিসন ছিল না যে প্রক্সি হিসেবে ট্রিপটা চালু রাখবে। সকাল সাতটার বাসের মামাটার নাম ভুলে গেছি। উনি একটু বয়স্ক, চুপচাপ, ভাল মানুষ টাইপের ছিল। আর বাসটাও ছিল লক্কর-ঝক্কর মার্কা।
প্রায়ই নষ্ট হয়ে যেতো, বৃষ্টি হলে ছাদ দিয়ে টুপটাপ পানি পড়তো...একদিন ফ্লাইওভার দিয়ে উঠার সময় বাসের তো খুবই কাহিল অবস্থা। নে হচ্ছিল পিছলেই পড়ে যাবে। এক আপু জিজ্ঞেস করল, 'মামা বাসের এই অবস্থা কেন?' তখন মামা বলল, 'আমি যেমন বুড়া আমার বাসও তেমন বুড়া, কোন জোরবল নাই। ' আর ছিল 'রাফ এন্ড টাফ' বজলু মামা, ডাবল ডেকারকে যে রেসিং কার মনে করতো। যখন মহাখালীর ফ্লাইওভারে বাস চলার অনুমতি দেয়নি তখনও মামা ডাবল ডেকার নিয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে উড়ে চলে যেতো।
হ্যাপী আপু, রোজি আপু আর মুক্তা আপু তিনজনে মিলে মামাকে নিয়ে ব্যাপক টানাটানি করতো!
শ্রাবণ বাসের মামা তো মামা বললে ভীষণ মাইন্ড করতো। সে তার সিটের পিছনে বড় করে নোটিস টানিয়েছিল 'আমাকে মামা বলবেন না। দয়া করে নাম বা পদবী ধরে ডাকুন'।
ভার্সিটির বাস চালায় বলে মামারা নিজেদের বিশাল কিছু মনে করতো। রাস্তায় একেবারে রাজার হালে কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে বাস চালাতো।
হোক সেটা রঙ সাইড অথবা অন্যায় কিছু। জানি ঠিক না কিন্তু খুবই মজা পেতাম সন্দেহ নাই। এমনি কত মজার মজার স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে ভার্সিটির লাল বাসটাকে ঘিরে!
যখন ভার্সিটির পাট চুকে গেল, আইডি কার্ড ফেরত দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভার্সিটির বাসকে বিদায় জানালাম, পাবলিক বাসে চড়তে খুবই কষ্ট হতো তখন। আমার এক বাসমেটের অফিস একই রুটে, একই বাসে যাই, যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। একদিন সকালে যাচ্ছি, সামনের সিটে বসেছে আমার বাসমেট।
পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের ডাবল ডেকারটা। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, 'এই দেখো, ভার্সিটির বাস'। একটুখানি হাসলাম। উদাস হয়ে গেল মন।
"হায়রে ভার্সিটির লাল বাস.....রইলো না মোর বাদুড় ঝোলার দিনগুলি....."
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।