আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে একবছরের অর্জন

Only I know what is my goal, My heart is my temple.

কাজী সায়েমুজ্জামান: আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো ৬ জানুয়ারী। বেসামরিক ছদ্মাবরণে দুই বছরে সেনাশাসনের পর বহুল প্রতাশিত নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ বিজয়ের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকার এক বছর পূর্ণ করলো। ৬ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন করে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দিন বদলের সনদের নামে একটি নির্বাচনী ইশহেতার প্রকাশ করে যেখানে নানা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। আর এতে পাঁচটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।

তারা এসব দ্রুত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। এক বছরে সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তেমন কোন সফলতা দেখাতে পারেনি। নির্বাচনের আগে মহাজোটের প্রতিশ্রুতিতে লোকজন আকাশচুন্বী প্রত্যাশার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেও বর্তমানে তারা বাস্তবতায় ফিরে গিয়ে সরকারের কাজের মূল্যায়ন করতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মোট ২৭টি অধ্যায়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।

অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রথম প্রতিশ্রুতি হলো- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এতে বলা হয়, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময় মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হবে।

সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। ’ সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর পর কিছু সময়ের জন্য দ্রব্যমূল্য কমতে শুরু করলেও বছরে মধ্যভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত তা বাড়তে থাকে। সরকারের কোন পদক্ষেপই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। অক্টোবর মাসে খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৪ দশামিক ৬০ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী শহর এলাকায় খাদ্যদ্রব্যে মুদ্রাস্ফীতি দুই অংকের কাছাকাছি অবস্থান করছে। এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবর মাসে খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতি ৫৬ শতাংশ বেড়ে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ হয়েছে। ভোগ্যপণ্য নিয়ন্ত্রনের জন্য কোন কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হয়নি। তবে ভোক্তা অধিকার আইন পাশ করেছে সরকার। এছাড়াও বিশ্বমন্দার প্রভাব থেকে দেশকে রার জন্য টাস্কফার্স গঠনের মাধ্যমে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল তার পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

মন্দার প্রভাব এড়াতে ছয় হাজার কোটি টাকা দেয়া হলেও টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন করা যায়নি। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে।

রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে। ’ পক্ষান্তরে সরকার এর উল্টোটাই করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন যাতে কাজ করতে না পারে সে কাজই বর্তমান সরকার করেছে।

২০০৪ সালের ৫নং আইন দিয়ে দুদক পরিচালিত হয়। ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা অধ্যাদেশ জারি করে এর কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা হয়েছিল। বর্তমান সংসদ তা গ্রহণ করেনি। এজন্য ওই বিধিমালা তামাদি হয়ে গেছে। এরপর ওই আইনও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ওই সংশোধনীতে সচিবের নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা সরকারের আওতায় রাখা হয়েছে। এছাড়াও চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমাতে সচিবকে প্রধান হিসাব রক্ষক কর্মবকর্তা করার মাধ্যমে তার পদমর্যাদা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতির বিধান রাখা হয়েছে। ফলে সরকার যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নয় তার বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নিতে পারবেনা। গত বছরের অক্টোবরের দিকে কেবল দুর্নীতির মামলা শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টে দুটি বেঞ্চ গঠন হয়।

এতে কমিশনও আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। তবে কয়েকদিন পর কোনো বোধগম্য কারণ ছাড়াই দুটো বেঞ্চই শুনানি বন্ধ করে দেয়। এরপর কমিশন চেয়ারম্যান বেঞ্চ গঠনের জন্য এ্যটর্নি জেনারেলের সঙ্গে দেখা করে স্পেশাল বেঞ্চ গঠনের অনুরোধও জানান। কিন্তু এ্যটর্নি জেনারেল তাকে কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন নি। মতাধরদের সম্পদ বিবরণ জমা নেয়ার কোন উদ্যোগই এ সরকারের নেই।

