সকালের মিষ্টি রোদ পেরিয়ে আমি এখন মধ্যগগনে,
দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রময় একমাত্র বন গবেষণা কেন্দ্র সম্বলিত লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কসহ কমলগঞ্জের সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের সবুজ নিসর্গ ক্রমেই ধ্বংস করা হচ্ছে। বিরামহীনভাবে এই নিসর্গ থেকে মূল্যবান প্রজাতির বৃক্ষ নিধনের ফলে বনাঞ্চলসহ ন্যাশনাল পার্কে অবস্থানরত জীব বৈচিত্র্য নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। পশু-পাখিরা হারিয়ে ফেলছে নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপনের পরিবেশ। জঙ্গলের দূর্লভ প্রাণীগুলো লোকালয়ে ছুটে এসে অধিকাংশই মারা যাচ্ছে। প্রভাবশালী দলের ছত্রছায়ায় এক শ্রেনীর অসাধু বন কর্মকর্তার যোগসাজষে বন ভক্ষকরা প্রতিনিয়তই লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে সবুজ এই প্রকৃতির সবটুকু নিসর্গ।
সংরক্ষিত বনের গাছপালা উজার ও পাচার করে অসাধু বন কর্মকর্তা ও পাচারকারীরা আর্থিকভাবে বিত্তশালী হলেও তারা সবার চোখের সামনেই নিঃস্ব করে দিচ্ছে প্রকৃতিকে।
সবুজ প্রকৃতি ঘেরা সুন্দর পরিচ্ছন্ন লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে সমাধিত। ন্যাশনাল পার্ক ছাড়াও এখানে হাজার হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার সংরক্ষিত এই বনের বেহাল অবস্থা। সংরক্ষিত বনের বিশাল এলাকা থেকে সেগুন কাঠসহ বিরল প্রজাতির মুল্যবান গাছগাছালি চোরাই কাঠ পাচারকারীরা হরদম পাচার করছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হতে হতে এখন পুরোপুরি নিঃশষ হওয়ার উপক্রম। বনাঞ্চল ও আশপাশ এলাকার বেকার লোকজন ছাড়াও কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কাঠ পাচার পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
সিলেট বন বিভাগের অধীনে এই বনাঞ্চলে আছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এই বনে মেছোবাগ, ভাল্লুক, বনমোরগ, হরিনসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশু,পাখির অবস্থান ছিল কিন্তু ১৯২৭ সালের বন আইনের আওতায় ১৯৯৬ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় জাতীয় উদ্যান। ১২৫০ হেক্টর জমিতে পশ্চিম ভানুগাছের রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ বিশেষ নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান গঠিত হয়েছে।
উদ্যান প্রতিষ্টার এক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানী পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়ায় গ্যাস উত্তোলনকালে অগ্নিকান্ডে ক্ষতবিক্ষত হয় বন, মাটি, মানুষ ও প্রাণীজগতের। পরবর্তী ২০০৮ সালে শেভরনের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রমে মাগুরছড়ার নিকটবর্তী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও আশপাশ এলাকায় মাটিতে ফাটল দেখা দেয় এবং বন্য প্রাণীরা ছোটাছুটি শুরু করে। বনাঞ্চল এলাকায় বেকারত্ব, রাজনৈতিক দলের প্রভাব, কৃষি জমির সম্প্রসারন, বসত বাড়ি স্থাপনা, জ্বালানী হিসাবে কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, বন বিভাগের জনবল কম, চোরাই কাঠ পাচারকারীর সাথে অসাধু বনকর্মকর্তা ও পুলিশের যোগসাজস সর্বোপরি অসচেতনতার কারণেই কমলগঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়ের কারন বলে স্থানীয় সচেতন মহলের ধারনা। বনাঞ্চল এলাকার স্থানীয় খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, কমলগঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারের ফলে এখানকার বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ও প্রাণী সমূহ বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায়। এখন আর এসব পশুপাখির দেখা মেলে না।
তাছাড়া বনাঞ্চলের বাঁশে বাঁশে ফুল আসায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এখানকার বাঁশঝাড়। সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলে বহু প্রজাতির জীব-জন্তু বন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে ও বনে আশ্রয় নেয় এবং বনেই বংশ বিস্তার করে। কিন্তু বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বন্য প্রাণীরা ও হুমকীর মুখে রয়েছে।
বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে বন্য প্রাণীরা। লোকালয়ে বেরিয়ে আসা এসব বন্য প্রাণী বিভিন্ন সময়ে মারা যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরে জঙ্গলের শতাধিক প্রাণীর প্রাণ হারানোর অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বিগত ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গল শহরতলীর হবিগঞ্জ রোডের ভৈরবতলী নামক স্থানে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে ৪ ফুট লম্বা ২৬ কেজি ওজনের একটি বাঘ মারা যায়। একই বছরে নভেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গল শীতেশ বাবুর ফিসারীতে পাহাড়ারত দুটি কুকুরের কাছে প্রাণ হারায় ৪ ফুট লম্বা ২০ কেজি ওজনের আরেকটি বাঘ। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আসা ১৩ ফুট লম্বা প্রায় ১০০ কেজি ওজনের ১ টি ওজগর সাপ জনপদে চলে আসলে চা শ্রমিকরা দড়ি দিয়ে বেধে সাপটিকে ৪ দিন আটকে রাখে। যার প্রতিবেদন তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারী কমলগঞ্জের খাসিয়াদের হাতে ধরা পড়ে বিরল প্রজাতির একটি ধূমকল, একই বছরের নভেম্বর মাসে লাউয়াছড়ার গভীর জঙ্গল থেকে ৩১ কেজি ওজনের ৩ ফুট লম্বা মেছো বাঘ বেরিয়ে আসলে ২ টি কুকুরের হাতে প্রাণ হারায়। ৭ ই নভেম্বর তারিখে সাড়ে ৩ ফুট লম্বা আরেকটি মেছো বাঘ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসলে লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। একই বছরের জানুয়ারী মাসে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরববাজারের লামুয়া নামক স্থানে গাড়ির ধাক্কায় মারা যায় ৩ ফুট লম্বা একটি গন্ধগোকুল। এই বছরে ডিসেম্বর মাসে খাদ্যের অভাবে পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা বিরল প্রজাতির ১ টি হনুমান জনতার হাতে ধরা পড়ে। ২১ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গল এলাকায় আহত অবস্থায় ধরা পড়ে ১ টি বন মানুষ।
২০০৮ সালের ১৩ এপ্রিল পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা একটি লজ্জাবতী বানর কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছে ধরা পড়ে জনতার হতে। পরে বানরটিকে বন বিভাগের সহায়তায় পৌছে দেয়া হয় শ্রীমঙ্গলের শীতেষ বাবুর চিড়িয়াখানায়। ১৮ এপ্রিল ০৯ইং আড়াই ফুট উচ্চতায় ও ৩ ফুট চওড়ায় একটি মায়া হরিণ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে বেরিয়ে মাধবপুর ইউনিয়নের বদলের গাঁও গ্রামের কৃষ্ণধন সিংহের বাড়ির পিছন থেকে লোকজনের ধাওয়া খেয়ে পার্শ্ববর্তী নোয়াগাঁও গ্রামের লোকজন হরিণটিকে ধরে নেয়। পরে গ্রামবাসীরা মায়া হরিণটিকে জবাইর পর মাংস ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। এছাড়াও বিগত বছরের বিভিন্ন সময়ে লোকালয়ে বেরিয়ে আসা বানর, মেছো বাঘের বাচ্ছা, হনুমান এর মৃত্যু এবং শিকারীদের হাতে কয়েকটি হরিণ জবাইর ঘটনা ঘটেছে।
এভাবেই প্রতিনিয়ত জঙ্গল থেকে ছুটে আসা প্রাণীগুলো মানুষের হাতে কখনও বা যানবাহনের নিচে, আবার কখনও অপর কোন প্রাণীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষের হাতে জীবিত ধৃত প্রাণীগুলোকে বন বিভাগ, বিডিআরও প্রশাসন ও পশুবিদ শীতেশ রঞ্জন দেব অবমুক্ত করে থাকেন। সরকার বিরল প্রজাতির পশু পাখীর আবাসস্থল এই লাউয়াছড়ার জৈব বৈচিত্র রক্ষায় লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে সকল প্রকার আহরন নিষিদ্দ করেছে। কিন্তু কিছুতেই তা মানা হচ্ছে না। পার্কের ভেতর দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লেবু, আনারস বাগান ও পান পুঞ্জির রাস্তা, যার জন্য পশু পাখীর নিস্তব্ধ পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
তবে বন কর্মীরা কাঠ পাচারে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে রাজকান্দি রেঞ্জের দায়িত্বরত কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম বলেন, জনবল কম থাকা সত্ত্বেও তারা যথাসাধ্য বনাঞ্চল রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিদিনই কোন না কোন স্থান থেকে গাড়িসহ কাঠ আটক করা হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।