আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পল্টনে পল্টি: বিএনপি কার্যালয়



কাকরাইল মোড় থেকে নয়া পণ্টনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অফিসের দিকে ফুটপাত ধরে হেটে যেতে যেতে যে কারোরই মনে হতে পারে একটু আগেই এখানে হয়তো এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে মোটেও তা নয়। নয়া-পল্টনের আশেপাশের গাড়ির শো-রুমগুলোতে মোটর গাড়ির øান পর্বের ধারাবাহিকতাই ফুটপাতকে অবিরত পানির ধারায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমন বৃষ্টিহীন বন্যা পার হয়ে স্যান্ডেলে খানিকটা কাদা মেখে হেটে হেটে আরেকটু সামনে যেতেই সামনে পেয়ে গেলাম বিএনপির নয়া পণ্টনের কার্যালয়। কার্যালয়ের প্রধান গেটের দু’পাশে বিস্কুটের প্যাকেটের মতো পার্ক করা আছে সারি সারি প্রাইভেট কার।

আর গেটের একেবারে সামনের জায়গাটা দখল করে দাড়িয়ে আছে তিনটি মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলগুলোর স্টার্ট বন্ধ থাকলেও সাইকেলের উপরে আরোহীর অভাব নেই। তিনটি মোটর সাইকেলের উপরেই তিনজন আরোহী বসে আছে। প্রথমজন সানগ্লাস চোখে দিয়ে বসে আছে। কানে সেলফোন ধরা।

কথা বলেছে কি বলছে না ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। দ্বিতীয়জন সিগারেটের ধোঁয়ায় দুপুরবেলায় শীতকালীন অস্বাস্থ্যকর কুয়াশা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তৃতীয়জনের মুখে কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আজীবন মোটর সাইকেলের উপর বসে থাকতে বললেও তার কোন আপত্তি থাকবে না। কার্যালয়ের মূল গেটের বাম পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।

আপনি চাইলেও এই চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা খেতে পারবেন না। কারণ সেখানে কাস্টেমারদের বসার জন্য কোন বেঞ্চ নেই। কার্যালয়ের ডান পাশে আরো দুটি সিগারেটের দোকান থাকলেও চা খেতে চাইলে আপনাকে ওই দোকানেই আসতে হবে। চায়ের দোকানের বিক্রেতার নাম আলমগীর। তার চুল কোঁকড়া ধরণের।

দশটি চায়ের কাপ নিয়ে তার ব্যাস্ততা চরম। দিনে কত হাজার কাপ চা তাকে বানাতে সেটা তিনি স্পষ্টভাবে জানাতে পারলেন না। এই চায়ের দোকানের পাশেই রয়েছে একটি ওপেন এয়ার ফোন আর মোবাইলের ব্যালেন্স রিচার্জের দোকান। কিন্তু সেখানে কোন দোকানদার দেখতে পেলাম না। অবশ্য রিচার্জের খাতা পত্র সবই খোলা আছে।

কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই নজরে পড়লো না। কার্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রকমের মানুষ। কেউ চাদর আবার কেউবা কোট পরে দাড়িয়ে আছে। গেটের একটু ভেতরে বাম পাশে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ারে এক বুড়ো চাচা আর এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসে থাকতে দেখা গেল । তারা দুজনে কি বিষয়ে নিয়ে ফিসফিস করে যেন আলাপ করছিলেন।

মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের হাতে একটা ওয়াকি-টকি । ওয়াকি-টকি থেকে একটু পর পর র্ঘর্ঘ ধরণের আওয়াজ বের হয়ে আসছিল কিন্তু তাতে করে তাদের গল্পের কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল না। এই সময় কার্যালয়ের ভেতর থেকে বেশ লম্বা ধরনের একজন মোটা গোঁফধারী হোমড়াচোমড়া বের হয়ে এলেন। তার পেছন আরো অনেক লোকজন। গোঁফধারী বেড়িয়ে আসতেই আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই সালাম দিতে শুর’ু করলেন।