সরকার দলের লোকজন সারা বছরই টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়ে। সরকারের তরফে বলা হয়েছিল ডিসেম্বরের দিকে সকল দরপত্র ইন্টারনেটে ছাড়া হবে। সরকার তা করতে পারেনি। ছাত্রলীগের টেন্ডার সন্ত্রাসের কারণে সরকার সারা বছরই বিব্রত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেষে আপে করে বলেছেন, আমার কষ্ট হয়, যখন পত্রিকার পাতা খুলে দেখি ছাত্রলীগের কর্মীরা টেন্ডার-চাঁদাবাজের সাথে জড়িত।

তবে সরকার এেেত্র ধমক দেয়া ছাড়া কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে এসব ধমক কোন কাজেই আসেনি। তৃতীয় অগ্রাধিকারে বলা হয়েছে, ‘ তিন বছর মেয়াদি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় বর্তমানে নির্মাণাধীন ও গৃহীত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দ্রুত বাস্তবায়ন, জরুরিভিত্তিতে ১০০-১৫০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন প্রকল্প, বৃহৎ ও ুদ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণসহ আওয়ামী লীগ আমলে বেসরকারি খাতে ১০, ২০ ও ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ’ ‘তেল ও নতুন গ্যাসত্রে অনুসন্ধান ও আহরণের কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।

গ্যাস ও এলপিজি’র সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে। জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে কয়লানীতি প্রণয়ন করা হবে। এ যাবৎ প্রাপ্ত কয়লার অর্থনৈতিক ব্যবহার এবং কয়লাভিত্তিক নির্মাণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। নতুন কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। ’ কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা ছিল পুরো বছর জুড়ে।

লোডশেডিংয়ের কারণে জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। বড় ও ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের প্রক্রিয়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে সরকার যে চুক্তি প্রডাক্টসন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট বা পিএসসি করেছে তাতে রপ্তানীর বিধান রাখা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তেল গ্যাস ও বন্দর রা কমিটির লোকজন পুলিশের পিটুনির শিকার হয়েছেন। কয়লা নীতি করা যায়নি।

চতুর্থ অগ্রাধিকার দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য রোধ। এতে বলা হয়-‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত প্রকল্প ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ আশ্রায়ন, গৃহায়ন, আদর্শ গ্রাম, ঘরে ফেরা, বাস্তবায়ন করা হবে। বয়স্ক ভাতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, সুবিধাভোগিদের সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ করা হবে। কর্মসংস্থান ব্যাংকে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হবে। বর্তমান দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন পিআরএসপি প্রণয়ন করা হবে।

বলা হয়েছিল, বেকার সমস্যা সমাধানের এবং নাগরিক জীবনকে অর্থবহ করার উদ্দেশ্যে একটি সার্বিক কর্মসংস্থান নীতিমালা নেয়া হবে। ’ সরকারের এক বছরে এ লক্ষ্য অর্জনে তেমন অগ্রগতি চোখে পড়েনি। বয়স্ক ভাতা দুস্থ মহিলা ভাতা ও সুবিধাভোগিদের সংখ্যা দ্বিগুন করার কথা বলা হলেও গত বাজেটে ২০ লাখ থেকে সাড়ে ২২ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়। এ হারে বাড়ালে সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণে এক যুগ লেগে যাবে। বলাই বাহুল্য বেকারদের তুলনায় কর্মসংস্থান চোখে পড়েনি।

দিনি দিন বেকারদের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সরকারের পঞ্চম অগ্রাধিকারে বলা হয়- ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেতা নিশ্চিত করা হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর ও জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার সম্পন্ন করা হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লংঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে। ’ এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে সরকার শেখ মুজিব হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করার পথে সফল হয়েছে।

বাকী গুলো শ্লোগান হিসেবেই থেকেছে। মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হলেও কমিশন শুধু বক্তব্য দিয়েই গেছে। একটি ঘটনারও তদন্তের বা ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়নি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নিজেরাই প্রতিশ্র“তি ভংগের নমুনা উপস্থাপন করেছে। ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ এ বছরের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ফলে ১৫৪ জন নিহত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধিদের বিচার নিয়ে এক ধরনের শিথিল মনোভাব দেখাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে বিদেশী চাপের বিষয়ে এক ধরনের লুকোচুরি খেলছে সরকার। জনগন কোন কিছুই জানতে পারছেনা। এছাড়াও এ অগ্রাধিকারের মধ্যে আরও যা রয়েছে তা হলো- ‘নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত থাকবে। জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমে প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেয়া হবে। ’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিরোধি দল সংসদ বয়কট করে রেখেছে। তাদের সংসদে নেয়ার জন্য সরকারের প থেকে কোন কার্যকর উদ্যোগও নেয়া হচ্ছেনা।

ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তি তার সম্পদের হিসাব দেননি। ইশতেহারে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ’ তবে সন্ত্রাস ও চাদঁবাজিতে জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ। এ দুটো অপরাধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পওে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস আর চাদাঁবাজিতে দেশ পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সাত জন নিহত হয়েছে। ইশতেহারে বলা হয়, ‘দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। ’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ায় এখন পুরো প্রশাসন দুভাগ হয়ে গেছে।

ভিন্ন মতের কর্মকর্তাদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে। পদোন্নতিতে মেধা একটি শ্লোগান ছাড়া কিছুই ছিলনা। প্রশাসনের স্থবিরতা ও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) নিয়োগ করার মাধ্যমেই বছর পার করেছে সরকার। বর্তমান সময় পর্যন্ত পুরো এক বছরে সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ইউএনও, এডিসি, উপসচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হয়। এছাড়া রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়।

এদের মধ্যে বর্তমান সরকারের আমলে ১৫জন সচিবকেই ওএসডি করা হয়। গত বছর প্রাশাসনের বিভিন্ন পদে রেকর্ডসংখ্যক ৬৭৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। এছাড়া রদবদল করা হয়েছে ৯৬০ কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৫৩, যুগ্ম-সচিব পদে ৭৪, উপসচিব পদে ২৮৭, সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদে ২৩৩, অন্যান্য (ননক্যাডার, পিএসসির মেম্বার ইত্যাদি) ১৯৭ কর্মকর্তা এবং ১১৬ সামরিক কর্মকর্তা। একই সঙ্গে বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৭৪ কর্মকর্তাকে।

ইশতেহারে বলা হয়- ‘জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীসমূহকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। তাদের বেতন-ভাতা, আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদপে নেওয়া হবে। ’ কিন্তু পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে সরকার। গত এক বছরেই বিনা পরোয়ানায় আটক হয়েছেন এক লাখ ৮৩ হাজার ৬৩০ জন ব্যক্তি। বছর জুড়ে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির জের টেনেছে নিরীহ নিরাপরাধ মানুষ।

বিনা পরোয়ানায় ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন তারা। ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারার সঙ্গে এ জাতীয় বিভিন্ন ধারায় তারা গ্রেফতার হয়েছেন। কোন অপরাধ না করেও শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়েছেন লোকজন। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় সংসদ সদস্য ফজলে নুর তাপসের গাড়ি ল্য করে বোমা হামলার পরই সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার বেড়ে যায়। গত ২১ অক্টোবর এ বোমা হামলা হয়।

এরপরই ব্যাপক ধরপাকড় চলে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আত্মীয় স্বজনদেরও এ ঘটনায় সংশ্লিস্টতা দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয়। তাদের প্রত্যেককে কয়েক দফা রিমান্ডে নিলেও বোমা হামলার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পারেনি সরকার। এর মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী যে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী তা প্রমাণ করেছে সরকার। ইশতেহারে রয়েছে, ‘প্রবাসী বাঙালিদের জাতি গঠনে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে।

রেমিটেন্সের বিনিয়োগ এবং প্রবাসী মূলধনকে আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবাসীদের মেধার সদ্ব্যবহারের জন্য পরামর্শক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। ’ ‘প্রবাসে শ্রমিক রফতানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ’ প্রবাসিদের ভোটার করা যায়নি। বিদেশে শ্রমবাজার ছিল হুমকীর মুখে।