গোঁফধারী তার লোকজন নিয়ে বের হয়ে যেতেই কার্যালয়ের সামনের দিকটা একটু ফাঁকা হয়ে গেল। এই সুযোগে আমি ভেতরে ঢুকে পরলাম। একটু ভেতরের দিকে যেতেই চোখে পরলো দুটি দরজা। একটি তালাবদ্ধ আর একটি খোলা। খোলা দরজায় চোখ রাখতেই দেখতে পেলাম সেখানে পার্টির লোকজন চেয়ারে বসে মিটিং টাইপ কিছু একটা করে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে সেখান থেকে একদল বের হয়ে আসছে আবার কখনো আরেকদল গিয়ে চেয়ারে বসে পরছে। এর মাঝে মাথায় উলের টুপি পরা একজন এসে তালবদ্ধ দরজার তালা খুলতে শুর’ করতেই ভেতরে কি আছে দেখার জন্য আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু আমাকে সেটা দেখার সুযোগ না দিয়েই লোকটা চট করে দরজা বন্ধ করে দিল। কি আছে ওই দরজার ওপাশে! তালাবদ্ধ করে রাখা দরজার পাশেই দেয়ালের একটা অংশ ভেঙ্গে পরে আছে। এই অংশটা ভাঙা কেন প্রথমে ঠিক বোঝা না গেলেও পরে খেয়াল করতেই দেখতে পেলাম একজন প্যান্টের চেইন আটকাতে আটাকাতে ভাঙ্গা অংশ দিয়ে বেড়িয়ে আসছে।

তখনই এই ইট খসানো অংশের মূল্য এবং মূল্যায়নটা আমি বুঝে নিলাম। নয়া পল্টনের এই বিএনপি অফিসে ঢুকলেই চোখে পরে যাবে এখানে সেখানে পরে আছে সিগারেটের পোড়া ফিল্টার, ম্যাচের কাঠি, বাদামের খোসা, ধুলোবালি সহ আরো অনেক কিছু। বেশ কিছু পুরোনো ভাঙ্গা শো-কেস আর সিগারেটের দোকানের অংশ বিশেষ পরিত্যাক্ত অবস্থায় পরে আছে এপাশে-ওপাশে। মোটামুটি অফিসের পরিবেশটাকে নোংরা বলেই চালিয়ে দেয়া যায়। কার্যালয়ের ভেতরের চারপাশের দেয়ালে পোস্টারের এমন অবস্থা যে প্লাস্টার করার কোন দরকার হয়নি।

পোস্টার দিয়েই প্লাস্টার করা হয়ে গেছে। এত পোস্টারের ভীড়ে তারেক রহমান, বাবর, মির্জা আব্বাসের স্থিরচিত্রই চোখে বেশি পড়ে। আমান উল্লাহ আমানের হাসিমাখা ছবিরও কমতি নেই। কার্যালয়ের গেটের ডানপাশে ঢোকার মুখেই রয়েছে একটি সিএনজি অটোরিক্সা আকৃতির সাঁেজায়া ট্যাংক। ট্যাংকের পেছনেই প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিল চারজন পুলিশ।

এদের মধ্যে একজন তার মোবাইলের গেমস খেলা নিয়ে ভীষণ মাত্রায় ব্যাস্ত। আশেপাশে তার বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। পাশ দিয়ে কেউ রাইফেল নিয়ে হেটে গেলেও টের পাবে বলে মনে হচ্ছিল না। তার পাশে বসে আরেক পুলিশ দুটি মোবাইল নিয়ে আরও ব্যাস্ত! উনি এক মোবাইল থেকে আরেক মোবাইলে ভিডিও গান ইনফ্রারেড দিয়ে নেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেটা কোন এক যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে হচ্ছিল না বলে তাকে খুবই বিরক্ত ভঙ্গিতে দেখা যাচ্ছিল।