জনশক্তি ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, গত এক বছরে জনশক্তি রপ্তানী কমেছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে যেখানে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মানুষকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো সেখানে গত বছর গড়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দেড় হাজার মানুষ অনুমতি চেয়েছেন। ২০০৮ সালে নয় লাখ মানুষ বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে তা পাঁচ লাখেরও কমে এসে দাড়িয়েছে। গত বছর সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ শ্রমিক দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি: ইশতেহারে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- পররাষ্ট্রনীতি। এতে বলা হয়-‘বিশ্বশান্তি রায় বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই নীতির আলোকে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করা হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে বহুমুখী সহযোগিতা জোরদার করা হবে। ’ কিন্তু বাস্তবে আন্তর্জাতিক অংগনে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।

একটি বিশেষ দেশের প্রভাব বলয় থেকে পররাষ্ট্রনীতি বের হয়ে আসতে পারেনি। মিয়ানমারের সঙ্গে সমূদ্রসীমা নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ভারতের সাত রাজ্যের স্বাধীনতাপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন উলফার সঙ্গে অযথাই শত্র“তার পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। উলফা সরকারের বিরুদ্ধে হুমকী দিয়েছে। বছর জুড়েই আশংকা ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বহিস্কার করার।

কুয়েত থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিনা কারণে বহিস্কারও করা হয়। দেশের জনশক্তি রপ্তানীর বড় বাজার সৌদী আরব। এদেশের মোট জনশক্তির ৭০ ভাগ সেখানে যেতো। কিন্তু গত দুই বছর ধরেই সেখানে জনশক্তি রপ্তানী বন্ধ রয়েছে। দেশের জনশক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক সমস্যায় পড়লেও তাদের রায় সরকারের কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।

ইশতেহারে অগ্রাধিকারের ১৯ তম স্থানে রয়েছে- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য-প্রবাহ। এতে বলা হয়-‘ সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য-প্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা হবে। সকল সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার করে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এবং সাংবাদিক নির্যাতন, তাদের প্রতি ভয়-ভীতি-হুমকি প্রদর্শন এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতি, দলীয়করণ বন্ধ এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে তার বিকাশে সহায়তা প্রদান করা হবে। ’ সরকার বছরের শেষ সময়ে গিয়ে সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক ও লেখকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে এর ১০ দিনের মাথায় একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এসময় টকশোর ওপরেও বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। সরকারের একবছরে ৩ জন সাংবাদিক নিহত, ৮৪ জন সাংবাদিক আহত, ৭৩ জন হুমকি এবং ৩৬ জন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। মারধরের শিকার হয়েছেন ৪৫ জন। আর হামলার শিকার হয়েছেন ১৬।

এসময় ২৩ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষন, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দায়ের হয়েছে। ইশতেহারে রয়েছে-‘বছরে ন্যূনতম ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের জন্য প্রত্যেক পরিবারের একজন কর্মম বেকার তরুণ/তরুণীকে কর্মসংস্থানের জন্য ‘এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি’ স্কিম পর্যায়ক্রমে কার্যকরী করা হবে। সকল কর্মম নাগরিকের নিবন্ধন করা হবে। ’ ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার নাম করে সরকার বছর জুড়েই দলীয় নেতাকর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন প্রভাবশালী নেতা এ বায়োডাটা সংগ্রহের কাজের সমন্বয় করছেন।

তবে প্রথম বছরে সরকার এ ধরনের কোন প্রকল্প হাতে নিতে পারেনি। শেষ কথা: সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে ২৭ টি অধ্যায়ে পাঁচ শতাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রথম বছর এসব প্রতিশ্রুতির প্রতি তাদের নির্বিকারই মনে হয়েছে। এক বছরেই ইশতেহারে দেওয়া তাদের প্রুতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। সরকারের সামনে আরও চার বছর রয়েছে।

আগামীতে তারা ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করে জনগণের আকাংখার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক কমিয়ে আনবে বলেই সবার প্রত্যাশা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.