এদিকে আরেকজন বসে বসে পাশের দু’জনের মোবাইলের কার্যক্রম পর্যবেকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। শেষজন খবরপত্র পত্রিকায় তার মুখ আড়াল করে বসে আছেন। আর পায়ের কাছে রাখা একটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল। মাঝে মাঝে তিনি পড়া থামিয়ে পানি খাচ্ছিলেন। হয়তোবা খবর পড়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল বলেই।

মূল গেটের বাইরে কার্যালয়ের আরেকটি পথ আছে। মাঝে মাঝে সেখানে ঢুকে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছিলেন কেউ কেউ। আমিও তাদের পেছনে পেছনে ঢুকতে গিয়ে দেখি প্রবেশপথের ডানপাশেই সেই বিখ্যাত হাফহাতা গেঞ্জি পরে মাটির উপরে বসে আছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। পাশে পরে আছে একটা মাটি কেটে বহন করে নিয়ে যাবার ঝুড়ি। তার হাতে একটি রিস্টওয়াচ।

কিন্তু রিস্টওয়াচের কোন ডায়াল না থাকায় কার ঘড়িতে কয়টা বাজে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু ভাস্কর্যটির যে বারোটা বেজে গেছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার ভাস্কর্য তারই অফিসের পাশে এমন অবহেলায় কি করে পরে থাকে! হয়তো এরকম ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। জিয়াউর রহমানের রুপালি রঙের এই ভাস্কর্যটির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। ভাস্কর্যের বাম চোখের নিচের অংশের দিক থেকে কিছুটা রং চটে গেছে।

নিচের অংশেও জমে আছে প্রচুর ধুলোবালি। ভাস্কর্যটির এমন করুণ দশায় থাকলেও উপরে রয়েছে মান্ধাতা আমলের একটি সিলিংফ্যান। ফ্যানটা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির জন্যই কিনা কে জানে! অফিসের সামনেই রয়েছে কিছু ভ্রাম্যমান খাবারের দোকান। নিউ বার্গার কিং নামের একটি দোকানে বিক্রি ১৮ টাকা মূল্যের কিং বার্গার। দোকানের সামনে বেশ ভীড়।

বোঝা যাচ্ছিল এটাই এখানকার হট আইটেম। পাশেই রয়েছে বাদাম-ছোলা আর ভেলপুরির ভ্রাম্যমান আয়োজন। সেখানেও ভালোই বিক্রি চলছে। একটু পর দেখি, জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে বেশ কয়েকজন। তাদেরই মধ্যে একজন ভাস্কর্যটিকে পেছনে রেখে তার উপর একটা পা তুলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের সাথে বেশ হাসিমুখে গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন।

নিজেদের আদর্শের উপর পা তুলে এভাবে কেউ কখনো কোথাও দাঁড়াতে পেরেছে কি-না আমার জানা নেই। অফিসের মূল অংশে শেষপাক দিয়ে ঘুরে বের হয়ে আসার সময় চোখে আটকে গেল আরেকটা দৃশ্যে। নয়া পল্টনের বিএনপি কার্যালয়ের বামপাশে অফিসের সাথেই রয়েছে পার্টির নেতা-নেত্রীদের ছবি সম্বলিত বিভিন্ন পোস্টার, লোগো, স্টিকার আর তাদের কার্যক্রম সর্ম্পকিত ক্যাসেট আর সিডির দোকান। দোকানের ডিসপ্লেতে একটি সিডির কাভারে লেখা, রাজনীতিতে বিএনপি নেত্রীর আপোসহীনতা। তার পাশেই ঝুলে থাকা আরেকটি পোস্টারে তারেক রহমানের আপোষহীনতা সম্পর্কিত পোস্টার ঝুলে আছে।

বিএনপি আসলে শেষ পর্যন্ত এই দুই রকম বানানের কোনটার সাথে একমত হতে যাচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.